পলার হাত থেকে স্টারবাকের কফিপেয়ালা নিতে গিয়ে আমার আঙুলগুলোতে ওর আঙুলের ছোঁয়া পেলাম। চকিতে মাত্র কিন্তু আমার ভাল লাগল; কোমল, স্পন্দিত ও উষ্ণ। অভ্যস্ত দ্রুততায় কফির পেয়ালা হাত বদল হতে যত সময় লাগার কথা, তার চেয়ে একটু বেশি সময় নিলাম আমি। ইচ্ছে করে। আমার ভাল লাগছিল, যদিও ভাললাগাটা মুহূর্তের মাত্র।
বিষয়টা এমন নয় যে আমি চাইলে পলার হাত ধরে সারা ক্যাম্পাস হেঁটে বেড়াতে পরি না; এমনও নয় যে এর আগে আমি কোনদিন ওর হাতের ছোঁয়ায় সিক্ত হইনি; কিন্তু কেন যেন খোলা আকাশের নিচে, শরীর জুড়ান রোদের তাপে, গরম কফির পেয়ালা ছুঁয়ে থাকা পলার দীর্ঘ আঙুলগুলোর ঐ ছোঁয়া আমার কাছে অন্য রকম মনে হল। পলার চেনা আঙুলগুলো, ওর ডান হাতের তর্জনি জড়িয়ে থাকা চেনা বার্থ স্টোন আমার কাছে অভূতপূর্ব মনে হল। মনে হল ওর আঙুলগুলো খুব সুবোধ্য ভাষায় কথা বলতে জানে।
গ্রাব ইট কেয়ারফুলি বয়, ইটস রিয়েলি হট।
ইয়েস ইনডিড, বাট হুইচ ওয়ান? তুমি, তোমার হাত, নাকি কফি?
পলা বুঝল আমার বিলম্বের কারণ।
আমার দিকে তাকাল খানিকটা ভ্রƒকুটি করে। কপট রাগে ভরা একজোড়া নীলচে চোখ, গভীর এবং দ্যুতিময়। আমার দিকে তাকিয়ে ভ্রূকুটি করার সময়, ওর ভ্রƒতে নয়, ভাঁজ পড়ল কপালে। বেশ দীর্ঘ কপাল পলার। আর তার নিচে ব্লন্ড ভ্রƒ, সয্তনেœ বিন্যস্ত।
তার নিচেই অবিন্যস্ত চুল দুই দিক দিয়ে গড়িয়ে কপোল বরাবর এসে পড়েছে। ওর চুলের দীর্ঘতা কাঁধ ছাড়িয়ে যাবে না, কখনো এর চেয়ে দীর্ঘ চুলে ওকে দেখিনি। সিঁথি নামক কোন সরু পথ ওর সোনালি চুলের কোথাও নেই। খুঁজেছি, পাইনি। বহুবার আমি জানতে চেয়েছি কেন লম্বা করেনা ওর সুন্দর এবং ঝলমলে চুল।
প্রতিবারই একই উত্তর, হার্ড টু মেনটেইন। কিন্তু ব্লন্ডচুলগুলো আরেকটু দীর্ঘ হলে কি ওকে বেশি মানাত না? বহুবার বলেছি, পলা, প্লিজ আরেকটু দীর্ঘ করনা চুলগুলো। দেখিনা দেখতে কেমন হও তুমি। পলার একই উত্তর। হার্ড টু মেনটেইন।
বোধ করি ও বাঙালি কবিদের লেখা রমণীর কেশবন্দনা শোনে নি, তাই বোঝে না দীর্ঘ চুলের সৌন্দর্য! হায় সৌন্দর্যবোধ! সবাই কেন সবকিছু নিজের মত করে দেখে। কেন সব সুন্দরই সবার কাছে সমান আবেদন জাগায় না? আবার ভাবি, এক দেখে না, বা একই ভাবে আন্দোলিত হয় না বলেই হয়ত পৃথিবীর এত বৈচিত্র্য! কি জানি। এসব কূটতর্ক, উত্তরের আশা করাই বৃথা।
পলার হাত থেকে কফি নিয়ে আমরা দুজন ঘাসের গালিচায় বসে পড়লাম। আবার সেই অনুভূতি।
সত্যি কি ঘাসগুলোকে আমরা কষ্ট দিচ্ছি! কেন যে আমার মধ্যে এই অনুভূতিটা হয় তা ঠিক জানি না। কিন্তু ঘাসে বসলেই অথবা যদি কখনও অন্যমনস্কতায় ঘাসের ওপর দিয়ে হেঁটে যাই অনুভূতিটা জেগে ওঠেই ওঠে। আমি নিজেকে সান্ত্বনা দেই, এ আমার রোজকার আচরণ নয়। ক্ষমা কোর হে ক্ষুদ্র সবুজ।
আমি পলার জন্য যে স্যান্ডউইচেস নিয়ে এসেছিলাম তা এগিয়ে দিলাম ওকে।
ধন্যবাদ দিতে ভুল হল না পলার, যদিও আমার হয়ে গেল ওর হাত থেকে কফির পেয়ালা নিতে নিতে। তবে ঐ যে পলের আঙুলের সামান্য ছোঁয়া, আর আমার ভাল লাগা, সে কি ধন্যবাদের চেয়ে কম? এত দিন হয়ে গেল, আমার এখনও ভুল হয়, প্লি¬জ, থ্যাংক য়্যু, এক্সকিউজমি বলতে। বিলেতে কথায় কথায় এসব বলতে না পারলে বিড়ম্বনার শেষ নেই। সবাই কেমন অবাক হয়ে তাকায়। তখন নিজের কাছেই নিজেকে অসভ্য মনে হয়।
বাস থেকে নেমে যাবার সময়, ড্রাইভারকে থ্যাংক য়্যু না বললে অসভ্যতা প্রকাশ পায়। টিকিট চাইতে হলে প্লি¬জ বলতে হয়। কফি কিনতে গেলে 'ক্যান আই হ্যাভ' বলতে হয়। অথচ আমরা এত ঘন ঘন এসব সৌজন্যসূচক শব্দ আউরাই না। সেজন্য মাঝে মাঝেই আমার ভুল হয়।
অনভ্যাসের ফোঁটা চট চট করে। পলাকে আমি বলেছিলাম, পূর্ব পশ্চিমের এই সাংস্কৃতিক ব্যবধানের কথা। ও প্রথমে বিশ্বাসই করতে চায়নি যে, কীভাবে মানুষ অন্যকে এপ্রিশিয়েট না করতে পারে! দ্যাটস রুড, ইজন্ট দ্যাট, পলার মন্তব্য। তোমাদের সংস্কৃতিতে কি তবে এপ্রিসিয়েশন নেই? এ কালচার উইথআউট এপ্রিসিয়েশন। স্ট্রেঞ্জ!!
ইটস নট এ্যাজ সিমপল এ্যাজ দ্যাট।
আমি আপত্তি করি। আমরা এপ্রিশিয়েট করি না, তেমন নয়। করি, কিন্তু আমাদের প্রকাশ ভঙ্গি হয়ত তোমাদের মত নয়। আমরা ভাবে, ভঙ্গিতে অথবা বিনয়ে তা প্রকাশ করি। আমার দেশে বড়রা ছোটদের কাছ থেকে কোন সাহায্য পেলে, প্রাণ খুলে আশীর্বাদ করেন: বেঁচে থাক, বড় হও, মানুষ হও এমন সব শব্দ দিয়ে।
এ ধরনের এপ্রিসিয়েশন তো তোমাদের মধ্যে নেই। সুতরাং আমাদের সংস্কৃতিতেও এপ্রিসিয়েশন আছে কিন্তু তার প্রকাশ ভঙ্গি বা ভাষা ভিন্ন। তবে আজকাল, তোমাদের মত আমাদের দেশেও চালু হয়ে গেছে থ্যাংক য়্যু আর প্লি¬জ বলার অভ্যাস। গে¬াবালাইজেশন, আর মিডিয়া আগ্রাসন আর কী!
সো নাউ য়্যু আর বিইং সিভিলাইজড! পলা তার দুষ্টুমি মাখা চোখে আমার দিকে তাকাল কথাটা শেষ করে। পলার খোঁচাটা আমি বুঝতে পারি।
বুঝতে পারি বলেই আমার প্রতিবাদের ধরন বদলে যায়।
হয়ত, হয়ত বা না। নোবডি নোজ। কিন্তু ঐ প্রবল মিডিয়া প্রভাবের পরও আমাদের দেশে স্বামী তার স্ত্রীর কাছে এক গ্ল¬াস পানি চাইতে প্লি¬জ বলবে না, আর যদি স্বামী ভদ্রলোক সারাক্ষণ এমন প্লি¬জ থ্যাংক য়্যু বলতে থাকে, তাহলে স্ত্রী নির্ঘাৎ ভাববে যে স্বামী তাকে আপন ভাবছে না। আমাদের সংস্কৃতিতে আপনজনদের সঙ্গে আমরা ততটা ফর্মাল নই যতটা তোমরা।
সংস্কৃতির সঙ্গে সংস্কৃতির পার্থক্যের এগুলোই তো নিয়ামক। তোমার কেন ধারণা পৃথিবীর সবাই তোমার মত, বা তাদেরকে তোমার বা তোমাদের মতই হতে হবে? এতো ইম্পিরিয়াল এ্যাটিচুড!
বৃটিশ সাম্রাজ্য বিস্তারের সময় এটা বেশ একটা লাগসই যুক্তি ছিল যে, বিলাতের লোকেরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে গিয়েছিল, যারা আনসিভিলাইজড, তাদেরকে সিভিলাইজড করতে। পলা আমার মুখের কথা কেড়ে নিয়ে মুখস্ত বলার মত বলে যায় এই দীর্ঘ বাক্য। কারণ আমি এই কথা ওকে অনেক বার বলেছি। একই ধরনে।
শুনতে শুনতে পলার প্রায় মুখস্ত হয়ে গেছে।
ইয়েস দ্যাটস ট্রু। আর এই খোঁড়া যুক্তিকে সামনে রেখে তোমার পূর্ব পুরুষেরা আসলে গিয়েছি খ্রিস্টানধর্ম আর কমার্স বিস্তার করতে। কোন দেশকে সিভিলাইজড করতে নয়। আমি পলাকে পাল্টা খোঁচা দেবার জন্য বিষয়টাকে ব্যক্তিগত পর্যায়ে নিয়ে আসি।
সবই ব্যবসা, বুঝলে সবই ব্যবসা। আর ব্যবসা করতে যা যা প্রয়োজন তাই তারা করেছে। তবে তোমার এটাও জানা উচিত, শুধু সভ্যতা নয়, সভ্যতার বাই প্রোডাক্টও তারা বিস্তার করেছে পৃথিবীময়। তুমি বুঝি জান না যে, সারা পৃথিবীতে তোমরাই ভেনিরিয়েল ডিজিস ছড়িয়েছ। নিয়ে গেছো পর্নোগ্রাফি সেই সব মানুষের কাছে যাদের এ বিষয়ে কোন ধারণাই ছিল না।
ইজ দ্যাট ট্রু? পলা অবাক হয়ে আমাকে প্রশ্ন করে।
ইয়েস ইট ইজ। সমস্ত পৃথিবীতে তোমাদের দেশেই সর্বপ্রথম পর্নগ্রাফির প্রসার ঠেকাতে আইন হয়েছে ১৮৬৩ সালে। আর ১৮৬৮ সাল থেকে ১৮৮০ সালের এই বার বছর মাত্র সময়ে মেট্রপলিটান পুলিশ আড়াই লাখ নগ্ননারীর ছবি সিজ করেছিল নানা জায়গায় হানা দিয়ে। বুঝতেই পার নাইনটিন সেঞ্চুরিতে তোমাদের সমাজে ভেনিরিয়েল ডিজিজ কেন এত প্রসার ঘটেছিল!
কিন্তু আমরাই তো আবার ঐ সকল রোগের ঔষুধ আবিষ্কার করেছি।
করিনি? আমাদের সাফল্যকে কেন তুমি দেখনা। পলা আমাকে থামিয়ে দিয়ে নিজের অবস্থান পরিস্কার করে।
করেছ, কিন্তু সেটাও তোমাদেরই প্রয়োজনে। যাদেরকে তোমরা সিভিলাইজড করতে গিয়েছিলে, তাদের কথা মনে করে নয়। তা ছাড়া, তুমি কে হে আমাকে অসভ্য বলার।
তুমি কী মনে কর, আমি জানি না যে ১৮৭০ পর্যন্ত তোমরা মিউনিসিপ্যালিটির সুইমিং পুলগুলোতে ন্যাংটো হয়ে গোসল করতে? বহু চেষ্টা করে ফরাসিদের কাছ থেকে তোমাদের কস্টিউম পরা শিখতে হয়েছিল। আর পাবলিক বাথপ্লেসগুলোতে তা ইমপ্লিমেন্ট করতে পুলিশের কী পরিমাণ ধকল পোহাতে হয়েছে?
ডু য়্যু থিংক ইভেন টু ডে, উই ওয়্যার টু মাচ কস্টিউম ইন দ্য সি বিচেস?
আমি হাসি পলার মুখের দিকে তাকিয়ে। ও তাকায় আমার চোখে। ওর নীলচে চোখের মণিতে সূর্যের আলো ঠিকরে ওঠে। আমি আমার বুকের গভীরে পলার দৃষ্টি অনুভব করি।
আর ভাবি আমার চশমা মোড়া চোখে কী দেখ মেয়ে? চোখের ভেতরে দিয়ে কি মন পড়া যায়?
এসব তর্ক উঠলে পলা কথা বাড়ায় না, কারণ ও জানে আমার ভান্ডারে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদকে আক্রমণ করার মত অসংখ্য তীর সংরক্ষিত আছে। বরং উৎসাহী হয়ে ওঠে সাংস্কৃতিক পার্থক্য নিয়ে কথা বলতে। সত্যিই তো, পার্থক্য আছে বলেই পৃথিবীর সংস্কৃতিকে এত ভাইব্রেন্ট মনে হয়, এত কালারফুল মনে হয়। ঠিক না? আমি বুঝতে পারি যে পলা প্রসঙ্গ পাল্টাতে চায়।
ঠিক তোমার মত, ভাইব্রান্ট এন্ড কালারফুল।
আমি কফিতে চুমুক দিতে দিতে পলাকে বলি। আর পলা? আবার সেই চেনা ভঙ্গিতে ভ্রƒকুটি করে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।