আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

জিতেন্দ্রনাথ চৌধুরী: ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অন্যতম সৈনিক

সময়... অনাদি... হতে... অনন্তের... পথে...

জন্মিলে মৃত্যু। জন্ম মৃত্যুর এই চক্রের মধ্যেই পৃথিবীতে এমন কিছু মানুষের আবির্ভাব ঘটে, যারা মৃত্যুর পরও বেঁচে থাকে মানুষের অন্তরে। তাদের আপন কীর্তির জন্যই মানুষ তাদের চিরকাল স্মরণ করে। তেমনি একজন জীতেন্দ্র নাথ পাল চৌধুরী। তিনি ছিলেন আদর্শ শিকক্ষ, নিষ্ঠাবান সমাজ সেবক, বিনয় ও ভদ্রতার প্রতীক, ধর্মপ্রাণ ও সহানুভূতিশীল একজন মানুষ।

ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের এক নির্ভিক সৈনিক। ১৯১৬ সালের ১৫ জুলাই সিলেটের শ্রীমঙ্গল উপজেলার রূপসপুর গ্রামে এক ঐতিহ্যবাহী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। যৌবনের প্রথম ভাগ কেটেছে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে। মহাত্মা গান্ধির অহিংসবাদে দীক্ষা নিয়ে ঘর ছেরেছিলেন স্বদেশী আন্দোলনে যোগ দেওয়ার জন্য। ছাত্র জীবনে ছিলেন একজন মেধাবী ছাত্র।

১৯৩৩ সালে ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয় থেকে লেটার মার্কসহ প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা, ১৯৩৫ সালে সিলেটের এমসি ততকালীন মুরালী চাঁদ কলেজ থেকে মানবিক শাখায় প্রথম বিভাগে উচ্চ মাধ্যমিক ও ১৯৩৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ‘ডিস্টিংশনসহ ইতিহাসে অনার্স পেয়ে স্নাতক ডিগ্রী অর্জন করেন। ছাত্র জীবনে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনে। তাই নেতাজী সুবাস চন্দ্র বসুর আদর্শে অনুপ্রানীত হয়ে আজাদ হিন্দ- ফৌজে যোগদানের জন্য তিনি বার্মা গমণ করেছিলেন। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের অংশগ্রহণে সত্যগ্রহ পালন করতে গিয়ে অনেকবার কারা বরণও করেছিলেন তিনি। বার্ম অবস্থানকালে কন্ট্রোলার অব মিলিটারি একাউন্টস- এ চাকুরি হয় তার।

১৯৩৯ সালে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে সকল ভারতীয়রা দেশে আসলেও যুদ্ধ বিধ্বস্থ মানুষের দুর্ভোগ তাকে আর দেশে আসতে দেয়নি। যুদ্ধে বোমার আঘাতে অসুস্থ আহত মানুষের সেবায় তিনি নিজেকে আত্মনিয়োগ করেন। সে সময় ভারতের সঙ্গে বার্মার সকল যানবাহন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলে তিনি তার অদম্য সাহস ও আত্মশক্তির উপর ভর করে পায়ে হেটেই স্বদেশের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়েছিলেন। ব্যাঙ্গুইন থেকে নাগাল্যান্ড ও আসামের শিলচর থেকে লীপুর হয়ে প্রায় তিনমাস পায়ে হেঁটে তিনি দেশে এসেছিলেন। তৎকালীন ইংরেজী দৈনিক স্টেটমেন্ট পত্রিকায় তার সেবা কর্মের স্বীকৃতি স্বরুপ ছবিসহ সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিলো।

১৯৪০ সালে বর্তমান পূর্ব পাঞ্জাবের হুশিয়ারপুরে পুনরায় কেন্ট্রোলার অব মিলিটারি পদে সুপারিটেনডেন্ট পদে কাজ করেন। পাঞ্জাবে চাকুরিকালীন অবস্থায় ছুটিতে বাড়ি আসলে স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের অনুরোধে সরকারি চাকুরি ছেড়ে জাতিগঠনের কারিগর হিসেবে মাত্র ৪০ টাকা বেতনে স্থানীয় ভিক্টোরিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দিয়েছিলেন তিনি। জাগতিক কোনো ভোগবিলাসিতা তাকে আকৃষ্ট করতে পারেনি। তাই সুদীর্ঘ ৪০ বছর অত্যান্ত গৌরবের সহিত একই স্কুলে চাকুরী করে শেষ কর্মদিবসে ছাত্রদের পরম শ্রদ্ধায় দেওয়া একমাত্র ফুলের তোড়াটি নিয়েই তিনি বাড়ি গিয়েছিলেন। তিনি আজ না থাকলেও এতদ অঞ্চলে একজন আদর্শবান শিক্ষক হিসেবে আজো তার ব্যাপক পরিচিতি আছে।

একজন শিক্ষকরূপে এখনও সদা জাগ্রত তার ছাত্রদের মনে। তার শিক্ষাদান পদ্ধতি, সময়জ্ঞান আর শৃঙ্খলাবোধ এখনও কিংবদন্তী হয়ে আছে সবার কাছে। তিনি কোনো প্রাইভেট ছাত্র পড়ানো পছন্দ করতেন না। তাই তার মতো এ ধরনের শিক্ষক সমকালেই দুর্লব। বর্তমান সামাজিক ক্রান্তিলগ্নে তার মতো ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন শিক্ষকের খুবই প্রয়োজন ছিল।

মেধা প্রতিভা ও নিজকর্মে তিনি সৃষ্টি করেছিলেন এক ভিন্ন জগৎ। যারাই তার সংস্পর্শে যাওয়ার সুযোগ পেয়েছিলো, তারাই অনুভব করতে পেরেছিলেন তার জ্ঞানের গভীরতা। তিনি ছিলেন একজন জাত শিক্ষক। ন্যায়পরায়ন ও মিতবাসী এই শিক্ষকের কর্তব্য কাজে ছিলোনা কোনো অবহেলা। ন্যায়-নীতিতে ছিলেন অন্ন- অটল।

শিক্ষাদানে ছিলেন নিবেদিত প্রাণ। শিক্ষকতা থেকে অবসর জীবনের মধ্যপথ থেকে তিনি আধ্যাত্মিকতার দিকে ধাবিত হয়ে ধার্মিকতাকে মুখ্য করে তোলেছিলেন। শ্রী শ্রী অনুকুল চন্দ্রের ভাবাদর্শে সৎ সঙ্গ মন্দির প্রতিষ্ঠার জন্য ৫ শতক ভূমি দান করেছিলেন। শতাব্দী ব্যাপী একটি মহা কাব্যিক জীবন ছিল তার। সেই জীবন ছিল কখনো দেশ মাতৃকার চরণে নিবেদিত, কখনো সমাজসেবায় নিবেদিত, কখনোও বা যুদ্ধের ময়দানে দীপ্ত।

সর্বক্ষেত্র সফল এই মানুষটি ২০০৫ সালের ২৭ জুলাই মৃত্যুবরণ করেছিলেন। গত ২৭ জুলাই তার দ্বিতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে প্রকাশিত হয়েছে "তোমার সৃষ্টির পথ" নামে একটি স্মারক গ্রন্থ। এই স্মারক গ্রন্থটি আগামী দিনের নতুন প্রজন্মের কাছে পেঁৗছে দিবে তাকে। আজ তিনি নেই, আছে তার আদর্শ, নীতি, উপদেশ ও স্নেহ। সেদিন মৃত্যু তাকে কেড়ে নিয়েছিলো সত্য, কিন্তু তার নিজ হাতে গড়া অসংখ্য ছাত্র, সহযোদ্ধা ও সুভানুধ্যায়ীদের অন্তর থেকে তার দাগ মুছে ফেলতে পারেনি।

তিনি যুগে যুগে বেঁচে থাকবেন তার সকল কর্মকান্ডের মধ্যেই। তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হয়ে তার মহান চলার পথ অনুসরণ করে চলবে নতুন প্রজন্ম।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।