অনেকের মাঝেও একা থাকা যায়, নি:সঙ্গতায় কারো অনুভব ছুঁয়ে যায় ...
সিতি নামে আমার রুমে দুজন ছিল। একজনের কথাতো বলেছি, ওর কারনে ঘরে বসেই অনেক মুভি দেখা হয়ে গিয়েছিল। ও আবার যখনই হোমটাউন যেত অনেক খাবার, ফলমূল নিয়ে আসত, সেটা আবার মোটামুটি সবাইকেই খেতে দেয়া হত। আরেক সিতি ছিল খুবই ছটফটে, হাসিখুশি। একবার আমার পড়ার টেবিল, আলমারিতে আমার কাপড়-চোপড় সব প্রায় এলোমেলো হয়ে আসছিল; ভাবছিলাম ছুটির দিনে সব গুছিয়ে ফেলব।
সেদিন বাসায় ফিরে একটু অবাক হলাম। পড়ার টেবিল, আলমারি সব সুন্দর করে গুছানো। সিতি হেসে জানাল সে আসলে একটু আগেই চলে এসেছিল, একা ছিল তাই কি করবে ভাবতে ভাবতে এসব করে ফেলেছে! ওর এই ব্যবহার খুবই ভাল লেগেছিল সেদিন।
মালয়শিয়ার সব বাসগুলোতে প্রতিটা বসার সিটের কাছাকাছি, উপরে, একটা করে পুশ বাটন দেয়া থাকত। গন্তব্য স্টপেজ আসার আগে আগেই ওটা চেপে এলার্মবেল জানানোর নিয়ম।
তাহলেই ড্রাইভার বুঝবে পরের স্টপেজে কেউ নামবে। স্টপেজ ছাড়া ওখানে যাত্রী ওঠা-নামা করা হয়না। সব স্টপেজেই সুন্দর করে ছাউনি দেয়া থাকে। কিছু কিছু বাস স্টপেজ তো অনেক দীর্ঘ হয়। সব বাসই এসি-বাস।
দাঁড়িয়েও যাত্রী নেয়া হয় তবে দাঁড়ানোর জায়গা কম-বেশী প্রশস্তই। কিছু কিছু বাসে একটা মেশিন ছিল যেখানে বাসে উঠে ভাড়ার নির্দিষ্ট পরিমান ফেলতে হতো; ড্রাইভার মেশিনের বাটন চাপলে টিকেট বার হয়ে আসত। গত বছর একটা বাস সার্ভিস শুরু হয়েছিল যেটা হলো দিনের মধ্যে একবার বাসে টিকেট করলে ওই রুটে সারাদিন আসা-যাওয়া করতে আর টিকেট করা লাগবে না! দুই রিংগিত আর এক রিংগিত করে বিভিন্ন রুটে অনেক বাস চলাচল শুরু হয়েছিল। যারা মাঝেমাঝে শুধু শুধুই ঘুরতে চায় তাদের জন্য এটা দারুন খবর নিঃসন্দেহে। তাছাড়া ভুল স্টপেজে নামলেও সমস্যা নেই বাড়তি ভাড়া তো গুনতে হবে না , টিকেট দেখালেই হলো।
এছাড়া ওখানে মাসিক বাসকার্ড, ট্রেন কার্ড, মনোরেল কার্ড পদ্ধতিও ছিল- এগুলো বেশ সাশ্রয়ী ।
প্রথমদিন হোস্টেলে এসেছিলাম ট্যাক্সিতে। নতুন শহরের অপরিচিত, ব্যস্ত রাস্তাঘাট মনে রাখা কষ্টকর মনে হচ্ছিল। পরেরদিন সকালে কলেজ যাওয়ার সময় মেয়েদের সাহায্য নিয়েছিলাম, বাস স্টপ, বাস নাম্বার জানার জন্য। আমাকে বলা হয়েছিল ফেরার সময় জালান গমবাক বাসস্টপেজ এ নেমে হেঁটে আসলেই আমার হোস্টেল রোডে পৌছানো যাবে।
তখন বিকাল পার হয়ে গিয়েছিল , বৃষ্টিও হচ্ছিল বেশ। আমি বাসের জানালা দিয়ে আমার রুমের বারান্দাটা পার হয়ে যেতে দেখলাম। সেদিন প্রথমবার জালান গমবাক বাস স্টপেজে নেমে একটু দিকহীন মনে হলো নিজেকে। বুঝতে পারছিলাম না কোন দিকে হাঁটতে হবে। যাইহোক, চিন্তা করে দিক ঠিক করে, অনেকখানি হেঁটে আমার হোস্টেল রোডের কাছাকাছি চলে আসলাম।
সমস্যা ছিল যে মেইন রোডে লেখা ছিল জালান সমপূরনা ; আমি খুঁজছিলাম জালান সেনতোসা, যেটা কিনা ভেতরের রাস্তায় লেখা। সকালবেলা যখন বার হয়েছিলাম তখন রাস্তার ওপারে হলুদ রঙের একটা শপিং সেন্টার দেখেছিলাম, কোর্ট ম্যামোথ নাম ওটার (ফার্নিচার, ইলেকট্রনিক্স - ক্যামেরা, ল্যাপটপ ইত্যাদি পাওয়া যেত)। প্রায় সন্ধ্যা বেলা, আর মেঘলা আকাশের কারনে রাস্তার এপার থেকে শপিং সেন্টারটা দেখলেও চিনতে পারছিলামনা। কয়েকবার আমি হাঁটাহাঁটি করে ফিরে গেলাম জালান গমবাক বাস স্টপেজেই। ওখানে এক ইনডিয়ান-মালয় লোক বোধহয় বুঝতে পারছিল আমার কোন সমস্যা হয়েছে।
নিজে এসেই জানতে চাইল। আমি আমার হোস্টল রোডের নাম বলাতে ও বুঝতে পারছিলনা। কোর্ট ম্যামোথ এর পুরো নাম ভুলে গিয়েছিলাম, শুধু বললাম কোর্ট নামের কিছু একটা হলুদ রঙের একটা বিল্ডিং । লোকটা জিগেস করল কাছাকাছি পোস্ট অফিস আছে কিনা; ছিল তবে তখন আমি সেটা জানতাম না। ও আবার জিগেস করল হোস্টেলের কারো ফোন নাম্বার আছে কিনা।
হোস্টেল সুপাভাইজারের নাম্বার ছিল, আমি একবার ফোনও করেছিলাম , সুপারভাইজারের ছোট ভাই ধরেছিল, ইংলিশ তেমন বলতে পারছিলনা, আমার এমনিতেই তখন মাথা গরম, আমি তার কথা কিছুই ধরতে পারছিলাম না। কিন্তু এই লোকটি স্থানীয়, আমি ফোন করে ওকে দিতে ও মালয় ভাষায় কিছু কথা বলল। এবার সে আমাকে আস্বস্ত করে বলল, আমার হোস্টেলের কাছাকাছি একটা পোস্ট অফিস আছে ও আমাকে সেখানে নিয়ে যাবে, হোস্টেল থেকে লোক আসছে আমাকে নিতে সেখানে। আমরা পোস্ট অফিস পৌছানোর পর দেখলাম আলোং (হোস্টেল সুপারভাইজারের ছোট ভাই) সেখানে দাঁড়িয়ে আছে। সাথের লোকটি জিগেস করলো এই ছেলেকে আমি চিনি কিনা, জানালাম চিনি।
এবার লোকটি আমাকে হাত তুলে রাস্তার ওপারে দেখিয়ে বলল, ওই যে তোমার হলুদ রঙের বিল্ডিং, ওটার নাম কোর্ট ম্যামোথ। আমার যেন সব কিছূ পাঁই করে মনে পড়ে গেল এক মুহুর্তে। মনে হলো এই লোকটাকে বোধহয় সৃস্টিকর্তা পাঠিয়েছে...! ধন্যবাদ জানানোর ভাষা পাচ্ছিলাম না; লোকটা হেসে শুধু সাবধানে চলা-ফেরা করার কথা বলে চলে গেল। আমার পায়ের স্যান্ডেলের একটা ফিতে তখন ছিঁড়ে গেছে, আমি স্যান্ডেল খুলে হাতে নিয়ে আলোং এর সাথে খালি পায়েই হাঁটা দিলাম। আলোং মনে হচ্ছিল আমার বেহাল অবস্থা দেখে খুব মজা পাচ্ছিল! ওই মুহুর্তটার একটা নাম আমি দিয়েছিলাম - লস্ট ইন মালয়শিয়া ।
তবে এরপর আর এরকমভাবে হারিয়ে যাইনি বরং মাঝে মাঝে তো আমি স্থানীয়দেরকেই রাস্তাঘাট চিনিয়ে দিয়েছি ...!
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।