আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বগা লেকে পৌছলাম (তাজিংডং-4)

ইচ্ছেমতো লেখার স্বাধীন খাতা....

আমরা জানতাম পাহাড়ে অন্ধকার হঠাৎ করেই নামে। তাই খুব জোরে জোরে হাটছিলাম। হাটতে হাটতে ঠিক সন্ধ্যার শুরুতে আমরা একটা প্রশস্ত উপত্যকায় গিয়ে পৌছলাম। তখনও গোধূলীর আলো আছে। পুরোপুরি অন্ধকার হয়নি।

এতোক্ষণ আমরা যেখান দিয়ে হাটছিলাম তা ছিল কয়েকটি পাহাড়ের মাঝের সংকীর্ণ এলাকা। সেখান থেকে আশপাশের কিছুই দেখা যাচ্ছিলো না। কিন্তু এখন অনেক দূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। দূরের একটি পাহাড়ের উপরে কয়েকটি বেড়ার ঘর দেখা গেল। কিন্তু সেখানে যাবার পথটা দেখা যাচ্ছিলো না।

এ সময় কিছুদূরে একটা আগুন দেখা গেল। আবছা অন্ধকারে আগুনের পাশে কয়েকজন মানুষ আছে বলে মনে হলো। আমরা ভয় না করে তাদের দিকে এগিয়ে গেলাম। কাছে গিয়ে দেখি ছোট্ট একটা পাহাড়ি গ্রাম। অল্প কয়েকটা বাড়ি।

একটু আগেও আগুনের পাশে কয়েকজন মানুষ ছিল কিন্তু এখন তারা কেউই নাই। গ্রামে ঢুকে দেখি কোনো জনপ্রাণি নাই। গ্রামের লোকজন সব গেল কোথায়? সবার ঘরের দরজা বন্ধ। তবে কি আমাদের দেখে সবাই ভয়ে পালিয়েছে? মহা সমস্যায় পড়লাম। অনেক ডাকাডাকির পর একজন লোক বের হয়ে আসল।

সে স্থানীয় চৌকিদার। অল্প বাংলাও বলতে পারে। সে আমাদের বগা লেকের পথটা দেখিয়ে দিল। এখান থেকে খাড়া পাহাড় বেয়ে উঠলেই বগা লেক। অন্ধকার নেমে এসেছে।

খাড়া পাহাড়ের একপাশে গভীর খাদ। খাদের ধার দিয়ে বিপদজনক পায়ে হাটা রাস্তা। অন্ধকারেই আমরা উঠতে শুরু করলাম। কিছুক্ষণ হাটার পর সবাই হাপাতে শুরু করলাম। সারাদিন কম ধকল যায়নি।

পথ ভুল করার জন্য সবাই গাইড সাং লিয়েনকে ইচ্ছেমতো ধমকাতে শুরু করলাম। ওর কারণেই আমাদের এতো ভোগান্তি। পথ হারিয়ে না ফেললে বিকালেই আমাদের বগা লেকে গিয়ে পৌছানোর কথা। আমি অবশ্য লিয়েনের ওপর একটুও রাগ করিনি। পথ না হারালে আর ঘুরার মজাটা থাকলো কোথায়! অন্ধকারে খাড়া পাহাড় যেন আর শেষ হতেই চায় না।

ক্লান্তিতে আমাদের হাত-পা আর চলে না। হাপরের মতো উঠানামা করে বুক। শুকনো বাশে আগুন জ্বালিয়ে মশাল তৈরি করা হলো। এ পথের শেষ কোথায়, আর কতদূর উঠতে হবে কিছুই বোঝা যাচ্ছে না। একটু সমতল স্থান দেখে কয়েকবার বিশ্রাম নিয়ে নিলাম।

তারপর আবার উপরে ওঠা। এভাবে একসময় পাহাড়ের উপরে পৌছলাম। এবার পথটা নিচের দিকে। পাহাড় থেকে নামার সময় পরিশ্রম কম হয়। কিছুক্ষণ নামার পর অন্ধকারেও জায়গাটা সমতল বলে মনে হলো।

ঠান্ডা বাতাসের ঝাপটায় আশপাশে জলাভূমি আছে বলে মনে হলো। রাত প্রায় 8 টার সময় আমরা বগা লেকের পাড়ে গিয়ে পৌছলাম। একটু এগোতেই পাহাড়িদের বসতি দেখতে পেলাম। এই এলাকায় আর্মি ছাড়া সাধারণত কোনো বাঙালি আসে না। লেকের ধারেই আমরা আমাদের তাবু খাটালাম।

তাবুটা খাটানো খুব সহজ। অ্যান্টিনার মতো দুইটা লম্বা স্টিক আছে। সেগুলো তাবুর সঙ্গে লাগালেই তাবু দাড়িয়ে যায়। এরপর তাবুর চারপাশে কয়েকটা গজালের মতো জিনিস পুতে দিতে হয়। এ কাজে সাধারণত দুই মিনিটের বেশি সময় লাগে না।

আশপাশ থেকে শুকনো কাঠ সংগ্রহ করে তাবুর পাশে আগুন জ্বালালাম। পরিশ্রমে এতোক্ষণ মনে ছিল না, আবহাওয়া অসম্ভব ঠান্ডা। তাবুর ভেতর মাটিতে শুয়ে কিভাবে ঘুমাব ভাবতেই পারছিলাম না। আমাদের প্রথম কাজ হলো খাওয়াদাওয়া করা। ক্ষুধায় নিজের কাপড়চোপড় খেয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে।

তাড়াতাড়ি রান্নার বন্দোবস্ত করতে হবে। আমাদের রান্নার পদ্ধতিটি খুবই মজার। আগুনের উপরেই গরম পানির একটি ডেকচি চাপিয়ে দিলাম। পানি কিছুক্ষণ গরম হবার পর সেখানে দিলাম কয়েক প্যাকেট নুডলস। এরপর সেখানে দেয়া হলো মসলা, লবণ, মরিচ ইত্যাদি।

থালা হাতে নিয়ে আগুন ঘিরে বসে আছি। কতোক্ষণে রান্না শেষ হবে বুঝতে পারছি না। এক চামচ ঝোল সহ নুডলস থালায় উঠিয়ে টেস্ট করলাম, আহ অমৃত। কি দরকার পানি শুকিয়ে নুডলস খাবার। পানি সহ ঝোল ঝোল নুডলস সবাই থালায় উঠিয়ে নিলাম।

নিমেষেই খেয়ে নিলাম ধোয় উঠা নুডলস। ব্যাপক চাহিদার কারণে দ্্বিতীয়বার রান্না করা হলো নুডলস। এবারও একই পদ্ধতিতে নিমেষেই খাওয়া হয়ে গেল। এর পরও যাদের ক্ষুধা যায়নি তারা বিস্কুট খেতে পারবে বলে জানানো হলো। ভারী ব্যাগ বহন করতে করতে পিঠে-কাধে ব্যথা হয়ে গেছে।

হাটতে হাটতে ব্যথা হয়েছে সম্পূর্ণ পা। এরপরও আমরা সবাই বয়সে তরুণ। উত্তেজনায় টগবগ করছি। কিছুক্ষণ বিশ্রাম করার পর ধীরে ধীরে শক্তি ফিরে এলো। আবার হাটতে বেরোলাম।

অন্ধকারেই গেলাম বগা লেকের পাড়ে। প্রকৃতির এক আশ্চর্য সৃষ্টি বগা লেক। সাগর সমতল থেকে প্রায় 1800 ফিট উপরে এর অবস্থান। একদম স্থির আর স্বচ্ছ পানি। রাতের বগা লেকের প্রকৃতি অসম্ভব সুন্দর।

তাবুতে ফিরে আসলাম। সারা রাত তাবুর পাশে আগুন জ্বালিয়ে রাখা হয়। পালা করে একজন পাহারায় থাকি। (ছবি: মশাল হাতে গাইড সাং লিয়েন এবং তার পেছনে আমরা। বগা লেকে পৌছানোর আগে উপরে ওঠার সময় তোলা)


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।