আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিভতে বসেছে অন্ধকারের আলোকশিখা পানিহার লাইব্রেরী

www.runews.weebly.com

রাজশাহী শহর থেকে 35 কিলোমিটার দুরে গোদাগাড়ী উপজেল সদরের ডাইংপাড়া মোড়। এখান থেকে আরো 12 কিলোমিটার দুরের গ্রাম আইহাই। এক সময়ে শুষ্ক বরেন্দ্র অঞ্চলের প্রায় প্রত্যান্ত এই অঞ্চল আদিবাসী অধু্যষিত। আশা যাওয়ার চওড়া রাস্তা। রাস্তার দুপাশে দিগন্ত বিস্তৃত ফসলের তে।

রাস্তার দুপাশের মাঠ আর সেখানে সাওতাল বালাদের কাজ যেন অনেকটা পটে আকাঁ ছবির মত। আইহাই গ্রামের ভেতর দিয়ে আকাঁবাকাঁ সরু রাস্তা পেরিয়ে পানিহার গ্রাম। রাজশাহী শহর বা গোদাগাড়ীবাসীর কাছে এই অঞ্চল এখনও প্রত্যন্ত বলেই পরিচিত। তবে পানিহারের পরিচিতি কেবল দেশই নয়, বিদেশেও। একেবারে নাক সিঁটকানো অজপাড়া গায়ের একটা লাইব্রেরীই পানিহারের এই পরিচিতির কারন।

এই লাইব্রেরীর দুর্লভ আর বিশাল বইয়ের বহরের টানেই পানিহারে এখনো ছুটে আসেন দেশী বিদেশী অনেকেই। কারণটা জানা গেল সাবেক তত্ত্বাবধায়ক রফিকুল আলমের কাছ থেকে। পঞ্চাশোর্ধ কাঁচাপাকা চুলের লম্বা লোকটি যেন ফিরে গেলেন বাল্যকালের স্মৃতি হাতড়াতে। ' এই লাইব্রেরী তৈরি করেছিলেন আমার চাচা এনায়েতুল্লাহ। আর তার হেলপার ছিলাম আমরা।

' গ্রামের লোকের কাছে এনাতুল্লাহর পরিচিতি 'এনায়েত পন্ডিত'। কারণটাও স্পষ্ট। তিনিই প্রথম শিার আলো জালিয়েছিলেন এই বরেন্দ্রর এই প্রত্যন্ত অঞ্চলে। রফিকুল আলম জানালেন, এনাতউল্লাহর বাবা ছিলেন কৃষক। লেখাপড়া না জানলেও তিনি শিানুরাগী ছিলেন।

আর একারণে ছেলেকে পড়তে পাঠিয়েছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব বাহাদুর হাইস্কুলে। বাংলা 1318 সালে ওই স্কুল থেকে তিনি এন্ট্রান্স পাশ করেন। তারপর সেখানেই শিকতা শুরু করেছিলেন। ওই সময়েই তিনি নবাব বাহাদুর হাইস্কুলের লাইব্রেরীর সদস্য ছিলেন। ওই লাইব্রেরীতে নিয়মিত পড়াশোনা করতেন তিনি।

পরে গ্রামে ফিরলেও বইয়ের মায়া ছাড়তে পারেন নি তিনি। আর এ কারণেই নিজের গ্রামে একটা লাইব্রেরী প্রতিষ্ঠার চিন্তা করছিলেন তিনি। আইহাই গ্রামে ফিরে তিনি একটা স্কুল প্রতিষ্ঠা করেন। এলাকার গ্রাম, বাড়ি বাড়ি ঘুরে ছাত্র সংগ্রহ করেন। কয়েকজন শিককে নিয়ে মাসিক 15 টাকা বেতনে স্কুলে শিকতা শুরু করেন তিনি।

এই স্কুলের ছাত্রদের পড়াশোনার জন্য বই আনা হতো কোলকাতা থেকে। এই বই কিনে পাওয়া কমিশন দিয়ে আরো বই আনা হতো লাইব্রেরীর জন্য। তখনও লাইব্রেরী কোন ভবন নেই। একটা , দুটো করে কেনা বইয়ের সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়লো। এই বই দিয়েই তিনি 1945 সালে প্রতিষ্ঠা করেন পানিহার লাইব্রেরী।

লাইব্রেরীর বই কেনার জন্য এনাতুল্লাহ হাত বাড়ালেন গ্রামের মানুষের কাছে। পাওয়া টাকায় আস্তে আস্তে বাড়লো বইয়ের সংখ্যা। এসময় নিজের বাড়ির সামনেই একটা মাটির বাড়ি তুলে সেখানেই স্থাপন করলেন লাইব্রেরীর ভবন। 1954 সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে এই এলাকা থেকে এমএলএ নির্বাচিত হয়েছিলেন সাগ্রাম মাঝি। তিনি ছিলেন এনায়েতউল্লাহর কাশমেট।

পরবতর্ীতে সহপাঠীর অনুরোধে তিনিও সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিলেন। সরকারী সাহায্যে আর এনায়েতউল্লাহর চেষ্টায় আরেক দফা বাড়লো লাইব্রেরীর বইয়ের সংখ্যা। কোলকাতা থেকে আনা হতে থাকলে জনপ্রিয় সাময়িকি আর পৃথিবীর নামকরা লেখকদের বই। এভাবেই শহর থেকে অনেক দুরের নিভৃত পল্লীতে তিলে তিলে গড়ে উঠলো বিশাল জ্ঞানের ভান্ডার সমৃদ্ধ পানিহার পাবলিক লাইব্রেরী। রফিকুল আলম আরো জানালেন, তিনিই এই অঞ্চলে প্রথম নিররতা মুক্ত করার অভিযানে নামেন।

এলাকার দরিদ্র, অশিতি পরিবার থেকে শিাথর্ীদের এনে ভর্তি করাতেন স্কুলে। আর পাঠ্য বইয়ের বাইরের পড়াশোনা করতে হত লাইব্রেরীকে বসে। এভাবেই তিনি এই এলাকার মানুষের মধ্যে জ্ঞানের আলো জালিয়েছিলেন। 1958 সালে এটি 'পানিহার পাবলিক লাইব্রেরী' নামে মঞ্জুরী প্রাপ্ত হয়। সে সময় শিা ও সংস্কৃতি মন্ত্রনালয়ের অধীনে পরিচালিত হতো এটি।

বছরে অনুদান হিসেবে দেয়া হতো 500 টাকা। 1980 সালে মন্ত্রনালয় এটিকে জেলা প্রশাসকের কাছে হস্তান্তর করে। 2000 সালে জেলা প্রশাসক লাইব্রেরীটিকে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের নিকট হস্তান্তরের পর নিয়মিত আর কোন অনুদান লাইব্রেরীর ভাগ্যে জোটেনি। 1991 সালে বিএনপি মতায় আসলে এলাকার সংসদ সদস্য ও তৎকালীন মন্ত্রী ব্যারিষ্টার আমিনুল হক 80 হাজার টাকা অনুদান দেন। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ থেকে দেয়া হয় 20 হাজার টাকা।

এই টাকায় তৈরি হয় লাইব্রেরীর পাঠাগারের জানালা-দরজা ও মেঝে পাকা সহ একটি নতুন ভবন। কিছু আলমারিও কেনা হলো নতুন সাজে সাজলো পানিহার লাইব্রেরী। এনায়েতউল্লাহ মারা যান 1975 সালে। এরপর থেকে সরকারী সাহায্যে আসলেও পানিহার লাইব্রেরী আর সেরকম উন্নতি হয় নি। এ সময় এই লাইব্রেরীর দায়িত্বে আসেন গ্রামের আরেক শিানুরাগী আব্দুল খালেক মোল্লা।

গত বছরের 30 এপ্রিল তার মৃতু্যর পর থেকে কার্যত বন্ধই হয়ে আছে এই লাইব্রেরী। পানিহার লাইব্রেরী তালাবন্ধই ছিল। আশপাশে কোন লোকজন নেই। অনেক খোঁজাখুঁজির পর পাশের একটি বাড়ি থেকে বেরিয়ে এলেন আব্দুল খালেক মোল্লার নাতনী ফারহা আমদেন ইভা। তালু খুলে ভেতরে ফুকলাম।

পুরো ঘরই ধুলোয় ধুসরিত। ঘরের মাঝখানে কয়েকটা টেবিলে বিপ্তি ভাবে পড়ে আছে বইপত্র। ঘরের ভেতরে স্যাতসেতে অন্ধকার। মেঝের এখানে ওখানে পড়ে আছে ইদুরের বিষ্ঠা। বইয়ের আলমারি কপাট খোলা হা করে।

ইভা বললেন, আমার দাদা দীর্ঘদিন ধরে এই লাইব্রেরীর দায়িত্বে ছিলেন। তার মৃতু্যর পর থেকে বন্ধই হয়ে আছে এই লাইব্রেরী। ইভা জানালেন, এই লাইব্রেরীতে সাময়িক পত্র- পত্রিকা, সাহিত্য, উপন্যাস, বিশ্বকোষ, ধমর্ীয় , কাব্য ও কবিতা, ইতিহাস রচনাবলী , বিজ্ঞান ডিটেকটিব, অর্থনীতি, উদ্ভিদ বিজ্ঞান ও জীব বিজ্ঞান বিষয়ে রয়েছে প্রায় 13 হাজার বই পুস্তক। আর আলাদা করে বইয়ের সংখ্যা 8 হাজার। টেবিলের রেজিস্ট্রার খাতার হিসাবে ইংরেজী, বাংলাভাষার অনেক পুরাতন বইয়ের সংগ্রহ রয়েছে এখানে।

বঙ্কিম, শরৎ, রবীন্দ্রনাথ থেকে শুরু করে হালের হুমায়ূন আহমেদের বইও রয়েছে পানিহার লাইব্রেরীর সংগ্রহে। রয়েছে কোলকাতার রজনীকান্ত দাষ সম্পাদিত শনিবারের চিঠি, মাসিক মোহাম্মদী থেকে শুরু করে দুই বাংলার অনেক সাময়িকি। নতুন ভবনের তিনটি ঘরের আলমারিতে এসব বই-পুস্তক সাজানো রয়েছে। পুরানো মাটির ঘরটি এখন ব্যবহৃত হয় গণশিা কার্যক্রমের স্কুল আর রিডিং রুম হিসেবে। তবে লাইব্রেরী বন্ধ থাকায় এটি এখন স্কুল হিসেবেই ব্যাবহৃত হয়।

লাইব্রেরীর দেয়াল জুড়ে টাঙ্গানো রয়েছে ইতিহাস বিখ্যাত ঘটনা ও মনিষীদের প্রতিকৃতি। অজপাড়া গায়ের পানিহার লাইব্রেরীর এখনকার জীর্ন দশা দেখে বোঝার উপায় নেই এক সময় এখানকার সংগ্রহ দেখে অনেক বিখ্যাত মানুষের চোখই কপালে উঠেছে। রফিকুল আলম জানালেন, পানিহার লাইব্রেরী ঘুরে গেছেন তৎকালীন মন্ত্রী প্রভাস লাহিড়ী, ধীরেন দত্ত, আইনুদ্দিন চৌধুরী, পল্লীকবি জসিমউদ্দিন, কবি বন্দে আলী মিয়া, উত্তরবাংলার চারণকবি আব্দুল মান্নানসহ আরো অনেকে। 30 বছর আগে এই পাঠাগার পরিদর্শন করে কবি বন্দে আলি মিয়া মন্তব্য করেছেন, 'শহরের আবেষ্টনী হতে বহু দূরে পল্লীর নিভৃত কোণে এই পাঠাগার। এখানে এসে পাঠাগারের গ্রন্থাবলীর বৈচিত্র্য এবং বিপুল সংখ্যা দর্শন করে বিস্মিত হলাম।

কতটা ঐকান্তিক আগ্রহ এবং সাধনা থাকলে এইরূপ একটি বিরাট সংখ্যার একত্র সমন্বয় করা সম্ভব সে শুধু কল্পনার বিষয়ও। ' নাচোলের রাণীখ্যাত ইলা মিত্রও এক সময় লুকিয়ে ছিলেন এই গ্রামে। সে সময়টাতে তিনি এই লাইব্রেরীতে এসে পড়তেন। এখনো দেশ বিদেশ থেকে অনেকেই আসেন গবেষনার জন্য। পানিহার লাইব্রেরী ধ্বংস হতে বসেছে।

রণাবেন আর অনুদানের অভাবে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এই লাইব্রেরীর বিশাল ও দুর্লভ সংগ্রহ। রফিকুল আলম জানালেন, এক সময় সারা বছরই উৎসব লেগে থাকতো এই গ্রামে\ আর এর উদ্দ্যোক্তা থাকতেন এই লাইব্রেরীর সাথে সংশ্লিষ্টরা। তবে বিশ্বস্ত লোক না থাকায় এখন পানিহার লাইব্রেরী চালানো সম্ভব হচ্ছে না। তবে এই লাইব্রেরীকে আবার ভালোভাবে চালু করা হলে আবার প্রাণ ফিরে পাবে পানিহার।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.