আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিশ্বাসবোধ ও একজন সফেদা বিক্রেতা

http://itmanagerblog.blogspot.com

শাহবাগ মোড়ে পিজি হাসপাতালের কোনাটা এখন খালি খালি লাগে। দাঁড়িয়ে-বসে সবার আড্ডা দেয়া , ফল বিক্রেতাদের হরেক রঙের টসটসে ফল, ঝাল-মুরিওলা, কিছুই গত কয়দিন ধরে দেখা যায় না। কেমন খালি-খালি লাগে জায়গাটা। বেশি ভাল লাগতো রঙ্গিন টসটসে ফল গুলো দেখতে। যত্নে সাজিয়ে রাখা বিদেশি ফল গুলোর দাপটই ছিল বেশি।

আর আমাদের, দেশী ভিন্ন সাইজের ফলগুলো মনে হয় খানিকটা অযত্নেই বিক্রেতার সামনে খাচায় পড়ে থাকত। ডাক্তার বন্ধুদের কাছ থেকে শুনে শুনে আমি অনেকদিন ধরেই মৌসুমী ফলের প্রতি একটু দরদী হবার চেষ্টা করছি। ভাবখানা এমন সুযোগ পেলেই প্রতিদিন কিছু মৌসুমী ফল কিনে খাব! মৌসুমের ফলে নাকি ওই মৌসুমের রোগ-বালাইয়ের প্রতিশেধক থাকে। তাই বেশি বেশি করে মৌসুমী ফল খেতে হবে। অফিস থেকে ফেরার পথে ফলগুলো দেখে দেখে বাসার দিকে হেটে যেতে যেতে, মানুষের ইতি-উতি দাঁড়িয়ে-বসে আড্ডা - ভালই লাগে।

আর প্রায় প্রতিদিনই ভাবি এত উপকারী মৌসুমী ফল কিছু কিনে নেই। কিন্তু কোনোদিন তা হয়ে উঠে না । ব্যাপারটা কেমন সংসারী হয়ে ওঠা মনে হয়, ব্যাচেলর জীবনের যেমন ইচ্ছে ভাবটা কিছু নষ্ট হোক তা চাইব সে সাধ্য কই আমার। নিজের জন্য এক হালি ফল কিনব? তিনদিন পর যখন টেবিল হতে ফল পচা গন্ধ বেরোবে তখন হয়ত মনে পড়বে, আ-হা-রে ফলগুলো নষ্ট হয়ে গেল, খাওয়া হয়নি। খুজে পেতে তখন স্তুপ কাগজ-বইয়ের নীচ হতে পচা ফলগুলো বের করে গারবেজ বাক্সে নিয়ে ফেলব।

ওই দিন পিজির মোড়ে ফাকা জায়গাটা দেখে শাহবাগের ফলেদের জন্য মনটা কেমন যেন করে উঠলো। যখন চোখের সামনে ছিল তখনতো এমন হয়নি। মনে হচ্ছে ফলের দোকান খুজছি আমি। আরেকটু হেটে ঔষধের দোকান গুলোর সামনে দেখলাম এক চাচা কিছু সফেদা নিয়ে বসে আছে, বিক্রির জন্য। জিজ্ঞেস করলাম দাম কত চাচা? হালি একদাম ১২ টাকা আঙ্কেল, জবাব পেলাম ।

গলায় একটু ঝাঁজ মিশিয়ে বললাম- একদাম কেন চাচা? ১০ টাকা, ১১ টাকা হবে না? ফলের খাচার দিকে একটু ঝুকে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম। উত্তরে ফল বিক্রেতা চাচা না বলল। ১২ টাকার ১ পয়সাও কম হবে না। বুঝলাম না - ১ পয়সা কম চাইতে পারি এমন ধারণা হোলো কেন? ব্যাপারটা নিয়ে পেঁচাইতে ইচ্ছা করল না। না-না, ১ পয়সা কম চাইব কেন, কি বলেন? বলটা তার কোটেই ছেড়ে দিলাম।

বললাম - তাহলে চাচা, আমাকে ১ হালি দেন। ভাল থেইকা তোলেন, ওই দাগঅলা গুলা দিয়েন না। আমি কিন্তু চিনিনা, আপনে ভাল দেইখ্যা দেন, যেন মিষ্টি হয়। খাইয়া যেন আবার আসতে ইচ্ছা হয়। বুড়ো বিক্রেতা বিড়-বিড় করে কি যেন বলছে চাচা কি বলেন? দিতাছি আঙ্কেল, জবাব এলো।

আপনে এইগুলান নিয়া যান, খাইয়া তার পরে কইয়েন। আমি ভাবছি খাইয়া তারপর কমু মানে, চাচাকি স্যাম্পল দিচ্ছে নাকি? গার্মেন্টস ব্যাবসায় যেমন বায়য়ার'কে আকৃষ্ট করার জন্য ভালকরে স্যাম্পল করা হয় সেই রকম কোন ব্যাপার নাকি? ফল চাচা আবার বলল- ব্যাবসাতো একদিনের জইন্য না, এইখানে বসি, আপনে আইজকা বিশ্বাস কইরা নিয়া গেলেন, ভাল দিলে আরেকদিন আইবেন। সায় দিয়ে বললাম ঠিকইতো চাচা। ১ হালি সফেদা সহ ঠোঙ্গাটা হাতে নিয়ে টাকাটা বুঝিয়ে দিয়ে আমি বাসার দিকে হাটা শুরু করলাম। আর ভাবছি - এই বৃদ্ধ ফল বিক্রেতার বোধ কেমন টনটনে, ঠিকইতো বলেছে লোকটা - সে আসলে আমাকে ঠকিয়ে, কয়টা টাকা বেশি নিয়ে কিইবা এমন লাভ করবে? কিংবা অনেক কিছুই নাহয় করল... ! আমাকে ঠকিয়ে সে আসলে বিশ্বাস হারাবে, হয়ত এই নিয়ে ফল বিক্রেতার সাথে আর কখনোই কথা হবে না, কোন অভিযোগ করা হবে না।

সংস্কারের কথা ভেবে আর কি হবে শুধু শুধু সময় নষ্ট, এমন ক্ষ্যাপাটে ভাব নিয়ে আমি নাগরিক দায়িত্ব পালন করব, নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে যাব। বাসায় পৌছে যথারীতি ভুলে গেলাম টসটসে সফেদাগুলোর কথা। মধ্যরাতে যখন কম্পিউটারে কাজ করছি, তখন কোথা থেকে যেন মিষ্টি এক সুবাশ টের পেলাম। কেমন যেন পরিচিত, শৈশবের গ্রামের গন্ধের মত। মনে আছে, যখন ছোট বেলায় গ্রামের বাড়ি যেতাম তখন পথের পাশ থেকে বুনো গন্ধ বের হত।

পচা পাতা, পচা পানি আর সবুজের গন্ধ মিলে বড় আপন সেই অনুভূতি। ইতি-উতি তাকিয়ে যখন খোজার চেষ্টা করলাম মিষ্টি গন্ধটা কোথা থেকে এলো, তখন দেখলাম সন্ধায় কিনে আনা সফেদার ঠোঙ্গা। কিছুটা ক্ষুদাও যেহেতু পেয়েছে- ভাবলাম, খেয়ে দেখি। খেতে গিয়ে টের পেলাম এটা কিভাবে খাই ভুলেই গেছি। মনে পরলো এই ফল নিয়ে মা'র কথা।

"বেশি করে খা' বাবা, আয়রন আছে..." তখন বেশ অবাক হয়ে ভাবতাম- আয়রন মানেতো লোহা। লোহা কি করে ফলের মাঝে থাকে? আর আজ এই মধ্যরাতে ফলগুলো নিয়ে আমি বসে ভাবছি কোথায় আমার সেই দিন গুলো, যখন সারা মুখ রসে ভরে আমি খেতাম ফল, আমার দেশি ফল। ফলগুলো মিষ্টি ছিল, খুবই মিষ্টি, রসালো, সফেদা এত সুস্বাদু! অনেক দিন খাইনি এমন ফল, এরকমটাই মনে হচ্ছিল। মুখটা একবারে রসে ভরে গিয়েছিল। বৃদ্ধ ফল বিক্রেতা বলার জন্যে কিছু বলেনি, সে যা বিশ্বাস করে তাই বলেছে, আমার বিশ্বাসের মূল্য সে দিয়েছ।

আমাকে সে ঠকায়নি। ক্রেতার আস্থা অর্জন করতে চেয়ে ভাল ফলটাই দিয়েছে। আরেকবার, বারবার ব্যবসা করতে চেয়েছে। আমিতো অনেক গুলো ফলের মধ্য থেকে ভাল ফলটা চিনে নিতে পারতাম না বলেই বলটা তার কোটে ছেড়ে দিয়ে খেলতে চেয়েছিলাম। কিন্তু জিতে গেল ফল বিক্রেতা, আর আমি দেখলাম বিশ্বাস বোধ... মানুষের।


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.