নিজের পরিবর্তন এবং দেশের পরিবর্তন
নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়নের জন্য কিছু প্রস্তাব
ড. বদিউল আলম মজুমদার
একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন, সম্ভব হলে ছবিসংবলিত আইডি কার্ডসহ, আজ জাতীয় অগ্রাধিকারে পরিণত হয়েছে। অনেক মহল থেকেই নানা রকম প্রস্তাব আসছে। এর অধিকাংশই অত্যন্ত সময়সাপেক্ষ ও ব্যয়বহুল প্রস্তাব। এগুলোর কথা শুনে রবীন্দ্রনাথের ্তুজুতা আবিষ্কার্থ কবিতার কথা মনে পড়ে। ্তুসুজন্থ-এর পক্ষ থেকে ভোটার তালিকা নিয়ে কাজ করার এবং ২০০০ সালের তালিকার ডাটাবেজ তৈরি করে অনলাইনে দেওয়ার অভিজ্ঞতা থেকে আমাদের মনে হয় যে ্তুনির্ভুল ভোটার তালিকা্থ তৈরির কাজটি অসাধ্য কিছু নয়।
এটি হতে পারে আগামী নির্বাচনের জন্য ছবিসংবলিত তালিকা প্রণয়ন এবং পরে ভোটারদের আইডি কার্ড প্রদান।
সারা দেশের জন্য একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন নিঃসন্দেহে একটি বিরাট কাজ। অপেক্ষাকৃত স্বল্পসময়ে ও স্বল্পব্যয়ে এটি সম্পন্ন করা সম্ভব হবে, যদি ১. কাজটি বিকেন্দ্রীভূত পদ্ধতিতে করা হয়, এ কাজে সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে পরিপূর্ণভাবে কাজে লাগাতে হবে। ২. এতে সবার অন্তর্ভুক্তিকরণ ও সম্পূর্ণ স্বচ্ছতা নিশ্চিত হয়, এতে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সামাজিক সংগঠনের অংশ নেওয়ার সুযোগ সৃষ্টি করতে হবে। ৩. এটি বিদ্যমান দায়বদ্ধতার সম্পর্ককে কাজে লাগিয়ে সম্পাদন করা হয়, যার ফলে শতভাগ সফলতা নিশ্চিত হবে।
৪. কাজটি ডাটাবেজ ফরমেটে সম্পাদন করা হয়, যা থেকে একটি স্থায়ী ভোটার তালিকা পাওয়া যাবে, যাতে নাম সংযোজন-বিয়োজনের সুযোগ থাকবে এবং ভবিষ্যতে এটি ক্রমাগতভাবে হালনাগাদ করা সম্ভব হবে। অনেকের স্নরণ আছে যে গত বছর সুপ্রিম কোর্ট ডাটাবেজ তৈরির মাধ্যমে একটি স্থায়ী ভোটার তালিকা তৈরির নির্দেশনা দিয়েছিলেন।
বিকেন্দ্রীভূত ভোটার তালিকা প্রস্তুতের ্তুহাব্থ বা কেন্দ্রবিন্দু হতে হবে উপজেলা। তবে তালিকা প্রস্তুত ও এটি সংশোধনের মূল কাজ হবে ইউনিয়ন, পৌরসভা বা সিটি করপোরেশনের ওয়ার্ডপর্যায়ে। তথ্য সংগ্রহের কাজ হতে হবে স্থানীয় নির্বাচিত প্রতিনিধি ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এবং কিছু সচেতন নাগরিকের তত্ত্বাবধানে তৃণমূলের একদল স্বেচ্ছাব্রতী দ্বারা।
(চট্টগ্রাম ও ঢাকা মহানগরের জন্য ভিন্ন পদ্ধতি ব্যবহার করতে হবে, কারণ এসব শহরের বিরাট জনগোষ্ঠী ভাসমান নাগরিক। ) উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইউনিয়ন পরিষদের মধ্যে বিদ্যমান দায়বদ্ধতার সম্পর্ক কাজে লাগাতে হবে। এ কাজে সেনাবাহিনীর সহযোগিতাও নেওয়া যেতে পারে।
ভোটার তালিকা প্রণয়নের কাজটি সম্পন্ন করতে হবে কয়েকটি ধাপে। প্রথম ধাপে কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ সম্পাদন করতে হবে, যার প্রথমটি হবে প্রয়োজনীয় ফরম ছাপানো।
একই সঙ্গে কতগুলো যন্ত্রপাতি কিনতে হবে। আমাদের হিসাব অনুযায়ী, দ্রুত কাজটি করার জন্য প্রায় নয় হাজার কম্পিউটার, তিন হাজার প্রিন্টার, ৪২ হাজার ডিজিটাল ক্যামেরা ও প্রয়োজনীয় সংখ্যক জেনারেটর সংগ্রহ করতে হবে। একই সময়ে উপজেলাপর্যায়ে কম্পিউটার রুম প্রস্তুত ও যন্ত্রপাতি স্থাপন, প্রয়োজনীয় লোকবল সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ প্রদান, সাংগঠনিক কাঠামো গঠন এবং ডাটাবেজ সফট্ওয়্যার তৈরি করতে হবে।
কাজটি যথাযথভাবে করতে হলে উপজেলাপর্যায়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাকে সভাপতি এবং উপজেলা নির্বাচনী কর্মকর্তাকে সদস্যসচিব করে এবং প্রধান দুই-তিনটি দলের প্রতিনিধি ও কয়েকজন স্থানীয় বিশিষ্ট ব্যক্তিকে নিয়ে নয় থেকে ১১ জনের ্তুউপজেলা তত্ত্বাবধায়ক কমিটি্থ গঠন করতে হবে। একইভাবে চেয়ারম্যানকে সভাপতি করে এবং সচিবকে সাচিবিক দায়িত্ব দিয়ে ্তুইউনিয়ন তত্ত্বাবধায়ক কমিটি্থ ও স্থানীয় নির্বাচিত মেম্বারকে সভাপতি করে ্তুওয়ার্ড তত্ত্বাবধায়ক কমিটি্থ গঠন করতে হবে।
এসব কমিটিতে পূর্ববর্তী নির্বাচনে সর্বাধিক ভোটপ্রাপ্ত ও দ্বিতীয় সর্বোচ্চ ভোটপ্রাপ্ত প্রার্থীকেও অন্তর্ভুক্ত করা যেতে পারে। প্রতি ওয়ার্ডে তিনজনের একটি ্তুতথ্য সংগ্রহকারী দল্থ থাকবে, যাঁদের একজন হবেন ক্যামেরাম্যান। ক্যামেরাম্যানের নিজস্ব ডিজিটাল ক্যামেরা থাকলে ভালো হয়, তা না হলে তাঁকে ক্যামেরা ক্রয় করতে উৎসাহিত করা যেতে পারে। তথ্য সংগ্রহের কাজে গ্রামপুলিশের সহায়তা পাওয়া যাবে।
প্রথম ধাপের কাজটি সম্পাদন করতে সিদ্ধান্ত গ্রহণের পর থেকে আনুমানিক ৩৫ দিন সময় লাগবে।
উড়োজাহাজে মালপত্র আনার ব্যবস্থা করলে এবং টেন্ডারপ্রক্রিয়া সহজ করা গেলে এটি আরও স্বল্পসময়ে সম্পাদন করা সম্ভব হবে। তবে এ ৩৫ দিনের শেষ সপ্তাহে তথ্য সংগ্রহকারীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটারদের থেকে তথ্য ও তাদের ছবি নিয়ে এসে খসড়া ভোটার তালিকা তৈরি করে আবার মাঠে নিয়ে যাচাই করে দেখতে পারবেন। প্রতি ওয়ার্ডে আনুমানিক ভোটারের সংখ্যা হবে এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার, ইউনিয়নে সর্বোচ্চ ২০ হাজার।
ওয়ার্ডপর্যায়ে প্রস্তুত করা তালিকা ওয়ার্ড কমিটি অনুমোদন করে ইউনিয়নে পাঠাবে। ইউনিয়ন কমিটি নয়টি ওয়ার্ডের তালিকা সমন্বয়ের পর অনুমোদন করে তা উপজেলায় পাঠাবে।
এর মাধ্যমে তথ্য সংগ্রহ, প্রয়োজনীয় সাংগঠনিক কাঠামো তৈরি ও জনমত তৈরির কাজটি সম্পন্ন করতে হবে।
দ্বিতীয় ধাপের কাজটি হবে সময়সাপেক্ষ ও প্রযুক্তিনির্ভর। এই ধাপে উপজেলা কমিটির তত্ত্বাবধানে গড়ে সর্বোচ্চ দুই লাখ ভোটারের তথ্য ৩০টি কম্পিউটারে ডাটাবেজ ফরমেটে ইউনিকোডে এন্ট্রি, ছবি ডাউনলোড এবং ছবিগুলো সংশ্লিষ্ট ভোটারের তথ্যের সঙ্গে সংযোজন করতে হবে। এখানে তথ্য আর ছবির অমিল ঘটার এবং প্রয়োজনীয় কয়েক হাজার ডাটা এন্ট্রি অপারেটর না পাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে আইডি তৈরি করে, নিবিড় তত্ত্বাবধানের মাধ্যমে এবং সামরিক-বেসামরিক সেক্টর থেকে দক্ষ জনবল সংগ্রহ করে এই ঝুঁকি দূর করা সম্ভবপর হবে বলে আমাদের বিশ্বাস।
ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরির পর সেগুলো প্রিন্ট করে পুনঃ সংশোধনের জন্য আবার ওয়ার্ডপর্যায়ে পাঠানো হবে। উপজেলাপর্যায়ে তৈরি ডাটাবেজটি জেলা ও কেন্দ্রীয়ভাবেও সংরক্ষণ করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে এটি নির্বাচন কমিশনের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হবে। এ ধাপটি সম্পন্ন করতে আনুমানিক ৩৫ দিন সময় লাগবে।
আমাদের হিসাব মতে, আইডি কার্ডসহ ভোটার তালিকা তৈরির দুটি ধাপের জন্য সর্বোচ্চ ৭৫ দিন সময় লাগবে।
এতে ব্যয় হবে সর্বোচ্চ ১৫০ কোটি টাকা, যা কোনোভাবেই একটি ছোট অঙ্ক নয়। তবে আমাদের প্রস্তাবিত পদ্ধতির অনেক আকর্ষণীয় দিক রয়েছে। প্রথমত, অন্তর্ভুক্তিকরণ ও স্বচ্ছতার ভিত্তিতে এবং প্রধান রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিদের সম্পৃক্ততায় প্রণীত হওয়ার ফলে ভোটার তালিকাটি নির্ভুল হতে বাধ্য। এতে ডুপ্লিকেট ভোটার থাকার সম্ভাবনা অতি ক্ষীণ, কারণ তথ্য ফরম পূরণ ও ছবি তোলার সময়, যা একত্রে করা হবে এবং ভোটারকে উপস্থিত থাকতে হবে। এ প্রক্রিয়ায় রাজনৈতিক দলের দায়বদ্ধতাও নিশ্চিত হবে।
দ্বিতীয়ত, ডাটাবেজ তৈরি হওয়ার মাধ্যমে আমরা একটি স্থায়ী ভোটার তালিকা পাব, যা ক্রমাগত পরিশীলিত করে একটি ত্রুটিমুক্ত তালিকা তৈরি করা সম্ভব হবে। ডাটাবেজের সার্চ প্রটোকল ব্যবহার করে ডুপ্লিকেট নাম বাদ দেওয়া এবং নতুন নাম সংযোজন করা যাবে। তৃতীয়ত, ডাটাবেজটি ব্যবহার করে যত খুশি সম্ভব কপি প্রিন্ট করা যাবে, বাইরের কোনো ছাপাখানার দারস্থ হতে হবে না। তবে নির্বাচনের সময় অতিরিক্ত কপি প্রিন্ট করার জন্য পিডিএফ ভার্সনের সিডি বাইরের কম্পিউটার সেন্টারে পাঠানো যেতে পারে। চতুর্থত, ডাটাবেজটি ব্যবহার করে পরে যে ধরনের আইডি আমরা চাই, তা (এমনকি ন্যাশনাল আইডি কার্ড) তৈরি করা সম্ভব হবে।
মনে রাখতে হবে যে আইডি কার্ডের ব্যাপারে কার্ডের ওপর ছাপানো লেখার স্থায়িত্ব ও কার্ডের নিরাপত্তা এবং ব্যয়ের পরিমাণের একটি সরাসরি সম্পর্ক রয়েছে। পঞ্চমত, ছবিসংবলিত ভোটার তালিকা তৈরির ফলে নির্বাচনে জাল ভোট দেওয়া সম্পূর্ণভাবে বন্ধ করা যাবে। একই সঙ্গে ভোটার আইডি নিয়ে প্রভাবশালীদের জোচ্চুরি বন্ধ করা সম্ভব হবে। ষষ্ঠত, উপজেলাপর্যায়ে সংগৃহীত কম্পিউটারগুলোর অধিকাংশ বিতরণ করে প্রতি ইউনিয়নে একটি করে ্তুইউনিয়ন তথ্যকেন্দ্র্থ গড়ে তোলা সম্ভব হবে। এমন তথ্যকেন্দ্রের সম্ভাব্য অবদান বিরাট বলে আমাদের ধারণা।
এসব কম্পিউটার ব্যবহার করে পরবর্তী সময়ে রুটিনভাবে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা সম্ভব হবে।
ঢাকা ও চট্টগ্রাম মহানগরের ভোটার তালিকা তৈরির জন্য তথ্য সংগ্রহ করার কাজে শিক্ষক, সমাজকর্মী, এমনকি সেনাবাহিনীকে কাজে লাগানো যেতে পারে। এ কাজটি করতে হবে ভোটকেন্দ্রভিত্তিক। প্রতি কেন্দ্রের আওতাভুক্ত এলাকাগুলোর ম্যাপ তৈরি করে তথ্য সংগ্রহকারী দল বাড়ি বাড়ি পাঠাতে হবে। তালিকাটি নির্ভুল করার এবং প্রত্যেক ভোটারের ছবি তোলা নিশ্চিত করার জন্য হয়তো এক শুক্রবার (জুমার সময় ছাড়া) বা শনিবার দিন বিশেষ আইন জারি করার প্রয়োজন হতে পারে।
এর জন্যও একটি দায়বদ্ধতার কাঠামো গড়ে তুলতে হবে।
এ প্রসঙ্গে বলা প্রয়োজন যে স্বল্পখরচে ও স্বল্পসময়ে ছবিসহ একটি নির্ভুল এবং নির্ভরযোগ্য ভোটার তালিকা তৈরি করতে হলে কাজটি জাতীয় অগ্রাধিকারে পরিণত করে শুরুতেই সব জনগোষ্ঠীর কাছে পৌঁছানোর জন্য ব্যাপক প্রচারাভিযান চালানো আবশ্যক। এ কাজে ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়া এবং জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের কাজে লাগাতে হবে। প্রচারাভিযানে সুস্পষ্টভাবে প্রচার করতে হবে যে একাধিক স্থানে একাধিকবার ভোটার হওয়া দণ্ডনীয় অপরাধ এবং ভোটার না হলে পরবর্তী সময়ে আইডি কার্ড পাওয়া যাবে না। প্রধান রাজনৈতিক দলগুলোর নেতাদেরও এ কাজে সম্পৃক্ত করতে হবে, যাতে তাদের মাঠপর্যায়ের কর্মীরা এ কাজে জড়িত হয় এবং পুরো কার্যক্রম সক্রিয়ভাবে পর্যবেক্ষণ করে।
আমরা আশা করি যে নির্বাচন কমিশন দ্রুত পুনর্গঠিত হবে এবং কমিশন সময়ক্ষেপণ না করে ভোটার তালিকা তৈরির কাজে হাত দেবে। এ ব্যাপারে অনেকের মতামত গ্রহণ করা প্রয়োজন। তবে আমরা ্তুসুজন্থ-এর পক্ষ থেকে এ কাজে নিঃশর্ত এবং নিঃস্বার্থভাবে কমিশনকে সহায়তা করতে প্রস্তুত।
ড. বদিউল আলম মজুমদার: সম্পাদক, সুজন-সুশাসনের জন্য নাগরিক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।