রঙ্গিন দুনিয়া গুলশান লেকপাড়ে একা বসে বহুতল ভবনগুলোর জৌলুসতা দেখছিলাম। হঠাত চোখের সামনে একটি স্মৃতি ভেসে উঠল তখন আমি ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা দিতে গিয়েছিলাম। ঢাকা থেকে চট্রগ্রাম আসা এমনকি ট্রেনে চড়ার প্রথম অভিঙ্গতা। সারারাত বন্ধুদের সাথে আড্ডা হইহুল্লোড়ের পর কখন যে ক্লান্তি অবসাদে ঘুমিয়ে পড়লাম আন্দাজ করতে পারলাম না। ভোরে বন্ধুদের ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গল।
তখন আমরা বটতলী রেলস্টেশনে উপস্হিত। আজ আমি বিখ্যাত চট্রগ্রামের বটতলী রেলস্টেশনের কথায় বলছি। চতুদর্দিকে শোনসান নীরবতা তখন ও মানুষের ঘুম ভাঙ্গেনি কোলালাহল ও তেমন একটা নেই। ২/৩ জন কুলি ছাড়া, সম্ভবত তারা ও ট্রেনের ট্রামের আওয়াজে জেগে উঠেছে।
বন্ধুরা সবাই ট্রেন থেকে নেমেই সোজা দৌড় কারন বিশ্ববিদ্যালয়ের শাটল তখন স্টেশনে খাড়া।
তবে ছাড়বে ঘন্টা তিনেক পর তবু ও ছাত্রদের তাড়াহুড়ো কারন ভর্তি পরীক্ষায় প্রচুর লোকের সমাগম ঘটেছে, কারো সাথে আছে তাদের অভিভাবক, তাই সিট পাওয়া মুশকিল। যথারীত আমি ও সবার সাথে পাল্লা দিয়ে ট্রেনের দিকে ছুটলাম, গন্তব্য ট্রেনে সিট দখল। আমার এই দুর্দম ছুটে চলার পেছন দিক থেকে একটি আওয়াজ কানে ভেসে আসল, স্যার একটা রুটি কিনে দিবেন গতরাতে কিছুই খাইনি। ঢাকা শহরে এইসব ভাসমান মানুষের ডাক স্বাভাবিক হলে ও এত ভোরে আমার কাছে আর্তিটা অস্বাভাবিক ঠেকেছে। ট্রেনে ব্যাগটা রেখে আমি আবার সোজা বাচ্চাটির কাছে গেলাম।
তখন দুএকটি ফুটপাতের দোকান সম্ভবত খোলা ছিল। এদিকে আমার ও পেট হালকা অস্তিরতা করছিল। তাই বাচ্চাটিকে রুটি কিনে দিয়ে, আমি ও পানি ও কয়েকটি রুটি নিয়ে ট্রেনে ফিরে আসলাম।
ভর্তি পরীক্ষা তাই মাথাটা ও খানিকটা ঘ্যানজাম করছিল। অনেক কাঠখোড়ের পর যখন ট্রেন ছাড়লে হাফ ছেড়ে বাচলাম।
তবে ট্রেনের উপর নিচে তিল ধারণের ঠাই ছিল না, এ যেন জনসংখ্যা বিস্ফোরণের জানান দিচ্ছিল। ভাগ্যিস সিটটা পেয়েছিলাম তা নাহলে কি যে হত!! শাটল ছাড়ার পর অসম্ভব রকম ভাল লাগছিল চারদিকের ছায়াসুনিবিড় প্রাকৃতিক দৃশ্যবলী আমাকে ছেলেবেলার সেই "ট্রেন চলেছে ট্রেন চলেছে রাত দুপুরে ওই" কবিতাটির কথা মনে করিয়ে দিল।
বিশ্ববিদ্যালয় গেইটে পৌছতেই বিশাল এক নৈসর্গিক পাহাড় আমাদের অভ্যর্থনা জানাল, কি-অপরুপ শোভিত দালানগুলো পাহাড়ের সাথে মিতালী গেথে আছে। আমার সিট পড়েছিল কলাভবনের ৪/৫ তলায় হবে, তবে এত উচুতে বসে দেখি, পাহাড় আমাকে ছেড়ে যাইনি। আমি আনন্দটা একটু বেশি পেয়েছিলাম কারন সমতটের ছেলেদের পাহাড় দেখার সৌভাগ্য একটু কমই হয়।
ফুরফুরে মেজাজে পরীক্ষা শেষ করে নির্দিষ্ট জায়গায় বন্ধুদের জন্য দাড়িয়ে রইলাম। কারন চট্র্রগ্রামের কোন কিছুই আমার চেনা-জানা নাই। তবে ভাগ্যটা এভার সুপ্রসন্ন ছিল না। সবাইকে নিয়ে অনেক কষ্টে একটি বগিতে গাদাগাদি করে দাড়ালাম তবুও দীর্ঘশ্বাস এইটুকু যে নির্দিষ্ট গন্তব্যের ধাপ পেরোনো। তবে সেসময় শীতকাল ছিল বলে শেষ রক্ষা হয়েছিল।
যেই শাটল বটতলিতে পৌছল তখন হড়হুড়িয়ে নামতে গিয়ে,আমি কিছুটা দিকভ্রান্ত হয়ে ফুটপাত ধরে একটা খোলা জায়গা দাড়িয়েছি। তার খানিকটা পাশেই ছিল আর্বজনার ভাগাড় যেখানে শহরের ময়লা ফেলা হয়। তার সাথে তিনজনকে দেখে আমি হতভম্ব হয়ে যাই একজন নারী ,একজন পুরুষ ও একটি শিশু। সম্ভবত তারা স্বামী স্ত্রী ও তাদের সন্তান। তাদের গায়ে জীর্ণশীর্ণ ছেড়া কাপড়, গায়ের অর্ধনগ্নতার জানান দিচ্ছিল, তবে তিনজনই ভাগাড় থেকে খাবার সংগ্রহে ব্যস্ত কিছুক্ষন পর তাদের সাথে দুটি কুকুর ও যোগ দিল খাদ্য সংগ্রহের জন্য, তবে বার বার কুকুরগুলো তাড়ানোর পর ও যাচ্ছে না।
বুকের ভেতরটা কেমন যেন কাপছে আগে কখন ও মানবতার এমন নিষ্টুর করুণ আর্তি প্রত্যক্ষ করিনি। আর দেখছি তিনজন মানুষের সাথে কুকুরগুলোর খাবার সংগ্রহের এই নিষ্টুর প্রতিযোগিতা। মাঝে মাঝে শিশুটির সাথে কুকুরগুলোর চলছে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার মত ঘটনা ।
অনেক খোজাখোজির পর শিশুটি একটি প্যাকেটের সন্ধান পেয়ে মাকে নিয়ে সামান্য দুরে সরে গেল। মুহুর্তের মাঝে কি মায়াবী দৃশ্য, শিশুটি তার মাকে পরম যত্নে মুখে খারার তুলে দিচ্ছে আবার মা ও স্বর্গীয় আদরে ছেলেকে কুলে নিয়ে মুখে খাবার তুলে দিচ্ছে, পচা বাসি ভাগাড়ের এই খাবারের মাঝে যেন হ্রদ্দতার গভীর ছোঁয়া।
ততক্ষণে বাবা ও খাবার দেখে ভাগাড় ছেড়ে চলে আসে তাদের কাছে। অনেক কাকুতি মিনতি করে খাবার চায় আবার মুঠো মুঠো কেড়ে নেয়। আর যাইহোক এটি হ্রদয়ে দাগকাটা সোনার বাংলার খন্ডিত চিত্রমাত্র। কাওরানবাজার আজিমপুর কিংবা শাহবাগের ফুটপাতে, রাতের বেলায় তার কিছু উন্নত চিত্র দেখা যাবে। ছোট ছোট শিশুদের ফুলবিক্রি প্লাষ্টিক কুড়ানো বা ডাস্টবিনে খাবার সংগ্রহে কুকুরের সাথে রীতিমত দাঙ্গা।
তবে এগুলো শিল্পাচার্য জয়নুলের কোন দুর্ভিক্ষের তৈলচিত্র নয়, নয় ইংরেজদের খাদ্য শষ্য ক্রোক করে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির কোনো ঘটনা। এটি শোষনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে অর্জন করা আজকের এই সোনার বাংলাদেশ। যেখানে অর্থনৈতিক সমতা, সুষম উন্নয়ন ও মৌল মানবাধিকারের কথা বলে মানুষকে স্বপ্ন দেখানো হয়েছিল। দেশীয় সকল সম্পদের উপর জনগনের সমান সুযোগ ও অংশগ্রহনেরে কথা বলা হয়েছে। দেশ আজ গতিশীল অর্থনীতির প্রবৃদ্ধি অর্জন করলে ও সমভাবে এসব লোকদের সামাজিক উন্নয়ন ও নিরাপত্তা হয়নি।
আজ যেখানে বসে আমি গগণচুম্বি অট্রালিকা, মনোরম বহুতল ভবন ও বিলাসিতা দেখছি অন্যদিকে ডাষ্টবিনে মানুষের হাহাকার ও তাদের দহন যন্ত্রনা চোখের সামনে বেসে আসছে। কই দেশের অর্থনীতিতো শ্রমিক মজুরের শ্রমে তলাবিহীন ঝুড়ি হয়নি। কম্বলচোর থেকে শুরু করে আজকের কালো বিড়ালগুলা তলাবিহীন করে যাচ্ছে। দেশকে দেওলিয়া করার ফন্দিফিকির করছে।
ভাঙ্গা সুটকেস থেকে হাজার কোটি টাকা, বিদেশে বাড়ী গাড়ী ও ব্যাংক ব্যালেন্সগুলো ফুলে ফেপে উঠছে।
সাথে আছে কিছু গিরগিটি যারা তৈলমর্দন করে অর্থনীতিকে গ্রাস করছে। বিলিয়ন বিলিয়ন বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ আসে কোথা থেকে? কারা জোগান দেয় অর্থনীতির সামগ্রিক দেনা পাওনার!! সামাজিক নিরাপত্তা খাতের স্বল্প বাজেট থেকে উন্নয়ন খাতের ব্যয় বৃদ্ধি করে চলছে দুর্ণীতির মহা আয়োজন। ভিজিডি ভিজিএফ বা অন্যান্য রেশনিংযের কতটুক পায় জনগন? আগে একজন বাজার শাসনে অতিষ্ট ছিল জনগন এখন হাজার রাজার শাসনে ডাষ্টবিনে মানুষের প্রাণ ওষ্ঠাগত। ক্ষমতাধর এসব দুবৃত্তদের কলার চেপে না ধরতে পারলে ডা্ষ্টবিনের করুণ চিত্রটি হবে আমাদের ভবিষ্যত জীবনের স্বাভাবিক চিত্রপট। অসহায় হয়ে আজ কবির পঙতি দিয়ে শেষ করছি;
পৃথিবীতে হায় সেই বেশি চায়
যার আছে ভুরি ভুরি।
রাজার হস্ত করে সমস্ত
কাঙ্গালের ধন চুরি। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।