দেশের সর্বোচ্চ আদালত সুপৃম কোর্টে গতকাল বৃহস্পতিবার নজিরবিহীন হামলা হয়েছে। প্রজাতন্ত্রের প্রেসিডেন্টরে বিরুদ্ধে দায়ের করা দুটি রাজনৈতিক রিটের কার্যক্রম আপিল বিভাগ স্থগিত করে দেয়ার প্রতিবাদে এ হামলা চলে। চিফ জাস্টিসের এজলাস আক্রান্ত হয়। তাণ্ডব চালিয়ে আদালতের বই, ফাইলপত্র, ফার্নিচার তছনছ করে গুণ্ডারা। আওয়ামী লীগ সমর্থক উগ্র আইনজীবীদের ছত্রছায়ায় বাইরে থেকে দলীয় সন্ত্রাসীরা এসে পুরো সুপৃম কোর্ট দখল করে নেয়।
চিফ জাস্টিস পালিয়ে প্রাণে বাচেন। বাইরের সন্ত্রাসীরা এসে আওয়ামী লীগ বিরোধী সিনিয়র আইনজীবীদের হেনস্তা করে, গাড়ি পোড়ায়।
বিচারকদের বিরুদ্ধে লাঠি মিছিল, হাই কোর্টে বস্তি বসানোর ন্যক্কারজনক ঘটনার পর একই রাজনৈতিক দল এবার এ ভয়ঙ্কর সন্ত্রাসী ঘটনার জন্ম দিল। এ সন্ত্রাসের পর আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা সদর্পে ঘোষণা করেছেন, চিফ জাস্টিসকে পদ ছেড়ে দিতে হবে। একই সঙ্গে রাষ্ট্রের অ্যাটর্নি জেনারেলকেও তারা অবাঞ্ছিত ঘোষণা করেছেন।
চিফ জাস্টিসের পদত্যাগ পর্যন্ত তারা কোর্ট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্টকে চ্যালেঞ্জ করে আনীত দুটি
রাজনৈতিক রিটের কার্যক্রম সুপৃম কোর্ট স্থগিত করায় ক্ষিপ্ত আওয়ামী আইনজীবীরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন। ওই উকিলদের পিয়ন ও মুহুরিরাও এতে যোগ দেয়। তারা বাইরে থেকে রাজনৈতিক কর্মীদেরও ডেকে আনে। তারা সবাই মিলে প্রধান বিচারপতির আদালত, অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসসহ কয়েকটি গাড়ি ভাংচুর করে ও পুড়িয়ে দেয়।
এ সময় অ্যাটর্নি জেনারেলের অফিসের সামনে পার্ক করা সাবেক আইন প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের গাড়ি পুড়িয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। তারা কোর্টের সামনের জাতীয় পতাকা টেনে নামিয়ে ফেলে। তখন সুপৃম কোর্টের সব বিচারক আটকা পড়ে যান নিজ নিজ কক্ষে।
গতকাল তিন রিটের প্রথমটির ওপর আদেশের দিন ধার্য ছিল। হাই কোর্ট বিভাগের জাস্টিস মোঃ আওলাদ আলী ও জাস্টিস মইনুল ইসলাম চৌধুরীর সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ গত বুধবার শুনানি শেষে আদেশের দিন ধার্য করেন।
কিন্তু গতকাল সকালে আদেশের আগে রাষ্ট্রের প্রধান আইনজীবী অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী আদালতে বক্তব্য দেন। এরপর আবেদনকারীদের আইনজীবী ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামও আদালতে শুনানি করেন। দুপুরের বিরতি পর্যন্ত তাদের শুনানি চলে। এরপর আদালত জানায়, বিরতির পর রিটের ওপর আদেশ দেয়া হবে।
জানা যায়, দুপুরে অ্যাটর্নি জেনারেল এ জে মোহাম্মদ আলী রিট আবেদনের শুনানি স্থগিত করতে প্রধান বিচারপতির কাছে যান।
এর আগে অ্যাটর্নি জেনারেল একটি বৃহত্তর বেঞ্চে এ রিটগুলোর শুনানি গ্রহণের জন্য বিচারপতি আওলাদ আলী এবং বিচারপতি মইনুল হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চের কাছে আবেদন জানান। আদালত এ বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত না দেয়ায় তারা প্রধান বিচারপতির কাছে যান বলে অ্যাটর্নি জেনারেল দফতর সূত্রে জানানো হয়।
কোর্ট আবার বসার শুরুতেই অ্যাটর্নি জেনারেল হাই কোর্টে তিনটি আবেদন পেশ করেন। জানা যায়, এগুলোতে প্রেসিডেন্টরে বিরুদ্ধে রিটের কার্যক্রম স্থগিত বিষয়ে আপিল বিভাগের আদেশ আদালতে জানানো হয়। তখন হাই কোর্টের বিচারপতিরা বিষয়টি উপস্থিত আইনজীবীদের অবহিত করেন।
এ ঘটনার পর আওয়ামী লীগ সমর্থক আইনজীবীরা ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠেন। আদালতের বাইরে এসে আবেদনের সমর্থক আইনজীবীরা চারদলীয় জোট সমর্থিত আইনজীবীদের ধাওয়া করেন। তারা প্রধান বিচারপতি সৈয়দ জে আর মোদাচ্ছির হোসেনের কক্ষে হামলা চালান। প্রধান বিচারপতির এজলাস কক্ষের দরজা তারা ভেঙে ফেলেন। আগুন লাগিয়ে দেন সাবেক প্রতিমন্ত্রী ব্যারিস্টার শাহজাহান ওমরের গাড়িতে।
তারা সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদকেও ধাওয়া করেন। পুরো ঘটনার সময় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও রোকনউদ্দিন মাহমুদ আদালত প্রাঙ্গণেই ছিলেন। বিকাল সোয়া ৩টায় তারা তড়িঘড়ি গাড়িতে করে আদালত থেকে চলে যান।
সবকিছু ঘটে গেলে বিকাল সাড়ে ৩টায় পুলিশ আসে। আন্দোলনকারী আইনজীবীরা তখন দৌড়ে বার ভবনে ঢুকে পড়েন।
পরে তারা একত্র হয়ে পুলিশকে ধাওয়া দেয়। তবে পুলিশ ও আইনজীবীদের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ হয়নি। বিকাল ৫টা পর্যন্ত আদালত প্রাঙ্গণে তারা মিছিল-সমাবেশ করেন। মিছিলে চিফ জাস্টিসের বিরুদ্ধে তাদের স্লােগান ছিল, ্তুমোদাচ্ছিরের দুই গালে জুতা মারো তালে তালে্থ এবং ্তুমোদাচ্ছিরের চামড়া তুলে নেবো আমরা্থ। এ ঘটনার সময় বিএনপি সমর্থক অধিকাংশ আইনজীবী চীন মৈত্রী সম্মেলন কেন্দ্রে খালেদা জিয়ার সঙ্গে মতবিনিময় অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন।
১৪ দলীয় জোট আইনজীবীদের সুপৃম কোর্টে তাণ্ডবের প্রতিবাদে এক প্রেস বৃফিংয়ে মওদুদ আহমদ বলেন, রিটগুলো প্রাথমিক পর্যায়ে ছিল। শুনানি হচ্ছিল। এ পর্যায়ে আপিল বিভাগ মামলার কার্যক্রম স্থগিত করেছে। এ ধরনের ঘটনা অতীতেও ঘটেছে। প্রশিকার কাজী ফারুকের মামলার রায় ঘোষণার মুহূর্তে একজন বিখ্যাত আইনজীবী আপিল বিভাগ থেকে সে রায়ের ওপর স্থগিতাদেশ এনেছিলেন।
জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ফোরামের আহ্বায়ক খন্দকার মাহবুবউদ্দিন আহমাদ বলেন, সংবিধান যদি না রক্ষা করা যায় তবে আমরা কার কাছে যাবো? চিফ জাস্টিসের কক্ষে ভাংচুর বিষয়ে তিনি তীব্র নিন্দা জানান। তিনি বলেন, যারা নির্বাচনকে বানচালের চেষ্টা করছে তাদেরকে সবাই মিলে প্রতিহত করতে হবে।
এদিকে হামলার ঘটনার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক সংবাদ সম্মেলনে ড. কামাল হোসেন বলেন, হাই কোর্টের আদেশ দেয়ার মুহূর্তে অ্যাটর্নি জেনারেল একটি কাগজ আদালতে পেশ করলেন যাতে আপিল বিভাগ আদেশের ওপর স্থগিতাদেশ দিয়ে দিল। অথচ এ বিষয়ে আমাদের জানানোর কথা। কিন্তু আমাদের কোনো নোটিশ দেয়া হয়নি।
এভাবে চিফ জাস্টিসের রুমে গিয়ে আদেশ আনাটা ঠিক হয়নি। তাছাড়া যে কাগজটি আদালতে পেশ করা হয় তা সিল্ড ছিল না বা এখানে চিফ জাস্টিসের স্বাক্ষরও ছিল না। ড. কামাল হাই কোর্ট দখল ও সন্ত্রাসের কোনো নিন্দা প্রেস কনফারেন্সে করেননি।
রোকনউদ্দিন মাহমুদ সাংবাদিকদের বলেন, আমরা জানতাম বিকালে বিচারপতি আওলাদ আলীর আদালতে প্রথম রিটের দ্বিতীয় বিষয়টির ওপর রুল দেয়া হবে। কিন্তু আদালতের আদেশ দেয়ার কিছু আগে অ্যাটর্নি জেনারেল রিটের বিষয়ে আপিল বিভাগের স্থগিতাদেশ আদালতে জমা দেন।
এতে বোঝা যায় চিফ জাস্টিস খালেদা জিয়ার নীল নকশার সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। এতোদিন তাকে আমরা মাননীয় বলতাম, কিন্তু এখন থেকে নাম ধরে ডাকতেও লজ্জা লাগবে।
কয়েকজন প্রবীণ আইনজীবী জানিয়েছেন, এই রিট বেঞ্চের সিনিয়র বিচারপতি মোঃ আওলাদ আলী একসময় ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের চেম্বারে জুনিয়র ছিলেন। তিনটি রাজনৈতিক রিটের পক্ষে ব্যারিস্টার আমীরও একজন আইনজীবী। এ পরিস্থিততে মামলা শুনতে অতীতে বিচারকদের বিব্রত হওয়ার নজির রয়েছে।
এদিকে নিজের গাড়ি ভাংচুরের পর প্রতিক্রিয়ায় শাহজাহান ওমর বলেন, ঘটনাটি খুবই দুঃখজনক। এ রকম ঘটনা উপমহাদেশে আগে কখনো ঘটেনি। যে কোনো বিষয়ে স্থগিতাদেশ দেয়ার এখতিয়ার চিফ জাস্টিসের আছে। উনি যেটা ভালো মনে করেছেন সে আদেশ দিয়েছেন। ১৪ দল সমর্থিত আইনজীবীদের উদ্দেশ্য হলো মারামারি।
দেশকে তারা অকার্যকর করতে চায়। তিনি বলেন, কুকুর পায়ে কামড়ালে কি করার আছে?
উল্লেখ্য, ২০ নভেম্বর বনানীর আদনান আনোয়ার বাদী হয়ে প্রেসিডেন্টরে চিফ অ্যাডভাইজর পদ গ্রহণকে চ্যালেঞ্জ করে একটি রিট আবেদন করেছিলেন। পরে গত রবিবার ১১টি রাজনৈতিক দলের নেতা তিনটি পৃথক রিট আবেদন করেছিলেন। প্রথম রিটটি পরবর্তী রিটের সঙ্গে মিলে যাওয়ায় আদালত একসঙ্গে শুনানি করে। রিটকারী নেতারা হলেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, ওয়ার্কার্স পার্টির রাশেদ খান মেনন, জাসদ নেতা হাসানুল হক ইনু, গণফোরামের পংকজ ভট্টাচার্য, এলডিপির মেজর আবদুল মান্নান, গণতন্ত্রী পার্টির নূরুল ইসলাম, সাম্যবাদী দলের দিলীপ বড়ুয়া, ইসলামী ঐক্যজোটের মিজবাহুর রহমান চৌধুরী, জাকের পার্টির মুন্সী আবদুল লতিফ, জাতীয় পার্টির বহিষ্কৃত নেতা জি এম কাদের ও ইসলামিক ফ্রন্টের সৈয়দ বাহাদুর শাহ।
গতকাল আবদুল জলিল ও হাসানুল হক ইনু আদালত প্রাঙ্গণে উপস্থিত ছিলেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।