বাংলাদেশের বৈচিত্র্যময় সংস্কৃতি ও সাংস্কৃতিক জীবন
বাস থেকে নেমে ভ্যানে চেপে বসতেই ভ্যানচালককে আমার পাশে বসা অন্য যাত্রীর সঙ্গে কথা বলতে শুনি- 'সুনাতন, গান শুনতি যাবি না?' 'যাবোনে, বাজারের এই থলেখেন বাড়ি থুয়ে যাবো। ' 'আজ আর শালা ভ্যান মারবো না, গান শোনবো। ' তাদের কথার মাঝখানে আমি হঠাৎ প্রশ্ন ছুড়ে দিলাম_ 'গান কোথায়?' তারা বলল-'তমাল তলা হাটে। ' আমি বললাম 'হাটে, না ঘাটে? তমাল তলা আবার হাট হলো কবে?' 'এট্টা গো হাট বসাচ্ছে, সেই জন্যিই তো গান দেচে। ' 'কি গান?' 'ভাবগান।
' 'শিল্পী কারা?' 'ফরিদপুরির তেন আয়চে। দুইজনই মিয়া মানুষ, দুই বুন (বোন)। এর আগেও তমালতলা গান গায়ে গেচে। ' 'আসর কখন?' 'এখনই তো মনে হয়_ হয় হয় টাইম, একুন কত বাজে?' ভ্যানচালক নিজে নিজেই প্রশ্ন করে আকাশের দিকে তাকাল এবং বলল- 'দুটো-আড়াইটা হবি... গান শুরু হবি তিনটে-চারটের দিকি। ' মুহূর্তেই আমি সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলি- গান শুনতে যাব।
ঢাকা থেকে প্রায় পাঁচ ঘণ্টার বাসযাত্রা শেষ করে সবে শেখপাড়া নেমে ভ্যানে চেপে বসেছি। বসন্তপুরের বাড়িতে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে হালকা নাশতা করে মাতৃ আজ্ঞা নিয়ে তমালতলার গানের আসরে যাব। বাড়ি পৌচ্ছে মিনিট চলি্লশের মধ্যে তমালতলার দিকে রউনা দিলাম। কিন্তু সেখানে পেঁৗছে দেখি গান শুরু হয়ে গেছে। শুরুটা দেখতে পেলাম না বলে আমার খুব আফসোস হলো।
আমার সে আফসোসে আসরের কেউ একজন শান্ত্বনা ছুড়ে দিল- 'ভাইজান খুব বেশি মিস করেননি, বন্দনা কেবল শ্যাষ হয়ছে। ' তার কথায় আফসোস ভুলে গানে ঢুকে পড়ি। প্রথম গায়েনের প্রশ্নকথা শুনেই আমার অভিজ্ঞতা বলে দিল_ এটা তো 'নারী-পুরুষ' পালা। কিন্তু আসরের দুজন শিল্পীই তো নারী। তত্ত্বালাপে তাই একজন নারীকে নিতে হয়েছে পুরুষের প, আর অন্যজনকে নারীর প।
নারীর প নিয়েছেন ছোট বোন ডলি পারভীন, সে অষ্টাদশবষর্ীয়া এবং অবিবাহিতা। পুরুষের প নিয়েছেন তারই বড় বোন শিউলি পারভীন, সে বিবাহিতা এবং কুড়িবষর্ী, মানে বয়সের দিক থেকে ডলির চেয়ে মাত্র দুই বছরের বড়। শিউলি শুধু বিচারগানের তার্কিক শিল্পী নয়, বেশ কিছু তত্ত্বগানেরও রচয়িতা। আসরে ঘুরে ফিরে দুই বোনের ভাবসঙ্গীতের যুক্তি-তর্কের ঘেরাটোপে বারবার সাাৎ-শিউলির বাঁধা গান শোনার নতুন একটি অভিজ্ঞতা হলো আমাদের। আরো বিস্ময়, আগে কখনো ভাবগানের তাত্তি্বক বিতর্কে এদের মতো এত কম বয়সী কোনো যুগল গায়েনকে অবতীর্ণ হতে দেখি নাই।
তার ওপর এরা আবার আপন দুই বোন। একই আসরে দুই বোনের ভাবসঙ্গীত বা ভাবগান উপভোগের অভিজ্ঞতাও আমার ছিল না। এক বোন বিবাহিতা, অন্য বোন কুমারী। বিবাহিতা পুরুষ প েআর অবিবাহিতা নারী প। ে সব মিলিয়ে আসরে ও দর্শক সারিতে বহুমুখী উত্তেজনা।
যেহেতু, আজকের আসরে এক বিবাহিতা বোনের প্রতিদ্বন্দ্বী তারই অবিবাহিতা এক ছোট বোন, সেহেতু আসর ঠেলে গানের ফাঁকে ফাঁকে প্রতিদ্বন্দ্বী ছোট বোনকে বড় বোন বিবাহ বিষয়ে কিছু বলে কি? সে প্রশ্নটি এখানে রেখে আমরা বরং মূল আসরে গিয়ে বসি। প্রথমে পুরুষ পরে গায়েন শিউলি পারভীনকে বেহালা হাতে বেশ আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে কথা বলতে শুনি_ 'আল্লাহুমা সাল্লে আলা সাইয়েদীনা মুহাম্মদ। আল্লা ও আমার নবী করিম মুহাম্মদ সাল্লেল লাহু আলাইহের সালামকে সালাম জানাই। যাক ভাই, আমরা জানি নারী মানে হাওয়া, সেই হাওয়া কিসের তৈরি? আদমের বাম পাঁজরের হাড় দিয়া হাওয়ার সৃষ্টি। আমি কি ঠিক বলছি? হঁ্যা ঠিক, হাওয়া মানে নারীর জাতি আদমের বাম পাঁজর দিয়ে সৃষ্টি।
তাই সেই নারী হইয়া বেশি ডেমাক দেওন ঠিক না। নারী এখন রাস্তায় মাটি কাটে, দৌলতদিয়া প্রসকুটোয় থাকে, মানে পতিতালয়ে থাকে। তাই সেই নারী নিয়া গৌরবের কিছু নাই। এখানে আমার প্রশ্ন থাকবে- বেহেশতে গেলে পুরুষ হুর পাবে। সত্তরটা হুর।
নারী কী পাবে? হুরই পাবে না অন্য কিছু পাবে?' শিউলি পারভীন তার এই প্রশ্নকথার মধ্যে বেহালা হাতে সুরে সুরে গান গেয়ে ওঠেন- 'ওরে পুরুষ হইল পরম জাতি সে ছাড়া তোর নাইরে গতি না বুঝিয়া হইল তি দেখ নারে ভাবিয়া \ তুমি আগে কর স্বামী পূজা এইটা তুমার রাস্তারে সুজা স্বামী ভক্তি কর তুমি বিবাহ করিয়া \' বড় বোন শিউলি পারভীনের প্রথম পর্ব এখানে এসে শেষ হতেই প্রতিদ্বন্দ্বী ছোট বোন ডলি পারভীন আসরে উঠে দাঁড়ান। আপন বেহালায় স্বর সেধে নিয়ে ডলি তার কথা শুরু করেন,_ "সে বলে গেছে- আদমের বাম পাঁজরের হাড় দ্বারাই হাওয়া সৃষ্টি হইছে। আমি বলি না। এই মায়ালোক যদি আদমের বাম পাঁজরের হাড় দিয়ে সৃষ্টি করেই থাকে আল্লাপাক, তবে যেই জা'গার হাড় তুলে নিয়েছে, সেই জা'গায় কোনো দাগ নেই কেন? যদি বাম পাঁজরের হাড় দিয়েই তৈরি করে থাকে, তবে সেই জা'গার চিহ্ন আমার দেখাইতে হবে। ওই আন্দাজে কথা বুললে আমি মা'নে নেব নানে।
" ডলি পারভীন এমনকথার মাঝে বেহালায় সুর লাগিয়ে গান ধরেন- 'ওরে আল কুরানে আছে প্রমাণ মাওলার মুখের বাণী জগৎ মাতা হইল আমার ফাতেমা জননী \ ওরে জীবের রূপ ধারণ করিয়া আসিয়াছো ভবেতে নাতিপুত্র দান করিয়া মেতে আছো জগতে \ ভূমন্তে আইলা যখন কে শুনাই মধুর বাণী জগৎ মাতা হইল আমার ফাতেমা জননী \' ডলি পারভীন তার এই গানের মধ্যে আবার কথায় ফিরে আসেন- "সে বলছে যে, এই মহিলা রাস্তায় মাটি কাটে, আছে দৌলতদিয়া প্রসকুটোয়, পতিতালয়ে। সুন্দর কথা। কিন্তু যতই মেয়েরা খারাপ কাজ করুক, একটা ভাইবে চিন্তে করে কথা বলবেন। কেননা, দেশের প্রধানমন্ত্রী কিন্তু এই মেয়ে। কোন দিকে আপনার ঘাটতি আছে, দেখেন তো? যেই জা'গা যাবেন সেই জা'গায় আমার মেয়েলোক।
যতই আমার মেয়ের বদনাম করুক, পুরুষ আজকাল বেকার, পুরুষদের আজ কোনো কাজ-বাজ নাই। এখন আপনার আদমরা তাই ঘরে বসে থাকে, আর মেয়েরা রাস্তায় মাটি কাটে। মেয়েলোকেরাই এ জামানায় বেশি চাকরিজীবী। বর্তমানে নারী-পুরুষের সমান অধিকার। কিন্তু মনে রাখবেন- আল কুরানে আছে প্রমাণ মাওলার মুখের বাণী জগৎমাতা হইল আমার ফাতেমা জননী\ হজ করতে মানুষ কোথায় যায়? মক্কা শরিফ নাকি? কিন্তু, মক্কা যেয়ে আর হজ করতে হবে না।
আল্লা বলেছে- একবার মায়ের মুখের দিকে সুনজরে তাকালে সত্তর হজের নেকি পাওয়া যায়। " এমনই কথার ভেতরে ডলি পারভীনের কণ্ঠে আবার গানের সুর বেজে ওঠে- 'তাই বলব কত মায়ের গুণ রহিয়াছে সবখানে আমি তাই মায়াবড়ি খাই নাই আমার জীবনে খাইলে কি আর নূর মোহাম্মদ পায়তো রে মা জীবনে \ ওরে আল কুরানে আছে প্রমাণ মাওলার মুখের বাণী। জগৎমাতা হইল আমার ফাতেমা জননী\" এখানে গানে ান্তি দিয়ে ডলি পারভীন এবারে প্রতিপরে গায়েন শিউলি পারভীনের প্রশ্নের উত্তরকথায় ফিরে গিয়ে বলেন- 'সে একটা প্রশ্ন করেছে, পুরুষ লোক মরলে বেহেশতে সত্তরটা হুর পাবে। আর মেয়েলোক কী পাবে? মেয়েলোক নিজেই নারী। মেয়েলোক আবার কী পাবে।
পুরুষলোক যে বেহেশতে যাবে সেই বেহেশতের চাবি কিন্তু আমার মা ফাতেমা। আর সেই মাকে ভক্তি দেওয়া ছাড়া কোনো পুরুষ বেহেশতে প্রবেশ করতে পারবে না। ' এমনই উত্তরকথার মধ্যে ডলি পারভীন আবার গানে প্রবেশ করেন_ 'যার নাইরে দম সেই তো আদম হাওয়াতে আদম গড়া হাওয়া না থাকলে আদম যায় মারা রে যায় মারা \' গানের মধ্যে কথায় এসে বলতে থাকেন_ 'সেই সর্বপ্রথম একটা কথা বলছে যে, সৃষ্টির মূলে নারী বলে কিছু নাই। ভুল হলি আপনার হতি পারে। আমার ভুল হয়নি।
কেননা, আপনার লেখা গান গেয়ে আমি আসরে প্রবেশ করছি- যার নাইরে দম সেই তো আদম হাওয়াতে আদম গড়া হাওয়া না থাকলে আদম যায় মারা রে যায় মারা \ হাওয়া পেয়ে হইল আদম হাওয়া রইল দমের মতন ধিয়ানে থাকলে যতন থাকবে রে তোর প্রাণ ধরা \ হাওয়া না থাকলে আদম যায় মারা রে যায় মারা \' এই গানের মধ্যে ছোট বোন ডলি পারভীন এবার প্রতিপ বড় বোনের উদ্দেশ্যে প্রশ্ন ছুড়ে দিয়ে বলেন- 'আপনার কাছে প্রশ্ন থাকবে, এমন একটা পুরুষ ছিল যে একটা নারীর জন্য আরেক নারীর অভিশাপের কারণে পাথর হয়েছিল, এই অভিশাপটা কে, কেন, কাকে দিয়েছিল? এবং পুরুষটার নাম কী? হিন্দু পুরাণ থেকে এই প্রশ্ন থাকল- হাওয়া রতি হাওয়া হইয়া আদমের ভিতরে যাইয়া হাওয়া রতি বেহেশতে যাইয়া আদমকে দিল ধরা। হাওয়া না থাকলে আদম যায় মারা রে যায় মারা। ' ডলি পারভীন তার এই গান শেষ করতেই দর্শকদের মধ্য থেকে এক যুবক উঠে দাঁড়িয়ে বলেন- 'আমার একটা কথা আছে। কথাডা শোনো। ' ডলি সম্মতিতে বলেন- 'হঁ্যা।
' দর্শক যুবক বলেন- 'আল্লা তো আপন সুরাতে আদমকে সৃষ্টি করেছেন। কিন্তু হাওয়াকে কোন সুরাতে সৃষ্টি করেছেন?' ডলি তার নিজের প থেকে এই প্রশ্নটার একটা উত্তর দেবার চেষ্টা করে বলেন-'আল্লার বেহেশতে যে হাওয়া ছিল, সে হাওয়াকে আল্লা নিজ সুরাতে সৃষ্টি করেছিলেন। ' দর্শক যুবক ডলির এমন উত্তর কথায় খুব সম্ভব খুশি হতে পারলেন না। তাই সে ডলিকে ধমক দিয়ে বসলেন। এতে আসরের অন্যান্য দর্শকরা হল্লা দিয়ে যুবক দর্শকটি থামিয়ে দিতে চায়লেন।
কিন্তু সে দর্শকটি ততণে নাছোড়বান্দা হয়ে উঠেছে, সে কিছুতেই থামতে চায়লেন না। অগত্যা কমিটির লোকজন যুবক দর্শকটিকে ধরে বাইরে নিয়ে যান। ডলি পারভীন সেই অবসরে দর্শকদের মেজাজ ধরে রাখতে গান ধরলেন- 'জিব্রাইলরে সঙ্গে নিয়া দেখাইল চিহারা পুরুষ রূপ দেখে যার হইয়াছো হারা রে তোরা রূপ দেখে যার হইয়াছো হারা \ যা হোক, এক দর্শক প্রশ্ন করেছে, তার জন্য আমার এইগান- ওরে জিব্রাইলের সংস্পর্শে আদম-হাওয়া প্রকাশ করছে। বলতে কথা আমার প েহইলাম দিশাহারা। ওরে দুই কানেতে ছিলরে দুল তাইতে শ্রেষ্ঠ রমণীকুল।
পার করিতে একূল ওকূল নিজাম থাকবে ধরা। ওরে অচিন মেয়ে সামনে পেয়ে মায়ের শ্রদ্ধা করা। ' ডলি এখানে এসে তার নিজের প েআরো কিছু যুক্তি খুঁজে নিয়ে প্রশ্ন করে- "তার কাছে আমার প্রশ্ন ছিল যে, একজন মায়ের দিকে সুনজরে তাকালে সত্তর হজের নেকি হয়। আর একটা পুরুষের দিকে তাকালে কয়টা নেকি হয়? আর একটা কথা_ মা ফাতেমাকে আল্লা 'মা' বলে ডাকেছে, কিন্তু কোনো পুরুষকে 'বাবা' ডাকেছে কি না? আশা করি সামনের মঞ্চে সে জবাব দেওয়ার চেষ্টা করবে। গানে আছে- অচিন মেয়ে সামনে পেয়ে মায়ের শ্রদ্ধা করা।
মানে একটি মেয়ে সামনে পেলে টিটকেরি দিওয়া যাবে না, মার মতো শ্রদ্ধা করতে হবে। তাই এইকথাটি মাথায় নিয়ে ভেবে দেখ যে করিবে এই ভব পার, তারে তো দিই না নজর ওরে সর্বহারা\ ওরে কপাল পোড়া\ শিউলি বলে দেখ চেয়ে রূপ দেখে তার হইয়াছো হারা\ " ডলি পারভীনের এই গানের কথার মধ্যে আগের সেই প্রশ্নকর্তা দর্শক-যুবকলাঠি হাতে আসরের দিকে ছুটে আসতে থাকেন। তিনি গায়েন ডলি পারভীনকে মারতে উদ্যত হয়ে মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে থাকলে দর্শকরা সবাই হৈচৈ করে ওঠেন। কেউ কেউ তার আক্রমনাত্মক গতি রোধ করে দেন। কিন্তু দর্শকদের সোরগোল আর থামতে চায় না, তখন সম্ভবত কমিটির লোকজন ভাবে এসব ওই দর্শকটার চক্রান্ত, তাই তাদের কেউ ঠাণ্ডা গলায় দর্শকদের শান্ত করতে চান।
কিন্তু, ওই যুবক দর্শকটির লাফালাফির সঙ্গে দর্শদের উত্তেজনা দেখে কমিটির একজন মঞ্চে উঠে গায়েনের সামনের মাইক্রোফোনটি নিজ হাতে নিয়ে চিৎকার করে বলতে থাকেন- 'এখানে কমিটি গান দিয়েছে। আপনারা কি চুদুফুদু মনে করেন নাকি আমাদের! অ্যা? আপনাদের বারবার পায়ে হাত দিয়ে অনুরোধ করছি। আপনারা কি মনে করছেন- আমরা জলে ভেসে আইছি নাকি? অ্যা? আপনারা যদি সুস্থভাবে এবং সুন্দর পরিবেশে গান শুনতে চান, তাহলে আমরা গান আপনাদের শুনাব। আর যদি আপনারা গান শুনতে না চান, বাইরে চলে যান, আপনাদের দরকার নেই এখানে। ' তার উত্তেজনাময় কথায় দর্শকদের মধ্যে হুল্লোড় আরো বেড়ে যায়।
শেষ পর্যন্ত কমিটির একজন ঠাণ্ডা মাথার লোক উঠে এসে বিনয় করে বলে_'দর্শকমণ্ডলী, আপনারা শান্ত হন, গান হবে। গান কিছুতেই বন্ধ হবে না। আপনারা একটু ঠাণ্ডা হয়ে বসে পড়েন। গান হবে। ' তার কথায় কাজ হয়ে দর্শকরা শান্ত হয়ে বসে এবং পুনরায় গান শুরু হয়।
এবারে পুরুষপরে গায়েন বড় বোন শিউলি পারভীনের পালা। সামান্য একটু কনসার্ট শেষে তিনি একটি গুরুপদ গেয়ে ওঠেন- "শোন বলি তোর কপাল ভালো তোর প্রতি তার নজর পইড়াছে। ওরে লিখিয়া এক প্রেমের চিঠি তোর কাছে পাঠায় দিছে \... গুরু-পীর-পয়গম্বর-আউলিয়া সব আমার পুরুষ মানুষ, নাকি? মহিলা কি হইতে পারে? ওর তো খাওয়া নাই। তাই মায়ের মুখের দিকে একবার সুনজরে তাকাইলে সত্তর হজের নেকি পাওয়া যায়। আর একবার সুনজরে যে পীরের খেদমত করলে সত্তর বছর বন্দেগি করার চাইতে সুয়াব হয়, সেই পীর কিন্তু মেয়ে মানুষ হইতে পারে না।
আবার কয় প্রধানমন্ত্রী! হে হে রে! যার নাই নিজির নাম, তার আবার মামা-খালা! বলি প্রধানমন্ত্রী হইছে কেমনে? নিজির যোগ্যতা নাই, বাবার কামায় ছিল_ সেই কামানোয় শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী হইছিল, ঠিক না? শেখ হাসিনার কি কেউ চিনতো, বাবা না থাকলে? হের স্বামী কে? চেনেন না। উনার বাবার জন্যি উনার উন্নতি হইছে। আর যে এখন বর্তমান_ খালেদা জিয়া? উনি আয়ছেন উনার স্বামীর জন্যি। উনার স্বামী কিছু কামায় করছে, এই কারণে উনি প্রধানমন্ত্রী হইছে। এ হে রে প্রধানমন্ত্রী অত সোজা!... তাছাড়া বলেছেন, মায়ের মুখের দিকে একবার সুনজরে তাকালে যে সুয়াব হয়।
সে কোন মা? যে মা বাবার খেদমত করে। শোনেন তাইলে- কাঠুরিয়ার স্ত্রী দুনিয়া থেকেই বেহেশতের খবর পাইলেন যে, আমি বেহেশতবাসী হবো আগে। মানে মা ফাতেমার আগে বেহেশতবাসী হবে কাঠুরিয়ার স্ত্রী। তাইলে শোনেন, উনি স্বামীর খেদমত কীভাবে করতেন? স্বামী যখন কাঠ কাটতে গেছেন, তখন তিনি লাঠি ঠিক করে রাখতেন, খাবার রাখতেন, দড়ি রাখতেন, পাখা রাখতেন। একদিন মা ফাতেমা নবীজীকে জিজ্ঞেস করলেন,_ 'আব্বা হুজুর, আমি আপনার কন্যা, আমি কি বেহেশতবাসী আগে হবো, না কে হবে?' নবীজী বললেন- 'না, তুমি না, আগে কাঠুরিয়ার স্ত্রী।
' মা ফাতেমা বলল- 'আমি আপনার কন্যা হইয়া আগে বেহেশতবাসী হইতে পারব না!' 'না, তুমি স্বামীর খেদমত সেইভাবে করতে পার নাই। তুমি একবার যাইয়া দেখ কাঠুরিয়ার স্ত্রী কীভাবে তার স্বামীর খেদমত করে। ' মা ফাতেমা কাঠুরিয়ার বাড়ি যা'য়ে দেখে সব কিছু গুছিয়ে রাখা। মা ফাতেমা বললেন- 'আপনি যে পাখা রাখছেন, দড়ি রাখছেন, লাঠিও রাখছেন এখানে। পানির বদনি এখানে, পাখা এখানে।
এইগুলি দিয়ে আপনি কি করেন?' কাঠুরিয়ার স্ত্রী বলেন,_ 'আমার স্বামী যখন কাঠ কাইটে আসে, তখন আগে দিবো পাখা। তারপর এক বদনি পানি। পানি দিওয়ার পরে তার নাশতা। নাশতার পরে যদি তার কাছে কোনো অন্যায় করে থাকি, খেদমতে যদি কোনো ভুল-ত্রুটি হয়, সে আমাকে লাঠি দিয়ে মারবে। লাঠিটা এখানে রাখা।
আর লাঠি দিয়া মারতে যদি তার অসুবিধা হয়, দড়ি আছে এখানে, দড়ি দিয়া বাঁধে আমাকে মারবে। ' তিনি মানে প্রতিপরে গায়েন আমার কাছে প্রশ্ন রাখলেন- মেয়ে মানুষকে আল্লা রাব্বুল আলামীন 'মা' বললেন, পুরুষ মানুষকে 'বাবা' বললেন না, কারণটা কী? পুরুষকে কিছু বলেন নাই এটার কোনো প্রমাণ আছে? কুরানে আছে- এই হাত আমার হাত, সর্বপীরের হাতই আমার হাত। ওই হাতে হাত যে দিল সে আমার হাতেই হাত দিল। কুরানের আয়াত তা প্রমাণ করেছে। আর সনাতন শাস্ত্রে আছে- গুরুকে যে না করে ভক্তি অধপাতে তার হয় রে গতি।
তাই গুরুকে এই ভক্তি করতে হয় যে, এ যেন সেই ভগবান। তাই লালন সাইজীর একটা গানে আছে-''যেহি মুরশিদ সেহি রাসুল। ইহাতে নাই কোনো ভুল...। ' এই কথা কুরানে লিখেছে। কুরানে তার প্রমাণ আছে।
তাই যা-ই বলেন সব জায়গায় ধরা আছে একটু একটু। " এই পর্যন্ত বলে নিয়ে শিউলি পারভীন গানে সুর ধরেন- 'ওরে বাবা-ই বিয়া না করিলে মা হইত না কোনোকালে \' গানের মধ্যে শিউলি তার কথাকে আরেকটু ভেঙে দিতে গিয়ে বলে ওঠেন_ "সারা সুমায় ধরে খালি মার কথা বলতেছে। আচ্ছা, আপনারাই বলেন- এই পুরুষেরা যদি বিবাহ না করত মা বলার মতা কি কারো থাকতো? সারা জীবন বাবার বাড়ি পড়ে থাকলে উনাকেও কেউ মা বলবে না, নাকি ক'ন? তাই বলি- স্বামীর সিবায় মত্ত হও গা যাইয়া, ও মাইয়া \ স্বামীর হুকুম মানল না যে মাইয়া বেহেশত হারাম হইল যে তার দেখনা যাইয়া হাদিস কুরান খুলিয়া রে মাইয়া \" বিবাহিতা বড় বোন শিউলি পারভীন তার প্রতিপরে অবিবাহিতা ছোট বোন ডলি পারভীনকে এভাবেই পুরুষপরে হয়ে বিবাহ ও স্বামী সেবায় মত্ত হতে বলে নিজের উত্তর-পর্ব শেষ করেন। এরমধ্যে দর্শকসারি থেকে বিচ্ছেদের অনুরোধ আসে। শিউলি পারভীনের ভাষায় ভাবগানের মধ্যে বিচ্ছেদের অনুরোধ মানে সালাদ।
ডলি ও শিউলি দুজনকেই বেশ কয়েকটি সালাদ গাইতে হলো। সালাদ গানগুলো দর্শকদের মধ্যে হৈচৈ ফেলে দেয়। কেননা, গানগুলো হচ্ছে- 'লোকে বলে আমার ঘরে নাকি চাঁদ উঠেছে। না গো নয় চাঁদ নয় আমার বন্ধু এসেছে...\' ও 'আমার বাড়ির সামনে দিয়া বন্ধু যখন বউ নিয়া রঙ্গ কইরা হাঁইট্টা যায়। ফাইট্টা যায় বুকটা ফাইট্টা যায়...\' এবং 'খাঁচার ভিতর ময়না, কয়না কথা কয়না, দেরে ছেড়ি কপাট খুলে দে...\' দর্শক অনুরোধের এইসব সালাদগান শেষে শিউলি পারভীন এতণ আসরে বসে থাকা লক্ষ্মীরূপী তৃতীয় একজন নারীকে পরিচয় করিয়ে দিয়ে তাকে একটি গান গাইবার সুযোগ করে দেয়।
নারীটি আসরে দাঁড়িয়ে হাত বাঁকিয়ে তার শাড়ির আঁচলটি কোমরে বেঁধে নেয় এবং তাল যন্ত্রের তালটি ঠিক মতো বাজাতে বলে নৃত্যের সঙ্গে গান শুরু করেন_ 'আমার ঘুম আসে নারে...\' সারা আসর জুড়ে লাজুক হয়ে বসে থাকা এই নারীটি যে যাত্রার একজন রঙ্গের নর্তকী তা সম্ভবত কারোরই জানা ছিল না, তাই ঘটে গেল ভাবগানের একটি বিপরীত ঘটনা, আসরে উপস্থিত বয়ষ্ক দর্শকদের হুল্লোড়ে মেয়েটির 'ঘুম আসে না'র নৃত্যগীত কমিটির লোকজন মাঝপথেই থামিয়ে দেন। পুরো ঘটনায় শিউলি পারভীন বেশ লজ্জিত হয়ে মাইক্রোফোন হাতে নিয়ে বলেন- 'আমার এই বোনটা যে যাত্রায় নাচে আমি জানতাম না, কিন্তু এইটা ভাবগানের আসর। এখানে এক ভাব আর যাত্রার আরেক ভাব। উনি হয়তো বুঝতে পারেন নাই। তাই আমি উনার হয়েই মা চাইছি।
' পুনরায় ভাবগানের কনসার্ট বেজে ওঠে। কিন্তু ভাবগান আর এগোয় না, কারণ ততণে সন্ধ্যা হয়ে গেছে, আর সন্ধ্যার পর গোহাট বসানোর জন্যে গানের দরকার কি? আসরের এই বিবরণের সুযোগে নিশ্চয় বোঝা গেল_ গোহাটে ভাবগানের আসর কেমন হতে পারে? ভাবগানের গাম্ভীর্য, দর্শকদের চিৎকার, দর্শকদের আক্রমণের ভঙ্গি, কমিটির লোকদের তেজি অভিব্যক্তি, আসরে চুপিসারে ঢুকে পড়া যাত্রার নর্তকী, কৌতুক গান, পুরুষের আধিক্য এবং নারীশূন্য দর্শকসারি তো গোহাটের গানের আসরেরই বিশেষত্ব, নাকি? এবারে সেদিনের আসর অনুযায়ী শিউলি ও ডলি পরভীনের দল পরিচিতি উল্লেখ করা হচ্ছে_ উভয় গায়েন শিউলি পারভীন ও ডলি পারভীনের গ্রামের বাড়ি ফরিদপুর জেলার বোয়ালমারী থানার কুন্দুরামদিয়া। লেখাপড়া জীবনে শিউলি অষ্টম শ্রেণী পাশ, ডলি সপ্তম শ্রেণী অতিক্রম করে পেশাগতভাবে গানে দীা নিয়েছেন। তাদের গানের গুরু হচ্ছেন নূর মোহাম্মদ। গুরু নূর মোহাম্মদ বৈবাহিক সম্পর্কে শিউলি পারভীনের স্বামী।
তিনি হাজারখানেক ভাবগানের রচয়িতা। পেশাগতভাবে তিনি বর্তমান দলের পরিচালক। দলের অন্যান্য সদস্যগণ হচ্ছেন_ 1. আব্দুর রহমান(55), তিনি এই দলে হারমোনিয়াম মাস্টার হিসেবে দোহারকি করে থাকেন, 2. আলাউদ্দিন(40), বিচারগানের আসরে বাঁশি বাজিয়ে থাকেন, 3. বোকন শেখ(37), দলে জুড়ি সঙ্গত করেন, 4. সেন্টু(50), পেশাগতভাবে বিভিন্ন গানের দলে ঢোল বাজিয়ে থাকেন। এই দল একটি আসরের জন্যে উভয় গায়ক চুক্তিতে 4000 টাকা থেকে শুরু কতরে 6000 টাকা পর্যন্ত বায়না নিয়ে থাকে। যে সব পালা করে থাকে_ গুরু-শিষ্য, নারী-পুরুষ, শরিয়ত-মারফত, হাসর-কিয়ামত, নবুয়ত-বেলায়েত, জীব-পরম ইত্যাদি।
দলের প্রধান গায়েন শিউলি পারভীনের একটি ভাবগানের অডিওক্যাসেট 'হিন্দু-মুসলমান' এর মাঝে মদুদ সরকারের সঙ্গে যৌথভাবে প্রকাশিত হয়েছে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।