যায় উড়ে যায় অনেক দূর...............
কলেজে থাকতে আমরা কিছু বন্ধু সবসময় একসাথে থাকতাম। তাদেরই একজন আমার জিগরি দোস্ত তানজিমা। ওদের বাসা সেসময় ছিল আমাদের হ্যাং আউটের মত। কারো বাসায় আড্ডা মানেই ওদের বাড়ি। দ্্বিতীয় বর্ষে ওদের বাসাতেই একটা ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটল।
ঘটনাটা হয়ত খুব ইউনিক না, তবে এটা না ঘটলে হয়ত আরো অনেক কিছুই অন্যভাবে ঘটত। জীবনে যা হয় আর কি - একেকটা ছোট্ট ঘটনা বড় কোন ঘটনার মোড় ঘুরিয়ে দেয়।
1996 সালের অগাস্টের 1ম দিনে গেলাম তানজিমাদের বাড়ি। ওর জন্মদিন বলে মহা ফুর্তিফুর্তি ভাব। ওখানে আমরা যারা চেনা বন্ধু ছিলাম তারা ছাড়াও আরেকজনের সাথে পরিচয় হল।
একটা বেশ ভাল ছেলে। চুপচাপ ধরনের। গল্প করতে করতে দেখা গেল আমাদের কিছু কমন আত্মীয় আছে। আমার সাথে খুব shy ধরনের কেউ যে কিনা হুট করে অচেনা কারো সাথে গল্প করতে পারেনা তাদের খুব সুবিধা হল যে তাদের প্রায় কোন effort দিতে হয় না to keep the conversation going. আমি একাই চালিয়ে নিতে পারি। এত কথা বলি যে অন্যদিকে কারো না বললেও চলে যায়।
সেদিনও মনে হয় সেরকমই হয়েছিল। ছেলেটাকে বেশ ভালই লাগল।
অপু সেসময় আমার বেস্টফ্রেন্ডের মত। আমি তখনো ভাবছি, এই মদন ডেফিনিটলি আমাকে কোনদিনই কিছু বলতে পারবে না। আমার ভুল ধারণাও হতে পারে।
যেরকম আঁতেল টাইপ - তাতে এসব নিয়ে এর ভাবারও কথা না। যা হোক, সেদিন বাসায় ফিরে অপুকে ফোন করে অনেক রসিয়ে রসিয়ে এই ছেলেটার গল্প করলাম। গল্পটা করার একটা গোপন উদ্দেশ্য ছিল ওকে একটু বাড়ি মেরে পরীক্ষা করে দেখা। এবার যদি বাছাধন মুখ খোলে! কিন্তু বাড়ি মেরে দেখা গেল অপু নির্বিকার! নিজের মনের কথা প্রকাশ তো দূরের কথা, আমাকে উলটা খুবই উৎসাহ দিল এ ছেলেটাকে নিয়ে। আমি হতাশ।
মনে মনে ভাবলাম, বাহ! এতদিন তাহলে আমি ভুল ভেবে গেলাম!
পরদিন কলেজে গিয়ে মজার ঘটনা শুনলাম। তানজিমা দেখি হাইলি এক্সাইটেড! ঐ ছেলে নাকি ঐ একদিনেই আমার প্রেমে পড়ে গেছে! সেসময়ে কলেজের বোরিং জীবনে এটা একটা উত্তেজনা উদ্রেক করার মতই ঘটনা বই কি! ছেলেটার সব ক্রেডেনশিয়াল বেশ ভাল। তানজিমার অনেক দিনের চেনা। ফ্যামিলি ফ্রেন্ড। একটাই সমস্যা - বাইরে পড়ে, ছুটিতে এসেছিল, ক'দিন বাদেই চলে যাবে।
অনেক ছেলে বন্ধু থাকলেও আমি বরাবরই love ব্যাপারটা নিয়ে বেশ স্কেপটিক, বিশেষ করে প্রথম দেখায় বা একদিনের পরিচয়ে প্রেমের ব্যাপারে। তাই বললাম, আমার সন্দেহ আছে, কথা বলে দেখতে হবে। কিন্তু সময় খুব কম।
বাসায় ফিরে as usual অপুর সাথে শেয়ার করলাম। অপুও দেখি খুব নরমাল।
আমাকে আরো জোরেসোরে উৎসাহ দেয়া শুরু করল। আমার প্রতি অপুর ফিলিংস যে আসলে বন্ধুসুলভ, আমিই যে বেশি-বেশি ভেবেছি - সে ধারণা বদ্ধমূল হল। ভেবে দেখলাম, এই ছেলেটার সাথে কথা বলেই দেখি না, ঘটনা কি হয়!
পরদিন না তার পরদিন ছেলেটা খুবই ভয়ে ভয়ে ফোন করেছিল মনে আছে। আমি যেমন ছেলে-মেয়ে যেকোন কারো সাথে অতি ফ্রি - এ ছেলে দেখা গেল তার উলটা। গলা শুনেই বোঝা গেল বেচারা অতি নার্ভাস।
আমি বেশ ডাইরেক্টলি জিজ্ঞেস করলাম, Why? একদিনে আমাকে কেন ভাল লাগল? ছেলেটা কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, You're so lively, vivacious...you're everything I'm not.
আগেই বলেছি, আমি বরাবর love এর ব্যাপারে সতর্ক। স্কুল-কলেজের বন্ধুদের এত বেশি না জেনে-না বুঝে ভুল করতে দেখেছি যে প্রচুর ছেলে বন্ধু থাকলেও সেভাবে কাউকেই কোনদিন চানস দেইনি। There would always be a limit. বিশেষ করে এরকম একদিনের পরিচয়ে ভুল করার মত আমি ছিলাম না। তারপরেও ছেলেটার এই কথাটা মাথায় আটকে গেল। আরেকটা ব্যাপার আটকাল, সময়।
ছেলেটা চলে যাচ্ছে, তাই আমার তাড়াতাড়ি কিছু ভাবতে হবে। আবার তাই অপুর সাথে শেয়ার করলাম। দেখি ও কি বলে।
অপু যা বলল তা হচ্ছে, This is your chance. এ সুযোগ হারানো উচিত হবে না। ছেলেটা ভাল মনে হচ্ছে।
রাজি হয়ে যাওয়াই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। আগেই বলেছি ছেলেটার অন্য সবকিছুই বেশ ভাল ছিল। যা হোক, ঘটনার আকস্মিকতায় আর অপুর নির্লিপ্ত উলটা উসকানিতেই হয়ত আমি পট করে ছেলেটাকে বলে ফেললাম যে আমি আছি। At least সামনের এক বছর, ওর আবার দেশে ফেরা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে পারি।
এরপর ছেলেটা চলে গেল।
বেশ ইন্টারেস্টিং ব্যাপার হল, ওকে বলার পরপরই আমার চোখ খুলে গেল। হঠাৎ করে প্রথমবারের মত love ব্যাপারটা আর ভবিষ্যত নিয়ে ভাবনা শুরু হল। আর আমি প্রথমবারের মত টের পেলাম যে আমি অপুকে ছাড়া আমার সামনের দিনগুলো ভাবতে পারছি না। মানুষ কেমন করে প্রেমে পড়ে বা ভালবাসা অনুধাবন করে আমি জানিনা। তবে আমি এভাবেই করেছিলাম।
খুব সিম্পলি। আমি ভেবে দেখলাম, এই ছেলেটাকে চিনিই না, ওকে ছেড়েই ছিলাম এতদিন, পরেও থাকা যাবে, কিন্তু অপুকে ছাড়া সম্ভব নয়। অপুর সাথে আমি প্রতিদিন যা শেয়ার করি সেটা ছাড়া কিভাবে থাকব? আর অন্য কারো সাথে থেকেও এভাবে অপুর সাথে সবকিছু শেয়ার করে যাওয়া তো সম্ভব না! সেতো প্রায় টু-টাইমিং এর মত হবে। খোদা! এখন কি করব?
যা হোক, সে যুগে ইন্টারনেট এত সুলভ নয়। আমার তখনো কম্পিউটারই নেই।
চিঠি চালাচালিরও তেমন রাস্তা নেই। তানজিমাই ভরসা। ওকেই বলে দিলাম জানিয়ে দিতে যে আসলে যা বলেছি সেটা ক্ষণিকের মোহই হবে। এর বেশি কিছু বোধ করি এরকম বিনা যোগাযোগে সম্ভব না। ছেলেটা বেশ দুঃখ পেয়েছিল মনে আছে, যদিও আমি বিশ্বাস করি সেটা কাটিয়ে ওঠাও খুব শক্ত ছিল না।
একদিনের চেনা একজনকে ভুলতে আর কতই বা কষ্ট? আমার আর অপুর মত স্মৃতির পাহাড় তো আর নেই সেখানে। পরের বছর দেশে এসে ফোন করেছিল। ওর সাথে বোধ হয় ঐ একবারই দেখা আর দু'বার ফোনে আলাপ। আমার সবসময়ই একটা অপরাধবোধ হয় ওকে হুট করে 'হ্যাঁ' বলেছিলাম বলে। আবার যখন ভাবি আমার চোখ খুলে দেবার জন্য সেটা দরকার ছিল - তখন এক ধরনের কৃতজ্ঞতাও হয়।
জানিনা কোথায় আছো, কিন্তু আমি সেদিনের জন্য ভীষণ দুঃখিত ও কৃতজ্ঞ। আশা করি, এ দশ বছর ভালই ছিলে এবং আছো।
সেদিন অপুকে বাড়ি দিতে চেয়ে নিজেই বাড়ি খেলাম। কিন্তু অপু? ও তখনো ওর মতই রয়ে গেল। সেই নিত্যদিনের ডেটা-শেয়ারিং আর ঝগড়া।
এবার শুরু হল অপেক্ষা। বন্ধুতার মধ্যে আরো কি যেন পাওয়ার জন্য অপেক্ষা। ওর যেকোন কথার আরো গভীর কোন মানে খুঁজে বেড়াই, যেকোন ছুতোয় কষ্ট দেবার চেষ্টা করি যেন ভিতরের অনুভূতিগুলো বের হয়ে যায়। যেটা বলতে চাই, বলি তার উলটা। বলে লক্ষ্য করি রিঅ্যাকশান।
ফোন রেখে দেই হুট করে রেগে। আবার ফোন করলে ভাল লাগে, কথা বলতে চাই, কিন্তু সেটা শো করা যাবে না, তাই রেখে দেই। কথা বললেই বুঝে যাবে। তাই খুব 'ভাব' নেই। যখন দেখি কষ্ট পাচ্ছে, সেডিস্টের মতই আনন্দিত হই আর ভাবি, যাক, he cares.
কিন্তু ঝগড়াগুলো একসময় খুব সিরিয়াস হয়ে গেল।
একেকবার ঝগড়া হয় আর মাসের পর মাস কথা বন্ধ হওয়া শুরু হল। ঠিক যেরকম ভেবেছিলাম সেরকম হল না। এভাবেই এইচ. এস. সি. পরীক্ষাও শেষ হয়ে গেল। শুরু হল আরেকটা অদ্ভুত সময়। অপু আর আমার জীবনের সবচেয়ে কষ্ট আর ভাল লাগার একটা সময়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।