দরজাও বন্ধ নয়
(এই লেখাটি আমার নিজের নয় লেখকের নাম ও মনে নেই, সংগ্রহে ছিলো তাই পোষ্ট করলাম, তবে লেখকের প্রতি কৃতজ্ঞতা রইলো। )
গ্রীষ্মের গরম একেবারে সীমা ছাড়িয়ে গেছে। সূর্যই কেবল তাপ ছড়ায় না, পাথর-বালি এমনকি গাছের পাতা থেকেও যেন চুইয়ে চুইয়ে পড়ে গরম। এই গরমে সমুদ্র তীরের এই বসতি নিথর বললেই চলে। সবাই ছায়া খোঁজে।
কিন্তু কিজিল কাঠের ছড়ি বিক্রেতা ছায়া খোঁজে না। তপ্তরোদে বসে থাকে সে। দুপুরের রোদকে সবসময় সে চ্যালেঞ্জ করে। সমুদ্রতীরের একটু দূরে পাথরের নিচু বাঁধটায় সে সবসময় এসে বসে। রোগা, বেঁটে, পোড়ামাটির মত গায়ের রঙ।
বয়সের ভারে মুখে অসংখ্য বলিরেখা, দেখে মনে হয় খেতের ফাটল। মাথার ছোট ছোট চুলগুলো দেখতে নুনের মত। বুড়োর পাশে কিজিল কাঠের তিনটি টাটকা ছড়ি। দেখলেই বোঝা যায়, সামপ্রতিক ঘষামাজা শেষ হয়েছে, এখনও হলদে হওয়ার সময় পায়নি। মসৃণ, মজবুত, ওজনদার ছড়ি, ফলাও করে বাঁকানো হাতল।
কালক্রমে এটায় হাতির দাঁতের রঙ ধরবে। তখন তাকে দেখাবে ভারিক্কী। কিন্তু কিজিল কাঠের ছড়ির মর্ম সবাই বোঝে না। বুড়োর বিক্রির পরিমাণও সেজন্যে কম। ও যখন উত্তপ্ত পাথরে কিজিল কাঠের ছড়িগুলো নিয়ে বসে থাকে তখন লোকেরা তাকে পাশ কাটানোর সময় ফিরেও তাকায় না।
যেন সে একটা শিলাখণ্ড।
একদিন সাদা পানামা হ্যাট পরা এক ছেলে সেই বুড়োর পাশে এসে দাঁড়াল। ভারি রোগা, সরু হাত, লম্বা গলা, বয়স আট-নয় হবে। সাদা টুপিটা তার কান পর্যন্ত নেমেছে। কিজিল কাঠের ছড়িগুলোর দিকে দেখিয়ে বলল, 'কত করে?'
'একটা এক আধুলি,' জবাব দিল বুড়ো, গাছাড়া সে জবাব।
সাদাটুপি পরা ছেলেটার ধারণা হলো, মাল বেচার জন্যে বুড়োর কোন তাড়া নেই। সাদাটুপির হাতে একটাকা আছে। কিন্তু সে ছড়ি কিনতে আসেনি। চলে গেল সে আইসক্রীম কিনতে।
এখানে ছেলেটা এসেছে বেড়াতে, তার বাবার বন্ধুর বাড়িতে।
গ্রীষ্মের ছুটিতেই বেড়ানো। প্রথম যেদিন সে আসে বাবার বন্ধু লোকটার সে কি সোলাস! যেন তার অপেক্ষাতেই পথ চেয়ে বসে ছিল। কিন্তু ক'দিন যেতে না যেতেই অতিথিকে নিয়ে তাঁর আর তেমন আগ্রহ নেই। বাড়ির সবাই যে যার কাজ করে, আর ছেলেটিও একা একা হাঁটে। গোসল করে নদীতে, যতক্ষণ মনে চায়।
আর পাহাড়ে যায়।
তো, একদিন পাহাড়ে উঠে সেই বুড়োকে দেখল, একটি কিজিল কাঠের ডাল কাটছে। সারা শরীর বেয়ে ঘাম ঝরাচ্ছে। আর ক্ষণে ক্ষণে, 'উহ! আহ্!' করছে।
পরদিন নদীর ধারে সাদাটুপি গিয়ে দেখে, বুড়ো বসে আছে সেই পাথরের উপর।
ছেলেটা এগিয়ে গিয়ে আইসক্রীম কেনার পয়সাটা এগিয়ে দিল বুড়োর কাছে। বলল, 'একটা ছড়ি কিনব। '
সাদাটুপি ভেবেছিল মাল বেচতে পারলে বুড়ো খুশি হয়ে উঠবে। কিন্তু না। বরং একটু যেন অবহেলার সঙ্গেই বলল বুড়ো, 'যেটা খুশি বেছে নে।
'
ছেলেটা একটা ছড়ি নিয়ে চলে গেল, এভাবে প্রতিদিন সে একটা করে ছড়ি কিনতে লাগল। প্রতিদিন নতুন ছড়ি তার চাই।
গ্রীষ্মের মাস শেষ হতে চলেছে, সেই সাথে সাদাটুপির ছুটিও শেষ হবে। তারপর বাড়ি ফেরার পালা। ঘনিয়ে আসছে চলে যাবার দিন।
একটা কথা ভেবে ছেলেটার দুঃখ হয়। সে যখন চলে যাবে, তখন কে কিনবে বুড়োর ছড়ি?
কালই এখান ছেড়ে চলে যাওয়ার দিন। বাবার বন্ধু এবং বাড়ির সবাই যেন হঠাৎ অতিথির উপস্থিতি সম্পর্কে সচেতন হয়ে উঠল। প্রথম যেদিন এসেছিল তখনকার মত এবার বাবার বন্ধুর সেকি আনন্দ। যেন সে চলে যাবে শুনে তাঁর কিছুতেই ভাল লাগছে না।
কালকেই চলে যাবে, তাই আজ শেষ বারের মত সাদাটুপি গেল বুড়োর কাছে শেষ একটা ছড়ি কেনার জন্যে। বুড়োর হাতে পয়সা দিয়ে একটা ছড়ি বেছে নিয়ে চলে আসছিল ছেলেটা, কিন্তু হঠাৎ এই প্রথম বুড়ো ডাকল। 'বস এখানে। '
বসল ছেলেটা।
'কাজ ছাড়া থাকতে পারি না রে,' বলল বুড়ো।
'তাই কিজিল কাঠের ছড়ি বানাই। '
কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ছেলেটা বলে উঠল, 'আমি কাল চলে যাব...কি হবে তখন?'
বুড়ো জবাব না দিয়ে থলে থেকে কি একটা জিনিস বের করতে ব্যস্ত হলো। কাপড়ে মোড়া কি একটা জিনিস। কথা না বলে কাপড় খুলল বুড়ো। ভিতর থেকে বেরুল রূপো দিয়ে হাতল মোড়া একটা ছোরা।
কালো খাপটায়ও রূপোর কাজ করা, হাতলের লাল রঙ নিষপ্রভ হয়ে এসেছে কালক্রমে। 'ধর,' বলে ছোরাটা সাদাটুপির দিকে এগিয়ে দিল বুড়ো।
এত দামী এমন একটা উপহার নিতে ছেলেটা সঙ্কোচ বোধ করল। বলল, 'ধন্যবাদ, কিন্তু এ আমার দরকার নেই। '
'নে, ধর!' বলল বুড়ো।
'তোকে আমার মনে ধরেছে, তুই মানুষ। ' ছেলেটার হাতে ছোরাটা গুঁজে দিল সে।
বেশ ভারী ছোরা। এই ভারটার জন্যে ছোরাটাকে ভাল লাগল ছেলেটার। নিরিবিলিতে বসে খাপ থেকে ছুরিটা বের করছে আর ভরছে।
ফলাটা ভাল করে দেখতেই হাতলের কাছে লেখাটা চোখে পড়ল। গোটা গোটা হরফে লেখা 'বিশ্বস্ত বন্ধুকে'। ড়
[বিদেশী গল্পের ছায়া অবলম্বনে]
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।