6 দফার প্রস্তাবসমুহ ছিলো
1. ঐতিহাসিক লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তিতে পাকিস্তানকে একটি সত্যিকারের ফেডারেশন রূপে গড়িতে হইবে। তাহাতে পার্লামেন্ট পদ্ধতির সরকার থাকিবে। সকল নির্বাচন সার্বজনীন প্রাপ্তবয়স্কদের সরাসরি ভোটে অনুষ্ঠিত হইবে। আইনসভা সমুহের সার্বভৌমত্ব থাকিবে।
** লাহোর প্রস্তাবে বলা হয়েছিলো ভারতের উত্তরপশ্চিমাংশের এবং পুর্বাংশের মুসলিমপ্রধান এলকাসমুহ নিয়ে একটা রাষ্ট্র গঠনের কথা, যেই রাষ্ট্রের অংশদ্্বয়ের স্বায়ত্বশাসন থাকিবে।
***
2. কেন্দ্রীয় সরকারের হাতে মাত্র 2টি বিষয় থাকিবে। প্রতিরক্ষা এবং বৈদেশিক নীতি। অবশিষ্ট বিষয় সমুহ প্রদেশসমুহের হাতে থাকিবে।
3. পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য পৃথক অথচ বিনিময়যোগ্য মুদ্্রার প্রচলন করিতে হইবে। অথবা দুই অঞ্চলের জন্য একই কারেন্সি থাকিবে।
শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট নির্দেশ থাকিবে যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার না হইতে পারে। এই বিধানে পাকিস্তানে একটি ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে। দুই অঞ্চলে দুইটি আঞ্চলিক রিজার্ভ ব্যাংক থাকিবে।
4. সকল প্রকার ট্যাক্স,খাজনা ধার্য ও আদায়ের ক্ষমতা থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে। আঞ্চলিক সরকারের আদায়কৃত রেভিনিউর একটি অংশ ফেডারেল তহবিলে জমা হইবে।
এইভাবে জমাকৃত টাকাই ফেডারেল সরকারের মূলধন হইবে।
5. দুই অঞ্চলের বৈদেশিক মুদ্্রা আদায়ের পৃথক পৃথক হিসাব রাখিতে হইবে। এইসব অর্থ প্রাদেশিক সরকারের এখতিয়ারে থাকিবে। কেন্দ্রীয় সরকারের প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মূদ্্রা দুই অঞ্চল সমানভাবে দিবে অথবা সংবিধানের নির্ধারিত হারে আদায় হইবে। বিদেশের সাথে বানিজ্য চুক্তি, বিদেশে ট্রেড মিশন স্থাপন ও আমদানি রপ্তানির অধিকার আঞ্চলিক সরকারের থাকিবে।
6. পূর্বপাকিস্তানের জন্য মিলিশিয়া বা পয়ারা মিলিটারি রক্ষী বাহিনী গঠন করা হইবে এবং প্রতইরক্ষা ব্যাবস্থার ক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তানকে আরও বেশী আত্মনির্ভরশীল করিতে হইবে।
পাকিস্তান এর ভৌগলিক বিচ্ছিন্ন 2টা প্রদেশের মধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয় ছিলো বেশী এবং এই রপ্তানি আয়ের অধিকাংশই ব্যায় হইতো পশ্চিম পাকিস্তানের অঙ্গ সৌষ্ঠব এবং অবকাঠামোগত উন্নয়নে।
ইসলামাবাদ নামক শহরটি স্থাপিত হয় এবং তা কলেবরে বেড়ে উঠে এই পূর্ব পাকিস্তানের টাকায়।
এই 6দফার উপর ভিত্তি করে পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্বশাসনের দাবিতে আন্দোলন গড়ে উঠে 66 সাল থেকে। এর ধারাবাহিকতায় 69এর গন আন্দোলন গড়ে উঠে ছাত্রদের 11 দফা দাবির ভিত্তিতে-যা আইয়ুব খানকে পদত্যাগে বাধ্য করে এবং তার উত্তরসূরি ইয়াহিয়া খান 70এ নির্বাচনের ঘোষনা দেন।
ছাত্রসমাজের 11 দফা দাবি ছিলো
1.
(ক) সচ্ছল কলেজসমুহকে প্রাদেশিক করনের নীতি পরিত্যাগ করিতে হইবে এবং জগন্নাথ কলেজ সহ প্রাদেশিককরনকৃত কলেজসমুহকে পূর্বাবস্থায় ফিরিয়ে দিতে হইবে।
(খ) শিক্ষার ব্যাপক প্রসারের জন্য প্রদেশের সর্বত্র বিশেষ করিয়া গ্রামাঞ্চলে স্কুল-কলেজ স্থাপন করিতে হইবে এবং বেসরকারি উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কলেজসমুহকে সত্ত্বর অনুমোদন দিতে হইবে। কারিগরী শিক্ষার প্রসারের জন্য পর্যাপ্ত সংখ্যক ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, পলিটেকনিক্যাল এবং কমার্শিয়াল ইনস্টিটিউট স্থাপন করিতে হইবে।
(গ) প্রদেশের কলেজসুমুহে দ্্ব ীতিয় শিফটে নৈশ শিফটে আই এ, আই এস সি, আই কম ও বি এ বি এস সি বি কম এবং চ=রতিষ্ঠিত কলেজসমুহে নৈশ শিফটে এম এ ও এম কম ক্লাশ চালু করিতে হইবে।
(ঘ) ছাত্র বেতন শতকরা 50 ভাগ হ্রাস করিতে হইবে।
স্কলারশিপ ও স্টাইপেন্ডের সংখ্যা বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং ছাত্র আন্দোলনে অংশগ্রহন করার অপরাধে স্কলারশিপ ও স্টাইপেন্ড কাড়িয়া লওয়া চলিবে না।
(ঙ) হল, হোস্টেলের ডাইনিং হল ও ক্যান্টিন খরচার 50 ভাগ সরকারি সাবসিডি হিসেবে প্রদান করিটে হইবে।
(চ) হল ও হোস্টেল সমস্যার সমাধান করিতে হইবে।
(ছ) মাতৃভাষার মাধ্যমে সর্বস্তরে শিক্ষার ব্যাবস্থা করিতে হইবে। সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পর্যাপ্ত সংখ্যক অভিঞ্জ শিক্ষকের ব্যাবস্থা করিতে হইবে।
শিক্ষকের বেতন বৃদ্ধি করিতে হইবে এবং স্বাধীন মতামতপ্রকাশের অধিকার প্রদান করিতে হইবে।
(জ) অষ্টম শ্রেনী পর্যন্ত শিক্ষাকে অবৈতনিক ও বাধ্যতামূলক করিতে হইবে।
(ঝ)
**** এই অংশগুলোকে বাদ দেওয়ার চেষ্টা করছি। আরও অনেকগুলো উপাংশ আছে-
যা এক করলে এই দাবিটাই স্পষ্ট হয় যে সকল প্রদেশে সকল ছাত্রের জন্য উন্নত শিক্ষা এবং কাজের নিশ্চয়তার দাবি ছিলো***
2. প্রাপ্তবয়স্কদের ভোটে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে পার্লামেন্টারি গনতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করিতে হইবে। বাক স্বাধীনতা ও সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা দিতে হবে।
দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকার উপর হইতে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করিতে হইবে।
3) নিম্নলিখিত দাবিসমুহ মানিয়া লইবার ভিত্তিতে পূর্ব পাকিস্তানের পূর্ন স্বায়ত্বশাসন দিতে হইবে।
ক) দেশের শাসনতন্ত্র হইবে ফেডারেশন শাসনতান্ত্রিক রাষ্ট্রসংঘ। এবং আইন পরিষদের ক্ষমতা হইবে সার্বভৌম।
খ) ফেডারেল সরকারের ক্ষমতা দেশরক্ষা, বৈদেশিক নীতি ও মুদ্্রা এই কয়েকটি বিষয়ে সীমাবদ্ধ থাকিবে।
অপরাপর সকল বিষয়ে অঙ্গ রাষ্ট্রসমুহের ক্ষমটা হইবে নিরংকুশ।
গ) দুই অঞ্চলের একই মুদ্্রা থাকিবে, এই ব্যাবস্থায় মুদ্্রা কেন্দ্রর হাতে থাকিবে,কিন্তু এই অবস্থায় শাসনতন্ত্রে এমন সুনির্দিষ্ট বিধান থাকিতে হইবে যে যাহাতে পূর্ব পাকিস্তানের মুদ্্রা পশ্চিম পাকিস্তানে পাচার হইতে না পারে।
ঘ) সকল প্রকার ট্যাক্স, খাজনা ও কর আদায় ও নির্ধারনের ভার থাকিবে আঞ্চলিক সরকারের হাতে, ফেডারেল সরকার কোনো প্রকার কর ধার্য বা আদায় করিতে পারিবে না।
ঙ) **
এই অংশের দাবিগুলো 6 দফার সাথে সংগতি পূর্ন।
তবে মৌলিক যেই দাবিগুলো এসেছে তা হলো
সকল প্রদেশের স্বায়ত্ব শাসনের দাবি, ভারি শিল্পসমুহকে জাতিয়করনের দাবি, কৃষকের উপর করের চাপ হ্রাস করা, শ্রমিকদেরর্ন্যায মজুরি, বোনাসের দাবি, তাদের বাসস্থানের সুবিধা এবং চিকিৎসা সুবিধার দাবি
পূর্ব পাকিস্তানের বন্যা নিয়ন্ত্রনের ব্যাবস্থা গ্রহন এবং জনসম্পদের ব্যাবহার
জরুরি আইন সহ সকল নিবর্তনমূলক আইনের বিলোপের দাবি।
সকল প্রকার জোটভিত্তিকচুক্তি যা পাকিস্তান সরকার গ্রহন করেছিলো তা বাতিল করে জোট ভির্ভুত স্বাধীন নিরপেক্ষ রাষ্ট্র তৈরি দাবি
এবং সর্বশেষ দাবি ছিলো আটক সকল নেতা ও রাজনৈতিক কর্মিদের মুকক্তির দাবি-
যেহেতু এই 11 দফা ঘোষনায় সবার কথাই জাতি নির্বিশেষে বলা হয়েছিলো তাই এই আন্দোলন সাফল্যের মুখ দেখে।
শিক্ষা, নিরাপত্তা, স্বায়ত্বশাসনজাতীয় মৌলিক দাবি, এবং শিক্ষার ব্যাবহার নিশ্চিত করার ব্যাবস্থা নিয়ে এই দাবির সর্বশেষ পরিনাম হলো আইয়ুব খানের ক্ষমতা হস্তান্তর।
এই দাবিগুলোর ভিত্তিতেই আওয়ামি লীগ 70এ নির্বাচনে অংশগ্রহন করে এবং পূর্বপাকিস্তানে এবং সমস্ত পাকিস্তানে একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করে।
আওয়ামি লীগের প্রাপ্ত আসনের পরিমান ছিলো সর্বমোট আসনের 67% এর বেশি। এই সংখ্যাগরিষ্ঠতায় তারা ইচ্ছা করলেই সংসদে নিজেদের দাবির আইনি প্রতিষ্ঠা করতে পারতো।
অথচ পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য এই স্বায়ত্বশাসনের দাবি গৃহীত হওয়ার বিষয়টা ছিলো নিজের পায়ের কুড়াল মারার মতোই ভয়ঙ্কর বিষয়। তাদের আমদামি রপ্তানি ব্যাবধান ছিলো দ্্বিগুনের বেশী। মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি আমদানি নির্ভর ছিলো- এই আমদানি ব্যায়ের অধিকাংশের যোগানদার ছিলো পূর্ব পাকিস্তানের রপ্তানি আয়-
যদি পূর্ব পাকিস্তান স্বায়ত্বশাসন পেয়ে যায় তাহলে এই মুফতে পেয়ে যাওয়ার ব্যাবস্থাটা বলবত থাকতো না- এই একটা কারনেই ইয়াহিয়া খান শেখ মুজিব এবং আওয়ামী লিগের হাতে ক্ষমতা ছাড়তে চান নি, এই নিয়ে আলোচনার কথা বলে সময় নষ্ট করা এবং পূর্ব পাকিস্তানে সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি এবং পর্যাপ্ত সৈন্য সমাবেশ সমাপ্ত হলে 25শে মার্চ সর্বাত্বক আক্রমনে নামে- এবং এটা যে একটা পরিকল্পিত আক্রমন ছিলো তা নির্ণয় করে এ ঘটনাই, পুরানো ঢাকার শাখারি বাজার লুটপাটের সময় সৈন্যবাহীনির সাথে যুক্ত হয় মুসলিম লীগ ও জামায়াতে ইসলামীর নেতা কর্মিরা।
এখন প্রশ্ন হলো শেখ মুজিব কি পাকিস্তানের বিলুপ্তির দাবি করেছিলান? মুজিব সব সময়ই স্বায়ত্বশাসনের পক্ষে, এবং তা অবশ্যই নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে- সংসদীয় গনতন্ত্রের ভিত্তিতে এবং তা সংসদে সংবিধানে সংশোধনের মতো রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায়-
বিচ্ছিন্নতাবাদী বা উগ্রতার বিষয়টা অনুপস্থিত একটা বিষয় এই আন্দোলনে, কিন্তু যখন পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যরা আক্রমন করলো তখন তাদের দাবি ছিলো পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষার জন্য তারা বাঙালি নিধন করছে-
এই দাবিটা এবং একই দাবি করছে জামায়াত, পাকিস্তানের অখন্ডতার জন্য টারা মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে।
আশ্চর্য দাবি- শেখ মুজিব যদি পাকিস্তান ভাঙার চেষ্টা করতো তাহলে এই দাবিটার গোড়ার সামান্য পানি থাকতো।
এটা একেবারে নির্ভেজাল মিথ্যাচার।
কিন্তু এর পক্ষ নিয়ে কথা বলছে এখানে অধিকাংশ জামায়াতের কর্মিরা এবং তাদের অন্ধ সমর্থকরা।
অন্যায় করা এবং তা অব্যাহত রাখার বিষয়টা বিবেচনা করে তাদের নব্য রাজাকার বলটে কোনো সমস্যা নেই। এই ধর্মভিত্তইক ইসু্য নিয়ে রাজনীতি যা বাঙালি সংস্কৃতির ধারার বীপরিতে যায় তা বেগবান করার কোনো অর্থ নেই।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।