আমার 'কলম' আজো আছে আমার সাথে, আমার কষ্টের সঙ্গী হয়ে,আমার সুখের ভাগ নিয়ে দেনা-পাওনা চুকিয়ে,এক চিলতে হাসি হয়ে...
সকাল বেলা তাড়াহুড়ার সময় যদি কাজের জিনিস গুলো খুঁজে না পাওয়া যায়,তাহলে মেজাজটা কার না খারাপ হয়...!এমনিতেই রাস্তায় জ্যামের কারনে টাইম মতো অফিসে যাওয়া যায় না,তার উপর যদি বাসা থেকেই বের হতে লেট হয়,তাহলে তো কথাই নেই,দ্রুত ব্যাগ গোছাতে যেতে খেয়াল হলো,চুল আঁচরানো হয়নি,শাল বের করা হয়নি,বোতলে পানি নেয়া হয়নি,আবারো রুমে দৌড় দিলো নিশাত। বোতলে পানি ভরে ডায়নিং থেকে আসার সময় খেয়াল হলো,আম্মুর কি কি ঔষধ যেনো লাগবে,একবার মনে করে নেয়া দরকার,মায়ের রুমে ঢুকে দেখলো মা কার সাথে যেনো মোবাইলে কথা বলছে। নিশাত কোন কিছু না বলে মায়ের প্রেসক্রিপশন নিয়ে রুম থেকে বের হলো। দু'পা এগিয়ে আবারো পেছালো নিশাত,শুনতে পেলো,
--ঠিক আছে,উনাদের পছন্দ না হলে আর কি করা,আমাদের তো পছন্দ হয়েছিলোই।
ওপাশ থেকে যেনো কি বলল,মা শুনে বলল,
--জানিনা,কপালে কি আছে,রাখি আল্লাহ হাফেজ।
নিশাত ছোট্ট করে একটা নিঃশ্বাস ফেলল। তারপর দ্রুত নিজের রুমে এসে ব্যাগ নিয়ে মাকে বলে বেরিয়ে গেল। গলির মুখে এসে দেখল আশে-পাশে অনেকেই দাঁড়িয়ে আছে রিকশার জন্য কিন্তু খালি রিকশার কোন দেখা নেই,দাঁড়িয়ে না থেকে দ্রুত হাঁটা শুরু করল। মেইনরোডে এসেও সেই একই অবস্থা,কোন বাস খালি নেই! ওদিকে অফিসের সময় চলে যাচ্ছে... অনেক কষ্টে ভীড় ঠেলে একটা বাসে উঠে,স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে,এটুকুই অনেক... এই শহরে ঘর থেকে বের হওয়া মানেই যুদ্ধ করা,যা সবাই বুঝেনা...
প্রতিদিনকার এই আসা-যাওয়ার যুদ্ধ শেষে রাতে বাড়ি ফিরে খাওয়া-দাওয়া শেষ করে এক মগ কফি নিয়ে সোজা চিলে কোঠায় চলে আসে নিশাত...অনেক দিনের অভ্যাস বলা চলে,রাতে খোলা আকাশের নীচে বসে রোজ একবার করে স্মৃতির এলবামটা শুরু থেকে এখন পর্যন্ত উল্টায়...
অনার্সে পড়া অবস্থায় বাবা মারা যায়,ছোট্ট একতলা এই বাড়িটা ছাড়া আর কিছুই রেখে যাননি। গ্রামে যা সম্পত্তি ছিল,তা বাবা থাকতে ঠিক মতো বাটোয়ারা না হওয়ায় চাচারা তা থেকে ওদের বঞ্চিত করে দেয়... ছোট তিন মেয়েকে নিয়ে বিশাল এই শহরে অনেক অসহায় হয়ে পড়েছিলেন নিশাতের মা লতিফা বানু।
পিতৃ-অভিভাবকহীন একটা পরিবারের জন্য এই সমাজে টিকে থাকা খুব সোজা কথা নয়। তবু আল্লাহর উপর ভরসা করে এতো গুলো বছর পাড় করেছে ওরা। কিন্তু ভাঙ্গা ঘরের বেড়া ভাঙ্গার লোকের অভাব হয় না,একদিকে মা যখন তিন মেয়ের ভবিষত নিয়ে চিন্তিত,তাদের পড়াশুনা,খাওয়া-পড়া নিয়ে আকুল সাগড়ে ভাসছেন ঠিক তখনই প্রেমের টানে মামাতো বোনের দেবরের সাথে পালিয়ে যায় নিশাতের বড় বোন নুপুর...! আত্নীয়-স্বজন,সমাজ সব দিক থেকে এক ঘরে হয়ে পড়ে নিশাতরা,শোকে-দুঃখে বিছানায় পড়েন মা।
কিন্তু জীবন তো আর থেমে থাকে না,সময়ের টানে জীবনকে চালাতেই হয়। একটা ভাঙ্গাচোড়া কিন্ডারগার্ডেনে চাকরী,আর রাত-দিন টিউশনি করে সংসারের চাকা সচল করার দায়িত্ব কাঁধে নিয়েছিল নিশাত।
কোন অভিজ্ঞতা ছাড়াই শুরু করেছিল জীবন যুদ্ধ। অভাবের সংসারে,একা একটা তরুনী মেয়ের জন্য দিন রাত বাইরে বাইরে থাকা,মানুষের হাজারো কথা সহ্য করা খুব সহজ ছিল না নিশাতের জন্য...সারা রাত কেঁদে বালিশ ভিজিয়ে অথবা জায়নামাযে বসে আল্লাহকে ডেকে এমন কতো রাত নির্ঘুম পাড় করেছে তা নিশাত ভালো করেই জানে। অসুস্থ মা,অবুঝ ছোট বোনের মুখের দিকে তাকিয়ে হাজারো জনের হাজারটা কথা শুনেও না শোনার ভান করেছে,সমবয়সি বান্ধবিরা যখন একে একে পড়াশুনা শেষ করে বিয়ের পিঁড়িতে বসেছে,নিশাত তখন চাকরীর জন্য শহরের এ মাথা থেকে ও মাথা হন্য হয়ে ঘুরেছে,নির্লজ্জের মতো স্বার্থপর আত্নীয়-স্বজনদের কাছে অনুরোধ করেছে। অবশেষে আল্লাহ মুখ তুলে তাকিয়েছেন,ব্যাংকে চাকরীটা হবার পর নিশাত অনেকটাই পেরেছে সংসারে স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে আনতে,ছোট বোনটার আবদার পূরন করতে,মাকে ভালো ডাক্তার দেখাতে,সময় মতো বাড়ীর বিল গুলো পরিশোধ করতে,দোকানে বাকীর খাতা বন্ধ করতে... গত পাঁচ বছরে এই অভাব গুলো পূরন্ করাই নিশাতের প্রাণপন লক্ষ্য ছিল...
শীতটা মনে হয় খুব জেঁকে আসছে,গায়ের শালটা আরো ভালো করে জড়িয়ে নেয়। মগটা হাতে নিয়ে দেখে কফি শেষ।
শূণ্য মগটা নিয়ে নিচে নেমে আসে,কিচেনে ঢুকে নিশাতের কেন জানি খুব রান্না করার ইচ্ছে হয়। যদিও রাতের খাবার খুব ভারী কিছু খায় না ওরা,তবুও আজ খুব ইচ্ছে হলো,মাঝে মাঝে একটু ব্যাতিক্রম হলে দোষ কি... মধ্যবিত্তের সংসারে একটু আনন্দের জন্য সব সময় উপলক্ষ্য থাকা লাগে না। ফ্রিজ থেকে মাংস-মশলা বের করে,পেয়াজ কাটতে বসে যায়,গায়ে শাল জড়িয়ে মা এসে দরজায় দাঁড়ায়,
--কিরে?কি রান্না করিস এই সময়?!
--তেমন কিছু না,মুরগী-পোলাও,তুমি বসো টুলটা নিয়ে।
--হঠাৎ করে মুরগী-পোলাও,সকালে আমাকে বললেই পারতি,করে রাখতাম।
--নাহ,এমনি হঠাৎ রাঁধতে ইচ্ছে হলো।
একটা চাপা নিঃশ্বাস ফেললেন লতিফা বানু মনে মনে। আজ মেয়েটার এই সময় শ্বশুড়বাড়ি থাকার কথা ছিল,কিন্তু কি কপাল,মেয়েটার একটা ভালো বিয়ে দিতে পারছেন না। ওর বাবা বেঁচে থাকলে হয়তো এতো চিন্তা করতে হতো না,কম চেষ্টা তো করছেন না,রুপ-গুন কোন দিক দিয়ে তেমন কম ও না,আর দশটা মেয়ের থেকে অনেক আলাদা কিন্তু তারপরেও বিয়ের কথা কিছু দূর এগিয়েই থেমে যায়...
--মা,তোমার বেশিক্ষন বসে থাকা ঠিক না,ঘরে যাও,আমি এখন পেঁয়াজ ভাজবো,তোমার ঝাঁঝ সহ্য হবে না।
উঠতে উঠতে ছোট মেয়েকে ডাকলেন,
--নীরা,এই নীরা,পড়া না থাকলে এদিকে এসে নিশুকে সাহায্য কর একটু।
রান্নাঘরে এসে নীরা বড় করে নিঃশ্বাস নেয়,ছোট আপু যা দারুন রাঁধতে জানে,কি সুন্দর ঘ্রান বেরিয়েছে...
--কোন হেল্প লাগবে আপু?
--নাহ,এখন লাগবে না।
--ওকে,তোমার রান্না শেষ হলে আমাকে ডেকো,আজকে নতুন স্টাইলে সালাদ বানাবো।
নিশাত হাসলো। আজকাল টিভি দেখে দেখে সারাদিন খালি নতুন রান্নার ভূত চাপে এই মেয়ের মাথায়। নীরার চলে যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আরেকবার হাসল,এই শান্তির হাসিটুকু,এই সুখানুভূতিটুকু...বেঁচে থাকার জন্য কি যথেষ্ট না? সব কিছুই যে হতে হবে,থাকতে হবে এমনতো কোন কথা নেই... একটা সময় ছিল,যখন হাসি কাকে বলে ভুলে গিয়েছিল!শংকা,দুঃশ্চিন্তায় খাওয়া পর্যন্ত হতো না। আজ সেই সব দুঃস্বপ্নের দিন থেকে অনেকখানি রেহাই পেয়েছে,এই তো অনেক... নিশাত জানে এখনো মা রাতে ঘুমাতে পারেন না,তার বিয়ের চিন্তায়,নীরার ভবিষতের চিন্তায়।
কিন্তু নিশাতের নিজেকে নিয়ে তেমন কোন চিন্তা নেই... মা সূস্থভাবে বেঁচে থাকুক,ছোট বোনটা নিশ্চিন্তে পড়াশুনা করুক এই এখন একমাত্র স্বপ্ন।
পরেরদিন অফিসে লাঞ্চ আওয়ারে কলিগ রুনা আপা খেতে খেতে বললেন,
--নিশাত,তোমাকে আমাদের অফিসের হাসিব সাহেবের কথা বলেছিলাম,কিছু ভেবেছো?
নিশাত কিছু না বলে চুপ করে থাকে। ওকে চুপ দেখে রুনা আপা বলে,
--দেখো নিশাত,তোমাকে আমি ছোট বোনের মতো দেখি,তোমার বিয়ে করার মতো যথেষ্ট বয়স হয়েছে, আমিতো তোমার বিয়ে না করার তেমন কারন দেখিনা,বিয়ের পরে চাকরী করতে কেউ না করছে না।
--রুনা আপা্,আমি আসলে এখনো সেভাবে কিছু ভাবছিনা,আর আমার বাসায় অলরেডি ছেলে দেখছে,সো আমি উনাদের উপরই ছেড়ে দিতে চাই।
কথা শেষ করেই উঠে ওয়াশরুমে চলে গেল নিশাত।
ও জানে বসে থাকলে এই টপিকস অনেক দূর গড়াবে... বেসিনে হাত ধূতে ধূতে আয়নায় নিজেকে একবার দেখলো, ক্লান্তি আর বয়সের ছাপ এখনো সেভাবে চেহারায় ফুটে উঠেনি,এখনো সেই লাবন্য আর মাধুর্য্য বেশ ভালোভাবেই আছে,সে জন্যই বোধকরি সবার চোখ এখনো পড়ে...
নিশাত অফিসের কাউকে সেভাবে নিজের পরিবারের কথা বলেনা,সবাই তাকে সিনসিয়ার,অমায়িক,বুদ্ধিমতি আর ব্যাক্তিত্ব সম্পন্ন মেয়ে হিসেবেই জানে,নিশাত জানে,এই কর্পোরেট দুনিয়াতে মেয়ে মানুষের চলতে হাজারো বাঁধা,সে নিজেও কম ফেস করেনি,কলিগ অথবা বস কারো না কারো সাথে কোন না কোনভাবে ফাইট করতেই হয়,সবাই চায় নিজের স্বার্থ আদায় করতে,নিজের স্বার্থে খেলতে...কতো জঘন্য আর নীচ যে হতে পারে মানুষ তা এই পাঁচ বছরের জীবন যুদ্ধে নিশাত ভালো ভাবেই বুঝেছে... সে জন্যই অনেক সীমাবদ্ধতা রেখে,দূরত্ব বজায় রেখে,কৌশলে চলতে হয়।
বাসায় এসে দেখল,ঘটক চাচী এসেছেন মায়ের রুমে। নিশাত সালাম দিয়ে নিজের ঘরে চলে এলো। মায়ের উপর মাঝে মাঝে খুব রাগ লাগে নিশাতের,শুধু শুধু এইসব মানুষের সাথে সময় নষ্ট করে...বিয়ে বিয়ে বিয়ে...এই একটা জিনিস ছাড়া যেনো সব কিছু অচল! এতোই যদি গুরুত্বপূর্ণ হতো তাহলে আর কারো দুঃখের গল্প শুনতে হতো না দুনিয়াতে...বিয়ে বিয়ে করে ঘর ছাড়লো বোন,শুনেছে অনেক কষ্টে আছে,দেখতে যাবার সাহস পায় না,মা কেন বুঝেন না,সে বিয়ে করে চলে গেলে এই সংসারের কি হবে?নীরার কি হবে?...কোন বাবা-মা চাইবেন ছেলে কে ওমন মেয়ের সাথে বিয়ে করাতে যে সংসারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যাক্তি,বাবা নেই,বড় বোন পালিয়ে ঘর ছেড়েছে ওমন পরিবারের মেয়েকে বউ করতে সবারই মান-সম্মানে বাঁধে! আর কেউ যদি রাজীও হয়,কোন না কোন স্বার্থ-দাবী নিয়েই আসবে... কি দরকার আরেকটা দুঃখের বোঝা বাড়ানোর?মানুষ তো আর কম দেখা হলো না...
প্রতিদিনের মতো আজো কফি নিয়ে চিলে কোঠায় এসে বসল নিশাত,যদিও প্রচন্ড ঠান্ডা চারপাশে,তাও নিশাত একটু মুক্ত হাওয়া নিঃশাস নেবার চেষ্টা করে...হঠাৎ কারো কথার আওয়াজে চোখ খুলেসে, মাথা ঘুরিয়ে দেখল,পাশেই ছয়তলা বিল্ডিং এর চারতলার বারান্দায় একটা ছোট্ট মেয়ে বাবার কোলে থেকে একটার পর একটা প্রশ্ন করেই যাচ্ছে,
--বাবা ঐটা কি?
--ঐটা স্টেডিয়ামের লাইট
--স্টেডিয়াম কি?
--খেলার মাঠ,টিভিতে দেখনা?খেলে যে
--আমি খেলবো...!!
নিশাত আপন মনে হেসে কফি খাওয়ায় মনোযোগ দেয়,আজ অনেকদিন পর কেন জানি বাবার কথা মনে পড়ে,বুকের ভেতর একটা শূন্যতা হাহাকার করে উঠে যেনো...হঠাৎ কারো কন্ঠ শুনে আবারো তাকায় সেই বারান্দায়,বাবা-মেয়ের পাশে হাসি মুখের একটা নিজের বয়সী মেয়েকে দেখতে পায়,বাচ্চাটা বলছে,
--মা'মনি দেখো,ঐ যে লাইট,বলতো কিসের লাইট?
--উমম,তুমি বলতো,দেখি আমার রাজকন্যা বলতে পারে কি না
--হুম,আমি বলতে পারি,বাবা বলেছে,স্তেদিয়াম!
--আচ্ছা?গুড...
তিনজনই একসাথে হেসে উঠল... । ঠিক পাশেই একতলা বাড়ীটার চিলে কোঠায় বসে একটা মেয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে অপলক।
মেয়েটার চোখে অশ্রু,আর ঠোঁটে অস্পষ্ট হাসি... কেন অশ্রু কেনই বা হাসি তার কারন কারোরই জানা নেই...কোন নাম নেই এই অনুভূতির...! ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।