আপনার শৈশবের কথা জানাবেন।
আমার জন্ম চাঁদপুরের চালিতাতলি গ্রামে। সাড়ে তিন বছর পর্যন্ত আমি গ্রামেই ছিলাম। মনে পড়ে, শৈশবে একবার আমি পুকুরের পানিতে পড়ে যাই। তখন বাবা বলেছিল ওদের কলকাতায় নিয়ে যাই।
কেননা বাচ্চা এভাবে পানিতে পড়ে গেলে একটা দুর্ঘটনা ঘটবে। ওই সময় আত্দীয়স্বজন আমাদের কলকাতায় যেতে দেয়নি। এরপর আবারও আমি খালে পড়ে গিয়ে পানিতে হাবুডুবু খেয়ে বেঁচে যাই। পর পর বড় দুটো দুর্ঘটনা ঘটার পর আব্বা বড় মামাকে চিঠি লিখলেন, 'যে অমুক তারিখে কলকাতার শিয়ালদহ ইস্টশনে আমি অপেক্ষা করব। আপনি আপনার বোন এবং আমার মেয়েকে নিয়ে চলে আসবেন।
' আব্বা কোনো বাধা মানলেন না। সেই সাড়ে তিন বছর বয়সে আমরা কলকাতায় চলে গেলাম। শৈশবের আরেকটি ঘটনা মনে পড়ে, আমার জন্মের পর সবাই আমাকে আদর করে ডাকত নূরী। স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় আব্বা আমার নাম রাখেন নুরুন্নাহার। একবার নানি আমাদের কলকাতার বাড়িতে বেড়াতে এসে আমার নাম রাখেন নূরজাহান বেগম।
কলকাতায় কোথায় থাকতেন।
আমাদের বাড়ি ছিল ১১ নাম্বার ওয়েলেসলি স্ট্রিটে। আমাদের দোতলা বাড়ির একদিকে ছিল আমার আব্বা মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন সম্পাদিত 'সওগাত' পত্রিকার অফিস। নিচতলায় ছিল প্রেস 'ক্যালকাটা আর্ট প্রিন্টার্স', পাশে ছিল থাকা-খাওয়ার ঘর। আমাদের বাড়ির পাশেই ছিল জমিদার বাড়ি।
তাদের অনেক পোষা পশুপাখি ছিল। দুটো হনুমান পালতো তারা। আমি হনুমান দেখলে ভীষণ ভয় পেতাম। একবার ঈদের দিনে জামাকাপড় পরিয়ে মা সব খাবারটাবার দিয়ে গেছে। খাবার খাওয়া নিয়ে মাকে খুব বিরক্ত করতাম।
দুষ্ট ছিলাম তো! যখন মা বলল আয় খেতে আয়, তখন খেলতে চলে গেলাম। ওই সময় জানালা দিয়ে হনুমান এসে সব খাবার খেয়ে যায়। মা খুব রাগ করলেন। 'সওগাত' অফিসে একটি ঘুরানো সিঁড়ি ছিল। একদিন ওই সিঁড়ির ফাঁকে একটি কালো বিড়াল দেখে আমি ভূত ভূত বলে চিৎকার শুরু করলাম।
তখন সবাই বলল কী ব্যাপার, কী হলো? সওগাত কর্মীরা কালো বিড়ালটা দেখতে পেয়ে আমার গায়ে হাত বুলিয়ে বললেন, নূরী এটা একটা কালো বিড়াল, ভূত নয়। আমাদের পাশের বাড়িতে এক ইংরেজ পরিবার বাস করত। তাদের লডেন ও টিটু নামে দুটি সন্তান ছিল। ওদের কাছ থেকে আমি ইংরেজি ভাষা শিখি। কলকাতায় অনেক স্মৃতি আছে।
আপনি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলে পড়াশোনা করেছেন।
আমার আব্বার সঙ্গে বেগম রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেনের খুব পরিচয় ছিল। তিনি আব্বাকে বললেন, আপনার মেয়ের স্কুলে যাওয়ার বয়স হয়েছে, ওকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। আব্বা বললেন, এখন তো নূরী ছোট, ওর মা রাজি হবে না। এই কথা মাকে জানানো মাত্রই তিনি ক্ষেপে গেলেন।
যাই হোক, একপর্যায়ে আমি সাখাওয়াত মেমোরিয়াল গার্লস হাইস্কুলে শিশু শ্রেণীতে ভর্তি হই। ওই স্কুলে শিশু শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণী পর্যন্ত পড়াশোনা করি। তারপর তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণী অন্য স্কুলে পড়ে আবার ওই স্কুলে পঞ্চম শ্রেণীতে ভর্তি হই। ১৯৪২ সালে সাখাওয়াত মেমোরিয়াল থেকে আমি ম্যাট্রিকুলেশন পাস করি। এরপর ভর্তি হই কলকাতার বিখ্যাত লেডি ব্রেবোন কলেজে।
ওই সময় গুটি বাঙালি মুসলিম মেয়ে লেডি ব্রেবোনে পড়ত। বাঙালি মুসলমানদের বিভিন্ন কাজে সামাজিক বাধা ছিল। মেয়েরা নাচতে পারবে না, গাইতে পারবে না, শব্দ করে কথা বলতে পারবে না, তরুণদের সঙ্গে মিশতে পারবে না। আমরা সহপাঠীরা [সাবেরা আহসান, রোকেয়া রহমান কবির, সেবতি সরকার, জ্যোৎস্না দাশগুপ্ত, বিজলি নাগ, কামেলা খান মজলিশ, হোসনে আরা রশীদ, হাজেরা মাহমুদ, জাহানারা ইমাম] মিলে একটি সাংস্কৃতিক দল তৈরি করি। এ দল থেকে আমরা কবিতা আবৃত্তি, নাট্যাভিনয় শুরু করেছিলাম।
আমি ব্যাডমিন্টন খেলতাম। ১৯৪৪ সালে আইএ পাস করে একই কলেজে বিএ ভর্তি হই। ১৯৪৬ সালে স্নাতক হই।
কিশোর বয়সে আপনি 'সওগাত' পত্রিকার নানা কাজে সাহায্য করতেন।
'সওগাত' পত্রিকায় নানা রকমের কাজ ছিল।
তখন হ্যান্ড কম্পোজ হতো। ব্লকে প্রিন্ট হতো। আমি পড়াশোনার ফাঁকে আব্বাকে সহযোগিতা করতাম। তার কাগজপত্র গুছিয়ে রাখতাম। ফাইলিংয়ের কাজ করতাম।
আব্বার এডিটিং রুমে বসে দেখতাম কীভাবে লেখা সম্পাদনা করা হয়। আব্বার এডিটিংয়ের হাত ছিল চমৎকার। তিনি সম্পাদনার সময় পাণ্ডুলিপির সবটা পড়ে লম্বা করে দাগ দিতেন। প্রয়োজনে লেখকদের সঙ্গে কথা বলতেন। মনে পড়ে, আব্বা একবার কবি কাজী নজরুল ইসলামকে বলেছিলেন, 'এটা কবিতা হয়েছে, কাজী তুমি এ জায়গাটা পড়ে দেখ, এটা ছন্দপাত না বজ্রপাত?' কাজী সাহেবের সঙ্গে আব্বার বেশ হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল।
সচিত্র সওগাত প্রকাশের পর ওই সময় বেশ সমালোচনাও হয়েছিল।
আমার আব্বা প্রগতিশীল মানুষ ছিলেন। তিনি আধুনিক মানসিকতা পোষণ করতেন। অবশ্যই সে সময়ে ছবি ছাপানোটা দোষের ছিল। বিশেষ করে মুসলিম সমাজে এটাকে ভালো চোখে দেখা হতো না।
ফলে সর্বপ্রথম সচিত্র 'সওগাত' প্রকাশের পর সম্পাদক হিসেবে তিনি অনেক সমালোচনার শিকার হয়েছিলেন। সওগাত পড়ে ফুরফুরার একজন পীর সাহেব আব্বাকে চিঠি লিখলেন_ 'নাসির সাহেব আপনার সওগাত পড়ে ভালোই লাগল তবে আমার অনুরোধ ছবিটা যদি না ছাপেন তাহলে ভালো হয়। ' তখন আব্বা চিঠির উত্তরে লিখলেন, 'মৌলানা সাহেব, শুনে খুশি হলাম। সওগাত আপনার ভালো লেগেছে। তবে আপনাকে একটি প্রশ্ন করি, আপনি যখন নামাজ পড়েন তখন বিদেশি সাহেবের ছবিযুক্ত কয়েন যদি আপনার পকেটে থাকতে পারে তাহলে পত্রিকায় ছবি ছাপতে দোষের কি!' এ রকমের বিভিন্ন সমালোচনা আব্বা নীরবে সহ্য করেছিলেন।
কাজী নজরুল ইসলাম সওগাতে লিখতে শুরু করেন কখন।
কাজী সাহেব সওগাতে প্রথম লেখা পাঠিয়েছিলেন 'বাউন্ডেলের আত্দকাহিনী' শিরোনামে, ১৯১৯ সালে করাচি থেকে। আব্বা তাকে উৎসাহিত করেছিলেন। কাজী সাহেব আমাদের বাড়িতে আসতেন। তিনি জর্দা দিয়ে পান খেতেন।
আমি তাকে পান এনে দিতাম। তিনি একটি পৃথক কক্ষে বসে একমনে লিখতেন। লেখার সময় কারও সঙ্গে কথা বলতেন না। এক ঘণ্টা-দুই ঘণ্টা পর পর তাকে পান দিতে হতো। বাবা কাজী সাহেবকে তাগাদা দিয়ে লেখাতেন।
কলকাতার বিভিন্ন সভা, সমিতি, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হলে তাকে আর রাখা যেত না। তখন পত্রিকা প্রকাশে বেশ সমস্যা হতো। এ নিয়ে আব্বা মাঝেমধ্যে দুঃখ করে বলতেন, কাজীকে এক জায়গায় বসানো যায় না। ওই সময় কাজী নজরুল ইসলাম 'মৃত্যুক্ষুধা' উপন্যাস লিখছিলেন। সওগাতের পক্ষ থেকে কাজী সাহেবকে একবার সংবর্ধনা দেওয়া হয়েছিল।
তিনি মাথায় টুপি, ধুতি-পাঞ্জাবি পরেছিলেন। আমি দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে তা দেখেছিলাম। এ দৃশ্য এখনো আমার মনে আছে। যদিও আমি তখন ছোট ছিলাম, কিন্তু বুঝতে পারছিলাম কলকাতাতে বিরাট কিছু হচ্ছে। কাজী নজরুলের নেতৃত্বে 'সওগাত' অফিসে জমজমাট আসর বসত।
বড় বড় কবি-সাহিত্যিকরা আসতেন, বাঙালি হিন্দু-মুসলমান সবাই আসতেন। তারা সাহিত্য নিয়ে নানা রকম আলোচনা করতেন। সমাজ সংস্কার বিষয়ে কথা বলতেন, নারী স্বাধীনতা নিয়ে কথা বলতেন।
সওগাতে ওই সময় কারা লিখতেন।
ওই সময় বাঙালি এবং মুসলিম লেখক খুব কম ছিল।
সওগাতের উল্লেখযোগ্য লেখকদের মধ্যে ছিলেন কবি কাজী নজরুল ইসলাম, খান মোহাম্মদ মঈদুদ্দীন, কবি গোলাম মোস্তফা, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, হবীবুল্লাহ বাহার, ইব্রাহীম খাঁ, কাজী মোতাহার হোসেন, আহসান হাবীব প্রমুখ।
বাবার হাত ধরেই তো আপনার সাংবাদিকতার হাতেখড়ি।
আমাদের বাড়িতে কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকরা আসতেন, তারা আব্বার সঙ্গে কথা বলতেন। আমি তা শুনতাম। আব্বা আমাকে সব সময়ই উৎসাহ দিতেন।
সাংবাদিকতায় আমার প্রথম হাতেখড়ি হয়েছিল ছবির বইয়ের মাধ্যমে। বাবা বিভিন্ন গল্পের বই, রঙিন ছবির বই এনে আমাকে পড়তে দিতেন। আমি বইগুলো যত্ন নিয়ে পড়তাম। আমার বয়স যখন ছয়-সাত তখন আব্বা আমাকে ফাইলিং করা শেখালেন। বলতেন, আতাতুর্কের ছবি এখানে, টার্কির ছবি এখানে ইত্যাদি।
আমি আন্তরিকভাবে এসব শিখেছিলাম। আব্বা ওই সময় ইন্স্যুরেন্স কোম্পানিতে চাকরি করায় তিনি প্রায় সময় বাইরে থাকতেন। তাই লেখকরা তাদের লেখা ছোট চাচাকে দিয়ে যেতেন। লেখাগুলো মার কাছে জমা হতো, পরে আমি বাবাকে দিতাম। কবি-সাহিত্যিক, সাংবাদিকদের দেখে মনে হতো এটাই সবচেয়ে মহৎ কাজ।
আমি দৃঢ় মনোবল পেলাম সাংবাদিকতা হলো পৃথিবীর সবচেয়ে সম্মানজনক কাজ।
আপনার বাবার উদ্যোগেই তো প্রথম নারীদের জন্য সাপ্তাহিক 'বেগম' পত্রিকা প্রকাশিত হয়।
আব্বা নারীদের ছবি ও লেখা দিয়ে প্রথম নারীসংখ্যা 'সওগাত' প্রকাশ করেন ১৯৩০ সালে। ১৯৪৫ সাল পর্যন্ত মহিলাদের ছবিসংবলিত সওগাত মহিলা সংখ্যা প্রকাশিত হয়। ১৯৪৬ সালে আব্বা নানা রকমের পরিকল্পনা করেন।
কীভাবে নারীদের আরও এগিয়ে নেওয়া যায় সে বিষয়ে ভাবতেন। তখন কলকাতায় নানা রকমের দাঙ্গা হচ্ছিল, রাজনৈতিক সংকট চলছিল। তার মধ্য থেকে আব্বা একদিন সুফিয়া এন হোসেন [কবি সুফিয়া কামাল]-কে ডাকলেন। আমাদের বাড়ির কাছেই পার্ক সার্কাসে থাকতেন তিনি। বাবা বললেন, সুফিয়া বছরের একবার করে নারীদের লেখা ছেপে লাভ নেই।
তোমাদের একটা সাপ্তাহিক পত্রিকা দরকার, তাতে নারীদের দ্রুত এগিয়ে নেওয়া যাবে। আমি তোমাকেই সেই পত্রিকার সম্পাদক করতে চাই। তখন খালাআম্মা বললেন, ঠিক আছে আমি যতটা পারি করব। তারপর ১৯৪৭ সালের ২০ জুলাই সাপ্তাহিক 'বেগম'-এর প্রথম সংখ্যা প্রকাশিত হয়। 'বেগম' উপমহাদেশে বাঙালি নারীদের প্রথম সচিত্র সাপ্তাহিক।
ওই সময় মহিলাদের সাপ্তাহিক বের করা আজকের মতো সহজ ছিল না। অনেক রকমের বাধা-বিপত্তি ছিল। ১৯৪৭ সালের আগস্টে ভারত ভাগ হয়ে যায়। সুফিয়া কামাল কয়েক মাস 'বেগম'-এর সম্পাদক থাকার পর স্থায়ীভাবে ঢাকায় চলে আসেন। তখন সম্পাদকের দায়িত্বভার আমাকে নিতে হয়।
১৯৪৮ সালে প্রথমবারের মতো মেয়েদের ছবিসহ ঈদসংখ্যা প্রকাশ করে। এরপর ১৯৪৯ সালে মেয়েদের ধর্মীয় জ্ঞান বিতরণের জন্য 'বিশ্বনবী' বেগম সংখ্যা বের করা হয়। দুই বাংলাতেই 'বেগম' নারী সমাজের মুখপত্র হিসেবে কাজ করেছিল।
বেগম পত্রিকার উদ্দেশ্য কী ছিল। বেগমে কারা লিখতেন।
নারীদের সৃজনশীল মানুষ হিসেবে গড়ে তোলাই ছিল বেগমের উদ্দেশ্য। 'বেগম' পত্রিকায় গল্প, কবিতা, প্রবন্ধ, নিবন্ধ, আলোচনা, পল্লী উন্নয়ন, মাতৃমঙ্গল, স্বাস্থ্য, সৌন্দর্যচর্চা, শিশুমঙ্গল, সেলাই, চিঠিপত্র, ছায়াছবির কথা ইত্যাদি বিষয়ে লেখা ছাপা হতো। ওই সময় নারী লেখকদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। লেখা সংগ্রহ করতে কষ্ট হতো। বিভিন্ন ইংরেজি পত্রিকা থেকে লেখা সংগ্রহ করে আমরা তা অনুবাদ করে দিতাম।
'সওগাত' নারীসংখ্যা করার জন্য নারীদের যে ছবি সংগ্রহ করা হয়েছিল আমরা সেগুলো ব্যবহার করতাম। ব্লক করে ছবি ছাপাতে হতো। বেগমে লিখতেন কবি সুফিয়া কামাল, শামসুন নাহার মাহমুদ, কবি মাহমুদা খাতুন সিদ্দিকা, হামিদা খানম, মহসীনা আলী, সাঈদা খানম, হোসনে আরা মোদাব্বের, হুসনা বানু খানম, লুলু বিলকিস বানু, মালেকা পারভীন বানু, মাজেদা খাতুন, সারা খাতুন, জাহানারা আরজু, লায়লা সামাদ, নূরজাহান মুর্শিদ, মাফরুহা চৌধুরী প্রমুখ।
আপনারা স্থায়ীভাবে ঢাকায় এলেন কবে।
১৯৫০ সালে আমরা ঢাকায় আসি।
আমরা ঢাকার বিজয়া প্রেসের সঙ্গে আমাদের সওগাত প্রেস এঙ্চেঞ্জ করি। ওই সময় ছিল টাইপের যুগ। ঢাকায় এসে দেখি টাইপ ভোঁতা, ব্লক নেই, সব ঘর টিনের। এগুলো আস্তে আস্তে ঠিক করে কাজ শুরু করি। ১৯৫০ সালে 'বেগম' প্রকাশিত হতে থাকে ঢাকার ৬৬ নাম্বার পাটুয়াটুলী 'বেগম' কার্যালয় থেকে।
১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে নারীদের জন্য অন্য কোনো সাপ্তাহিক ছিল না। সে জন্য বাইরে থেকে যারা আসত তারা 'বেগম' কার্যালয়ের কাজ দেখতে চাইত। একদিন সরকারি তথ্য বিভাগ আমাদের জানাল, আমেরিকা থেকে একজন নারী সাংবাদিক ঢাকায় এসেছেন। তিনি 'বেগম' কার্যালয় দেখতে চান। সাংবাদিক মিসেস আইডা আলসেথ তখন বেগম কার্যালয় পরিদর্শন করলেন।
তিনি বেগম পত্রিকার বিভাগগুলো দেখে বলেছিলেন, তোমরা এত রিডিং ম্যাটারিয়াল কীভাবে দাও! তিনি 'বেগম' পত্রিকার কর্মকাণ্ড দেখে মুগ্ধ হয়েছিলেন। তিনি আরও বলেছিলেন, আমেরিকার নারীসমাজ যথেষ্ট বাধা বিপত্তি ও সংগ্রামের উন্নতি করেছে। তিনি আমাদের একটি মহিলা ক্লাব গঠনের পরামর্শ দেন। যার মাধ্যমে মেয়েরা একসঙ্গে বসে মতবিনিময় করতে পারবে, নানা বিষয়ে আলাপ-আলোচনা করতে পারবে।
বেগম ক্লাব প্রতিষ্ঠা করলেন কত সালে।
আব্বা [মোহাম্মদ নাসিরউদ্দিন] উদ্যোগী হয়ে বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ ও কবি সুফিয়া কামালের সঙ্গে ক্লাব গঠন নিয়ে আলোচনায় বসেন। এরপর ১৯৫৪ সালের ১৫ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিকভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় 'বেগম ক্লাব'। এই ক্লাবের প্রেসিডেন্ট হন বেগম শামসুন নাহার মাহমুদ এবং সেক্রেটারি হয়েছিলাম আমি আর খালাম্মা [বেগম সুফিয়া কামাল] ছিলেন এর অন্যতম উপদেষ্টা। বেগম ক্লাবের কোনো কার্যনির্বাহী সদস্য করা হয়নি, কারণ আব্বা নিজেই অনুষ্ঠানের সব খরচ বহন করেছিলেন।
দাদাভাই [সাংবাদিক, শিশুসাহিত্যিক, সংগঠক রোকনুজ্জামান খান] এর সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে?
রোকনুজ্জামান খান [দাদা ভাই] সাহেবের সঙ্গে সওগাত প্রেসেই আমাদের পরিচয়।
তিনি তখন শিশু সওগাতের ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক ছিলেন। তার সততা, নিষ্ঠা, একাগ্রতা দায়িত্বশীলতা ও নম্র ব্যবহার আমাকে মুগ্ধ করেছিল। আমার আব্বার কোনো পুত্রসন্তান ছিল না। আমি একমাত্র সন্তান। তাই ভাবলাম বেগম ও সওগাত প্রেস দুটোর দায়িত্বই আমাকে এক সময় পালন করতে হবে।
আমার মনে হয়েছিল এ দায়িত্ব পালন করার জন্য দাদা ভাই-ই আমাকে সবচেয়ে সাহায্য করতে পারেন। আমার মনে হতো আমি চলে গেলে 'বেগম' বন্ধ হয়ে যাবে। কিন্তু 'দাদা ভাই'ও সাংবাদিক হওয়ার কারণে সে ভয় ছিল না।
আপনাদের বিয়ের কথা কি মনে পড়ে! বিয়ের কথা যদি বলতেন।
১৯৫২ সালে আমরা বিয়ে করি।
বিয়ের প্রস্তাব এনেছিলেন শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক। আমাদের বিয়েতে আব্বা প্রথমে রাজি ছিলেন না। পরে ফজলুল হক সাহেব তাকে রাজি করিয়েছিলেন। প্রত্যেকটি বাঙালি মেয়ের জীবনেই দুটো দিক থাকে। বাবা-মার বাড়িতে তারা খুব আদর-যত্নে বড় হয় এখানে তাদের নিজস্ব প্রতিভা বিকাশের সুযোগ থাকে।
কিন্তু বিয়ের পর শ্বশুরবাড়ির আত্দীয়দের সঙ্গে তাল মেলাতে গিয়ে অনেক মেয়েকেই তার নাচ-গানসহ বহু পছন্দের বিষয় ছাড়তে হয়। দাদা ভাই-এর সঙ্গে বিয়ে হওয়ার কারণে আমাকে 'বেগম' ছাড়তে হয়নি। তার উৎসাহেই নিজের পছন্দ মতো কাজ করতে পেরেছি। পত্রিকা চালাতে গিয়ে কোনো সমস্যা হলে তিনি আমাকে সব সময়ই সাহায্য করেছেন। জীবনসঙ্গী হিসেবে দাদাভাই ছিলেন খুব ভালো বন্ধু।
পারিবারিকভাবে আপনি কতখানি সহযোগিতা পেয়েছেন।
আমার পারিবারিক জীবন বেশ সুখের ও আনন্দময়। শৈশবে প্রগতিশীল, উদারচেতা, সংস্কারমুক্ত আব্বার স্নেহের ছায়ায় বেড়ে উঠি। অন্যদিকে মা ফাতেমা খাতুনের নিত্য সাহচর্য ও জীবনবোধ আমার জীবনকে আলোকিত করেছে। বিবাহিত জীবনে এবং কর্মক্ষেত্রে আমার স্বামী রোকনুজ্জামান খান উদারভাবে সহযোগিতা করেছেন।
আমার দুই সন্তান। বড় কন্যা ফ্লোরা নাসরীন খান ও ছোট মেয়ে রীনা ইয়াসমিন খানও আমাকে অকুণ্ঠ সহযোগিতা করেছে। বড় মেয়ে বেগমের দায়িত্ব নেওয়ায় আমি অবসর পেয়েছি। ও সফলভাবে নিজের দায়িত্ব পালন করছে।
আমাদের দেশের নারীরা সামাজিকভাবে কতখানি এগিয়েছে বলে আপনি মনে করেন।
আমাদের দেশের সার্বিক উন্নতি হলেও গ্রামীণ জনগোষ্ঠী ও নারীরা বেশ পিছিয়ে রয়েছে। শহরে এগিয়ে গেলেও দেশের বহু গ্রামে আজো ভালো রাস্তাঘাট নেই, শিশুরা স্কুলে যেতে পারে না। গ্রামীণ নারীদের শিক্ষার হার বাড়েনি। ধর্মীয় বাধা, মোল্লাদের ভয়ভীতি রয়েছে। আমাদের মেয়েরা সারা জীবন শ্বশুরবাড়ি থাকে।
তারপরও তারা নিজেদের জীবনে উন্নতি করতে চায়। আমি ব্রিটিশ, পাকিস্তান ও বাংলাদেশ পর্বে বহু পরিবর্তন দেখেছি। নারীরা এখন নতুন নতুন পেশায় দক্ষতার সঙ্গে কাজ করছে। তবুও দেশের উন্নয়নে নারীর ভূমিকাকে তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। নারীদের ন্যায্য সম্মান দিতে হবে।
তাদের কাজের স্বীকৃতি দিতে হবে।
নবীনদের উদ্দেশে আপনার চাওয়া কী।
আমাদের ইতিহাস অনেক দীর্ঘ। আমাদের ঐতিহ্য টিকিয়ে রাখতে ও দেশকে সমৃদ্ধ করতে নারী-পুরুষ সবাইকে একসঙ্গে কাজ করতে হবে। দেশে শিক্ষার হার না বাড়লে পুরুষ ও নারীকে পৃথক সারিতে থাকতে হবে।
গ্রামে স্কুলপড়ুয়া শিক্ষার্থীদের ঝরেপড়া রোধ করতে হবে। শিক্ষার বিকল্প নেই। সবাইকে নিজ ধর্ম ও সমাজের মূল্যবোধ মেনে চলতে হবে। মানুষের মেধা ও সৃজনশীলতাকে কাজে লাগাতে হবে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।