১.
তখন অনেক ছোট। স্কুলে পড়ি কিংবা পড়ি না। থাকতাম মফস্বল এলাকায়,পাশাপাশি অনেকগুলো বাসা,টিনের ঘর। কলেজের টিচাররা সবাই একসাথে একটা মহল্লার মত(আমার বাবা ছিলেন কলেজের সহকারী অধ্যাপক। ) সামনেই খেলার মাঠ।
এক সাথে আমরা অনেকজন ছিলাম একই বয়সি। বিকেল হলেই খোলা মাঠে দৌড় ঝাপ। কানামাছি,কাঠকাঠুরে ভাই,গোল্লাছুট আরও কত রকম খেলা...
খেলতে খেলতে হঠাৎ করেই মাঝে মাঝে আমি বাসার দিকে দৌড় দিতাম-এক দৌড়ে বাসার জানালার সামনে এসে পর্দা তুলে উঁকি দিয়ে ডাকতাম-“মা?”
ঘড়ের ভেতর থেকে আমার খেলা ছেড়ে হঠাৎ আগমনে অবাক হয়ে মা জবাব দিতেন-“কি রে?”
আমি কোন উত্তর না দিয়ে আবার ছুটতাম খেলার মাঠে...
উত্তর যে জানা ছিল না!
খেলতে খেলতে হঠাৎ মনে হত-“মা কোথায়?”
দৌড়ে এসে দেখে যেতাম মা আমার ঘরেই আছেন,আশ্বস্ত হয়ে আবার ছুটতাম খেলার মাঠে!!
এখনও মাঝে মাঝে কাজের ফাঁকে হঠাৎ হঠৎ-ই দৌড়ে যেতে ইচ্ছা করে,অবাক করে দিয়ে ডাকতে ইচ্ছা করে-“মা?”
মা অবাক হয়ে হাসি দিয়ে বলবেন-“কি রে?”
পারি না...
যাওয়া হয় না...
তবু বলি-“ভালবাসি মা,সেই আগের ছোট্ট বেলার মতই...”
২.
পৃথিবীর সব থেকে মধুর হাসি কার? মোনালিসার? ভালবাসার মানুষের? পরম আরাধ্য কোন জিনিস পাওয়ার পর তৃপ্তির হাসি? মা বা বাবার কাছে হয়ত সন্তানের হাসি। আমার যেহেতু বউ এর দেখাই মেলেনি তাই সন্তানের হাসি কেমন, তা জানি না। যার হাসি এবং আরও আলাদা করে বলতে গেলে যে হাসি টা আমার কাছে সব সময়ের জন্য স্পেশাল হয়ে আছে সেটা বলি -
ওইসময় দেশের একটি স্বনামধন্য ক্রিকেট ক্লাবের ফিজিওথেরাপিস্ট এর দায়িত্বে ছিলাম।
দলের সাথে যেতে হয় যেখানে খেলার ভেন্যু সেখানে। তিন দিন পর বগুড়া শহীদ চান্দু স্টেডিয়ামে খেলা। আর খেলার ঠিক দুইদিন আগে রংপুর কারমাইকেল কলেজে আমার ব্যান্ডের প্রোগ্রাম। আমার ক্রিকেট টিম বগুড়া যাবে খেলার আগের দিন বিকেলে। যেতে হবে আমার বাড়ির পাশ দিয়েই - সিরাজগঞ্জ পার হয়ে।
বলে রাখি, আমার বাড়ি সিরাজগঞ্জ।
সে যাই হোক, রংপুরের প্রোগ্রাম শেষে ব্যান্ডের সবার ঢাকায় ফেরার কথা। আমি খুব ইন্ডিসিশনে ছিলাম যে কি করব! ঢাকায় ফিরে টিমের সাথে বগুড়া আসব আবার নাকি বগুড়া চলে যাব। ঝামেলার কথা হচ্ছে ওই সময়ে বগুড়া থেকে রংপুর পর্যন্ত সড়ক পরিবহন ধর্মঘট চলছিল। যাবার সময়ই বগুড়া থেকে রংপুর যেতে হয়েছে এম্বুলেন্সে করে।
আসার সময় হল আরও বিপত্তি। আয়োজকরা ট্রেনের টিকেট বুকিং দিয়ে রেখেছিলেন ঠিকই কিন্তু টিকেট কাটেনি নি। সড়ক অবরোধের কারণে ট্রেনে উপচেপড়া ভীড়! ভাল কোন সিট নেই। ট্রেনের ক্যান্টিনে বসে ফিরতে হবে। আমি তীব্র আপত্তি জানালাম।
শেষমেষ ঠিক হল এই ট্রেনে করে বগুড়া পর্যন্ত যাওয়া হবে। সেখানে বাসের টিকেট (বগুড়া টু ঢাকা) কাটানোর ব্যাবস্থা করা হল রাতের শেষ বাস এর কারণ বগুড়া পৌছে সেই বাস ধরাও কঠিন হয়ে যাবে।
কোনমতে এসে বাস ধরতে পারলাম। রাত দেড়টার দিকে গাড়ি ছাড়ল। হুট করেই স্বিদ্ধান্ত নিলাম - ঢাকা ফিরবো না! ব্যান্ডের অন্যদের বললাম আমার গিটার,প্রসেসর নিয়ে যেতে।
আমি সিরাজগঞ্জ 'কড্ডার মোরে' নেমে গেলাম। সেখান থেকে সি এন জি আর রিক্সায় করে বাসায়। আমি যে বাসায় আসব সেটা বাবা মা কাউকেই জানাইনি ইচ্ছে করেই। কখনো তো বাবা মা কে সারপ্রাইজ দেয়া হয় নি। ভোর রাতে সন্তানের হঠাৎ উপস্থিতির চেয়ে বড় আনন্দের এবং ভাললাগার সারপ্রাইজ আর কী বা হতে পারে বাবা মা'র কাছে? গেটের সামনে এসে বাবা কে ফোন দিলাম (কারণ আমাদের ঘর টা উঠান পার হয়ে, তাই গেটে নক করলে ঘরের দেয়াল ভেদ করে সেই আওয়াজ বাবা মা'র কানে পৌছাবে না! মজার ব্যাপার হচ্ছে বাবা কে বহু যুক্তি দেখিয়েও কলিং বেল লাগাতে রাজি করাতে পারি নি, কারণ উনার ধারণা তাহলে এলাকার পোলাপাইন গুলো নাকি সারাদিন কলিং বেল চাপবে!!! আমার বাবা 'অদ্ভুদ')
বাবা হয়ত এত রাতে ফোন পেয়ে টেনশনে পড়ে গিয়েছিলেন!
আমি যেন কিছুই হয়নি এমন একটা ভাব নিয়ে বললাম -"দড়জা খোল।
"
বাবা খুব অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন -"মানে??!! "
পাশে থেকে মা'র চিন্তিত গলা শুনলাম -"কি হইছে? "
আমি আর দীর্ঘায়িত করলাম না। বললাম - "দড়জা খোল, আমি গেটে দাড়ায় আছি। "
গেট খোলার পর মায়ের যে আনন্দিত মুখ দেখেছিলাম তার জন্য সব কষ্ট ভুলে যাওয়া যায়। দুই তিন দিনের টানা ধকল এক মুহুর্তে নাই হয়ে যায়।
মাত্র ১২ ঘন্টা বাসায় ছিলাম।
বিকেলে আবার বগুড়া চলে গেলাম টিমের সাথে যোগ দিতে। সাথে নিয়ে গেলাম যে কোন কষ্ট ভুলে যাবার মত মহৌষধ!!!
***********************
সুবোধ অবোধ
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।