আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

দেশভাগঃ পটুয়াখালীর বুকে নিঃশব্দ রক্তক্ষরণ (পর্ব তিন)



পটুয়াখালীর সর্বশেষ জমিদারঃ সম্রাট আওরঙ্গজেবের আমলে ১৬৮৮ সাল পর্যন্ত দুই দফায় শায়েস্তা খানকে বংলার সুবেদার করে পাঠায়। দাক্ষিণাঞ্চলের মগ-পর্তুগীজ জলদস্যু দমনে কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য শায়েস্তা খানের পুত্র বুজুর্গ উমেদকে চন্দ্রদ্বীপ-বাজুহা এলাকার দায়িত্ব দেন। তার নামানুসারে ঐ পরগনার নামকরণ হয় বুজুর্গ উমেদপুর। সেই অতীতের বুজুর্গ উমেদপুর পরবর্তীকালের আওরঙ্গপুরই হচ্ছে আজকের পটুয়াখলী। পটুয়াখালীর ভূমি দফতরের পুরানো দলিল দস্তাবেজে উল্লেখ রয়েছে আওরঙ্গপুর পরগনার নাম।

শায়েস্তা নগরের জমিদার রাম গোপলের কনিষ্ঠ পুত্র জানকী বল্লভ বাংলার সুবাদার আওরঙ্গজেবের পুত্র আজিম-উস-সানের নিকট থেকে তিনি ১৬৯৯ সালে আওরঙ্গপুর পরগনার জমিদারি লাভ করেন । নবাবের হুকুম হয় 'যত ভাটা তত জানকী বল্লভ রায়ের পাটা'। অর্থাৎ সাগর পর্যন্ত বিস্তৃত ভাটির অঞ্চল আওরঙ্গপুর পরগনার জমিদারি পেলেন তিনি। পটুয়াখালী, মির্জাগঞ্জ ও আমতলী ছিল এই পরগনার অন্তর্গত। তখন এসকল এলাকা ছিল গভীর অরণ্য।

জমিদারি লাভের পর জানকী বল্লভ কলসকাঠীতে বসতি স্থাপন করেন এবং নির্মান করেন অট্টালিক। ১৭৪৪ সালে তিনি পুনরায় জমিদারি বন্দোবস্ত নেন। তিনি পটুয়াখালীর উত্তর পাড়ে লাউকাঠীতে এসে জঙ্গল কেটে আবাদ করার ব্যবস্থা করেন ও পরবর্তিতে এখানে কাছারী স্থাপন করেন। তখন দক্ষিণ পাড়ে ছিল গভীর জঙ্গল। সেখানে নদীতীরে ছিল ভয়ংকর এক দস্যুদলের আস্তানা।

জমিদারী পত্তনের পর গৃহবিবাদে জড়িয়ে পরে তার উত্তরপুরুষরা। কলসকাঠীর যে ১৩ ঘর জমিদার ছিলেন তারা জমিদার জানকি বল্লভ রায়ের পরবর্তি বংশধর। এই জমিদাররা কলসকাঠী ঘিরে গড়ে তুলেছিল বৃহৎ অট্টালিকা, ঠাকুরবাড়ি, নাট্যমন্ডপ, ঘাট। কলসকাঠীকে একসময় দ্বিতীয় কলকাতা বলা হতো। সেই বৃটিশ আমলে জমিদাররা এখানে চিড়িয়াখানা স্থাপন করেছিলেন।

গ্যাসের লাইট দিয়ে কলসকাঠীকে আলোকিত করা হয়েছিল। ১৮০৭ সালে বরিশালের জজ-ম্যাজিস্ট্রেট হয়ে আসেন মিঃ বেটি। দক্ষিণাঞ্চলের সুন্দরবন কেটে বসত বৃদ্ধি পাওয়ায় বেটির শাসন আমলেই ১৮১২ সালে পটুয়াখালীকে নিয়ে গঠন করা হয় মির্জাগঞ্জ থানা। পরবর্তীতে দেওয়ানী শাসন প্রসারের জন্য ১৮১৭ সালে বরিশালে স্থাপন করা হয় পৃথক ৪টি মুন্সেফী চৌকি। ১৮৬০ সালের ১ জুন বাউফল থেকে চৌকি স্থানান্তর করা হয় লাউকাঠীতে।

আধুনিক বরিশালের রূপকার মহাত্মা অশ্বিনী দত্তের পিতা ব্রজমোহন দত্ত বাউফল ও পরবর্তিতে লাউকাঠী চৌকির মুন্সেফ ছিলেন। ১৮৭১ সালে পটুয়াখালী মহাকুমায় রূপান্তর হলে ১৮৮৯ সালে এ সময় কলসকাঠীর জমিদার বরদাকান্ত রায় চৌধুরীর পুত্র বিশ্বেশ্বর রায় চৌধুরী পটুয়াখালী মহকুমার স্বাধীন কালিকাপুর কিসমতের বন্দোপাধ্যায় মুদাফাত তালুক খরিদ করে। এ অঞ্চলের সর্বশেষ জমিদারগন ছিলেন বিশ্বেশর রায় চৌধুরীর পাঁচ পুত্র রাজেশ্বর, রতেœশ্বর, সিদ্ধেশ্বর, অমরেশ্বর, হরেশ্বর রায় চৌধুরী ও ব্রজকান্ত রায় চৌধুরীর তিন পুত্র সুরেন্দ্র, নরেন্দ্র ও মনিন্দ্র এরা সকলে বসবাস করতেন কলসকাঠীর জমিদার বাড়িতে। পটুয়াখালীতে আসতেন খাজনা আদায়সহ বিভিন্ন উপলক্ষ্যে। পটুয়াখালী শহরের নতুন বাজার একোয়ারস্টেট বর্তমানে সদর উপজেলা ভূমি ও রাজস্ব অফিস।

এ ভবনটি পরিচিত ছিল জমিদার রাজেশ্বর রায় চৌধুরীর কাছারি বাড়ি হিসেবে। এখানে তাদের জমিদারীর হাউলিও ছিল। হাউলির কয়েক গজ সম্মুখে পাষাণময়ী কালীবাড়ি। তার পিতা বিশ্বেশ্বর রায় চৌধুরী বাংলা ১৩১১ সালের (১৯০৪ইং) ৩০ চৈত্র চতুর্দশী অমাবশ্যা তিথিতে এই পাষাণময়ী কালীবাড়ি প্রতিষ্ঠা করেন। মূল মন্দিরের সম্মুখের দেয়ালে শ্বেত পাথরের শিলালিপিতে উৎ্কীর্ণ রয়েছে, বাংলা ১২৯৬ সনে কলসকাঠীর জমিদার বিশ্বেশ্বর রায় চৌধুরী তৎ্কালীন পটুয়াখালী মহকুমার কালিকাপুর তালুক খরিদ করেন।

এদিকে, ব্রজকান্ত রায় চৌধুরী নামে অপর একজন জমিদার এই তালুক খরিদের এক ভাক্ত কবলা জাহির করেন। এনিয়ে প্রায় এক দশক ধরে চলে উভয় পক্ষের মধ্যে একাধিক ফৌজদারী ও দেওয়ানী মামলা। বিশ্বেশ্বর রায় চৌধুরী মানত করেন, ঐ সকল মোকদ্দমায় জয়লাভ করলে তার পটুয়াখালীস্থ নিজ বাড়িতে স্থাপন করেন পাষাণময়ী কালী মাতার বিগ্রহ। মামলা গড়ায় হাইকোর্টে। জয়ী হন বিশ্বেশ্বর রায় চৌধুরী।

পাষাণময়ী কালী মন্দিরঃ বাংলা ১৩০৬ সালে জমিদার বিশ্বেশ্বর রায় চৌধুরী তার লোকদের আদেশ দেন কালী মন্দির প্রতিষ্ঠার সকল আয়োজনের। ইসিবপুর নিবাসী স্বরূপ চন্দ্র দে রাজমিস্ত্রী দ্বারা মন্দির নির্মাণ করে তার মধ্যে শ্মশান প্রস্তুত করা হয়। ঐ শ্মশানে ১৩০৮ সালের ২৪ অগ্রহায়ণ, মঙ্গলবার কলেরায় মৃত গুরুচরণ কর্মকার নামে এক ব্যক্তির শবদাহ করা হয়। এদিকে নায়েব চন্দ্র কুমার সরকার কলিকাতা থেকে তৈরি করে ১৩০৭ সালের ১৮ আশ্বিন কলসকাঠীতে আনেন কালী মাতার বিগ্রহ। ৫ বছর ৮ মাস ১১ দিন পর ১৩১৩ সালের ২৯ জ্যৈষ্ঠ কলসকাঠী থেকে পটুয়াখালীর এই মন্দিরে আনা হয় কালী মাতার বিগ্রহ এবং তা ৮ বছর ১০ মাস বিনা প্রতিষ্ঠায় থাকে।

অভ্যন্তরে তৈরি করা হয় একটি বেদী। জমিদারের হাতের মাপের সোয়া হাত পরিমিত বেদীর চার কোণে ও মাঝখানে মোট ৫টি গর্ত করা হয়। তাতে স্থাপন করা হয় ৫টি জারজ পুরুষ চন্ডালের মুন্ড (খাপড়া শাস্ত্র মতে)। পঞ্চমন্ডী স্থাপন করে " ঁক্রী" মন্ত্রে কালী নামে প্রতিষ্ঠা করা হয় কালী মাতাকে। অবশেষে ১৩২১ সালের ৩০ চৈত্র অমাবশ্যা তিথিতে মহাবিষুব সংক্রান্তি দিবসে অভ্যুদায়িক পৌরানিক মতে ঐ মন্দিরে কালী মাতার বিগ্রহ স্থাপন করা হয় তন্ত্রমতে।

মন্দির প্রতিষ্ঠাকালে জমিদার বিশ্বেশ্বর রায় চৌধুরী তার আত্মীয়-স্বজন বরিশাল থেকে লঞ্চ নিয়ে আসেন পটুয়াখালীতে। এ অনুষ্ঠানে জমিদারী স্টেটের সর্বপ্রধান কর্মচারী পেনশনপ্রাপ্ত ডেপুটি কালেক্টর রায় প্যারিমোহন বসু জজ কোর্টের উকিল উমেশ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়সহ তত্কালীন গণ্যমান্য ব্যক্তিবর্গ উপস্থিত ছিলেন। ঐ সময় তিনজন পুরোহিত রোহিনী কুমার চক্রবর্তী, মনোরঞ্জন চক্রবর্তী ও ভবরঞ্জন চক্রবর্তীকে নিযুক্ত করা হয় অমাবশ্যার পূজা ও দৈনিক পূজা করার জন্য। শতাব্দীকালের পুরানো এই মন্দিরটি আজো টিকে আছে ভক্তদের দক্ষিণা ও দান-অনুদানে। ডাকাতিয়া কালীবাড়িঃ সেন্টার পাড়ার এই কালী বাড়ি ৫ শত বছরের পুরনো বলে অনেকে দাবী করেন।

একদল কাপালিক ছাড়া অন্য কোন জনমানবের পদচারণা ছিল না এই ভূখণ্ডে। গভীর অরণ্যে ঘেরা সুন্দর বনাঞ্চলের মাঝে উঁচু মাটির টিলার উপর প্রতিষ্ঠিত ছিল এই মন্দির। ঐ মন্দিরে চৈত্র অমাবশ্যায় কালী পূজায় দেবীর নামে উত্সর্গ করে দেয়া হতো নরবলি। পাশের নদী দিয়ে যাতায়াতকারী লোকজন ঢাক-বাদ্যের শব্দ শুনে শিউরে উঠে বলত ঐখানে ডাকাতিয়া কালীবাড়ি। ভয়ে সেখানে যেতো না কেউ।

কালের পরিবর্তনে জমিদারী আমলে লোকজনের আগমন ঘটে। কাপালিকরা মন্দির পরিত্যাগ করে চলে যায় অন্যত্র। জমিদাররা সেখানে প্রতিষ্ঠা করে সার্বজনীন কালী মাতার মন্দির। দীর্ঘদেহী এই কাপালিকগণ পরিধান করতেন গেরুয়া বসন। গলায় পরতেন নাভি অবধি রুদ্রাক্ষের লম্বা মালা।

কপালে অঙ্কিত করতেন সিঁদুরের ত্রিশুল। তারা ছিলেন দেবী কালী মাতার উপাসক। সেসময়ে লোনার কারণে নদীর জল ব্যবহার করা যেত না। জলের জন্য তারা খনন করেন পুকুর। জলোচ্ছ্বাসের কবল থেকে নিজেদেরকে রক্ষায় তৈরি করেন সুউচ্চ মাটির ঢিবি।

নিত্য পূজা ছাড়াও প্রতি অমাবশ্যায় নানা ধরনের নৈবদ্য সাজিয়ে ভোগের আয়োজন করা হতো। তারা কার্তিকের অমাবশ্যার তিথিতে মায়ের বিশেষ পূজা সমাপন শেষে কাঁধে খড়গ ও ত্রিশুল নিয়ে নামতেন লুণ্ঠন কজে। লুণ্ঠনই ছিল তাদের পেশা। চন্দ্রদ্বীপের জনবসতি এলাকায় ও নৌপথে যাতায়াতকারী বাণিজ্যিক নৌকায় ডাকাতি করে তারা লুটে নিত ধন-রত্ন ও প্রয়োজনীয় মালামাল। ফিরে আসার সময় তারা অপহরণ করে আনতেন নিখুঁত ও সুঠামদেহী কোন এক হতভাগ্য অবিবাহিত কিশোর কিংবা যুবককে।

তারা ফিরে এসে বিশাল আয়োজন করতেন চৈত্র অমাবশ্যায় কালী পূজার। এই পূজায় কালী মাতার নামে উত্সর্গ করে তাকে দেয়া হতো নরবলি। উপরোক্ত মন্দির দুটির বিষয়ে প্রাপ্ত তথ্যে বেশকিছু বিভ্রান্তি রয়েছে বলে মনে হয়। জমিদারদের তালুক পরিচালনা বিষয়েও তথ্যের অপর্যাপ্ততা রয়েছে। সতীন সেনের মামলার রায় ও বোলাকী সাহার বিদ্রোহের পটোভূমি দেখলে এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় এতদ্বাঞ্চলের জমিদাররা খুবই অত্যাচারী ছিল।

তবে ডাকাতিয়া কালীবাড়িতে নরবলির কথা যদি সত্য বলেও ধরে নেই পাষাণময়ী কালীমন্দিরে ১৯০৫ সালে ‘পঞ্চমন্ডী’ স্থাপনের তথ্য সঠিক হতে পারেনা। রাজেস্বর রায় চৌধুরীর ঘনিষ্ঠ ছিল এমন পরিবার কিংবা তার স্মৃতি মনে আছে এমন মানুষ এখনও অনেকজন জীবিত আছেন। রাজেস্বর রায়রা দেশভাগের পরপরই পটুয়াখালী ত্যাগ করে। জমিদারী প্রথাও বিলুপ্ত হয় ১৯৫০ সালে। তাদের কিছু সম্পত্তি বকশীদের কাছে বিক্রি করে দেয় ও বাকী সম্পত্তি সরকার দখল করলো শত্রু সম্পত্তি হিসেবে।

রাজেস্বর রায় চৌধুরী দেশত্যাগের আগে তার ব্যবহার্য্য দ্রব্যাদি স্থানীয় ঘনিষ্ঠ লোকদের উপহার বা দান করে যান। তার দেয়া কাসার থালে এখনও ভাত খাচ্ছে কিংবা স্মারকগুলো সংগ্রহে আছে এমন মানুষের সাথেও আমার কথা হয়েছে। একোয়রষ্ট্যেট বিল্ডিং সংলগ্ন ছিল বকশী বাড়ী। তাদের সর্বশেষ উল্লেখযোগ্য ব্যক্তিত্ব কালু বকশী স্বনামধন্য মোক্তার ছিলেন। আজকের প্রেস ক্লাব ও পিছনের পারু আপাদেরর বাসা, রাস্তার উল্টো পাশে অগ্রনী ব্যাংকসংলগ্ন জায়গার মালিক ছিলেন বকশীরা।

বকশীরা পটুয়াখালী ত্যাগ করেন সম্ভবত ৬৫ এর পাক ভারত যুদ্ধের সময়। অর্জুন সাহাঃ বৃটিশ পিরিয়ডে শহরের সবচেয়ে ধনাঢ্য ব্যক্তি হিসেবে অর্জুন সাহাকে চিনতো দক্ষিণাঞ্চলের সবাই। বিভিন্ন প্রকারের আড়তদারি ও সরকারী প্রায় সকল পণ্যের বড় ডিলার ছিলেন তিনি। পটুয়াখালীর ভোজ্যপণ্যের বাজার নিয়ন্ত্রন করতো অর্জুন সাহা। কাঠপট্টির দক্ষিণ মাথা থেকে মুকুল সিনেমা হয়ে প্রায় মিঠাপুকুর অবধি ছিল তার সম্পত্তি।

পুরান বাজারের ভিতরে বেশ কয়েকটি বড় আড়ত ছিল তার। শহরের পুরানো সকল বাড়ীর মধ্যে কাঠপট্টিতে অবস্থিত অর্জুন সাহার বাড়িটি ছিল সবচেয়ে সুন্দর। সনাতন ধর্মের বিভিন্ন দেব-দেবীসহ নানা প্রকারের ফুলেল ডিজাইনের কারুকাজ ছিল বাইরে ও ভিতরে। এখনও কিছুটা অবশিষ্ট আছে। ৪৭ এর দেশভাগের সময় বিভিন্ন প্রকারের হয়রানি ও ভয় দেখিয়ে সপরিবারে তাকে দেশ ছাড়া করেন একটি শক্তিশালী দুষ্টচক্র।

দেশভাগের পরপরই তিনি ফিরে এসেছিলেন। সেই চক্রটি তাকে ডিএসবির ভয় দেখায়। ভয় দেখায় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গারও। বাধ্যহয়ে প্রায় কপর্দক শূণ্যহাতে সুবিধখালী দিয়ে নৌপথে তাকে ভারত পাঠিয়ে দেয়। অর্জুন সাহা আর ফিরে আসেনি।

হাতেগোনা দু’একজন তার প্রায় সকল সম্পত্তি কুক্ষিগত করে নেয়। তার সম্পত্তি দিয়েই পরবর্তিতে এ শহরের একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী হয়েছেন তারা। রাখাল রাজ ঘোষঃ ব্রিটিশ যুগের প্রখ্যাত উকিল ছিলেন রাখাল রাজ ঘোষ । নতুন বাজারের সর্দার ভিলাসহ আশে পাশে অনেক সম্পত্তি ছিল তার। আসাদ উকিল পরপর তিনবার পটুয়াখালী মিউনিসিপ্যালিটির নির্বাচিত চেয়ারম্যান ছিলেন।

তার পরপরই দেশ বিভাগোত্তর সময়ে (১৯৪৮-৪৯) রাখাল রাজ ঘোষ ছিলেন পটুয়াখালী মিউনিসিপ্যালিটির চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়। তার দুই ছেলে জুবিলী স্কুলে আমাদের বাচ্চু মামার (বদরুল হক) ক্লাসমেট ছিলেন। প্রবেশিকা পরীক্ষার আগেই ৫১/৫২ সালে ছেলেদের ভারত পাঠিয়ে দেয়। নানা হয়রানীর মুখোমুখি হয়েও পরিবারের কিছু সদস্য পাকিস্তান পিরিয়ডেও এখানে ছিল। মুক্তিযুদ্ধের সময়ে পরিবারের অবশিষ্টরাও দেশ ছেড়ে চলে যায়।

সুরেন ব্যানার্জিঃ প্রখ্যাত আইনজীবি সুরেন ব্যানার্জি ছিলেন পটুয়াখালী বারের একসময়ের সভাপতি। সজ্জন হিসেবে তার খুব সুনাম ছিল। মুসলিম পাড়ার আজাদ ভবন থেকে রাজ্জাক প্রফেসর অর্থাৎ সৈয়দ মিজান ভাইদের বাসা পর্যন্ত বিস্তৃৃৃত ছিল তাদের বাড়ি। সুরেন ব্যানার্জির সন্তানরা ছিল খুব মেধাবী। তার এক ছেলে সুভাষ ব্যানার্জি জুবিলী স্কুল থেকে সেই সময় ষ্ট্যান্ড করেছিল।

তখন বরিশাল বোর্ড তো দূরে থাক, যশোর বোর্ডই হয় নি। জুবিলী স্কুল ছিল তখন ঢাকা বোর্ডের অধীন। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বেই ব্যানার্জিরা দেশ ছাড়লেন সপরিবারে। উল্লেখ্য পটুয়াখালী ত্যাগী অধিকাংশ হিন্দুরাই অশ্রয় গড়েছে পশ্চিম বঙ্গের চব্বিশ পরগনার প্রধান শহর বারাসাতে। সুরেন ব্যানার্জি পরবর্তিতে বারাসাত কোর্টেও ভাল নাম কুড়িয়েছিলেন।

এ পর্ব শেষ করবো বিষাদময় একটি রম্যতথ্য দিয়ে: প্রখ্যাত রাজনীতিবিদ আবুল মনসুর আহমদ (১৮৯৮-১৯৮৯) তার গল্পের ‘আদু ভাই’ চরিত্রটি নির্মানের আগে একবার যদি আমাদের শহরের সুবলদা’র সন্ধান পেত তবে ‘সুরেন ওঝা’ নামে একটি বাড়তি ক্লাসিক চরিত্র বাংলা রম্য সাহিত্যে স্থায়ী আসন পেত। পুরনো সোনালী ব্যাংকের বিপরীতে খাল পাড়ে কার্তিক খলিফার বাড়ীর পাশেই ছিল সুরেন ওঝার বাড়ি। তার একমাত্র ছেলে সুবল। বাপে পুতে দুজনই সেরাম বিখ্যাত। শহরের সবচেয়ে নামী ওঝা ছিলেন সুরেন ওঝা।

বিপদগ্রস্থ শহরবাসীর আশা ভরসার শেষ ভরসা সুরেন ওঝা। সাপের বিষ নামানো, ঝাড়ফুক, বাটি চালান, চাল পড়া, বান মারা, তাবীজ-তুমার, বদ জ্বীনের আছর থেকে মুক্তিসহ জগতের যাবতীয় অধিবিদ্যায় তিনি পারদর্শী। যেকোন প্রকারের শাররীক-মানসিক অসুস্থতা, প্রেম-প্রীতিতে ব্যর্থতা, স্ত্রী-বশীকরণ কিংবা গোপন সমস্যার সহজ সমাধানও তিনি নামমাত্র মূল্যে দান করে থাকেন। তার সন্তান সুবলের কামাই আবার পিতার চেয়ে কম নয়। সুবল খুবই বন্ধুপ্রিয়, বেশ কয়েকটা টিউশনি করায়, বন্ধুদের পিছনে টাকাও খরচ করে।

বাপ অশিক্ষিত বলে সুবল খুব আক্ষেপ করে বন্ধুদের সাথে। খুব বিশ্বস্ত ও ঘনিষ্ঠদের কানে কানে বলে তার পিতা একজন ভন্ড, লোক ঠকায়, ভুং-ভাং বুঝায়; কেননা প্রায় প্রতিদিনই সুবল কিছু না কিছু চুরি করে, কিন্তু অদ্যোবধি তার পিতা টের পায় নাই। সুরেন ওঝার এই গর্বিত সন্তানটি মেট্রিক পরীক্ষার্থী। অষ্টম বারের বার তিনি মেট্রিক পাশ (এসএসসি) করলেন। বাঙালরা গুণিদের কদর বোঝেনা বলে ৮০’র দশকের মাঝামাঝি সময়ে এই ঐতিহাসিক ওঝা পরিবারটি বাংলাদেশের মায়া ত্যাগ করে ভারতবাসী হলেন।

তার বাড়ির খালপাড়ে একটি স্মৃতিফলক স্থাপন করলে মন্দ হয় না যেখানে খোদাই করে লেখা থাকবে ‘হিয়ার লিভ্ড্ সুবল উইথ হিজ স্প্রিপ্রচুয়াল ফাদার, হু পাস্ড এসএসসি এ্যান্ড মাইগ্রেটেড ফ্রম পটুয়াখালী টু বারাসাত। ’ For more: http://coastalnews24.com Click This Link Click This Link Click This Link Click This Link

সোর্স: http://www.somewhereinblog.net     দেখা হয়েছে ১১ বার

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.