জেলখানা থেকে ছাড়া পেলাম ১৬ সেপ্টেম্বর। ৫০ দিন অন্তরীণ থাকতে হলো। কারা নির্জনে বসে অনেক কিছু ভেবেছি, অনেক কিছু করেছি- সব কিছু লিখিনি বা লেখাটা সঙ্গত বলে মনে হয়নি। কারাবাস নিয়ে প্রায় ৬০ হাজার শব্দের আত্দজীবনী লিখেছি। কিছু কিছু বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং ডিনিউজে ছাপা হয়েছে।
প্রসঙ্গ এলে ভবিষ্যতে হয়তো বাকি অংশ ছাপা হবে। তবে পূর্ণাঙ্গ লেখা বই আকারে পেতে সম্মানীত পাঠকদের হয়তো বইমেলা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে।
কারাগারে বসে যা লিখেছি তা মূলত বাংলাদেশ প্রতিদিন এবং এর সম্মানীত পাঠকদের প্রতি আস্থা ও বিশ্বাস রেখেই রচনা করেছি। সে মতে গত ৮টি পর্বে তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে। আজকের এ লেখার মাধ্যমে ধারাবাহিক পর্বের সমাপ্তি ঘটলেও ভবিষ্যতে হয়তো আরও কিছু কৌতূহলী লেখা সময় ও সুযোগ বুঝে পাঠকদের উপহার দেওয়ার সুযোগ দেবেন প্রিয় সম্পাদক মহোদয়।
৫০ দিনের কারাবাসে আমার এক নিদারুণ অভিজ্ঞতা হয়েছে জেলের ভেতর এবং জেলের বাইরের পরিবেশ থেকে। জেলের মধ্যে আমার আশপাশে ছিলেন বিভিন্ন চাঞ্চল্যকর মামলার সাজাপ্রাপ্ত আসামি- খুন, ধর্ষণ, চাঁদাবাজি, স্ত্রী পেটানো, ছিনতাই মামলা, প্রতারণা, ফটকাবাজিসহ নানা অপরাধে তারা ছিল অভিযুক্ত। বিচিত্র সব অপরাধ করতে গিয়ে এসব লোক নানা রকম বিচিত্র সব অভ্যাসের দাসে পরিণত হয়ে জেল খাটছে। তাদের চিন্তাভাবনা, প্রেম-ভালোবাসা, আবেগ, স্নেহ, মায়া-মমতা কিংবা অপরাধ প্রবণতার নানা রকম চাঞ্চল্যকর ঘটনা জানার চেষ্টা করেছি। একেকটি ঘটনা নিয়েই একেকটা উপন্যাস বা চলচ্চিত্র হতে পারে।
অন্যদিকে কিছু নিরপরাধ ব্যক্তির সাজাভোগ আমাকে প্রচণ্ডভাবে নাড়া দিয়েছে। আগামী দিনে ওইসব লোকের জন্য কিছু করতে জেলখানায় বসে মনে মনে প্রতিজ্ঞা করেছি।
জেলের মধ্যে ঘটে যাওয়া ঘটনাপুঞ্জির সঙ্গে বাইরের দুনিয়ার অনেক কিছুরই বাস্তবে মিল খুঁজে পাবেন না। ওখানকার জগৎটাই যেন আলাদা। ওখানে বসে অনেক বড় মানুষ ছোট ছোট চিন্তা করতে থাকে।
আবার অনেক ছোট মানুষ বড় বড় চিন্তা করে। অফুরন্ত নির্জন সময়ে আপনার এমনসব বিষয় মনে হবে সচরাচর হয়তো এগুলো আপনি ভাবতেনই না। আবার এমনসব ছেলেমি করে বসবেন, যা বাইরে থাকলে হয়তো করতেনই না। আমিও এর ব্যতিক্রম ছিলাম না। একদিন বাথরুমে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সেইভ করার সময় লক্ষ করলাম আমার নাকের ভেতর থেকে বেশ কয়েকটি লোম বের হয়ে এসেছে।
রেজার দিয়ে অনেক চেষ্টা করেও একটি লোমও কাটতে পারলাম না। আমার এই ব্যর্থতায় অন্য সময় হলে মন খারাপ বা মেজাজ গরম হয়ে যেত। কিন্তু সেদিন হঠাৎ একটি ঘটনা মনে হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শুরু হলো হাসি। প্রাণভরে অনেকক্ষণ হাসলাম। তারপর শুরু করলাম নতুন কাণ্ডটি, যা আমি কোনো দিন করিনি।
প্রথমে হাসির কারণটি বলি এবং পরে বলছি নতুন কাণ্ডটির কাহিনী।
সংসদে আমরা বেশ কয়েকজন তরুণ এমপি পাশাপাশি বসি। সুযোগ পেলেই গল্পগুজব শুরু করি এবং নানা প্রসঙ্গ তুলে নিজেদের মধ্যে হাসাহাসি করি। একদিন আমরা বসে কথা বলছিলাম। যতদূর মনে পড়ে আমার পাশে নজরুল ইসলাম বাবু, ইকবালুর রহিম, মুরাদ জং এবং পলক ছিল।
আমরা যে সারিতে বসতাম তার বামদিকের সারিতে বসা একজন বয়স্ক সংসদ সদস্যের দিকে আমার নজর পড়ছিল। দেখলাম ভদ্রলোক খুব সযতনে তার নাকের একেকটা লোম ধরছেন আর সজোরে টান মেরে ছিঁড়ে ফেলছেন। কখনো তিনি পারছেন আবার কখনো পারছেন না। হাত পিছলে লোম হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে কখনো কখনো। ভদ্রলোক বেশ মনোযোগসহকারে অতি সতর্কতার সঙ্গে এবং বেশ যত্ন নিয়ে কাজটি করছেন।
কাজটি শুরু করার আগে তিনি সতর্কতার সঙ্গে আশপাশে তাকিয়ে দেখে নিচ্ছেন তার কর্মটি কেউ দেখছে কিনা। তিনি যখন নিশ্চিন্ত হলেন যে, তাকে কেউ লক্ষ করছেন না তখন সজোরে লোম টান মারেন। যদি ছিঁড়তে পারেন তবে আনন্দচিত্তে আবার আশপাশে তাকান সফলতা কেউ দেখে ফেলল কিনা। কিন্তু যেবার ব্যর্থ হন সেবার তিনি হঠাৎ মুখ ভার কর ফেলেন এবং আবার আশপাশে তাকিয়ে নিশ্চিত হওয়ার চেষ্টা করেন, তার ব্যর্থতা কেউ দেখেনি। ভদ্রলোকের বয়স, মুখচ্ছবি এবং সামগ্রিক কর্মকাণ্ড দেখার পর আমি খক খক, কুত কুত করে শুরু করলাম হাসি।
আমার তরুণ বন্ধুরা সমস্বরে বলে উঠল, এই রনি কি হয়েছে। ওইদিকে ভদ্রলোক নিশ্চিন্ত মনে অনবরত তার কর্ম করেই যাচ্ছেন এবং এতদূর থেকে কেউ যে তাকে ফলো করছে তা তিনি ভাবতেই পারলেন না।
বন্ধুদের প্রশ্নে আমার হাসি আরও বেড়ে গেল। মনে হলো, আমি ৮-১০ বছরের বালকে পরিণত হয়েছি। আমি হাসার চোটে কিছু বলতে পারলাম না।
কেবল আঙ্গুল উঁচিয়ে ভদ্রলোককে দেখিয়ে দিলাম। আর যায় কোথায়। হাসির মহামারী ছড়িয়ে পড়ল বন্ধুদের মাঝে। হাসতে হাসতে আমাদের চোখে পানি ঝরতে লাগল। ওইদিকে ভদ্রলোক খেয়ালই করতে পারলেন না, তাকে নিয়ে অদূরে বসে কয়েকজন নবীন সংসদ সদস্য কি করছেন।
ফলে তিনি নবউদ্যমে নাকের লোম ছিঁড়তে লাগলেন। আমাদের হাসি বাড়তে বাড়তে ভয়ানক আকার ধারণ করল। আমরা যথাসাধ্য চেষ্টা করলাম হাসি বন্ধ করার জন্য। আমাদের শংকা হলো- হাসির খোড়াক ছড়িয়ে যেতে পারে সর্বত্র। তাই তাড়াতাড়ি এসেম্বলি হল থেকে লবিতে বের হয়ে আসলাম হাসতে হাসতে।
ওই দিনের পর আমার আর ঘটনাটি মনে হয়নি কিংবা হাসি পায়নি। কিন্তু জেলখানায় বসে স্মরণ হতেই শুরু করলাম বুকফাটা অট্টহাসি। প্রাণভরে কতক্ষণ যে হেসেছি তা বলতে পারব না। তবে হাসি আসার পর মনে হলো, আচ্ছা আমিও তো নাকের লোম ছেঁড়ার চেষ্টা করতে পারি। যেমন কথা তেমন কাজ- শুরু করলাম লোম ছেঁড়ার চেষ্টা।
কষ্ট অনুভব করলাম মূল থেকে লোমের শেকড় উচ্ছেদের সময়। মনে পড়ল নিজের রাজনৈতিক শেকড়ের কথা। বাইরের লোক এসে আমাকে ওপর থেকে কেটে ফেললেও মর্মমূল থেকে উচ্ছেদ করতে পারেনি।
জেল জীবনের এমনি অসংখ্য ঘটনার কিছু কিছু বিষয় লেখনীর মাধ্যমে তুলে আনার চেষ্টা করেছি। কিন্তু বাইরের জগতে আসার পর মনে হচ্ছে কিছু বিষয় সম্পাদনা করার প্রয়োজন।
কারণ যেসব তথ্য-উপাত্ত ব্যবহার করেছি তা মিলিয়ে দেখা প্রয়োজন।
ছাড়া পাওয়ার আগের দিন অর্থাৎ ১৫ সেপ্টেম্বর বিকাল থেকেই আমি ভয়ানক উৎকণ্ঠায় থাকলাম। আমার বিরুদ্ধে মোট তিনটি মামলা হয়েছিল। একটি ঢাকায় অন্যটি নির্বাচনী এলাকায়। জঘন্য প্রকৃতির দুটো মামলা।
খুবই ইতর মনমানসিকতাসম্পন্ন না হলে প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এ ধরনের মিথ্যা ও হয়রানিমূলক মামলা কেউ দেয় না। এ দুটি মামলা ছাড়াও আমার শ্বশুর, ভাই ও আত্দীয়স্বজনসহ মোট ৪০-৫০ জনের বিরুদ্ধে একটি ডাকাতির মামলা দেওয়া হয়েছে। তিনটি মামলায় আসামির সংখ্যা প্রায় ২০০ জন। সবাই আওয়ামী লীগের দীর্ঘদিনের পরীক্ষিত নেতা-কর্মী। তাদের অপরাধ তারা সভানেত্রীর মনোনীত প্রার্থীর পক্ষে নির্বাচনী কাজ করছিলেন এবং আগামী দিনেও নেত্রীর নির্দেশ মান্য করবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন।
তারা কোনো এক ব্যক্তির হয়ে দলের বিরুদ্ধে যেতে চাননি বলেই সরকারের শেষ সময়ে ত্রাস হয়রানির শিকার হচ্ছেন। সরকারের ২-৩ জন বিতর্কিত মন্ত্রী, শেয়ার মার্কেট কেলেঙ্কারির নায়ক-মহানায়কেরা, একজন মনোনয়নপ্রত্যাশী সাবেক আওয়ামী লীগ নেতার সিন্ডিকেট সমন্বিতভাবে চেষ্টা-তদবির করে আমার বিরুদ্ধে সব কিছু করে যাচ্ছিলেন। এহেন নোংরামি নেই যে তারা করেননি। মামলা-মোকদ্দমা ছাড়াও তারা টেলিফোনে আমার স্ত্রীকে হুমকি-ধমকিসহ অকথ্য ভাষায় গালাগাল করেছিলেন। কোনো উকিল যাতে আমার মামলা না নেন, কোনো ব্যক্তি যেন আমার সাহায্যে কিছু না করতে পারেন কিংবা আমার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের কর্মচারী-কর্মকর্তারা যেন ঠিকমতো অফিসে আসতে না পারেন সে জন্য হোন্ডা, গুণ্ডা থেকে শুরু করে থানা পুলিশের হয়রানির সর্বোচ্চ নোংরামি তারা করেছেন।
কিন্তু মহান আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে আমি হাইকোর্ট থেকে জামিনলাভ করি। হাইকোর্টের রায় পাওয়ার পরও আমাকে বেশ কয়েক দিন জেল খাটতে হয় আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে। নির্বাচনী এলাকার মামলাগুলোর জন্য বেলবন্ড ক্লিয়ারেন্স আনার দরকার ছিল পটুয়াখালী থেকে। এ জন্য অতিরিক্ত ৩-৪ দিন সময় লাগে।
এক অসহনীয় বেদনা আর উৎকণ্ঠায় শেষের কয়েক দিন কাটাতে থাকলাম।
জেলের ভেতরের প্রতিবেশী আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমান সব সময়ই আমার মুক্তির ব্যাপারে ইতিবাচক বক্তব্য দিয়ে আমাকে চাঙ্গা রাখতেন। মীর কাসেম আলী এবং এ টি এম আজহার সাহেব তাতে সমর্থন দিতেন। কিন্তু আমার জেলখানার নব্য বন্ধু গিয়াস উদ্দিন আল মামুন তার দীর্ঘদিনের তিক্ত অভিজ্ঞতার কারণে ভিন্নমত পোষণ করতেন। এখানে বলে রাখা উচিত, মামুন ও আমি সমবয়সী। যদিও আমাদের পূর্ব পরিচয় ছিল না।
কিন্তু জেলখানার নিদারুণ পরিবেশে সে যে বন্ধুত্বের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল সম্পূর্ণ নিঃস্বার্থভাবে তা প্রকাশ না করলে আমি হয়তো বিবেকের কাছে অপরাধী থেকে যাব। যা হোক, এই প্রথমবার আমার জেলবন্ধু মামুন আমার মুক্তির ব্যাপারে অন্য সবার সঙ্গে সহমত প্রকাশ করলেন। কিন্তু তাতেও আমার শংকা দূর হলো না। কারণ আমার প্রতিপক্ষদের নোংরামি এবং নীচুতা সম্পর্কে এই কয়েক দিনে আমার মোটামুটি ধারণা জন্ম দিয়েছিল।
জেলসুপার জাহাঙ্গীর, জেলার সুভাস অন্তর থেকে চাইত আমি তাড়াতাড়ি মুক্তি পাই।
তারা সব সময় আমার খোঁজখবর রাখত এবং সাধ্যমতো চেষ্টা করত আমার কষ্টগুলো লাঘব করার। অন্যদিকে মহিলা জেলের প্রধান আলতাফ যে কিনা সম্প্রতি ডিআইজি প্রিজন পদে পদোন্নতি পেয়েছে, সে সম্পর্কে আমার ভাগিনা হয়ে গেল। আমার এক ভাগিনার ঘনিষ্ঠ বন্ধু হিসেবে আলতাফ এই বিপদের দিনে যেভাবে আমার স্ত্রী ও সন্তানদের পাশে দাঁড়িয়েছে তা বর্তমান যুগে বিরল। অন্যদিকে সুভাষ ও জাহাঙ্গীরের ঋণও শোধ করার মতো নয়। আমার এই মনোকষ্টের মুহূর্তে সন্ধ্যার ঠিক পরপরই জেলার সুভাষ আমার রুমে এসে বলল, শাহবাগ থানার মামলার জামিনের কাগজ জেল গেটে চলে এসেছে।
পটুয়াখালীরটা সকালের মধ্যে চলে আসবে। সেখানকার জেলারের সঙ্গে নাকি সুভাষের কথা হয়েছে। সব কিছু ঠিকঠাক আছে। সে আমাকে আমার মালপত্র গোছানোর পরামর্শ দিয়ে উঠতে যাচ্ছিল। আমি ওকে বসিয়ে আদর করে এককাপ কফি খাওয়ালাম।
জেলের কর্তাব্যক্তিরা সবাই বিভিন্ন সম্পর্কে আমার নিকটতম পরিচিতজন হওয়ার কারণে তাদের তুমি বলে সম্বোধন করতাম। যা হোক, সুভাষ চলে যাওয়ার পর আমার মধ্যে শুরু হলো হাসি, আনন্দ আর বেদনামিশ্রিত এক উত্থাল-পাতাল ঢেউ। নানা কথা মনে হতে থাকল। সারাটা রাত ঘুমাতে পারলাম না। আমার সেবক মিজানও সারা রাত ঘুমাল না।
সে শুধু ক্ষণে ক্ষণে উঠে নামাজ পড়ছে আর আমার জন্য চিৎকার করে কাঁদছে। একবার বলছেম হে আল্লাহ আমার স্যারকে মুক্ত কর। আবার বলছে, স্যারকে ছাড়া থাকব কীভাবে। ওর কান্না শুনে আমিও ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকলাম।
রাতে শুয়ে শুয়ে ছাইপাশ নানা রকম আবোল-তাবোল কল্পনা করতে থাকলাম।
নিজের ত্রুটিগুলো স্মরণ করতে থাকলাম। মনে হলো, গত ২৮ বছরে স্ত্রীকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। কেবল মজা করার জন্য অনেক বিরক্তিকর কথা বলেছি। আমার এই দুঃসময়ে স্ত্রী ছাড়া আর কেউ তো ওভাবে এগিয়ে এলো না। কাজেই জীবনে আর তাকে কষ্ট দেব না বলে প্রতিজ্ঞা করলাম।
সন্তান-সন্ততি, সহকর্মী, বন্ধুবান্ধবসহ অনেকের কথা মনে হলো। কারও কারও প্রতি কৃতজ্ঞতা বেড়ে গেল। মনো হলো বের হয়ে সবার মন জুগিয়ে চলব। কোনো অবস্থাতেই কারও সঙ্গে কটু কথা বলব না। এসব ভাবতে ভাবতেই ভোর হয়ে গেল।
বেশির ভাগ মালসামানা রাতেই গোছানো হয়ে গিয়েছিল। বাকিটা সকালে গোছানো হলো। এর পর সেইভ, গোসল সেরে ভালো জামাকাপড় পরে নাস্তার টেবিলে গেলাম।
সেদিন সকালে সবাই আমাকে আদর-যত্ন করে খাওয়াল। আমার মুক্তির আনন্দে সবাই খুশি।
অন্যদিকে নিজেদের বন্দিত্বে তারা ছিল যুগপৎ দুঃখিত ও হতাশ। সবাই আমাকে শুভেচ্ছা জানালেন এবং নানা রকম উপদেশ দিলেন। সবার সঙ্গে কোলাকুলি করে বিদায় নিতে গিয়ে এক ধরনের নষ্টালজিয়ার মধ্যে পড়ে গেলাম। বিশেষ করে মাহমুদ ভাইয়ের সকরুণ হাসি ভুলবার নয়। কট্টর সরকার সমালোচক ও কঠিন হৃদয় মাহমুদুর রহমানকে দেখেছি সমানভাবে বিএনপির সমালোচনা করতে।
অন্যদিকে তার মধ্যে শিশুর মতো কতিপয় সরলতা এবং একই সঙ্গে পাণ্ডিত্য যে কাউকেই মুগ্ধ করবে বলে আমার বিশ্বাস। একদিন প্রশ্ন করেছিলাম, আচ্ছা আপনাকে যদি কোনো দিন প্রধানমন্ত্রী ফোন করতেন তবে কি করতেন? তিনি উত্তর দিয়েছিলেন- রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ সম্মানীত ব্যক্তিকে যেভাবে সম্মান ও সৌজন্য দেখাতে হয় আমি সেটিই করতাম।
ইতোমধ্যে সুবেদার সাহেব আমার মুক্তির পয়গাম নিয়ে এলেন। আমার মালপত্র সব গাড়িতে তোলা হলো। সেবকরা সব নিচে নেমে হাতে হাতে সব কিছু করল।
আমার জেলবন্ধু মামুন দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সব তদারক করল। আমি তার কাছ থেকে বিদায় নেওয়ার জন্য হাত বাড়ালাম। সে বলল, চলুন গেট পর্যন্ত এগিয়ে দেই। গেট পর্যন্ত এগিয়ে আসার পর সে আমাকে জড়িয়ে ধরল এবং শুভাশিস জানাতে গিয়ে বাকরুদ্ধ হয়ে পড়ল। আমি তার দিকে তাকালাম না।
মনে হলো অনেক দিন পর অশ্রু বাঁধ ভেঙেছে। আমিও স্মরণ করতে থাকলাম তার দুঃখের কাহিনীগুলো, যা গত সাত বছরে তার জীবনে ঘটেছে এবং গত কয়েক দিনে সে যা আমাকে বলেছে। বিদায় নিয়ে নতমুখে জেল অফিসের দিকে রওনা দিলাম।
সিনিয়র জেলসুপার জাহাঙ্গীরের রুমে আমার স্ত্রী ও সন্তানরা অপেক্ষা করছিল। কিসের যেন একটা আতঙ্ক তাদের সবাইকে তাড়া করছিল।
জেলসুপার আমাকে তাড়াতাড়ি কাগজপত্র স্বাক্ষর করে চলে যেতে বললেন। আমি তাদের শংকার কারণ অনুভব করতে পারলাম। জেলের ফরমালিটিস সেরে দ্রুত জেলগেট পার হয়ে মুক্ত বাতাসে এসে দাঁড়ালাম। প্রাণভরে নিঃশ্বাস নিয়ে মহান আল্লাহপাকের শোকরিয়া আদায় করে ধীরে ধীরে গাড়ির দিকে এগুলাম। সাংবাদিকরা সব ঘিরে ধরল।
আমি সংক্ষেপে প্রতিক্রিয়া জানিয়ে গাড়িতে চড়ে বসলাম। গাড়ি ঢাকার পানে ছুটে চলল।
গাড়িতে বসার পর স্ত্রী, কন্যা ও ছেলেদের দিকে তাকালাম। সবার মুখে তখনো আবেগ ও উৎকণ্ঠা। তারা ভয় করছিল জেলগেটে আমি আবার গ্রেফতার হতে পারি এবং বিভিন্ন মহল থেকে তাদের সেভাবেই হুমকি দেওয়া হচ্ছিল।
আমার অবশ্য সেদিকে খেয়াল ছিল না। আমি ভালো করে আকাশ দেখতে থাকলাম। রাস্তার দুই পাশের বাড়িঘর, গাছপালা, ফসলের মাঠ-ঘাট, বিচরণশীল গবাদিপশু এবং বিভিন্ন রকম পাখি ওড়ার দৃশ্য দেখে আমার নয়ন জুড়িয়ে গেল। এবার আমি গাড়ির মধ্যে দৃষ্টি নিবন্ধন করলাম। ভালো করে তাকিয়ে দেখলাম তারা অনেক শুকিয়ে গেছে।
মনে হলো গায়ের রং কালো হয়ে গেছে। চোখে-মুখে ভীতি, অপমান আর লাঞ্ছনার প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠেছে। মনে হলো সন্তানদের গালে হাত বুলিয়ে দেই। কিংবা স্ত্রীর হাতটি চেপে ধরি। কিন্তু কিসের যেন একটি বাধা আমার মধ্যে কাজ করছে।
পাশ ফিরে তাকিয়ে দেখি স্ত্রী কাঁদছে। কারও কান্না দেখলে আমি ভীষণ রকম বিব্রতবোধ করি। আমারও তখন কান্না পেয়ে বসে। স্ত্রী আমার গাঁ ঘেঁষে বসেছিল। কিন্তু অন্য সময়ের মতো তার সানি্নধ্য আমাকে স্বস্তি দিল না।
মনে হলো আমাদের উভয়ের মধ্যে যেন কাশিমপুর কারাগারের দেয়ালটি বাধা হয়ে আছে। কারা প্রকোস্টের লোহার মোটা মোটা শিকগুলো যেন প্রাণপণ চেষ্টা করছে আমাদের মধ্যে দূরত্ব সৃষ্টির জন্য।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।