আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

“টনটিং, গসেপিং ও লাদেন স্মৃতিকথা – ০১”



অবসরে স্মৃতি্র জানালা খোলে। আজ এই সামান্য অবসরে ঘরের পুরো খোলা জানালার সামনে, খাটে বসে বালিসে খাতা রেখে কিছু স্মৃতিকথা লিখতে যেয়ে তা টের পাচ্ছি। খোলা জানালা দিয়ে আলো আর হাওয়া যে ভাবে হু হু করে বিনা বাঁধায় ঘরে এসে পড়ছে, তেমনি হাজারো মধুর টক, মিষ্টি, ঝাল স্মৃতিগুলো স্মৃতিপটে ভেসে ভেসে উঠছে। আমি লেখার কারিগর নই। কোন শব্দের পর কোন শব্দ দিয়ে মালা গাঁথলে একটি চমতকার কথার মালা তৈরী হয়, তা আমার অনায়ত্ত।

সূর্য যেভাবে পুরো একটা দিনের জমানো স্মৃতি তার বুকে ধারন করে ডুবে যাওয়ার আগে পশ্চিম আকাশে লাল আভায় ছড়িয়ে দেয়, ঠিক আমিও চেষ্টা করব আমার বুকে জমে থাকা অসংখ্য স্মৃতির মাঝে কিছু স্মৃতি আপনাদের কাছে ছড়িয়ে দিতে। পার্থক্য এতটুকুই, ছড়ানো স্মৃতিগুলোতে রঙ দিতে আমি অপারগ। রাতের আকাশের লক্ষ-কোটি তারার মাঝে কিছু তারা থাকে যা সব সময় অতি উজ্জল ভাবে দেখা দেয়। মানুষের স্মৃতিগুলোর মাঝে স্কুল জীবনের স্মৃতিগুলোও তাই। আর স্কুল জীবনের স্মৃতিগুলোও কী নেহায়েত কম।

ওপস . . . এই দেখুন স্কুলের অধ্যায়ে প্রবেশ করতেই কত্ত কত্ত স্কুল স্মৃতির অনুচ্ছেদ। কোনটা ছেড়ে কোনটা লিখি বলুনতো। আচ্ছা শুরু যখন করতেই হবে তখন আমার স্কুল জীবনের এক স্যারকে দিয়েই শুরু করি। আমার বিদ্যালয় জীবন কেটেছে “রাজশাহী ক্যান্টনমেন্ট বোর্ড উচ্চ বিদ্যালয়ে”। ক্যান্টনমেন্ট গুলোতে সাধারনত দুটো করে স্কুল থাকে।

একটি ক্যান-পাবলিক আর অপরটি ক্যান-বোর্ড। আমি যখন পড়তাম তখন রাজশাহী ক্যান্টনমেন্টে একটি স্কুলই ছিল। এই স্কুলে সেনাবাহিনীর ছেলে-মেয়েরা পড়ত আবার আমরা বাইরের ছেলে-মেয়েরাও পড়তাম। অবশ্য ছেলে আর মেয়েদের ক্লাস হত আলাদা। ক্যান্টনমেন্ট স্কুল, ব্যাপক বাঁধা-ধরা নিয়ম।

যেখানে কথায় কথায় টিসি (ট্রান্সফার সার্টিফিকেট) টাইপ করা হয়। তারপরও আমাদের দুষ্টামির নজির কম ছিল না। এমনই স্কুলের একজন সহজ সরল স্যার ছিলেন … আমি নামটা বলতে চাচ্ছি না। স্যার তো স্যারই তাই নয় কী। তাই তাঁকে স্যার বলেই সম্বোধন করলাম।

আমরা প্রত্যেক স্যারের একটা করে উদ্ভট নাম দিতাম। এই যেমন আমরা একটা স্যারের নাম দিয়েছিলাম “ভল্লুক”। কিন্তু এই স্যারকে নিয়ে আমরা এতটাই দুষ্টামিতে মেতে থাকতাম যে স্যারকে কোন নামই দেয়া হয়ে উঠেছিল না। আমরা দুষ্টামি করলে স্যার বলত, “টনটিং কোর না, গসেপিং কোর না। আমি কিন্তু হেড স্যারকে বলে দেব।

” ব্যাস, এতটুকুই। আর মাত্রা চরমে উঠলে, আমাদের সামনে বেত নিয়ে ঝাঁকাতেন, ভয় দেখানোর চেষ্টা করতেন। কিন্তু আমারা কী আর ঐ বেতকে ভয় পাই। ছোট বেলা থেকেই স্কুলের প্রত্যেকটা ছেলে বড় হয়েছে ঐ বেতেই বাড়ি খেয়েই। স্যার এর প্রতি আমাদের প্রধান আকর্ষন ছিল স্যারের পোষাক।

প্রত্যেকদিন আমরা গুনে গুনে দেখতাম স্যার কয়টি পোষাক পড়েছেন। একটু ঠান্ডা বাড়লেই স্যারের পোষাকের পরিমান দ্বিগুন হারে বাড়ত। স্যারকে আমরা একসঙ্গে পাঁচটি পোষাক পড়তে দেখেছি। প্রথমে গোল গলা গেঞ্জি তারপর কলার গেঞ্জি তারওপর শার্ট তার ওপর সোয়েটার তারপর কোর্ট। গোনার সময় কেউ কেউ আবার ভেতরের না দেখতে পাওয়া সেন্ডুগেঞ্জিটাও বাদ দিত না।

স্যার এতটাই সাধারন ছিলেন যে আমরা পুরো স্কুল জীবনটাই স্যারকে ঐ একই সোয়েটার আর কোর্ট পড়তে দেখেছি। স্যারকে একবার কিছুদিনের জন্য আমাদের ক্লাসটিচারের দায়িত্ব নিতে হয়েছিল। আর তখন ক্লাসের সবার শুরু হয়েছিল গণ পেট ব্যাথা আর ডায়েরিয়া। দুপুরে টিভিতে সিরিয়াল “শক্তিমান” আর আমাদের ক্লাসটিচার “স্যার”। আর যাবে কোথায়।

কোন মতে দুটো ক্লাস করেই শুরু হত ছুটির দরখাস্ত লেখা। লেখা শেষ হওয়া মাত্রই শুরু হত প্রচন্ড পেট ব্যাথা। আহ! কী ভীষণ পেট ব্যাথা আর ডায়েরিয়া। চোখ-মুখ খিঁচিয়ে পেট টিপে ধরে অন্য হাতে দরখাস্ত নিয়ে স্যার এর সামনে উপস্থিত হতে পারলেই হয়। ব্যাস কেল্লাফতে।

স্কুলের গেটটা পেরলেই আর কোথায় পেট ব্যাথা!!? গঙ্গাধার হয়ে যেত শক্তিমান। একদিন স্যার ক্লাস নিচ্ছেন। আমরা যে যার মত গল্প করছি। ক্লাসের যারা মাঝি-মাল্লা অর্থাৎ ভাল ছাত্ররা মনযোগ দিয়ে ক্লাস করছে। হঠাত দুম করে বিকট আওয়াজ।

কোন এক ছেলে ক্লাসেই “পটকা” (বাজি) ফুটাইছে। স্যার ধড়মড়িয়ে, “কী হল, কী হল?” এক ছেলে দুষ্টামি করে বলে ফেলল, “স্যার লাদেন স্কুলে হামলা করেছে। ” আর যায় কোথায়। স্যার সত্যি সত্যি বিশ্বাস করে ছুটে গেলেন হেড স্যারের কাছে। গিয়ে বললেন, “স্যার লাদেন আমাদের স্কুলে হামলা করেছে।

” পুরো ক্লাস টিসি হওয়ার কথা। কেন যে হয়নি তা ভাবলে আজও অবাক লাগে। পরীক্ষার মূল ফলাফলের আগে আমাদের প্রতিটি বিষয়ের ফলাফল আলাদা আলাদা ভাবে দেয়া হত। আর যে স্যার যে বিষয় পড়াতেন সে স্যার সে বিষয়ের পরীক্ষার খাতা মার্কিং করার পরে বাড়ীতে দেখানোর জন্য এক দিনের জন্য দিতেন। বাড়িতে খাতা দেখিয়ে অভিভাবকের সই নিয়ে আবার সেই স্যারের কাছে জমা দিতে হত।

এই স্যার এর বিষয়ের খাতার ফাঁকা জায়গায় ছেলেরা আবার নতুন করে লিখত। আর স্যারকে বলত, “স্যার এইটাতে নম্বর দেয়া হয়নি”। স্যার সহজ সরল মানুষ। নম্বর দিয়ে যোগ করে দিতেন। একদিন দেখা গেল এই কাজ (অকাজ) করে এক ছাত্রের প্রাপ্ত নম্বর মোট নম্বরের চেয়ে বেশি হয়ে গেছে।

স্যার আর কিছুতেই হিসেব মেলাতে পারছেন না। স্যার বার বার গুনেন, আবার গুনেন। কিন্তু নাহ, প্রাপ্ত নম্বর মোট নম্বরের চেয়ে বেশি। অবশেষে আমরা স্যারকে বললাম, “স্যার ও মনে হয় বিকল্প প্রশ্নগুলোরও উত্তর দিয়েছে। তাই নম্বর বেশি হচ্ছে।

” স্যার বললেন, “ও হ্যা তাই হবে। না হলে তো এমন হবার কথা নয়। এই তোমরা টনটিং কোর না, গসেপিং কোর না । বস , বস। ” স্যার একবার আমাদের কৃষি ক্লাস নিয়েছিলেন।

কৃষি ক্লাসের ব্যাবহারিক ছিল। ব্যাবহারিক পরীক্ষায় সবাইকে টবে করে নিজ হাতে লাগানো বিভিন্ন প্রকার চারা-গাছ নিয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কে নিয়ে যায় গাছ? অধিকাংশ ছেলে দেখিয়েছিল স্কুলের টবের গাছ। তাও আবার একই গাছ অনেকে। তিন তলায় স্কুলের হল রুম।

হল রুমেই ছিল আমাদের ক্লাস। একবার স্যার ক্লাস টেস্ট নেবার জন্য সাদা খাতা নিয়ে এসেছেন। রেখেছেন টেবিলের উপরে। ব্ল্যাকবোর্ডে প্রশ্ন লিখবেন বলে পেছনে ফিরে বোর্ড মুছলেন। এবার সবার মাঝে খাতা বিতরন করতে যেয়ে দেখেন একটি খাতাও নেই।

কয়েকজন ছেলে খাতা গায়েব করে দিয়েছে। স্যার জিজ্ঞেস করলেন, “কী ব্যাপার খাতা কই?” ছেলেরা বলল, “জানি না স্যার, মনে হয় গায়েব হয়ে গেছে। ” স্যার তো রেগে আগুন। স্যারকে আর কখনো এমন রাগতে দেখিনি। স্যার বললেন, “সবার ব্যাগ চেক করব।

” চেক করেও কিছু পাওয়া গেল না। যাবে কী ভাবে। সব খাতা তো ভাগ ভাগ করে অনেকের একেবারে প্যান্টের ভেতর। খাতা না পেয়ে স্যার গেলেন হেড স্যারকে ডাকতে। হেড স্যারকে ডেকে নিয়ে এসে স্যারতো একেবারে থ! ।

সমস্ত খাতা আবার টেবিলের উপরেই রয়েছে। সে বারও যে কী ভাবে সবাই বেঁচে গিয়েছিলাম তা ভাবলে আজও অবাক লাগে। স্যারের নিষ্পাম কোমল মুখখানি চোখের সামনে বার বার ভেসে উঠছে। একটি পরিবারের সবাই কড়া হলে সে পরিবারে টেকা যায় না। সে পরিবারে কেউ না কেউ একজন অনেক কোমল থাকে, যে সবাইকে আগলে রাখে নিজের বুকে।

আমাদের রুক্ষ কঠিন নিয়মে বাঁধা স্কুলে স্যার ছিলেন তেমন একজন নরম হৃদয়ের অভিভাবক। যিনি আমাদের আগলে রেখেছিলেন তাঁর ভালবাসা দিয়ে। তিনি আমাদের কাছ থেকে পেয়েছিলেন শুধুই দুষ্টামি, বিনিময়ে আমাদেরকে দিয়েছিলেন এক অভয়ারন্য। এমনি আরো কত স্মৃতি লাইন নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, একের পর এক। এক লিখায় কী তা শেষ করা সম্ভব।

সূর্যের আলো ডুব দিয়েছে আঁধারে অনেকক্ষন হল। ঘরে এখন বৈদ্যুতিক আলো জ্বলছে। আকাশে তারাদের মেলা। ঐ একটি তারা, ঐ আরেকটি, হাজারো তারা তাকিয়ে আছে। আজ এই রাতে আকাশে চাঁদ উঠবে কী না আমার জানা নেই।

চাঁদ বিহীন হাজারো তারার আকাশ, মন্দ কী? ……………. (চলবে)

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।