ডিসক্লেইমারঃ লেখকের ক্যামেরা প্রাগৈতিহাসিক এবং তার ছবিতোলার হাত সেইরকম হওয়ায় এই লেখায় কোন ছবি থাকবে না। দুই একটা ছবি থাকতে পারে ডেমোনেস্ট্রেশনের জন্য যার বাস্তবের সাথে কোন মিল নেই। বাস্তবের পর্বতেরা কোটিগুণ সুন্দর।
একটা মেগাসিটিতে থাকি আরেকটাতে অর্ধেক জীবন কাটায়ে আসছি, উঁচু বিল্ডিং মনুমেন্ট দেখছি। ঢাকায় বাংলাদেশ ব্যাঙ্কের তিরিশ তলা উঁচু বিল্ডিং দেখেছি, টরন্টোর স্কাই ক্র্যাপার, এমন কি এক সময়ের মানুষের তৈরী উঁচুতম দালান সিএন টাওয়ারও দেখা হয়েছে, হচ্ছে।
সেইসব উঁচু বিল্ডিং সব জুড়ে দিলেও এই পর্বতের সমান হবে না। এরকম কিছু আমি বাস্তবে কেন, স্বপ্নেও দেখি নাই। অনুভূতির কোথাও লুকিয়ে থাকলেও থাকতে পারে। দৈর্ঘ্যে প্রস্থে উচ্চতা, গভীরতায়, অপ্রতিসমতায় কোনভাবেই কিছুর সাথে তুলনা আমি এই পর্বতের তুলনা করতে পারছিলাম না। ফেরার পথে অবশ্য এই পর্বতকেই রীতিমত টিলার মত লাগছিল!!!
দূরের ঘনায়মান গাঢ়মেঘরঙা পর্বতেরা এরপর বিরতিহীন ভাবে আসতেই থাকলো।
আরো অনেক উঁচু আরো বিশাল। দুটো পর্বতের উপত্যকার ফাঁকা দিয়ে যতদূর চোখ যায় ঢেউয়ের মত অসংখ্য পর্বত। এরা এতোই উঁচু আর বিশাল যে সরাসরি উপরের দিকে না তাকালে আকাশ আর দেখতে পাচ্ছিলাম না। এক একটা পর্বত যেন বুকের ভেতর মন্দ্রসপ্তকের এক একটা স্বর চেপে যাচ্ছিল। শব্দতর সেই পর্বতের গান অনুভূতিকে গ্রাস করে গলার কাছে কেমন যেন ডেলা পাকাচ্ছিল।
এই অপার্থিব সৌন্দর্য দেখে আমার ফুঁপিয়ে কাঁদতে ইচ্ছা করছিল। বাংলাদেশের মানুষ। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য বলতে ঝকঝকে সবুজ বুঝি, নীল আকাশ বুঝি, আমাদের সোন্দর্যের ব্যকরণ বইতে এমনকি মাটির রঙও রাঙ্গা। এই চেতনা গ্রাস কারী রুক্ষ, ধূসর, পরিচিত আকাশ ঢাকা সৌন্দর্যের নাম আমি জানি না। যথারীতি এখানের মেঘহীন আকাশের রঙও অপার্থিব নীল।
কিন্তু জীবনের এই প্রথমবার আমি আকাশের এই নীল রঙ উপেক্ষা করে পর্বতদের অন্তস্থ করতে লাগলাম।
চিন্তার অতীত কোন প্রাচীণকালে এই পর্বতগুলো তৈরী হয়েছিল, আরো অনিদির্ষ্ট কাল থাকার প্রতিজ্ঞা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে তো আছে। দেখলেই কেমন জানি নিজেকে খুব ক্ষুদ্র, তুচ্ছ, নশ্বর মনে হতে লাগলো। পর্বতদের কি আসলেই জয় করা যায়? চট্টগ্রাম যাওয়ার পথে চন্দ্রনাথ পাহাড় দেখে একটা পর্বতের চূড়ায় বাড়ি বানানোর খুব শখ হয়েছিল। এতো বিশাল বিশাল পর্বত দেখে হঠাৎ মনে হল পর্বতদের আমার করার দরকার আমার নাই।
আমাকে এদের করে নিলেই আমার জীবন ধন্য।
দেখতে দেখতে ব্যানফ ন্যশনাল পার্কের ঢুকার মুখের কাছাকাছি চলে আসলাম। বিশাল লম্বা গাড়ির লাইন ৫ মিনিটে একফুট করে আগাচ্ছে। সামনে একটা কনভারটিবলে দুইজন ভদ্রলোক খুব করুন মুখ করে বসে আছে। গাড়ির নেইমপ্লেটে লেখা পান্নু।
আমার ড্রাইভার কাম জামাই কাজের অভাবে পান্নুরে পান্নুরে বলে নিজের অজান্তে স্বরচিত গান গাওয়া শুরু করলো। গাড়ির জানালা খোলা। আমি যতই চোখের ইশারা করে বলি গান থামাতে ভদ্রলোক ততোই না বুঝে আরো দরদ দিয়ে গায়। একটু পর সামনের দুঃখী ভদ্রলোকদ্বয় বিরক্ত হয়ে গাড়ির ছাদ লাগায়ে দিল! আস্তে আস্তে অবশেষে গেটের কাছে আসলাম ও পার্কে ঢুকার টিকেট কিনতে পারলাম।
টিকেটের দাম দেখেই ভাব্লাম শুধু শুধু ছিল দিতেছে।
পরে অবশ্য এই ভুল ধারণা ভেঙ্গেছে। একেবারে দুর্গম জায়গায় যেইখানে মোবাইল নেটওয়ার্ক নাই, গারবেজ বিন নাই সেই খানেও খান দুয়েক পার্কিং লট আর একটা স্যানাটারী হলেও টয়লেট বানায়ে রেখেছে। টয়লেট ও সেইরকম কাঠের লগের সুদৃশ্য বাড়ির মত। আমি একবার ভুলে ছবি তুলতে গেছিলাম আরেকবার খাবার কিনতে! আসলে ঘটনা হল পার্ক শুনলেই আমার রমনা পার্কের আয়তনের কিছু একটা মনে হয়। ব্যানফ জ্যাস্পার ন্যাশনাল পার্কের মোট আয়তন ১৭,৫১৯ বর্গ কিমি।
তুলনার জন্য বলা যায়ঃ গোটা বাংলাদেশের আট ভাগের একভাগ প্রায়!
যাই হোক, আমাদের কানাডিয়ান রকির আনুষ্ঠানিক পর্যটনিক যাত্রা শুরু হল মিনেওয়াঙ্কা হৃদ দিয়ে। এতোক্ষণ হাইওয়েতে দূর থেকে পর্বত দেখে আহা উহু করেছি। এইবার ধীরে সুস্থে পর্বতের মধ্যে দিয়ে পথে পাড়ি জমালাম। ধীরে সুস্থে কথাটা একেবারে আক্ষরিক অর্থেই। আঁকাবাঁকা সরু পথ।
এতো বাঁকের কারনে খালি ভয়ে থাকতে হয় অন্যপাশ দিয়ে গাড়ি আসে কিনা। গাড়ি আসতে দেখলে যে ওস্তাদ ডাইনে চাইপা বলে টেম্পো কন্ডাক্টরের মত হাঁক দিবো সেই উপায় নাই। মাঝে মাঝেই পাশে খাড়া খাদ। সেইখানে আবার এক্সট্রা খাতির হিসেবে বেতের মত সোজা সোজা পাইন গাছ। যাই হোক পৌছালাম মিনেওয়াঙ্কা হৃদের পার্কিং লটে।
পার্কিং লটের পাশে খুব অনায়াসে খান দুয়েক পর্বত। ছবিতুলার চেষ্টা করে দেখলাম আমার মাথা আসলে তেনারা আসেন না,তেনারা আসলে আমি বাদ পরে যাই। তেনাদের আনতে যে ক্যামেরা প্রায় উল্টায়ে ধরতে হয়। পার্কিং করতে গেলে আরেক মজা! পার্কিঙ্গের পরেও গাড়ি পিছায়ে আসে ঢালের কারণে।
লেক মিনেওয়াঙ্কা দেখেই বুঝলাম ফটোশপ।
নাহলে পানি এতো নীল কেনো? একটা পর্বততো একদম পারফেক্ট জায়গায় ফিট করা। আমাদের পাশে হাল্কা জঙ্গুলে জায়গা। মানে পুরাই ফটোশপ। পরে অবশ্য বুঝছি ব্যানফ জ্যাস্পারের ফটোশপ স্কেলে মিনেওয়াঙ্কা চান্দে সাইদীর (সাইদীর নামের আগে মতিকন্ঠ প্রণিত বিশেষণ গুলা মনে করতে ভুলবেন না যেন) মত।
মানুষজন বোটে চড়ার জন্য লাইন ধরে দাঁড়ায়ে আছে।
আমরা সময় স্বল্পতা ও পেটের খালিত্ব চিন্তা করে দেখলাম আরো ডজনখানেক লেক দেখার কথা আছে। সেইসব কোন একটাতে বোট রাইড নিবোনে। সত্যি কথা হল রকি মাউন্টেন দেখতে এসে নৌকা চড়ার মানে হয় না। এখানকার লেইক গুলো এতো সুন্দর যে নৌকা চালানোর মত কিছুতে সময় নষ্ট না করে পাড়ে বসে হা করে সৌন্দর্য্য দেখা বেশি লাভের। আমরা বুদ্ধিমান দম্পতি।
পাড়ে বসে উলটাদিকের পর্বতের দিকে তাকায়ে থাকলাম। থাকতে থাক্তেই একটা জরুরী জিনিস বুঝলাম। আসার পথে পর্বতের গায়ে কালচে সবুজ ঘাস দেখে বড় অবাক হয়েছিলাম। ঘাস তো সারাজীবন ফ্লোরোসেন্ট সবুজই দেখে আসছি। যেইসব কে আমি ঘাস ভাবছি সেইগুলা আসলে পাইন গাছ এবং এই পাইন গাছের উচ্চতা ৫০ ফিটের মত হয়।
পর্বতের নাম মাউন্ট আইলমের। পর্বতের নিচের দিকে ত্রিভুজ আকারের গাঢ় সবুজ পাইন গাছের চাদর। উপরের দিকে রুক্ষ,ধূসর। চূড়া একেবারে নাঙ্গা। আরো ভালো মত তাকিয়ে দেখি একটা ভীষণ সরু পাইন গাছের লাইন, তিনকোণা কাঠামোর একটা বাহু ধরে ঠিকই চূড়ার কাছাকাছি চলে গেছে।
পাথুরে পর্বত গুলোকে যদি কিছু জয় করে থাকতে পারে তবে তা এই নাছোড়বান্দা পাইনের সারি। বহু জায়গায় দেখেছি এতো খাড়া ঢালের কারণে একসারি গাছ গোড়া ভেঙ্গে পরে আছে। পরের সারিটা ঠিকই আবার আগানোর পথে। ঘন অবিচ্ছিন্ন গাছের সারির মাঝের অজানা কারনে শুকিয়ে ছাই রঙের হয়ে গেছে। পাথুরে মাটিতে শিকড় গাড়তে না পেরে শ্বাসমূলের মত মাটির উপরে শিকড়ের ছড়াছড়ি।
মিনেওয়াঙ্কার কাছেই টু জ্যাক। সেইখানে বেশ মুভির শুটিং শুটিং আবহাওয়া। চকচকে রোদ। ঝকঝকে নীল পানি। ঝলমলে বুনো ফুল।
মানুষজন পিকনিক মুডে বারবিকিউ করছে। সেখানে গিয়ে আমার জামাই ভদ্রলোক মাথার নিচে স্যান্ডেল দিয়ে শুয়ে আজ আমির কাল ফকির এইরকম চিন্তাভাবনায় মগ্ন হয়ে গেলো। আর আমার পানিতে নেমে মনটা খুব ফুরফরে লাগতে লাগলো।
এই পার্ক যে আসলেই রমনা পার্কের চেয়ে একটু আলাদা সেইটা ধরতে পারলাম খাবার দাবারের কিছু না পেয়ে। সাথে করে নিয়ে আসা কলা আর কোক খেয়ে পেটে কিল দিয়ে রওনা দিলাম মাউন্ট নরকোয়ের উদ্দেশ্যে।
রাস্তার আশে পাশে ৬০ ডিগ্রীতে খাড়া খাড়া পর্বতের ঢাল উঠে গেছে। সেইঢালগুলোতে আবার ৩০ ডিগ্রী কোণে অগুন্তি পাইন গাছ। পথে মাঝে মাঝে এক একটা পর্বত সামনা সামনি এতো কাছে চলে আসে যে বুক ধ্বক করে ওঠে। ভালোমত তাকালে পর্বতের গায়ে ছোট ছোট আঁকা বাঁকা কোণ দেখা যায়। এতো সৌন্দর্্য্য দেখতে দেখতে কেমন শ্বাসরোধ হয়ে আসে।
এখানেই আমার বানফে দেখা একমাত্র ঘাসে ঢাকা পর্বতের দেখা পেলাম। স্কি করে বোধহয়। কালচে সবুজের পাশে চকচকে সবুজ দেখতে কেমন জানি মেকাপ একটু বেশি হয়ে গেছে বলে মনে হল।
পর্বতে উঠার রাস্তা একেবারে সেইরকম। খান ছয়েক জিকজাক মোচড়।
৯০ ডিগ্রী না ১২০ এর মোচড়। এক মোচড় দিয়ে গাড়ি সোজা করতে না করতেই আরেকটা এসে হাজির। রাস্তার পাশে রেলিং নাই। বহু নিচে ব্যানফ শহর হাল্কা পাতলা দেখা যায়। এর মধ্যে আরেক জ্বালাঃ উপরে উঠতেছি আর শ্রবণশক্তি লোপ পাচ্ছে।
আমি বলি দেখো ডানদিকে একটা কালো ভাল্লুক। আর ও বলে আরে নেট ঘেঁটেই তো দ্রাঘিমাংশ অক্ষাংশ বসাইছি। উপযুক্ত শ্রবণশক্তির অভাবে খালি পেট, এক্সট্রা সতর্ক ড্রাইভিং, আমার এক তরফা কথা বলতে বলতে ক্লান্ত হয়ে যাওয়ার মত শক্ত প্রভাবক থাকতেও কোন ঝগড়া দানা পাকাতেই পারলো না। গাড়ি নিয়ে উঠা যায় এমন রাস্তার শেষ পর্যন্ত গিয়ে নিচে তাকিয়ে মনের অজান্তে মুখ দিয়ে বের হয়ে গেলো “খাইছে”। নরকোয়ের একটা ধার সোজা অনেক নিচে নেমে গেছে।
সেখান থেকে ব্যানফ শহরের শুরু। এতো নিচে শহর যে বাড়িঘর আলাদা করে বোঝা যায় না। দেখতে গুগল ম্যাপের মত লাগে। আর পাশাপাশি তাকালে খান দুই তিন পর্বত। এবং আগের দিনে বাংলা সিনেমায় কলাগাছের পাতা আস্তে আস্তে সরায়ে যেমন সুন্দরী নায়িকা মুখ দেখাতো, সেইরকম পর্বতগুলার ফাঁকে ফাঁকে যতদূর চোখ যায় নয়া নয়া পাহাড় পর্বত।
ঘাড় ঘুরায়ে দেখি কিছু পার্বত্য ছাগল বিরসমুখে পাতা চিবাচ্ছে আর এক দংগল উতসাহী পর্যটক প্রায় কোলে উঠে ছবি তুলছে। আমরা যেহেতু “এসো নিজে করিঃ কিভাবে ভ্রমন করবেন” পড়ে গেছি, সেইজন্য দ্রুত গাড়িতে উঠে সিঁদুরে হৃদে রওনা দিলাম।
সিঁদুরে হৃদের পানির রঙ লাল না, নীলও না। এইটাই আমার দেখা একমাত্র লেক এই যাত্রায় যেইটা ফটোশপিং নীল না। পানির রঙ স্বাভাবিক পানির মত।
খুব ভালো মত তাকালে হটাত হটাত লাল আলোর ডোরা দেখা যায়। পাশে ফ্রি মাউন্ট রান্ডল। লেক দেখে খানিকটা সময়ের জন্য পথ হারিয়ে পরে জিপিএসের দেখানো পথে হাজির হলাম ক্যানমোরে আমাদের হোটেলে রামাদা ইনে।
শরীরের ইমার্জেন্সি চার্জ ব্যবহার করে জিনিসপত্র রুমে তুল্লাম। দুজনে কিছুক্ষণ ঠেলাঠেলি করে রুমে খাবার অর্ডার দিলাম।
খেয়ে দেয়ে অনেক কষ্টে দুইকাপ কফি বানালাম। ভদ্রলোক কফির কাপ হাতে ঘুমায়ে পরলো। আর আমি কফি হাতে জানালার পর্দা সরায়ে আমি প্রেমে পড়ে গেলাম। হ্যাঁ, হোটেলের ঠিক পিছনে ছবির মত রেইললাইন। তবে তারো একটু পেছনে পাশাপাশি [url=http://en.wikipedia.org/wiki/Three_Sisters_(Alberta)]তিনচূড়ার ত্রিভগ্নী পর্বত[/url]।
সবচেয়ে উঁচু চূড়াটা মেঘে ঢাকা। মর্ত্যের পৃথিবীর মাটির পর্বতের মাথায় স্বর্গের মেঘের আনাগোনা দেখে আমি বাকি রাতের মত অচল হয়ে রইলাম।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।