২০০১ কিংবা ২০০২ সালের কথা। আমি তখন যুক্তরাজ্যের কার্ডিফ বিশ্ববিদ্যালয়ের আইনের ছাত্র। ক্লাসের ফাঁকে একটু বিরতি পেলেই ছুটে যেতাম বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশেই সিটি সেন্টারে ক্যাপিটাল বুক হাউস নামক একটি পুরনো বইয়ের দোকানে। বইয়ের সঙ্গে আমার সম্পর্ক অনেক পুরনো। ক্যাপিটাল বুক হাউসের শক্ত বাঁধাইয়ের বাদামি ও কালো মলাটযুক্ত বইগুলো আমাকে হাতছানি দিয়ে ডাকত।
যদিও ছাত্র অবস্থায় বই কেনার সামর্থ্য ছিল খুবই সীমিত। তারপরও আমার বাবার পাঠানো আমার হাত খরচের অধিকাংশ কড়ি ব্যয় হতো বই কিনে। ওই বইয়ের দোকানে যাতায়াতের ফলে কালক্রমে বই দোকানির সঙ্গে পরিচয় ও সখ্য গড়ে ওঠে। বই দোকানি একজন প্রৌঢ়া পূর্ব ইউরোপীয়, সম্ভবত চেক কিংবা পোলিস দেশীয় হবেন। নাম ত্রেস্তা, পোশাকি নামটি হয়তো আরও বড় ছিল, কিন্তু এই মুহূর্তে সেটি মনে পড়ছে না।
হাড়-কাঁপানো শীতের এক ক্রিসমাসে তার কাছ থেকে সুন্দর র্যাপিং করা কাগজে মোড়া একটি বই উপহার পেলাম। ত্রেস্তা আমাকে বলল_ "উপহারটি এবারকার ক্রিসমাসে তোমার জন্য হবে একটি শ্রেষ্ঠ উপহার"। বিশ্ববিদ্যালয়ের ডর্মে এসে র্যাপিং পেপারের মোড়ক খুলতেই দেখলাম বাদামি রঙের শক্ত বাঁধাইয়ে অ্যালিস মুনরোর 'ড্যান্স অব দ্য হ্যাপি শেডস' নামের ছোটগল্পের একটি পুরনো বই। আজ বলতে দ্বিধা নেই, এর আগে অ্যালিস মুনরোর নাম আমি আগে কখনো শুনিনি। সে রাতেই বুকে বালিশ চেপে পড়লাম তার একটি ছোট গল্প, নাম রেড ড্রেস বাংলায় যার অর্থ 'লাল জামা'।
আমাকে স্বীকার করতেই হয়, গল্পটি ছিল এককথায় অসাধারণ। তার গল্প প্রসঙ্গে পরে আসছি, এখন একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে যাই।
আমরা যারা সাহিত্যের সঙ্গে কিঞ্চিৎ যোগাযোগ রাখি তাদের জন্য প্রতি বছর সাহিত্যে নোবেল কে পাচ্ছেন এ নিয়ে বেশ খানিকটা উত্তেজনা দেখা দেয়। এ বছর আমি ধারণা করেছিলাম নোবেল পুরস্কারটি সম্ভবত জাপানের হারুকি মুরাকামির হাতে যাবে। কারণ বর্তমান বিশ্বের অন্যতম জনপ্রিয় লেখক হারুকি মুরাকামি।
যার নতুন কোনো বই প্রকাশিত হলেই টোকিও কিংবা নিউইয়র্কের মতো জায়গাগুলোতে বইপাগল মানুষ ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থেকে তার বই কিনে। আমি নিজেও তার লেখার অসম্ভব একজন ভক্ত। মুরাকামির 'মাই পুওর আন্টস' গল্পটি পড়ে আমার মধ্যে এক প্রকার ঘোর তৈরি হয়েছিল। এ রকম আঙ্গিকে ও রচনাশৈলীতেও যে গল্প লেখা যায় সেটি একমাত্র হারুকি মুরাকামির হাতেই সম্ভব। জনপ্রিয়তার তালিকায় আরও ছিলেন আমেরিকান সাহিত্যিক ফিলিপ রথ, কিংবা জয়েস ক্যাবল ওটস।
কিন্তু বিজয়ের শেষ হাসিটি হাসলেন অ্যালিস মুনরো। অ্যালিস মুনরোর জন্ম ১৯৩১ সালের ১০ জুলাই কানাডার অন্টারিওর ইউংহ্যামে। বাবা রবার্ট এরিক লেইডল ছিলেন একজন খামার ব্যবসায়ী। মা অ্যানি ক্লার্ক লেইডল ছিলেন স্কুল শিক্ষক। মুনরো ইউনিভার্সিটি অব ওয়েস্টার্ন অন্টারিওতে দুবছরের বৃত্তি পেয়ে সাংবাদিকতা ও ইংরেজি বিষয়ে পড়াশোনাকালীন তার লেখালেখিতে হাতেখড়ি হয়।
১৯৫০ সালে তার প্রথম গল্প ছাপা হয় 'ডাইমেনশনস অব হ্যাপি শ্যাডো' নামে।
অ্যালিস মুনরো বিয়ে করেন ১৯৫১ সালে। বিশ্ববিদ্যালয় পড়াকালীন তিনি কাজ করেছেন রেস্তোরাঁর ওয়েটার হিসেবে, তামাক চাষের শ্রমিক হয়ে, কিংবা খণ্ডকালীন গ্রন্থাগারের কেরানির পদে। ১৯৬৩ সালে ব্রিটিশ কলম্বিয়ার ভিক্টোরিয়া নামক শহরে স্বামী-স্ত্রী মিলে খুললেন বইয়ের দোকান 'মুনরো বুকস'। দোকানটি এই নামে আজও বহাল আছে।
মুনরো ১৯৬৮ সালে ৩৭ বছর বয়সে তার প্রথম গল্প সংকলন 'ড্যান্স অব হ্যাপি শেডস' প্রকাশের পর পরই চারদিকে হইচই পড়ে যায় এবং সঙ্গে সঙ্গেই তিনি পেয়ে যান কানাডার সর্বোচ্চ সাহিত্য পুরস্কার গভর্নর জেনারেলস অ্যাওয়ার্ড। এরপর মুনরোর পথচলা আর থেমে থাকেনি। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় তার দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ 'লাইভস অব গার্লস অ্যান্ড উইমেন'। গড়ে প্রতি চার বছর পর পর প্রকাশিত হয় তার একটি করে গল্প সংকলন। অ্যালিস মুনরো ম্যান বুকার, কমনওয়েলথ রাইটার্স প্রাইজসহ বিশ্বের প্রায় সবকটি গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য পুরস্কার ইতোমধ্যে অর্জন করেছেন।
২০১৩ সালে এসে মুনরো জয় করলেন এ সময়ের শ্রেষ্ঠ পুরস্কার। শুধু ছোটগল্প লিখে নোবেল পাওয়ার ঘটনা ইতিহাসে এই প্রথমবার ঘটল। এটা যেন সেই শ্রুতকীর্তি সাহিত্যিকদের জয়। যারা সর্বপ্রথম ছোট গল্পের জন্ম দিয়েছিলেন। ছোটগল্পের ইতিহাস ঊনবিংশ শতাব্দীর।
একবিংশ শতাব্দীতে এসে মুনরোর হাতে এর সর্বোচ্চ স্বীকৃতি জুটল। সাহিত্যের ইতিহাসে ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ ভাগেই ছোটগল্প বৈচিত্র্যে ও গভীরতায় এক মহিমান্বিত স্থান অর্জন করে নিয়েছিল। আমেরিকায় ওয়াশিংটন আর্ভিং (১৭৮৩-১৮৫৯), অগাস্টাস বি লংস্ট্রিট (১৭৯০-১৮৬৪), ন্যাথানিয়েল হোথ্রন (১৮০৪-১৮৬৪) এদের হাতেই ছোট গল্প রূপটির নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়েছিল। আর এর পরিণতি লাভ করে অ্যাডগার অ্যালান পো (১৮০৯-১৮৪৯) এর হাতে। তবে ইংরেজি ছোটগল্পকে উৎকর্ষতার দিক দিয়ে শ্রেষ্ঠ ফরাসি গল্পকার মোপাঁসার কাছাকাছি নিয়ে গিয়েছিলেন আমেরিকান গল্পকার ও' হেনরি (১৮৬২-১৯১০)।
প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় মন্তব্য করেছেন_ 'ছোট গল্পের জন্ম আমেরিকায় হইলেও তথাকার সাহিত্যে ইহা তেমন স্ফূর্তিলাভ করে নাই। প্রথম শ্রেণীর ছোট গল্প লেখকের সংখ্যা আমেরিকায় অধিক নহে। বরঞ্চ ইংরাজি সাহিত্যে ইহার সমধিক বিকাশ দৃষ্ট হয় আর সম্পূর্ণ বিকাশ ফরাসি সাহিত্যে। ইংরাজি ছোট গল্প ঘটনাপ্রধান। ফরাসি ছোট গল্পে রসের প্রাধান্য পরিস্ফুট।
'
এবার একটু বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্প সম্পর্কে দুটি কথা বলতে হয়। যেহেতু উপরোক্ত ছোট গল্পকারদের রচনার ভাষা ইংরেজি, অনুমান করা যেতে পারে ঊনবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলা ছোট গল্পের পরীক্ষা-নিরীক্ষার প্রাথমিক পর্ব শুরু হয়। বাঙালি লেখকরাও কেউ কেউ এদের লেখার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলেন নিশ্চয়ই। কবি রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং অ্যাডগার অ্যাল্যন পোর ভক্ত ছিলেন। প্রভাত কুমার মুখোপাধ্যায় যিনি নিজেই একজন জনপ্রিয় ছোট গল্পকার, তিনি এক সময় লিখেছিলেন, 'উপন্যাসের মতো ছোট গল্প জিনিসটাকেও আমরা পশ্চিম হইতে বঙ্গ সাহিত্যে আমদানি করিয়াছি।
'
সদ্য নোবেল জয়ী অ্যালিস মুনরোর লেখার আখ্যানবস্তু ও আঙ্গিক নিয়ে। কি আঙ্গিকে তার গল্পগুলো বৃক্ষের ডালপালার মতো শাখা-প্রশাখা বিস্তার করে একটি অমোঘ নিয়তির দিকে ধাবিত হয়ে এর পরিণতি পর্যন্ত পেঁৗছাত? পাঠকদের একটি বিষয় জানিয়ে রাখছি যে, অ্যালিস মুনরোর গল্পগুলোতে প্লট বিষয়টি মুখ্য নয়। এটি একটি সেকেন্ডারি বিষয়। সাধারণ কথায় বলতে হয় যে, মুনরোর গল্পে কোনো গল্প নেই_ অর্থাৎ কোনো চমকপ্রদ উপসংহার নেই। যেমন, আমেরিকার ছোটগল্পকার এডগার অ্যালান পো, ও' হেনরী কিংবা ফরাসি সাহিত্যিক মোপাঁসার গল্পে অতি বিশদভাবে এই কাঠামো অনুসরণ করা হতো যে, জীবনের সত্য প্রতিফলন ঘটতেই হবে ছোট গল্পে এমনটিই চেয়েছিলেন ছোট গল্পের স্রষ্টারা।
আখ্যান বস্তু হয় হোক সাধারণ তবু তাতে থাকবে হবে কোনো জোরাল নাটকীয় উন্মেষের সম্ভাবনা। তার তথ্যমূলক উপাদানগুলোতে থাকা চাই একটি একাগ্র অভিনিবেশ, এক সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা এবং সেই গল্পে থাকবে এক উপসংহার যা শুধু তরান্বিতই হবে না, পারলে সেটি হবে চরম লোমহর্ষক ও অসাধারণ চমকপ্রদ। কিন্তু মুনরোর গল্পে মানুষের সাদামাঠা জীবনের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়ের ওপর আলো ফেলে দেখানো হয় যে, যে বিষয়গুলো অবজ্ঞা করে কিংবা না দেখার ভান করে সম্পূর্ণ যাপিত জীবনটির শেষ পর্যায়ে এসও অতীতের সেই মুহূর্তগুলো আদতে ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তার বিখ্যাত গল্প 'দ্য বিয়ার কেম অভার দ্য মাউন্টেন' গল্পে লেখিকা সেই যাপিত জীবনের ছোট ছোট বিষয়গুলো তার লেখনীর অাঁচড়ে চিত্রিত করেছেন। বিশ্বের গল্প পাঠক মুগ্ধতায় ও বিস্ময়ের সঙ্গে দেখল যে, দৈনন্দিন জীবন যাপনে যেসব তুচ্ছাতি তুচ্ছ বিষয়ের দিকে আমরা সাধারণত কোনো দৃষ্টিই দেইনি।
সাদা চোখে যা আমাদের নজরেই পড়ে না, মুনরো তা-ই আমাদের সামনে অণুবিক্ষণ যন্ত্র দিয়ে তুলে এনেছেন আমাদের দৃষ্টিতে একেবারে সামনে। আমরা তখন অবাক হয়ে উপলব্ধি করি_ আমরা তাহলে এরকম! এভাবে আমরা জীবনযাপন করছি! মুনরোর অন্য আরেকটি গল্প লাল জামার আঙ্গিক নিয়ে আলোচনা করব লেখার একেবারে শেষে। তবে এ মুহূর্তে চেকভ ও রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্প নিয়ে একটু আলোচনা করা যাক। কারণ মুনরোর ছোট গল্পে এ দু'জন লেখকের লেখার প্রতিচ্ছবি পাওয়া যায়। আন্তন চেকভের ছোট গল্প সৃষ্টির বেশ কিছু কাল আগে মহামতি লেখক দস্তইয়েফস্কি বলেছিলেন_ রাশিয়ার সমস্ত গল্প বেরিয়ে এসেছে গোগলের কোটের পকেট থেকে।
গোগল ও অ্যালান পোর জন্ম একই সালে অর্থাৎ ১৮০৯ এবং গোগলকেও দেখি অ্যালান পোর মতো হ্যালুসিনেসান, বাস্তব ও স্বপ্নের বিভ্রান্তিকর জটাজাল বিষয়গুলো তার গল্পের আঙ্গিক হয়ে উঠে আসতে। ইম্প্রেশনিস্ট শৈলীতে গল্প লেখার নিরীক্ষা দিয়ে আবিভর্ূত হয় ফিওদর দস্তইয়েফস্কি। মনস্তাত্তি্বক বিশ্লেষণের প্রবণতাকে তিনি এগিয়ে নিয়ে গেছেন। রুশ সাহিত্যের ছোট গল্প চেকভের মতো তার কাছেও বিশেষভাবে ঋণী। এ কথা বললে অত্যুক্তি হবে না যে, দস্তইয়েফস্কির ভূতলবাসী আর তলস্তয়ের ইভান ইলিচের মৃত্যু সত্যিকার অর্থেই বেরিয়ে এসেছে গোগলের কোটের দুই পকেট থেকে।
উপরোক্ত সাহিত্যিকদের হাতে রুশ কথা সাহিত্য যখন একটা সিরিয়াস ও ধ্রূপদী মেজাজ লাভ করেছে, যখন গল্প বলতে একটি পরিপূর্ণ আখ্যান বোঝায়। যার থাকবে একটি সূচনা, মধ্যভাগ ও পরিণতিপূর্ণ সমাপ্তি। ঠিক সেই সময়ে রুশ সাহিত্যে আবির্ভাব ঘটে আন্তন চেকভের (১৮৬০-১৯০৪)। তিনি তার লিখনীতে রুশ গল্প পাঠকদের একেবারে চমকে দিলেন। তিনি নিয়ে এলেন এমন গল্প, যার মধ্যে ঘটনার ঘনঘটা নেই, নেই নিটোল কোনো কাহিনীও।
পরিবর্তে তিনি পাঠকদের সামনে হাজির করলেন ছবি, ডিটেইল, হালকা মেজাজে সূক্ষ্ম রসাত্দক ভাষায় ফুটিয়ে তোলা মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের খুঁটিনাটি চিত্র। তাদের চলাফেরা, কথা বলা, কিংবা পারস্পরিক আচরণের ছবি। আর এ জন্য এ সময়ের অনেক সাহিত্যিক বোদ্ধা সহসাই মুনরোকে চেকভের সঙ্গ তুলনা করেছেন। তবে আমি চেকভ ও মুনরোর উভয়ের ছোট গল্প পর্যালোচনা করে এতটুকু বলতে পারি যে, মুনরো মানুষের দৈনন্দিন জীবনযাপনের খুঁটিনাটি চিত্র চেকভের চেয়ে আরও নিপুণ, সূক্ষ্ম ও সার্থকতার সঙ্গে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন। মুনরো তার গল্পের উপাদান আহরণ করেন তার চারপাশে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে বিশেষ করে কানাডার অন্টারিও অঞ্চলে ঘটে যাওয়া অনেক ঘটনাই তার লেখায় উপজীব্য হয়ে উঠে আসে।
এদিক থেকে তার লেখার সাযুজ্য মেলে আমেরিকার বিখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম ফকনারের সঙ্গে। ফকনারও তার গল্পের রসদ আহরণ করতেন তার চারপাশে ঘটে যাওয়া সব ঘটনা থেকে। অন্যদিকে চেকভ ১৮৮৩ থেকে ১৮৮৫ এই দুটি বছর প্রচুর লিখেছেন মূলত টাকার জন্যই। আর তার গল্পের সাজসরঞ্জামের জোগান হতো বন্ধু-বান্ধব ও পরিবারের সদস্যদের কাছ থেকে গল্পের আইডিয়া কিনে। প্রতিটি আইডিয়ার জন্য চেকভকে ব্যয় করতে হতো ১০ কোপেক আর কাহিনীর জন্য ২০ কোপেক।
তবে যে যাই বলুক তার গল্প লেখার প্রেরণা ও ভিত্তি গড়ে উঠেছিল তার মা ইভগেনিয়ার কাছ থেকে। কারণ তার মা চমৎকার গল্প বলতে পারতেন। ঠিক যেমন মাইকেল মধুসূধনের প্রেরণা ও উৎসাহের কেন্দ্রবিন্দু ছিল তার মায়ের কাছ থেকে শোনা মহাভারত ও রামায়ণের গল্পগুলো। মার্কেজের যেমন তার দাদিমার কাছ থেকে গল্প শুনে।
আমি ব্যক্তিগতভাবে মনে করি চেকভের চেয়েও মুনরোর ছোট গল্পের বেশ সাদৃশ্য রয়েছে রবীন্দ্রনাথের ছোট গল্পের সঙ্গে।
রবীন্দ্রনাথ গল্প লেখা শুরু করেন ১৮৯১ সাল নাগাদ। ততদিনে এডগার অ্যালান পো, ও' হেনরী কিংবা ফরাসি লেখক মোপাঁসা পশ্চিমে প্রতিষ্ঠিত ছোট গল্পকার হিসেবে বিশেষ খ্যাতি পেয়ে গেছেন। প্রভাত কুমারের কথা অনুযায়ী বাংলা সাহিত্যে ছোট গল্প বিষয়টি পশ্চিম হতে আমদানি হলেও রবীন্দ্রনাথের পাণ্ডিত্য ও শ্রেষ্ঠত্ব এখানেই যে_ গল্পের সেই চিরাচরিত প্রথাগত চমকপ্রদ উপসংহারের প্রথায় না গিয়ে তিনি নিজস্ব স্বকীয়তায় মানুষের জীবনের খুঁটিনাটি বিষয়গুলো তার ছোট গল্পে অসম্ভব সার্থকতার সঙ্গে তুলে ধরেছেন। ঠিক যেমনি এ সময়ের অ্যালিস মুনরোর লেখায় সেই প্রতিচ্ছবি দেখা যায়। মুনরোর গল্পের সঙ্গে সাদৃশ্য মেলে রবীন্দ্রনাথের 'পোস্ট মাস্টার'. 'একরাত্রি' কিংবা 'কাবুলিওয়ালা'সহ আরও বহু গল্প।
এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায় যে, রবীন্দ্রনাথ মোপাসাঁ কিংবা ও' হেনরীর লেখার সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। অন্যদিকে এ কথা আমরা জানি যে, তিনি অ্যালান পো'র লেখার একজন গুণমুগ্ধ ভক্ত ছিলেন। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় এই যে, এদের কেউই ছোট গল্পে তার ওপর প্রভাব বিস্তার করতে পারেননি।
লেখাটি শেষ করছি অ্যালিস মুনরোর লাল জামাটির সম্পর্কে আলোচনার মধ্য দিয়ে। এই গল্পটিতে গল্পের কথক উত্তম পুরুষে তার কিশোরী জীবনের ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বলে যাচ্ছেন, নদীতে প্রবাহিত জলের ধারার মতো।
এখানে মা-মেয়ের ভালোবাসা কিংবা ঘৃণা বিষয়গুলো ফুটে উঠেছে দারুণভাবে। গল্পে মা তার মেয়ের জন্য একটি লাল ভেলভেটের জামা তৈরি করেছেন। কারণ আসন্ন একটি বলড্যান্সের অনুষ্ঠানে তার মেয়েটি সেই লাল জামা পরে সে খুঁজে নেবে একজন ছেলে বন্ধু এবং এরপর তারা একে অপরের সঙ্গে নাচবে। গল্পে মা বেশ আনন্দিত ও উদ্বেলিত যে, তার মেয়ে জীবনে এই প্রথম ছেলে বন্ধু খুঁজে নিতে যাচ্ছে (পশ্চিমা সংস্কৃতিতে এটাই সাধারণ রীতি) কিন্তু গল্পের কথক মায়ের এই আচরণে খুশি হতে পারে না। মা যখন তার চারপাশে ঘুর ঘুর করে তখন সে বিব্রতবোধ করে।
মায়ের উত্তপ্ত নিঃশ্বাস যেন সে অনুভব করতে পারে। হিল জুতা পরে তার মা যখন হাঁটে তখন তার পায়ের নীল রগ ফুটে ওঠে। সে বর্ণনাও বাদ যায় না গল্প থেকে। এ ছাড়া গল্পে কথকের সবচেয়ে প্রিয় বান্ধবী লনির সঙ্গ সে চুরি করে কিভাবে সিগারেট ফুঁকে কিংবা লুকিয়ে লুকিয়ে প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য লিখিত প্রবন্ধ পড়ে, কিভাবে এবোরশন করতে হয় কিংবা ছেলেদের কিভাবে পরিতৃপ্ত করতে হয় ইত্যাদি। গল্প পড়ে মনে হয় মুনরো যেন নিজের কৈশোরের কথা বলছেন নির্বিঘ্নে।
তার ঋতুময়ী হয়ে ওঠার কথাও বাদ যায় না_ অসাবধানতাবশত তার স্কাটে ছোপ ছোপ রক্ত লেগে থাকে। এরপর আসে সেই মাহেন্দ্রক্ষণ যে দিনটিতে যে ডেলভেটের লাল জামাটি পরে নাচের অনুষ্ঠানে যায় একটি ছেলে বন্ধু খুঁজতে। সেখানে তার পরিচয় ঘটে আরেকটি মেয়ের সঙ্গে নাম মেরী ফরচুন।
মেরী ফরচুন গল্পের কথককে পরামর্শ দেয় যে, ছেলেদের মুখাপেক্ষী না হতে। এখানে কথকও সে কথায় সায় দিয়ে মাথা নাড়ে।
কিন্তু গল্পের কথকের ভাগ্যে কোনো ছেলে জোটে না, অথচ তার বান্ধবী লনি ইতোমধ্যে একটি ছেলে জুটিয়ে বলড্যান্স অনুষ্ঠানটিতে নাচা শুরু করেছে। কোনো ছেলে বন্ধু জোটাতে না পেরে কথক যখন সেই স্থান ত্যাগ করতে উদ্যত হয়, ঠিক তখনই একটি ছেলে এগিয়ে এসে বলে_ 'নাচবে আমার সঙ্গে' গল্পের কথক মেরী ফরচুনের উপদেশ পরামর্শ ভুলে এগিয়ে যায় ছেলেটির সঙ্গে নাচতে। দূর থেকে মেরী ফরচুনের সঙ্গে চোখাচোখি হলে কথক তার চোখ সরিয়ে নেয় লজ্জায়। মানুষের বৈতসত্তার চরম পরিস্ফুটন ঘটে এ গল্পটিতে। বাদ বাকিটুকু পাঠকরা পড়ে নেবেন নিশ্চয়ই।
আমি চিরায়ত সাহিত্যের সংজ্ঞা খুঁজে পেয়েছি মুনরোর গল্পে। আমি মনে করি, চিরায়ত কিংবা ক্ল্যাসিক সেসব গল্পগুলোকেই বলা যেতে পারে, যা প্রথম পাঠে যেটুকু আনন্দ দেয়, দ্বিতীয়বার পাঠে তার চেয়ে অধিকতর আনন্দ দেয়। তৃতীয়বারে তার চেয়েও একটু বেশি। অ্যালিস মুনরোর গল্প ঠিক সেরকম_ বার বার পড়তে ইচ্ছে হয়। সেই অর্থে তিনি একজন সমকালীন সার্থক ক্ল্যাসিকার।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।