জলোচ্ছ্বাসে মরে ফুলে ওঠা একটা গরুর পা ওপরের দিকে উঠে আছে। তার পাশে হতভাগ্য কোনো এক ব্যক্তির মৃতদেহ। কালি দিয়ে আঁকা ছবিটির নিচে তারিখ দেওয়া আছে ১৯৭০।
চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারের সিঁড়ি দিয়ে উঠলে দোতলার দুটো পাঠকক্ষের মাঝে এক চিলতে বারান্দা। সেখানে জানালার পাশে দেয়ালে ঝুলছে মোটা কালো ফ্রেমে বাঁধানো এই ছবিটি।
শৈলী দেখেই বোঝা যায়, সাধারণ কোনো ছবি নয় এটি। ভালো করে তাকালে জয়নুল আবেদিনের স্বাক্ষরও চোখে পড়বে।
কেবল এটি নয়, একই সময়ে শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিনের আঁকা আরও তিনটি চিত্রকর্ম গ্রন্থাগারে তৃতীয় ও চতুর্থ তলার দেয়ালে শোভা পাচ্ছে। সবগুলোরই বিষয়বস্তু ঘূর্ণিঝড়। স্বাক্ষরের পাশে তারিখও একই।
গত ২৩ নভেম্বর গণগ্রন্থাগারে গিয়ে ছবিগুলো ওই অবস্থায় দেখা যায়। গ্রন্থাগারের বিভিন্ন তলার বারান্দা ও পাঠকক্ষের স্যাঁতসেঁতে দেয়ালে ঝোলানো ছবিগুলো কয়েক যুগ ধরে আর্দ্র আবহাওয়ায় অনেকটাই প্রকৃত রূপ হারিয়েছে।
সম্প্রতি এ বিষয়ে প্রথম আলোর অনুসন্ধান শুরু হওয়ার পর গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষ ছবিগুলো দেয়াল থেকে নামিয়ে রাখেন।
জয়নুল আবেদিনের এই চারটি ছবি কী করে চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারে এল, এমন প্রশ্নের উত্তরও নেই গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষের কাছে। ছবিগুলো এমনকি গ্রন্থাগারের সম্পদের তালিকায়ও অন্তর্ভুক্ত হয়নি।
যোগাযোগ করা হলে গ্রন্থাগারিক মুহাম্মদ হামিদুর রহমান বলেন, ‘ছবিগুলো সম্পর্কে কোনো তথ্য নেই আমাদের কাছে। তবে এগুলো জয়নুলের আসল ছবি বলেই শুনেছি। ১৯৮৯ সালে গ্রন্থাগারের নতুন ভবন হওয়ার আগে বাংলাদেশ পরিষদ নামের একটি সংস্থার কার্যালয় ছিল এখানে। আমাদের ধারণা, ছবিগুলো বাংলাদেশ পরিষদের কাছ থেকে পাওয়া। তবে প্রথম আলোর অনুসন্ধানের পর আমরা ছবিগুলো খুলে স্টোরে রেখেছি।
বিষয়টি জানিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় গণগ্রন্থাগার ও সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ে চিঠি দিয়েছি। ছবিগুলো দেখতে ঢাকা জাদুঘর থেকে একটি বিশেষজ্ঞ দল আসবে শিগগিরই। ’
প্রথম আলোর পক্ষ থেকে জয়নুলের ছবিগুলো দেখাতে গত ৩০ নভেম্বর চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক শিল্পী ঢালী আল মামুনকে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারে। সব দেখে তিনি বলেন, ‘প্রাথমিকভাবে এটা বলা যায়, এগুলো জয়নুলেরই আঁকা। চারটি ছবিই কালি ও তুলিতে আঁকা।
ছবিগুলো আর্দ্র আবহাওয়ার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। ’
ছবিগুলোর অঙ্কনশৈলী ব্যাখ্যা করতে গিয়ে তিনি বলেন, ‘চারটি ছবির প্রতিটিতেই জয়নুলকে চেনা যায়। প্রতিটি ছবিই শিল্পের বিচারে অসাধারণ। ইঙ্ক-ব্রাশে খুব অল্প লাইনে ফিগার এঁকেছেন তিনি। ’
ছবিগুলো দেখেছেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও শিল্প সমালোচক আবুল মনসুর।
তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশ, ভারত ও পাকিস্তানের নানা প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তিগত সংগ্রহে জয়নুলের ছবি আছে। চট্টগ্রাম গণগ্রন্থাগারের ছবিগুলোও জয়নুলেরই আঁকা। এগুলোতে ১৯৭০ সালের ঝড়ের চিত্র উঠে এসেছে। মোমের রেখার ওপরে কালির প্রয়োগ দেখা যায় ছবিগুলোতে। এই কৌশল জয়নুলেরই।
সব বিচারে ছবিগুলো অনন্য সাধারণ। এখন এই অমূল্য শিল্পকর্মগুলো দ্রুত যথাযথ সংরক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। ’
ঢাকার শান্ত মারিয়াম বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা বিভাগের প্রভাষক রেজাউল করিম কয়েক দশক ধরে চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারে যাতায়াত করছেন। তিনি বলেন, ‘ছবিগুলো জয়নুল আবেদিনের অরিজিনাল, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। তবে কেন এভাবে ছবিগুলো অযত্নে পড়েছিল তা খতিয়ে দেখা উচিত।
জয়নুলের ঠিক কতটি ছবি গ্রন্থাগার কর্তৃপক্ষের কাছে ছিল তাও তদন্ত করে বের করতে হবে। ’
এ ব্যাপারে জানতে ঢাকার গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আলী আহমদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, এ বিষয়ে কোনো তথ্য তাঁর কাছে নেই।
১৯৮৮-২০০৬ সাল পর্যন্ত গণগ্রন্থাগার অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছেন কাজী আবদুল মাজেদ। মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, ‘আমি দায়িত্বে থাকার সময় বেশ কয়েকবার চট্টগ্রাম গণগ্রন্থাগারে এসেছি। ছবিগুলো আমার কাছে জয়নুলের আঁকাই মনে হয়েছে।
তবে কারা ঠিক কয়টি ছবি গ্রন্থাগারে পাঠিয়েছিল এ তথ্য জানা নেই। ’
এ বিষয়ে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব রণজিত বিশ্বাস বলেন, ‘চট্টগ্রাম বিভাগীয় গ্রন্থাগারে জয়নুলের ছবি থাকার বিষয়টি আমরা জেনেছি। আমরা অচিরেই একটি বিশেষজ্ঞ দল পাঠাব ছবিগুলো সংরক্ষণের জন্য। ’
এদিকে, ছবিগুলো বিভাগীয় গ্রন্থাগারেই সংরক্ষণের দাবি তুলেছেন চট্টগ্রামের শিল্পবোদ্ধারা।
এ ব্যাপারে শিল্পী ঢালী আল মামুনের দাবি, ছবিগুলো চট্টগ্রাম বিভাগীয় গণগ্রন্থাগারেই সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা হোক।
এতে গণপাঠাগারটি যেমন সমৃদ্ধ হবে, তেমনি চট্টগ্রামের শিল্পামোদী দর্শকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে পরিণত হবে।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।