বোকারা ভাবে তারা চালাক, চালাকরা ভাবে তারা চালাক। আসলে সবাই বোকা। বোকার রাজ্যে আমাদের বসবাস
“প্রিতম বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে চোখ মুছেই হেসে ফেলল, বৃষ্টির মাঝে আলাদা করে চোখের পানি মোছাটা কি হাস্যকরই না দেখায়। তার হঠাৎ করে কান্না পেল কেন সে জানেনা, কিন্তু এমন অঝর ধারায় বৃষ্টি যেন তার হৃদয়ের অন্তঃস্থল থেকে কান্নাটাকে অজানা কোন এক বড়শি দিয়ে তুলে এনেছে। প্রিতম এখন আর কাঁদে না, কারণ সে বুঝে গেছে এই পৃথিবীতে তার কান্নার কোন মূল্য নেই, তাই কেঁদে আর কি হবে।
আর শুধু তাই না, প্রিতম এখন অনেক বড় হয়েছে। গেল বছর জেএসসি পরীক্ষা পাশ করেছে। তার নাকের নীচে কালচে আভারা জানান দিচ্ছে সে বড় হয়ে গেছে। আর বড় হলে কাঁদতে নেই। কই তার জন্যতো তার বাবা-মা কাঁদলো না।
তবে সে কেন তাদের জন্য কাঁদবে।
গত একটা বছরে প্রিতম যেন অনেক বড় হয়ে গেছে। গত বছরের জানুয়ারি মাসের দিকে, যখন প্রতিবছর তারা সেন্টমার্টিন বেড়াতে যায় ঠিক সেই সময়টায় বাবা-মার মধ্যে কি নিয়ে যেন ঝগড়া শুরু হল। সেই ঝগড়া হতে হাতাহাতি, মা চলে গেল নানুর বাসায়, তার পর... ... তারপর আর ভাবতে ভালো লাগছে না। এর চেয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে একটু কেঁদে নেয়া যাক.... ... ..
এই একটা বছরে প্রিতমের জীবনটা কেমন ছন্নছাড়া হয়ে গেল।
আজ তার কোন নিজ ঠিকানা বলতে কিছু নেই। দাদুর বাসায় চাচ্চু আর ফুপ্পিরা তাকে মোটেও দেখতে পারে না। সারাক্ষন খুব খারাপ ব্যাবহার করে। অথচ বাব-মার ঝামেলার আগ পর্যন্ত তারা কি আদরটাই না তাকে করত। কিন্তু কি থেকে কি হয়ে গেল...।
নানু বাসায় অবশ্য কেউ কিছু বলে না, কিন্তু প্রিতম বুঝতে পারে তাকে কেউ এখন আর পছন্দ করে না। সে বুঝতে পারে না, কেন সবাই তাকে হঠাৎ করে এত অপছন্দ করতে শুরু করল। তার কি দোষ? নাকি প্রিতম নিজেই একজন খুব খারাপ ছেলে? হ্যাঁ প্রিতম আসলেই একটা খারাপ ছেলে। আর তাইতো সে স্কুল ফাঁকি দিয়ে ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় ভবঘুরেদের মত ঘুরে বেড়ায়। ”
এইরকম প্রিতমদের আপনি কি কখনো দেখেছেন আপনার আশেপাশে? আমি দেখেছি, খুব কাছ থেকে দেখেছি।
বাবা-মা নামক দুজন সত্ত্বা যখন ব্যাক্তিগত সমস্যা থেকে পরিত্রান পেতে পরিবার নামক বাঁধনকে ভেঙ্গে দিয়ে আশ্রয় নেয় ‘ডিভোর্স’ নামক এক যন্ত্রণাময় সমাধানের, তখন সৃষ্টি হয় উপরের প্রিতমদের মত মানুষদের।
বিবাহ নামক এক পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে মানুষ খুঁজে ফেরে পরিবার নামক এক নিরাপদ আশ্রয়। একজোড়া মানব-মানবী এই ভালোবাসার বন্ধনে জড়ায়ে উন্মোচন করে এক সুখের জগত আর তাদের ভালোবাসার ফসল হিসেবে সংসারে আসে মানব শিশু। আর এই শিশুকে ঘিরে ব্যাপ্তি পায় মানব-মানবী রচিত ছোট্ট সংসারটির। তো সেই মানব শিশু যাদেরকে কেন্দ্র করে এই পৃথিবীতে পা রাখলো, সেই বাবা-মা যখন নিজেদের ব্যাক্তিগত সমস্যার কারনে পৃথক হয়ে যায়, তখন এক নিদারুন অস্তিত্বের সঙ্কটে পড়ে যায় সেই অবুঝ মানব সন্তান, ছোট্ট দেব শিশু অথবা আমাদের প্রিতমেরা।
মিডিয়া এবং পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত তথ্য পর্যালোচনা করলে যে ভয়াবহ চিত্র ফুটে উঠে তা অকল্পনীয়। শুধুমাত্র ঢাকা জোন-১ এ ২০১২ সালে মোট ১৬,৪৫৩টি ডিভোর্স ফাইল জমা পরে। এখন সমগ্র ঢাকা শহরের আর সারা বাংলাদেশের অবস্থা একবার চিন্তা করুণ। অনেকে ভাবতে পারেন আমি আসলে কি বলতে চাচ্ছি। আমি কি ডিভোর্স এর পক্ষে না বিপক্ষে বলছি? আমি আসলে বলছি ডিভোর্স নামক করাতের শাখের নীচে বলি হওয়া ছেলে-মেয়েদের কথা।
কি দোষ এইসব ছেলে-মেয়ের যারা এক ভোতা যন্ত্রণাময় অস্তিত্বের সঙ্কট নিয়ে সারাটা জীবন বেড়ে ওঠে। বাব-মা হওয়ার আগে অবশ্যই স্বামী-স্ত্রী’র এই সিদ্ধান্তে আসা উচিত যে তাদের মানসিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং এই পর্যায়ে এসেছে কি না, যে মানসিক আন্ডারস্ট্যান্ডিং এ তারা সারা জীবন সংসার নামক ভেলায় চরে পাড়ি দিবে জীবন পথের সঙ্কুল সকল বাঁক। হ্যাঁ কেউ কেউ হয়ত বলবেন সবসময় কি ভবিষ্যৎ দেখা যায়? অথবা এই বিবাহ বিচ্ছেদের পেছনে এই এই কারণ দায়ী। সব মেনে নিয়ে বলতে চাই সবচেয়ে বেশী দায়ী ঐ দুইজন যারা নিজেদের এই পবিত্র বন্ধনকে টিকিয়ে রাখতে ব্যর্থ। আমি আমার খুব কাছ থেকে দেখা দুটি ঘটনা আপনাদের সাথে শেয়ার করতে চাই।
ঘটনা ১।
“টুম্পামনি বাবা-মা’র খুব আদরের সন্তান। এইচএসসি পাশ করার পর ভর্তি কোচিংয়ে যেয়ে পরিচয় হয় তারেকের সাথে। পরিচয় থেকে প্রেম, পরিনয়। ভার্সিটি ভর্তি পরীক্ষার আগে হঠাৎ করেই পালিয়ে বিয়ে করে তারেককে।
বিয়ের তিন মাসের মাথায় জানতে পারে তারেক নেশা করে। এ নিয়ে শুরু হয় তারেকের সাথে চেঁচামেচি, কথা কাটাকাটি। এরই মাঝে টুম্পামনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পরে। তারেকের নেশার পরিমান দিনকে দিন বাড়তে থাকে। টুম্পামনি যখন সাতমাসের অন্তঃসত্ত্বা তখন তারেক একদিন ঝগড়ার একপর্যায়ে তাকে লাথি মেরে বিছানা থেকে ফেলে দেয়।
কিন্তু টুম্পামনি কাউকে তার এই কষ্টের কথা কখনো বলতে পারেনি। তারেকের অত্যাচার সয়ে গেছে দিনের পর দিন। কি করতো সে, ভালবেসে নিজেইতো বেছে নিয়েছিল তারেককে। এখন কার কাছে কমপ্লেইন করবে? এক সময় তাদের একটি ফুটফুটে পুত্রসন্তান জন্ম হল। টুম্পামনি ভেবেছিল ছেলের দিকে তাকিয়ে তারেক সব ছেড়ে দিবে, নিজেকে শুধরাবে।
কোথায় কি? তার নেশা দিন দিন বেড়েছে। অবশেষে দীর্ঘ নয় বছর সংসার করে টুম্পামনি তারেককে ডিভোর্স দেয়। কিন্তু ততদিনে তার ছেলে রাতুল হয়ে গেছে আট বছরের। এখন টুম্পামনি আবার বিয়ে করে সুখে আছে, তার নতুন সংসারে একটি মেয়ে হয়েছে। কিন্তু রাতুল? তার কি হল? সে এখন দুইদিন দাদার বাসায় তো দুইদিন নানার বাসায় থাকে, মাঝে মাঝে মার কাছে গিয়ে থাকে দুই-এক দিন।
কি অদ্ভুত জীবন মানুষের। দুইজন বাবা, দুইজন মা, তারপরও নেই আপন ঠিকানা। “
ঘটনা ২।
“রিয়া যখন মাত্র অনার্সে ভর্তি হল তখন তার এক বান্ধবীর মাধ্যমে পরিচয় হয় মিজানের সাথে। পরিচয় থেকে ভালোলাগা, বন্ধুত্ব হয়ে পরিন্য।
দীর্ঘ ছয় বছর সম্পর্কের পরিণতি দুই পরিবারের সম্মতিতে বিয়ে। বিয়ের আট দিনের দিন রিয়া মিজানের আলমিরা থেকে আবিস্কার করে একগাদা প্রেমপত্র। উঁহু, রিয়ার লেখা নয়, অন্য প্রায় হাফ ডজন মেয়ের প্রেমপত্র। সবগুলো শেষ পাঁচ-ছয় বছরে লেখা। হাসবে না কাঁদবে।
তারমানে সে এই ছয় বছর ধরে প্রতারিত হয়েছে। সে কাকে বোঝাবে তার মনের ব্যাথা। যে মিজানের প্রতি সে এতটাই বিশ্বস্ত ছিল যে, ভার্সিটির বন্ধুদের সাথে কোথাও লাঞ্ছে গেলেও ফোনে মিজানকে জানিয়ে, অনুমতি নিয়ে গিয়েছে। এমন কি পরিবারের সবার সাথে বেড়াতে গেলেও একই কাজ করেছে। আর সেই মিজান কিনা এমন বিশ্বাসঘাতকতা করল।
এরপর রিয়া এই ব্যাপার নিয়ে মিজানের সাথে অনেকবার কথা বলার চেষ্টা করেছে, কিন্তু মিজান প্রতিবারই একই কথা বলেছে, “এগুলো জাস্ট ফান”। বিয়ের দুই বছরের মাথায় মিজান হাইয়ার ডিগ্রির জন্য কানাডা যায় বছর খানেকের জন্য। দেশে ফেরার পর মিজানের আচরণ আরও বেপরোয়া হয়ে যায়। সে নতুন আরেকটি এফেয়ারে জড়িয়ে পরে। অবশেষে বিয়ের পাঁচ বছরের মাথায় রিয়া মিজানকে ডিভোর্স দেয়।
এই পাঁচ বছর পরিবার, আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব, পাড়া-প্রতিবেশী সবাই রিয়াকে যে প্রশ্নটি করে পেরেশান করেছে তা হল তোমারা বেবি নিচ্ছ না কেন? তোমাদের দুজনের মধ্যে কারও কি সমস্যা আছে? ডাক্তার দেখাও... .. . ইত্ত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু রিয়া কাউকে বলতে পারে নাই যে সে মিজানকে বিশ্বাস করতে পারছে না, সে ভরসা পাচ্ছে না আরেকটি নতুন প্রাণকে এই পৃথিবীতে আনতে। তাই সে সময় নিয়েছে। এই পাঁচ বছরে সে তার সামর্থ্যের সর্বোচ্চটা প্রয়োগ করেছে মিজানকে তার দিকে ফেরাতে। রিয়ার রুপ-গুন-শিক্ষাগত যোগ্যতা কোনটাই কমতি ছিলনা, ছিলনা তথাকথিত ফ্যামিলি স্ট্যাটাসেরো ঘাটতি।
কিন্তু সবকিছু থাকার পরও কেন সে মিজানকে ফেরাতে পারলো না সে নিজেও জানে না। আজ রিয়া নতুন স্বামীর সাথে সুখে ঘর করছে। রিয়াকে বইতে হয়না রাতুলদের কান্না মাখা আর্তনাদের গ্লানি। “
সবশেষে বলব, প্লিজ বিবাহ নামক বন্ধনে জড়াবার আগে ভাবুন, জড়াবার পর এই সম্পর্ককে মূল্য দিতে শিখুন, ভালবাসা-আদরযত্ন দিয়ে তিলে তিলে সাজিয়ে তুলুন আপনার সংসার নামক ছোট্ট ভুবনকে। আর কোন রাতুল বা প্রিতমরা যেন বিনা অপরাধে এত বড় সাজার ভাগীদার না হয়।
আসুন সবাই মিলে “ডিভোর্স”কে না বলি।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।