হৃদয়ের কাছে বুদ্ধির বাস ভাল কথা। কিন্তু মাঝে মঝে হৃদয়ের ওপর থেকে বুদ্ধির শাসন তুলে দিতে হয়, হৃদয়কে স্বাধীন করে দিতে হয়, মুক্ত করে দিতে হয়। স্বাধীন মুক্ত হৃদয়ের ধর্মকে সব সময় বুদ্ধি দিয়ে বিচার করতে নেই
প্রাচীন মিশরের বিখ্যাত শহর আলেকজান্দ্রিয়া এখানেই জন্মগ্রহন করেন পৃথিবীর প্রথম মহিলা জ্যোর্তিবিজ্ঞানী হাইপেসিয়া। তিনি ছিলেন পাগান জ্ঞানীদের অন্যতম। এই হাইপেসিয়া প্রচার করতেন “যুক্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত নয় এমন সব ধর্মমত হল প্রতারনা মূলক।
এবং আত্নসন্মানবোধ যে কোন মানুষেরই সেই ধর্মমতকে চুড়ান্ত হিসাবে গ্রহন করা উচিত নয়”
হাইপেসিয়ার জন্মসাল
হাইপেসিয়ার জন্মসাল নিয়ে অনেক বিতর্ক আছে। হাইপেথিয়ার জীবনীকার মারিয়া জিলসকা (Maria Dzielska). তার লেখা Hypatia of Alexzndria বইতে তথ্য প্রমানসহ লিখছেন হাইপেসিয়ার জন্ম ৩৫৫ খ্রীষ্টাব্দে, অন্যান্য অনেক জীবনীকার তার জন্মসাল ৩৭০ খ্রীষ্টাব্দে বলেছেন কারন তাদের মতে হাইপেসিয়া মারা যাবার সময় (৪১৫ খ্রীষ্টাব্দে) যথেষ্ট সুন্দরী ছিলেন। আবার চার্লস কিংসলে তার Hypatia of Alexzndria বইতে লিখেছেন হাইপেসিয়া ৩৯০ খ্রীষ্টাব্দে জন্মেছেন। তবে অধিকাংশ জায়গায় তার জন্মসাল ৩৫৫ খ্রীষ্টাব্দে উল্লেখ্য করা হয়েছে।
পরিবারের কথা
হাইপেসিয়ার মার কথা খুব বেশি উল্লেখ্য না থাকলে ও বাবার কথা বেশ কয়েকবার উল্লেখ্য রয়েছে।
কারন তার বাবা ছিল ইতিহাস প্রসিদ্ব বহুমুখী প্রতিভা ও জ্ঞান গরিমার অধিকারী। হাইপেসিয়ার বাবার নাম ছিল থিওন। তার জন্ম ৩৩৫ খ্রীষ্টাব্দে, মৃত্যু ৪০৫ খ্রীষ্টাব্দে। জন্ম, মৃত্যু, কর্ম সবই এই আলেকজান্দ্রিয়া শহরে। এই শহরের রত্ন ছিলেন থিওন।
থিওন তার মত করে তার মেয়েকে মানুষ করতে চেয়েছেন। মেয়ে অবশ্য তার বাবার প্রতিভকে অতিক্রম করে গিয়েছিলেন। থিওন আলেকজান্দ্রিয়ার বিখ্যাত লাইব্রেরির প্রধান হিসাবে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ওই সময় আলেকজান্দ্রিয়ার এই রাজকীয় লাইব্রেরী্টি দুনিয়ার সব চেয়ে বড় লাইব্রেরী হিসাবে পরিগ্নিত হত। আজ আর এই লাইব্রেরীটির কোন অস্তিত্ত নেই।
৩৯১ সালে এই লাইব্রেরীটি ধবংস হয়ে যায়। ওই একই সময় সমস্ত পাগান মন্দির ও ধবংস করা হয়।
পড়াশুনা
হাইপেশিয়া ছিলেন পরিপূর্ন বিজ্ঞান মনস্ক মানুষ। কার্যকারন ছাড়া কোন কিছুই তিনি মেনে নিতে পারতেননা। হাইপেসিয়া পড়াশুনায় এতটাই আগ্রহী ছিলেন যে তার বাবাকে চাপ দিয়ে ওই সময় জ্ঞান বিজ্ঞানের সূতিকাগার এথেন্সে এ আসেন জ্ঞান আহরনের জন্য।
জীবনের সমস্ত আনন্দ দূরে সরিয়ে রেখে তিনি ওখানে মনযোগ দিয়ে অধ্যায়ন করেন দর্শন, জ্যোতিবিজ্ঞান, শিল্পকলা। শিক্ষা শেষে তিনি এথেন্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পেলেন “পত্র-মাল্য”। যা ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের কেবল মাত্র শ্রেষ্ট ব্যক্তিগন কেই অর্পন করা হত। হাইপেশীয়ার কাছে এই “পত্র-মাল্য”র মূল্য ছিল অপরিসীম।
অবিস্কারক হাইপেসিয়া
পৃথিবীর প্রথম মহিলা জ্যোতিবিজ্ঞানী হাইপেসিয়া তৈরী করেছেন অ্যাষ্ট্রোলব এবং প্লানিস্ফীয়ার।
এছাড়াও তিনি কিছু সংগীত যন্ত্রের আবিস্কার করেন, আবিস্কার করেন হাইড্রোমিটার। জ্যোর্তিবিজ্ঞনে অ্যাষ্ট্রলব আবিস্কার এক যুগান্তকারী ঘটনা। এই যন্ত্রের সাহায্যে চন্দ্র, সূর্য, গ্রহ নক্ষত্রের অবস্থান আগেভাগেই জানা সম্ভব। এর আবিস্কারক হিসাবে হাইপেসিয়া বিখ্যাত হলেও কেউ কেউ আবিস্কারক হিসাবে হিপার্কাসের নামও বলে থাকেন। প্ল্যানিস্ফীয়ার যন্ত্রটি জ্যোর্তিবিজ্ঞানের এক অতি গুরুত্বপূর্ণ আবিস্কার হিসাবে আজো স্বরনীয়।
একটি প্ল্যনিস্ফীয়ার ছাড়া আজো কোন জ্যোর্তিবিজ্ঞানী আকাশ পর্যবেক্ষনের কথা চিন্তাও করতে পারেন না। প্ল্যানিস্ফীয়ার যন্ত্রটি কিন্ত অ্যাষ্ট্রোলবের উত্তরসূরী। এই সরল অথচ গুরুত্বপুর্ন যন্ত্রটি কিন্তু আজো অপেশাদার জ্যোর্তিবিজ্ঞানীদের কাছে একটি গুরুত্বপূর্ন অস্ত্র।
গ্রন্থ রচনা
হাইপেসিয়া কিছু কিছু বিষয়ে পুস্তক রচনা করেছেন যা আজও বিদগ্ব মহলে সমান গুরুত্বপূর্ন। ১৩ খন্ডে লিখিত “Commentary on the Arithmetica of Diophantus” তার এক অনন্য কৃতিত্ত্ব।
প্রিয় বিষয় জ্যোর্তিবিজ্ঞানের উপর যে বই লিখেছেন তার নাম The Astronomical Canon”। এছাড়া সম্পাদনা করেছেন তার বাবার লেখা পূস্তক “Commentary on the Almagest of Ptolemy” “on the Conics Of Apollonius”। এ ছাড়া জ্যোর্তিবিজ্ঞানের ওপর অজস্র বক্তৃতা দিয়েছেন। তার বেশ কিছু কাজ তার প্রিয় ছাত্র সাইনেসিয়াস ধরে রেখেছিলেন।
হাইপেসিয়ার ভক্তরা
হাইপেসিয়া ছিলেন সে যুগের অসম্ভব সুন্দরী মহিলা।
তিনি কোনদিন বিয়ে করেননি। আমৃত্যু কুমারী থেকে গেছেন। ছাত্ররা সর্বদা তার সঙ্গ লাভের চেষ্টা করতেন যাতে তাদের জ্ঞানের পরিধী কিছুটা হলেও বাড়িয়ে নেয়া যায়। হাইপেসিয়া সন্মধ্যে আমরা যা কিছুই জানতে পেরেছি তার সবই তার প্রিয় ছাত্র সাইনেসিয়াসের জন্য। সত্যি বলতে কি হাইপেসিয়াকে লেখা সাইনেসিয়াসের বেশ কিছু চিঠি আজো সংরক্ষিত, সেখান থেকে আমরা হাইপেসিয়া সন্মধ্যে জানতে পারি।
আরো একজন উচ্চপদাধিকার ব্যাক্তি হাইপেসিয়ার গুনে মুগ্ধ হয়েছিলেন। লোকে বলে তিনি খ্রীষ্ট ধর্মে নিবেদিত প্রান হয়েও পাগানদের সাথে বড় বেশি ওঠাবসা করতেন। তার নাম ছিল ওরেসটেস। তিনি আলেকজান্দ্রিয়ার অধ্যক্ষ ছিলেন।
মৃত্যু
সময়টা ৪১২ খ্রীষ্টাব্দ।
থিওফাইলাস চলে যাবার পর প্রথম সাইরিল তার স্থালাভিষিক্ত হন। রোমান ক্যাথলিক চার্চ তাকে সেন্ট বলে ঘোষনা করেন। তার ধ্যানজ্ঞান ছিল কি ভাবে আলেকজান্দ্রিয়ায় খ্রীষ্ট ধর্মের প্রসার ঘটানো যায়। আর খ্রীষ্ট ধর্মের শত্রু পাগানদের ধবংস করা। ওই সময় হাইপেসিয়া এত জনপ্রিয় ছিল যে সে যখন রাস্তায় বের হত তখন জনগন চিৎকার করে তার উদ্দ্যেশ্য বলত ‘থিওন কন্যা দীর্ঘজিবী হোক’ কিংবা ‘কলঙ্ক মুক্ত নক্ষত্র দীর্ঘজিবী হোক’।
এই সব ব্যাপার গুলো সাইরিলের গাত্র দাহ তৈরী করত।
৪১৫ খ্রীষ্টাব্দের এক দিন, আলেকজান্দ্রিয়ার রাস্তায় প্রিয় ঘোড়ার গাড়ীতে করে চলছেন সে যুগের উজ্জ্বল নক্ষত্র হাইপেসিয়া। হঠাৎ কোথা থেকে যেন উদয় হল ৫০০ র মত লোক। এরা প্রত্যেকেই খ্রীষ্টীয় ধর্মাবলম্ভবী সন্যাসী- গায়ে তাদের কুচকুচে কালো আলখেল্লা মাথায় কাল টুপি। অসহায় একাকী হাইপেসিয়া নড়ার ও সুযোগ পেলেননা।
গাড়ীর উপর ঊঠে পড়ল খুনে মানুষগুলো, এদের নেতৃত্ত্ব দিচ্ছিল চার্চের এক রিডার নাম পিটার। এই পিটার ছিল সাইরিলের ডান হাত। পিটারের নির্দেশে এই লোকগুলো হাইপেসিয়া কে টানতে টানতে এনে গির্জার অভ্যান্তরে নিক্ষেপ করল। এই গির্জাটির নাম সিজারিয়াম। এর পর বেদীর সামনে নিয়ে ঝিনুকের খোল দিয়ে ঘষে ঘষে তার শরীরের চামড়া আর মাংস ছড়িয়ে নেয়া হয়।
সভ্যতার আলোকবর্তিকার রক্তে ভেসে গেল মেঝে। মৃত হাইপেসিয়ার দেহকে টুকরো টুকরো করে কাটা হল তারপর উন্মত্ত মানুষগুলো সেই টুকরো নিয়ে গেল সিনারন নামে এক স্থানে, সেখানে আগুন দেয়া হল হাইপেসিয়ার টুকরোগুলোকে। ছাই হয়ে গেল হাইপেসিয়ার পবিত্র দেহ।
কার্ল সাগানের অনুভুতি
বিশিষ্ট জ্যোর্তিবিজ্ঞানী কয়েক বছর আগে প্রয়াত কার্ল সাগান তার লেখা কসমস পুস্তকে বলেছেন “The last scientist to work in the library was a mathematician, astronomer, and physicist and head of the Neoplatonic school of philosophy- an extraordinary range of accomplishment for any individual of any age. Her name was Hypatia.
মুক্তির মন্দিরের সোপান তলে যত জীবন বলিদান হয়েছে হাইপসিয়া তার মধ্যে উজ্জল নক্ষত্র হয়ে আছে।
Click This Link
http://en.wikipedia.org/wiki/Hypatia
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।