২৯ তারিখ এক পাঠক আমাকে ফোন করে বলেন, আমি নাকি গত সপ্তাহে সংলাপের বিরুদ্ধে লিখে ঠিক কাজটি করেছিলাম। তাঁর বক্তব্য আমি অন্তত চাই, শেখ হাসিনা তাঁর ভাষায় বঙ্গবন্ধুর এই মেয়েটি প্রাণে বেঁচে থাকুন। ভদ্রলোকের কথার ভেতর কেমন একটা হেয়ালি মনে হয় আমার কাছে। তাই পাল্টা প্রশ্ন করি, ভাই ঠিক আপনার কথার অর্থ বুঝতে পারছি না। সংলাপে না যাবার সঙ্গে প্রাণে বেঁচে থাকার সম্পর্ক কি? ভদ্রলোক এবার যা বললেন, তাতে আমার একদম চুপ হয়ে যাওয়া ছাড়া কোন উপায় ছিল না।
তিনি একটু ঠাট্টার সুরে বললেন, আপনার লেখা ঠেকা পড়ে মনে হয়, কিছু বোঝেন ঠোজেন, কিন্তু আপনার সঙ্গে কথা বলে তো হতাশ হলাম। আমি আর কথা বাড়াতে চাইলাম না। কারণ, প্রবীণ রাজনীতিবিদ অধ্যাপক মোজাফফর আহম্মদও আমাকে একই কথা বলেন। বলেন, তোমার সঙ্গে কথা বললে, তুমি কেবল স্যার আর জী জী করো।
কথা বলে মজা পাই না।
যাই হোক, এই ভদ্রলোকের কথায় ফিরে আসি, তিনি আমাকে বলেন, আপনি কি প্রধানমন্ত্রী ও বিরোধীদলীয় নেত্রীর ফোনালাপ শোনেননি? বললাম শুনেছি। এবার ভদ্রলোক বলেন, তাহলে আপনি কিভাবে বলেন, সংলাপ হলে বঙ্গবন্ধুর এই কন্যাটি প্রাণে বাঁচত? টেলিফোনে আপনি খালেদার অবস্থা তাঁর কথায় কিছু বোঝেননি? আর টেলিফোনে যদি এই হয় তাহলে সামনে পেলে খালেদা কী করতেন? উনি তো চুলের মুঠি ধরে শেখ হাসিনাকে সোফা থেকে নামিয়ে আনতেন। পারত এসএসএফ ঠেকাতে?
টেলিফোনে খালেদা জিয়ার বাজখাই গলা শোনার পরে ভদ্রলোকের কথা উড়িয়ে দেবার জায়গা কম। তারপরেও শান্ত গলায় বলি, না, না অমনটা ভাববেন না। লেখা পড়া নাই জানুন দু’ বার প্রধানমন্ত্রী তো ছিলেন।
তাই ওটুকু বিশ্বাস করা যায়। একেবারে চুল ধরবেন না? ভদ্রলোক এবার আমার ওপর বিরক্ত হলেন, বললেন, থাকুন ভাই আপনার বিশ্বাস নিয়ে। আমি আমার বিশ্বাস থেকে এক চুল নড়ছি না। সংলাপে গেলে এটাই ঘটবে? আমি তাঁকে বলি দেখুন বেগম জিয়ার সঙ্গে এখন আর সংলাপ করে কোন লাভ নেই। এবং নৈতিক অবস্থান থেকে সেটা সম্ভব নয় সেটা তো আমি গত সপ্তাতে লিখেছি।
কারণ, তাঁকে যতই বিএনপির নেতা বলা হোক না কেন তিনি বাস্তবে এখন জামায়াতে ইসলামীর নেতা। তবে গত ২৫ অক্টোবর থেকে এ কথা বলা যায়, বেগম জিয়া এখন তার অবস্থানটি একটু পরিবর্তন করেছেন। এতদিন তিনি জামায়াতে ইসলামীর নেতা ছিলেন এখন তিনি নব্য আলবদর বাহিনীর সুপ্রীম কমান্ড। কারণ, ২৫ অক্টোবরের সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বেগম জিয়া যে সমাবেশ করেন সেটা কাছ থেকে যাঁরা দেখেছেন তাঁরা কেউ বলবেন না এটা ১৮ দলীয় জোটের কোন সমাবেশ ছিল। বাস্তবে ছিল এটা ছাত্রশিবিরের একটি সমাবেশ।
ছাত্রশিবির যে ২০১৩ তে নব্য আলবদর বাহিনী এটা নিয়ে এখনও যাদের কোন দ্বিধা আছে তাদের সম্পর্কে কোন মন্তব্য না করাই ভাল। বেগম জিয়া এই নব্য আলবদর বাহিনীর নেতৃত্ব ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আসার আগেই গ্রহণ করেছেন। কারণ, তিনি পেশাজীবী সম্মেলনেই এই নব্য আলবদর বাহিনীর কার্যকরী কমান্ডার বা অপারেশন হেড দেলোয়ারের মুক্তি চেয়েছেন। কারণ তিনি ভালভাবে জানেন, তিনি যে গণহত্যা ও গৃহযুদ্ধ চাচ্ছেন সেটা তাঁকে তাঁর এই নব্য আলবদর বাহিনী দিয়েই করাতে হবে। যদিও অনেক আগেই তারেক রহমান বলেছিলেন, ছাত্রশিবির ও ছাত্রদল একই মায়ের সন্তান।
অর্থাৎ দুটোই খালেদার সন্তান। তারপরেও মা হিসেবে খালেদা ভালভাবেই জানেন, দেশকে রক্তাক্ত করতে তাঁর ছাত্রদলের সব সন্তান আসবে না। কারণ, অনেকেই আছে নানা কারণে ছাত্রদল করে। কিন্তু তারা কিছুটা হলেও বাংলাদেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে। একেবারে বেগম জিয়ার মতো নয়।
এছাড়া জামায়াত-শিবির ও বেগম জিয়ার একটি জায়গাতে মিল বড় গভীর। তাদের রক্তক্ষরণও একই কারণে। সেটা হচ্ছে পাকিস্তান ভেঙ্গে যাওয়া। কারণ, জামায়াতে ইসলামীর প্রতিটি লোক পাকিস্তানের পক্ষে ছিল ১৯৭১ সালে। তারা তাদের পরবর্তী জেনারেশনকে সেভাবেই গড়ে তুলেছে।
অন্যদিকে, বেগম জিয়া শতভাগ পাকিস্তানের পক্ষে ছিলেন ১৯৭১ সালে। জিয়াউর রহমান বার বার তাঁকে মুক্তিযুদ্ধে নিয়ে যাবার জন্য লোক পাঠালেও তিনি জাননি। তিনি পাকিস্তান ক্যান্টনমেন্টে জানজুয়ার তত্ত্বাবধায়নে ছিলেন। আর এই নিয়াজী-জানজুয়াররা যে ঐতিহাসিক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে আত্মসমর্পণ করেছিল। নিয়াজি- জানজুয়াদের অপমানের প্রতিশোধ কিছুটা হলেও বেগম জিয়া নিলেন গত ২৫ অক্টোবরে।
২৫ অক্টোবরে তার নব্য আলবদর বাহিনী দিয়ে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যুদ্ধাপরাধীদের ছবি, পোস্টার, ফেস্টুন স্বাধীনতা স্তম্ভ, শিখা চিরন্তনের পাশে নিয়ে কিছুটা হলেও সেই ১৯৭১-এর ১৬ ডিসেম্বরের রক্তক্ষরণকে প্রশমিত করেছেন বেগম জিয়া। জানজুয়ার মৃত্যুতে শোকবাণী পাঠিয়ে যতটা না দায় শোধ করতে পেরেছিলেন তার থেকে অনেক বেশি করলেন তিনি ২৫ অক্টোবর।
২৫ অক্টোবর নিয়ে আমাদের সুশীল সমাজ একেবারে বাংলাদেশে ‘গগন চটি’র অবস্থা করে ফেলেছিলেন। যেন বাংলার আকাশে সেই গগন চটি দেখা গেছে। বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে যাবে ২৫ অক্টোবর।
কিন্তু ২৫ অক্টোবর আসলে কী ঘটল সেটা কিন্তু এখনও সেই সব মুখে শুনিনি। ২৫ অক্টোবর টেলিভিশনে দেখে ও কাছ থেকে দেখে যাঁরা বেগম জিয়ার ওই তথাকথিত মহাসমাবেশকে ভালভাবে পর্যালোচনা করেছেন তাঁরা নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছেন, এতদিন জামায়াতের আমিরের দায়িত্ব পালন করলেও ২৫ অক্টোবর নব্য আলবদর বাহিনীকে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার চেতনা ও মূল্যবোধের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে যুদ্ধ ঘোষণা করেন তিনি। আর সেই যুদ্ধের সুপ্রীম কমান্ড তিনি তার হাতে তুলে নিয়েছেন। যে কারণে তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি হরতাল প্রত্যাহার করা। এবং কেন তিনি করেননি সেটা মনে হয় ষাট ঘণ্টার হরতালের পরে এখন দেশের সাধারণ মানুষ বুঝতে পারছেন।
কারণ, এই ষাট ঘণ্টার হরতালের ভেতর দিয়ে যে কাজগুলো বেগম জিয়ার নব্য আলবদর বাহিনী করেছে সে কাজের চরিত্র বিচার করে দেখুন শতভাগ মিলে যাবে তাদের একাত্তরের কাজের সঙ্গে।
টানা ষাট ঘণ্টা হরতালে তারা সশস্ত্র অবস্থায় বিভিন্ন জায়গায় চোরগোপ্তা হামলা করে মানুষ হত্যা করেছে। তারা সংখ্যালঘুদের বাড়ি হামলা করেছে। তাদের হত্যা করেছে। তাদের নারীদের শ্লীলতাহানি করেছে।
এবং তাদের সম্পদ লুট করেছে। শুধু তাই নয়, একাত্তর সালে তারা গ্রামে গ্রামে যেভাবে সংখ্যালঘুদের সম্পদ লুট করেছিল এবারও পিরোজপুর, বগুড়া, লালমনিরহাট, নোয়াখালীতে একই কাজ করেছে। শুধু এখানেই শেষ নয়, বগুড়ায় তারা এই তিন দিন ধরে যে অপারেশন চালিয়েছে তার খরচ দিতে বাধ্য করেছে সংখ্যালঘুদের। তাছাড়া এই তিন দিনে দেশে সর্বোচ্চ বোমাবাজি হয়েছে। বোমাবাজিতে দিনমজুর থেকে শুরু করে বুদ্ধিজীবী পর্যন্ত কেউই রেহাই পায়নি।
১৯৭১-এর ২৫ মার্চ যেমন একদিকে আমরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শহীদ বুুদ্ধিজীবী অর্থাৎ ছাত্র শিক্ষকের লাশ দেখি অন্যদিকে দেখি রিকশার ওপর মৃত অবস্থায় পড়ে আছে দরিদ্র রিকশাওয়ালা। এবারও তেমনি দেখা গেছে একদিকে ছাত্রদের লাশ অন্যদিকে বোমার আঘাতে নিহত ও ছিন্ন ভিন্ন দিনমজুর, ট্রাক ড্রাইভার এদের শরীর এবং এটা যে কোন আন্দোলন নয়, একাত্তরের মতো একটি নৈরাজ্য সৃষ্টির জন্য তারও প্রমাণ কিন্তু এখানে পাওয়া গেছে। কারণ, কোন রাজনৈতিক কর্মী কখনও কোন আন্দোলনের সময় জনগণের সম্পদ লুট করে না। কিন্তু নৈরাজ্য সৃষ্টিতে খুব বেশি কাজ দেয় এই লুটতরাজ। এটা পৃথিবীর সমস্ত নৈরাজ্যকারীর ইতিহাস পড়লে দেখা যায় তারা তার সৈন্যদের এই সুযোগ দেয়।
৬০ ঘণ্টার হরতালে, সংখ্যালঘুদের দোকান থেকে জিনিসপত্র, নগদ অর্থ নেয়া হয়েছে। বাড়ি ঘেরাও করে টাকা নেয়া হয়েছে। অন্যদিকে ট্রাক ড্রাইভারকে আহত করে তার পকেটের টাকা নিয়েছে বেগম জিয়ার সৈনিকরা। টাকা নিয়েছে বাস যাত্রীদের নামিয়ে তাদের পকেট থেকে।
এর পরে বিষয়টি নিশ্চয়ই স্পষ্ট যে, ২৫ অক্টোবর থেকে বেগম জিয়া নব্য আল বদরদের নিয়ে কোন যুদ্ধ শুরু করেছেন।
তাই ষাট ঘণ্টার এই নরহত্যা ও লুটতরাজ, নারীর শ্লীলতাহানি, মন্দির ভাঙ্গা এর পরে আর সংলাপের কোন প্রশ্ন ওঠে না। বরং এখন প্রশ্ন নব্য আল বদরদের এটা কেবল শুরু। বেগম জিয়া দেশের বিরুদ্ধে এই যুদ্ধের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু করেছে। আগামীতে অবরোধের নামে তার বাহিনী আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠবে। তাই এ সময়ে সুশীলদের মতো অঙ্ক কষে হিসাব মেলানোর সময় মনে হয় দেশের সাধারণ মানুষ, প্রগতিশীল যুব সমাজ, ছাত্র সমাজ কারোরই নেই।
যত দ্রুত সম্ভব তাদেরকে একটি বিন্দুতে মিলিত হয়ে মিলিত শক্তি হিসেবে প্রতিরোধ করতে হবে, পরাজিত করতে হবে এই নব্য আলবদর বাহিনীকে। নইলে তারা শুধু দেশের সম্পদ নয়, দেশকেও ধ্বংস করে দেবে। কারণ, এবারও তাদের পেছনে পাকিস্তান। দেশের মানুষ ইতোমধ্যে জেনেছেন যে, তারেক রহমান পাকিস্তান গোয়েন্দা বাহিনী আইএসআইয়ের ছকে যাবতীয় কাজ করছে। আর এই বদর বাহিনীর মূল শক্তিকে যে পাকিস্তানের এই গোয়েন্দা বাহিনী তাতে কারও কোন সন্দেহ থাকার কথা নয়।
তাই আগামীতে অবরোধের নামে নরহত্যা, লুটতরাজ, দেশের সম্পদ নষ্ট শুরু করার আগেই দেশকে প্রস্তুত হতে হবে নব্য এই আলবদর বাহিনীকে প্রতিহত করার জন্য। সংলাপ সংলাপ খেলার সময় এখন নয়। এখন যারা সংলাপ সংলাপ খেলতে যাবে তারা ১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধের সময় মোশতাক যে ভূমিকা পালন করেছিলেন সেই ভূমিকাই পালন করবেন। অন্য কিছু নয়।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।