বিডিআর সদর দপ্তরে ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারির নারকীয় হত্যাকাণ্ড এবং ঘটনার পর উদ্ভূত পরিস্থিতিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ১ মার্চ রোববার সেনাকুঞ্জে সেনা কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকে নারকীয় এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিচার বিভাগ ও সেনাবাহিনীর অংশগ্রহণে নিরপেক্ষ কমিটির মাধ্যমে সুষ্ঠু তদন্তের দাবি জানান সেনা কর্মকর্তারা। এ বৈঠকে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের পরিবারের সদস্যদের উপযুক্ত ক্ষতিপূরণ দেওয়া এবং বিডিআরের পলাতক বিদ্রোহী জওয়ানদের ধরতে বিশেষ অভিযান চালানোর দাবি জানানো হয়।
১ মার্চ সকাল ১০টা ৫০ মিনিটে সেনাকুঞ্জে যান প্রধানমন্ত্রী। তাঁর সঙ্গে ছিলেন কৃষিমন্ত্রী মতিয়া চৌধুরী।
বৈঠক শুরুর একপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রীর সামনেই ক্ষোভে ফেটে পড়েছিলেন সেনা কর্মকর্তারা। শতাধিক সহকর্মীর নির্মম মৃত্যুতে মুষড়ে পড়া সেনা কর্মকর্তাদের কেউ কেউ উচ্চ স্বরে কেঁদে ওঠেন, আবার কেউ বারবার চোখের পানি মোছেন। বিডিআর সদর দপ্তরের ঘটনা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর কাছে নানা প্রশ্ন করেন তাঁরা। প্রধানমন্ত্রী তাঁদের সব কথা শোনেন এবং প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেন।
প্রধানমন্ত্রী পৌঁছানোর আগে সকাল ১০টার মধ্যে ঢাকা সেনানিবাসে কর্মরত প্রায় দুই হাজার পদস্থ কর্মকর্তা বৈঠক স্থলে উপস্থিত হন।
অনুষ্ঠানে বিডিআর সদর দপ্তরের ঘটনায় বেঁচে যাওয়া বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
সেনাকুঞ্জের দক্ষিণ পাশে স্থাপিত মঞ্চে চেয়ার ছিল দুটি। মঞ্চে উঠে ওই চেয়ারে বসেন প্রধানমন্ত্রী এবং তত্কালীন সেনাপ্রধান জেনারেল মইন উ আহমেদ। বৈঠকের শুরুতে নিহত সেনা কর্মকর্তাদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালন করা হয়। এরপর শেখ হাসিনা মাইক্রোফোন নিয়ে প্রায় আধা ঘণ্টা বক্তব্য দেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, প্রধানমন্ত্রী ওই দিনের ঘটনা এবং পরবর্তী পরিস্থিতি সম্পর্কে সেনা কর্মকর্তাদের বিস্তারিত জানান। তিনি বলেন, ‘ওই সময় বিডিআর প্রধান শাকিল আমাকে ফোন করেছিলেন। আমি তাঁকে ধৈর্য ধরতে বলি। এরপর কীভাবে সমাধান করা যায়, তা নিয়ে কথা বলি। আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে এ নিয়ে কথা বলি।
পরিস্থিতি নিয়ে কী করা যায়, সে ব্যাপারে সেনাপ্রধানকে ফোন করি। তাঁর কাছে জানতে চাই, সেখানে সেনা অভিযান চালাতে কত সময় লাগবে। তিনি জানালেন, একটু সময় লাগবে। তাঁর কাছে জানতে চাই, এয়ার ট্রুপস নামাতে পারবেন কি না। পরে জানতে পারি ভেতরে কর্মকর্তাদের মেরে ফেলা হয়েছে।
তাঁদের পরিবারের সদস্যদের জিম্মি করা হয়েছে। এরপর অভিযান চালালে নিরীহ মানুষের প্রাণহানি ঘটত। এতে পরিস্থিতি আরও খারাপ হয়ে যেত। এসব ভেবে সেনা অভিযান না করে রাজনৈতিক সমাধানের কথা ভাবি। আমার লোকজন জানের মায়া ত্যাগ করে সমঝোতা করেন।
এরপর কী হয়েছে তা আপনারা জানেন। ’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যে ক্ষতি হয়েছে তা পূরণ করা সম্ভব নয়। আমি নিজে স্বজন হারিয়েছি। এর জ্বালা যে কী, সেটা আমি ছাড়া কেউ ভালো জানে না। আমার ছোট ভাই ছিল রাসেল।
সে বলত, বড় হয়ে আমি আর্মি হব। সেই ভাইসহ আমার পরিবারের ১৮ জনকে নৃশংসভাবে মেরে ফেলা হয়েছে। আমার ভাইসহ পরিবারের সবাই বনানী কবরস্থানে শুয়ে আছেন। আমি হাজারটা লাশ দেখিনি, কিন্তু হাজারটা কবর দেখেছি। ’ এ কথা বলতে বলতে প্রধানমন্ত্রী কেঁদে ফেলেন, আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন।
আর কথা বলতে পারছিলেন না।
প্রধানমন্ত্রী চশমা খুলে চোখ মুছে বলেন, যারা এ নারকীয় হত্যার সঙ্গে জড়িত তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হবে। আপনারা যেভাবে চান, সেভাবেই হবে। যাঁরা স্বজন হারিয়েছেন, তাঁরা ক্ষতিপূরণ পাবেন। সরকারের পক্ষে যা যা করা দরকার সব করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী উপস্থিত সেনা কর্মকর্তাদের কাছে জানতে চান, তাঁদের কোনো বক্তব্য আছে কি না। তখন একজন সেনা কর্মকর্তা কিছু কথা বলে বসে যান। এরপর বিডিআর সদর দপ্তর থেকে প্রাণে বেঁচে আসা এক কর্মকর্তা উঠে দাঁড়ান। একজন তাঁর হাতে মাইক্রোফোন এগিয়ে দেন। তিনি বলেন, ওই দিন বিডিআর প্রধান প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলার পর তাঁদের বলেছিলেন, সেনাবাহিনী তাঁদের উদ্ধার করতে আসছে।
তাঁরা অপেক্ষায় ছিলেন, কিন্তু কেউ এগিয়ে আসেনি। তিনি বলেন, সেনাবাহিনী পাঠানো হলে হয়তো এতো কর্মকর্তার মৃত্যু হতো না। সেখানে নারীরা অত্যাচারের শিকার হয়েছেন বলে তিনি জানান।
এ প্রসঙ্গ উঠতেই সেনা কর্মকর্তারা প্রধানমন্ত্রীর সামনেই ক্ষোভে ফেটে পড়েন। কেউ কেউ উচ্চ স্বরে কান্নায় ভেঙে পড়েন।
সেনা সদস্যরা এ সময় নানা দাবির কথা বলতে শুরু করেন। এ পর্যায়ে একজন কর্মকর্তা দাঁড়িয়ে সবাইকে শান্ত থাকার অনুরোধ করেন। একজন কর্মকর্তা বলেন, সরকার এ ঘটনা সমাধান করতে অযথা সময় নিয়েছে। এ জন্য স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ও স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রীর সমালোচনা করা হয়। প্রতিমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির ও সাংসদ মির্জা আজমকে বিদ্রোহীদের সঙ্গে যোগাযোগের দায়িত্ব দেওয়ার সমালোচনা করেন একাধিক সেনা কর্মকর্তা।
আরেকজন কর্মকর্তা বলেন, বিদ্রোহীদের সঙ্গে আলোচনার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী ভেতরে গিয়ে কয়েকটি পরিবারকে বের করে চলে আসেন। তিনি হাতেগোনা কয়েকটি অস্ত্র জমা দেওয়ার পর কেন বের হয়ে এলেন। তিনি যদি কোয়ার্টার গার্ডে একবারের জন্য যেতেন, তাহলে ভেতরে আটকে থাকা নারীরা উদ্ধার পেতেন। এ কথার পরপরই আবার হইচই শুরু হয়। তাঁরা বলতে থাকেন, সমঝোতার নামে সেনা কর্মকর্তাদের হত্যা ও লাশ গুম করা এবং বিডিআর জওয়ানদের পালানোর সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
এ কারণে অবিলম্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, স্থানীয় সরকার প্রতিমন্ত্রী ও হুইপ মির্জা আজমকে বরখাস্ত করার দাবি জানান তাঁরা।
একজন সেনা কর্মকর্তা বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আপনি জানেন না আপনার কাছের লোকজন আপনার সঙ্গে ছলনা করেছে। তারা আপনাকে বিভ্রান্ত করছে। আপনি তাদের বিশ্বাস করবেন না। আমরা আপনার সন্তানের মতো।
আপনি আমাদের বিশ্বাস করুন। প্রয়োজনে আমরা আপনার জন্য জান দিয়ে দেব। ’
সূত্র মতে, অপর একজন কর্মকর্তা বলেন, ‘সেনাবাহিনী নিয়ে রাজনীতি চলবে না। আপনার কী দরকার সেটা আমাদের বলবেন, আমরা তা করে দেব। এ পর্যায়ে আরেকজন বলেন, কার কোন জায়গায় পোস্টিং হবে সেটা যদি অবসরপ্রাপ্তদের কথায় হয়, তাহলে তাকে সেনাবাহিনীতে এসে চাকরি করতে বলুন।
’ এ সময় কর্মকর্তারা সমস্বরে বলেন, এসব বক্তব্য মিডিয়ায় দিতে হবে। মানুষ সব জানুক।
একজন সেনা কর্মকর্তা বলেন, টেলিভিশনে টক শোতে সেনাবাহিনীর নামে বিষোদ্গার করা হয়। কথায় কথায় সেনাবাহিনী সম্পর্কে নেতিবাচক কথা বলা হয়। কয়েকজন বলেন, সেনাবাহিনীর নামে সংসদেও এভাবে কথা বলা যাবে না।
এ পর্যায়ে একজন পদস্থ কর্মকর্তা মাইক নিয়ে সবাইকে শান্ত থাকার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, যাঁরা নিহত হয়েছেন, তাঁদের পরিবারের জন্য ঢাকায় একটি ফ্ল্যাট অথবা প্লট দিতে হবে। সেই সঙ্গে নগদ এক কোটি টাকা দিতে হবে। নিহতের পরিবারের আজীবন পুরো পেনশন নিশ্চিত করতে হবে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, একজন কর্মকর্তা বিডিআর নাম বদল করে ‘বর্ডার গার্ড’ রেখে এ বাহিনীকে নতুন করে সাজানোর পরামর্শ দেন।
বিডিআরের যেসব সদস্য পালিয়ে গেছে, তাদের যোগদানের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর যারা কাজে যোগ দেবে না, তাদের ধরতে ‘অপারেশন রেবেল হান্ট’ নামে বিশেষ অভিযান শুরু করতে হবে।
এসব দাবি-দাওয়া শোনার পর প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি আপনাদের সব কথা শুনলাম। এ ব্যাপারে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কী ব্যবস্থা নেওয়া হবে তা আপনাদের জানানো হবে। কোনো কিছুই আড়াল করা হবে না।
আপনারা সব জানতে পারবেন। ’
বৈঠকের শেষপর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী নিহত সেনা কর্মকর্তাদের রুহের মাগফিরাত কামনার জন্য মোনাজাত করার আহ্বান জানান। প্রধানমন্ত্রী নিজেই মোনাজাত পরিচালনা করেন।
(২০১০ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলোয় এই প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়েছিল। পাঠকের আগ্রহের কথা বিবেচনা করে সেই প্রতিবেদনটি আবারও তুলে দেওয়া হলো।
)
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।