আমি বখতিয়ারের ঘোড়ার মতই চঞ্চল আমি আমি নজরুলের সেই বিদ্রোহী। আমি বিশ্বজয়ী সেই জুলকারনাইন।
এমনও কারোর জীবনে হয় ! এ যেন খানিকটা গল্প-উপন্যাসের মতো । মানুষের জীবনে নানা আঘাত আসে, সম্পদ-বিপদ আসে । সে সব তো আলাদা ।
এতো একেবারে কল্পনার মতো । এমনটাই হয়েছে বনলতা-র জীবনে । বনলতা আমাদের এ পর্যায়ের নায়িকা । বাড়ি থেকে বার বার ওর বিয়ের উদ্যোগ নেওয়া হ’য়েছে, কিন্তু বনলতা বার বার তাঁর নিজের বিয়ে থেকে দূরে থাকার জন্যে যুদ্ধ ক’রে চ’লছে । বাড়িতে বার বার এ নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছে ।
প্রশ্ন উঠেছে নিজেদের মধ্যে, প্রশ্ন করা হ’য়েছে বনলতা-কে । ওর কথা শুনলে নানা মন্তব্য ক’রবে সেইসব মানুষ যারা জীবনকে সোজা অঙ্কের বাঁধা গতে সাজানো দেখেন, কারণ ওর কথা তো ও নিজেও প্রতিষ্ঠিত ক’রতে পারবে না । বস্তুতও, ওর কথা তো তেমন কোন যুক্তিসঙ্গত-ও নয় । এমনকি বিবেচনাপ্রসূত নয় ব’লে মনে হবে সবার কাছে । কেমন ক’রে ও বাবা বা মা-কে বোঝাবে ! অন্যও কাউকে বোঝাবার কোন দায় ওদের নেই, তাই বাঁচোয়া ।
তা নয়তো বেশ মুশকিলে প’ড়তো বনলতা । বিয়ের ব্যাপারে ঘরের মানুষের থেকে বাইরের মানুষের মাথাব্যথা থাকে বেশি । তাদের কিছু না এলে-গেলেও তারাই বয়প্রাপ্ত পাত্র বা পাত্রী-কে ঝামেলায় ফেলে, বাড়ির মানুষদের মাথা খায় । সে পাট নেই ব’লেই রক্ষে । কিন্তু বিষয়টা যে ওর কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ এবং এ প্রসঙ্গ যে ওকে কতটা অসহায় করে, তা কে বুঝবে! ও বোঝাতেও তো পারবে না ।
তাই বিয়েটা আটকে আছে অনির্দিষ্ট কালের জন্যে । বনলতা পড়াশুনোয় ফেল মারা মেয়ে নয় । মাস্টার্স ক’রছে। পার্ট ওয়ান । সোশিয়লজি ওর সাবজেক্ট ।
ওকে তো জোর ক’রে বিয়ের পিড়ি-তে বসানো যায় না । ও বাচ্চা মেয়েও নয় যে, ধ’রে-বেঁধে ওকে জবাই করার মতো ঝুলিয়ে দেওয়া হবে কারোর গলায় । একটা কঠিন ব্যক্তিত্বে এড়িয়ে যায় এ প্রসঙ্গ । মা দুশ্চিন্তা করেন । ভাবেন, এরপর হয়তো এক সকালে মেয়ে অনুভব ক’রবে যে, তার বিয়ের বয়স পার ।
অযাচিত, স্বাভাবিক বা প্রাকৃতিক যে কোন কারণই বলা যাক না কেন, মন বা শরীর তখন আর যুগল জীবনে সায় দিচ্ছে না । এটাও কিন্তু বনলতা চায় না । সে তো বিবাহ বিরাগিণী নয় ।
সাধারণত, মেয়েদের জীবনে দু-বার বিয়ের জন্যে মন কেমন করে। প্রথমবার, একেবারে ছোট বয়সে, মানে পুতুল খেলার বয়সে ।
সেই সময় একটা কাউকে, মানে যে কোনো ছেলেকে, রাঙ্গাদা, পাড়ার ঝন্টু দা, কিম্বা বাড়িতে কাজ করে নাদুস-নুদুস উড়ে চাকরটা--- যাকে হোক, মানে যাকে শিশুমনে ধরে, তাকেই মনে মনে বর ব’লে ভেবে বসে, বর-বউ খেলে । তাকে বর ব’লে ভাবতে ভালো লাগে । বর কী--- এসব না বুঝেই চলে এ খেলা । এরপর একটা লগ্নে এই বোকামিটা চলে যায় । মেয়েটি বড়ো হয়, তাঁর স্কুল জীবন শুরু হয় ।
সে বুঝতে পারে যে, সে বড়ো হচ্ছে । তার শরীরে নানা বৈশিষ্ট এসে তাকে জানিয়ে দ্যায়, সে নারী। তখন অর্থাৎ ক্লাশ এইট বা নাইনে আর একবার সেই পুরনো নেশার মতো বিয়ে-পাগলামিটা পুরো না হ’লেও একটা প্রেম- পাগলামি মনে বাসা বাঁধে । যার বাঁধে না, সে হয়তো কোন অনুভূতির মধ্যে পড়ে না । এই সময় অনেককেই প্রেমিক পুরুষ ব’লে ভাবতে ইচ্ছে করে ।
সে হ’তে পারে বোকা-সোকা প্রাইভেট টিউটরটি, অথবা দাদা-র খুব স্মার্ট শ্যালকটি বা দিদি-র দেওরটি । শরীরে এমন সব বৈশিষ্ট্য জেগে জেগে উঠতে শুরু করে যে, যৌনতার সম্পূর্ণ জ্ঞানগম্যি না থাকলেও একটা যৌনতা পেয়েই বসে । এটার মধ্যে কোনো লজ্জার ব্যাপার নেই । শাস্ত্র বলে, এটা না হওয়াটাই লজ্জার বিষয় । পথে পঞ্চাশ টাকার নোট গড়াগড়ি খাচ্ছে, অথচ একজন তা দেখেও তুলে নিতে চাইছে না, এতে যথেষ্ট চিন্তার কথা থাকে।
এমন লোককে বলে মহাপুরুষ বা অথবা ভীরু। এরা দুজনেই সমাজে বা অর্থনীতিতে কোন কাজে আসে না । সহজে পয়সা আয় করার পিছনে একটা সাহসিকতা আছে । সেটা যার থাকে না, সে নিজেকে সৎ ব’লে অন্যের কাছে চালাবার চেষ্টা করে অথবা অসৎ-এর প্রতি তাঁর আক্রোশ দেখাবার জন্যে তাকে নানাভাবে লাঞ্ছিত করে । আসলে ওটা তার হতাশা এবং হতাশাকে স্বীকার না করার একটা মিথ্যে কৌশল ।
সে ভাবও বনলতা-র জীবনে এসেছিল । চ’লেও গেছে । কিন্তু যেদিন থেকে সত্যি সত্যি বিয়ে নিয়ে ভাবনা করা উচিত, সেদিন থেকে চ’লে যাওয়া একটা পুরনো ভাবনা ওকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে । এইটাই কাউকে সে ব’লে বোঝাতে পারবে না ব’লেই বিয়ে থেকে স’রে স’রে আছে ।
বনলতা অবিনাশ সেনের মেয়ে ।
ও পরিবারের একই সন্তান । ওর বাবা-মা মনে করেন, তাদের সন্তান প্রয়োজন ছিল, পেয়েছেন । দ্বিতীয় সন্তানের কোন প্রয়োজন নেই । তাই বনলতা একমেবাদ্বিতীয়ম্ । একাই সে রাজ করে গোটা পরিবারে ।
ওর বাবা অবশ্য রাজা-র মতো কেউ নন । ব্যাঙ্কের এক করণিক মাত্র । তবু বাবা-র যা কিছু সে একা ভোগ করে । তা আদর হোক, বায়না হোক, শখ-সাচ্ছন্দ্য হোক, বিলাসিতা হোক, বা বাবা-মা’র শাসন । সবটাই তার একার ।
কোন শরীক নেই, ভাগীদার নেই, এমনকি ঈর্ষা ক’রবারও কেউ নেই ।
তবে মাঝে মাঝে একজন ভাইয়ের অভাব বনলতা অনুভব করে । বিশেষ ক’রে যখন দেখে যে, তার বন্ধুরা দিব্যি ভাইফোটার দিন একটা সাজো সাজো রব তুলে শপিং করে, এটা কেনে, ওটা কেনে, তারপর পাড়ার নানা বাড়িতে একেকটা সময় পরে পরে শাঁখ বাজে, হুলুধ্বনি হয়, তখন ওর মনে হয়, ওদের সঙ্গে এই আনন্দ অনুষ্ঠানে থাকতে পারলে ও বেশ একটা সার্থকতা পেতো একটা মেয়ে হয়ে জ’ন্মে । কিন্তু মানুষ যা যা চায়, তার সবই যদি মানুষ পেয়ে যায়, তবে তো তথাকথিত দেবদেবীদের কেউ আর মূল্য দেবে না । রাজনৈতিক নেতাদের মতো দেবতারাও বুঝে গেছেন, সব পাইয়ে দিতে নেই ।
ঝুলিয়ে রাখো, দেখিয়ে রাখো--- এটা তোমার পাওনা, তোমাকে দেবো । কিন্তু এটা পেলে ওটা । নয়তো নয়, বাবা ।
তাই এই পরিণাম বনলতা মেনে নেয় মনে মনে । কখনও তার মামাতো, পিসতুতো বা অন্য কোনো তুতো ভাইকে ভাইফোঁটা দেবার জন্যে ও ডেকে আনে না বাড়িতে ।
ও দেখতে পায়, অনেক মেয়ে, ওর বয়সী হোক বা ছোট হোক, তারা তাদের এই অভাব পূরণ করে নানা তুতো ভাইদের নিমন্ত্রণ করে । এমনকি এটাও ও দেখেছে যে, ওর মামাতো বোন নিজের ভাইকে ফোটা দেওয়া সত্বেও ঐ দিন অন্যান্য ভাইদেরকে নিমন্ত্রণ ক’রে ডেকে আনে । তাদের মধ্যে হয়তো সবারই নিজেদের বোন আছে । হয়তো কোনো প্রয়োজন নেই এমনতর ডেকে আনার । তবুও ওরা ঐ দিনটাকে সেলিব্রেট করে একসঙ্গে ।
হৈ হৈ, খাওয়া-দাওয়া, সিনেমা দেখা বাড়ির ভি.সি.ডি.-তে, অন্ত্যক্ষরী, মেমরি গেম খেলে কাটিয়ে দ্যায় সারা দিন । সেটা তারা পারে, কারণ তাদের কোনো অক্ষমতা নেই । বরং তারা একটা ভালো কাজ করে এই যে, যে ভাইদের বোন নেই, তারা একটু বোনের সঙ্গ পায় । ‘ভগ্নীহীন ভ্রাতা বা ভ্রাতাহীন ভগ্নী’ মনে হয় মানব সমাজে একটা অন্য প্রজাতি। ফলে অন্তত ঐ দিনটাতে তারা নিজেদেরকে অসহায় বা ভিন্ন প্রজাতি মনে ক’রে নিতে বাধ্য হয় না ।
কিন্তু এসব কৃত্রিম প্রাপ্তির তোয়াক্কা বনলতা করে না । ওর যা আছে, তাই নিয়েই ও খুশি থাকতে চায় । অন্তত নিজের অবস্থায় খুশি থাকা ও পছন্দ করে । কোনো জোড়া-তাপ্পি দেওয়া সম্পর্ক ওর ভালো লাগে না । তাছাড়া এমনটা ক’রলে বাবা-মা দুঃখও পেতে পারেন ।
তাদের মনে হ’তে পারে যে, তাঁরা তাদের লতু-র এ বিষয়টা ভেবে দেখেননি ।
অবশ্য এ ছাড়া আর কোন উপায়ও নেই । বনলতা-র ভাই নেই যে, তা নয় । খুড়তুতো কেউ নেই । ওর বাবা তাঁর বাবা-র অর্থাৎ কিনা বনলতা-র ঠাকুরদার একমাত্র সন্তান ।
বনলতা-র অবশ্য এক পিসি আছেন । কিন্তু তিনি থাকেন জামশেদপুরে । তাই যে পিসতুতো ভাই আছে, তাঁর সঙ্গে দেখা-সাক্ষাৎ হয় কালেভদ্রে । বনলতা-র মাতৃকুলের সাথে আজ ওদের কোনো সম্পর্ক নেই । এর কারণ-টা অবশ্য খুবই অপ্রীতিকর ।
বনলতা-র দাদু অর্থাৎ পিতামহ পার্টিশানের সময় চ’লে আসেন এই দেশে । সবকিছু তাঁকে ফেলে চোখ মুছতে মুছতে আসতে হয় এক অজানা অচেনা বিদেশ বিভুয়ে । তিনি ছিলেন কোর্ট-এর ক্লার্ক । এক ছেলে আর এক মেয়ের সংসারে তিনি আর ঘরবাড়ি কিছুই ক’রে উঠতে পারেননি । হয়তো চাকরীর প্রথম দিকে বাড়ি ক’রলেও ক’রতে পারতেন।
কিন্তু একটা বড়ো প্রতিকূলতা হ’য়ে উঠেছিলো বনলতা-র মায়ের অসুস্থতা । বনলতা-র মা চিরকাল অসুস্থ নন । এটাও একটা ইতিহাস ।
চাকরীর প্রথম দিকে বনলতা-র বাবা বাড়ি ক’রতে একটা উদ্যোগ নিয়েছিলেন । কিন্তু বনলতা-র দাদু-দিদা তা ক’রতে দেননি ।
বনলতা-র দাদু-র অর্থাৎ মাতামহর প্রভূত জমি-জায়গাসহ প্রাসাদোপম বাড়ি ছিলো। এই প্রভূত রিয়েল এস্টেটের একটা বিরাট অংশ বনলতা-র মায়েরও প্রাপ্য ছিলো । সেই পাওনাটার কারণেই বনলতা-র মা মিনতি দেবী-কে আর বনলতা-র বাবা অবিনাশ বাবুকে ওর দাদু-দিদা বাসস্থান নির্মাণ করা থেকে বিরত ক’রেছিলেন । তাই ওরা ভাড়া বাড়িতে থেকেছেন চিরকাল। কিন্তু অদূরদর্শীতা যে একটি পরিবারে কী ধরনের অশান্তি আর অসন্তোষ নিয়ে আসতে পারে, তার বোধহয় বাস্তবসম্মত কোনো জ্ঞান ছিলো না বনলতা-র দাদু-দিদার ।
হয়তো বনলতা-র বাবা-মায়েরও । দাদু-দিদা তাদের প্রভূত সম্মতির কোন উইল ক’রে যাননি । ফলে তাদের মৃত্যুর পর হঠাৎ কী যে হোল মামাদের মনে, তাঁরা বোন-কে অসম্মান ক’রে প্রায় তাড়িয়ে দিলো তাঁর প্রাপ্য অধিকার থেকে । মামা যে বাস্তবে শকুনি মামা হ’য়ে উঠতে পারে, তা বনলতা দেখলো তার জীবনে । বুঝলো, অর্থম অনর্থম ।
এই সত্য যদি বনলতা-র দাদু-দিদা বুঝতেন, তবে এতোটা কুৎসিত নাটক হ’তো না । কিন্তু ঐ যে সত্য । মানুষ যা যা চায়, তা তা যদি সে সত্যি পেতো, তবে তো হ’য়েই যেতো । তা তো হবার নয় ।
আসলে বনলতা দেখেছে, মানুষের সাথে মানুষের সম্বন্ধটা একেবারে কৃত্রিম ।
যতক্ষণ একপক্ষ তা রক্ষা ক’রে চ’লেছে, ততক্ষণ তা আছে । ‘যে সয় সে রয়’ নয় । বনলতা মনে করে, এটা সম্পূর্ণ ভুল কথা । আসলে যে সয়, তার নিশ্চিত লয় । মানুষ যতক্ষণ সয়, তার বান্ধবতা আত্মীয়তা ততক্ষণ রয় ।
নয়তো গোল্লা । যদি কোন পক্ষ অপর পক্ষের মন্দাচরণের প্রত্যুত্তর দ্যায়, অর্থাৎ ‘সেম কয়েন ব্যাক করে’, তবেই চিত্তির। সব প্রেম, ভালবাসা, সমানুভূতি, দরদ, আত্মীয়তা গোল্লায় যাবে । বেরিয়ে প’ড়বে দাঁত-নখ । রক্তপায়ীর-র মতো রক্তপান ক’রতে পিছপা হবে না আপনজন বা পরমাত্মীয়, যে একদিন স্নেহ-চুম্বন দিয়েছে কপালে।
তখন তাকে চেনাই দুষ্কর হয় । কে কাকা, কে মামা, কে-ই বা পিসি-মাসী । যতোসব বিদ্যেবুদ্ধি সব যাবে বাড়ির মদ্দি । তা নয়তো বনলতা কি ভাবতে পেরেছিল যে, ওর মামা-রা এমনটা ক’রতে পারে ! এটাই স্বাভাবিক । এর অধিক কিছু করাটাই অস্বাভাবিক ।
এই অস্বাভাবিক প্রত্যাশার ছলনাতেই ম’রেছেন মিনতি দেবী আর তাঁর স্বামী অবিনাশ সেন । মাইকেল-এর কবিতাটা ওঁরাও প’ড়েছেন স্কুল জীবনে, কিন্তু ভুলে গিয়েছেন । কবিতা যে শুধু কবিতাই নয়, একটা বিরাট বাস্তবতা, সেগুলো যে এলোমেলো শব্দের কঙ্কাল নয়, এটা অনেকেই বোঝে না । কিন্তু ইচ্ছে ক’রলে বাবা-মা আদালতে যেতে পারতেন, আদায় ক’রে নিতে পারতেন নিজেদের অধিকার । কিন্তু সবাই তো সবটা পারে না ।
এটাই তাঁদের পরিচয় । এই না পারার মন নিয়েই তাঁরা পৃথিবীতে এসেছেন । এই চরিত্রের যে কোন পরিণামের জন্যে সে আপনি প্রস্তুত ।
কিন্তু বনলতা-র বৈবাহিক সমস্যাটা হ’লো একেবারে স্বতন্ত্র । একথা ভাবার কোন কারণ নেই যে, ওর কোন যৌন সমস্যা আছে ব’লে ও প্রথাগত বিয়ে পরিহার ক’রে আসছে ।
একটা খেলা যে একটা মেয়ের জীবনে কী রূপান্তর নিয়ে আসতে পারে, সেটাই ওর জীবনে একটা চরম সত্য উঠেছে ।
অবিনাশ বাবু-রা আগে এখানে ছিলেন না । তিনি তাঁর শ্যালকদের সাম্বোধনিক সার্থকতা প্রত্যক্ষ ক’রে পুরনো জায়গা ছেড়ে চ’লে এসেছেন এখানে, এই কল্যানী-তে । যদিও তাঁর চাকরী ট্রান্সফারেব্ল, তথাপি এই বদলি তিনি চেয়ে নিয়েছিলেন । অসহ্য লাগছিলো চন্দননগর ।
কথায় বলে, ‘কানের পাশে কাকের বাসা’ । তেমনি শ্বশুরবাড়ির পাশে থাকা যে এমনভাবে যন্ত্রণাদায়ক হ’য়ে উঠবে, তা তিনিও ভাবতে পারেননি । চন্দননগর শুধু বনলতা-র বাবা-র কাছে নয়, বনলতা-র কাছেও অসহ্য লাগছিলো । ঠিক চন্দননগর নয় । গোটা টাউন গার্লস হাইস্কুল, তার লন, তার বড়ো বারান্দা যেখানে রি-ইউনিওন অনুষ্ঠান হ’য়েছিল ডেকোরেট ক’রে, প্রতিটি সহপাঠী বা সহপাঠীনী--- সব ওর কাছে একটা অসহনীয় লাগছিলো ।
বাবা-কে তো ব’লতে পারেনি । সহ্য ক’রেছে । কিন্তু বাবা স’রে আসতে মনে মনে বাবা-কে থ্যাংকস দিলো বনলতা । কিন্তু কী হ’লো ! কিছুই তো হ’লো না ।
এরপরেই সম্পত্তির প্রতারণার পরিণামবশত বনলতা-র মা অসুস্থ হ’য়ে পড়েন ।
বিশ্বাসভঙ্গের এই চরম পরিণাম যে তাঁর জীবনে নেমে আসবে, এটা ভাবা-র আগেই বাবা ট্রান্সফার নিয়ে চ’লে এসেছেন এই কল্যানী-তে । ওদের বাড়ি ডাক্তার পাড়া-তে । ডাক্তার পাড়ায় প্রায় সবার জীবিকাই চিকিৎসা । কল্যাণী এমনিতেই বিধান চন্দ্র রায়ের করা একটা সম্পূর্ণ প্ল্যান্ড সিটি । অবশ্য সেই প্ল্যান মানুষ আর রাখেনি ।
প্ল্যান ক’রলেই তো হয় না । তাকে তো রক্ষা ক’রতে হয় । সেটা তো আর বাস্তবে আয়ুষ্মান বি.সি.রায়-এর পক্ষে সম্ভব নয় । তিনি তো আর একজনের প্ল্যান মতো চ’লে গেছেন আর এক সিটি-তে । সিটি অব প্যারাডাইস ।
এখানেই কমলা গার্লস হাই স্কুলের পাঠ শেষ ক’রে বনলতা কল্যাণী বি.সি. রায় কলেজে প’ড়েছে আর্টস নিয়ে । পড়াশুনোয় চিরকাল ভালো না হ’লেও মন্দ নয় বনলতা । সোশিয়লজি অনার্সে সেকেন্ড ক্লাসেই কলেজের গণ্ডি পার হ’য়েছে । এখন কল্যাণী ইউনিভারসিটি-তে পড়ে । এই তো ঝিলপাড় থেকে বনলতা বাস ধরে ।
ঝিলপাড় মানে এখন সেখানে কোনো ঝিল-টিল নেই। কোন এক সময়ে হয়তো ছিলো । ও হেঁটেই যায় ঝিলপাড়ে । তারপর পঁচাশি নম্বর বাস ধ’রে তিনটে স্টপেজ পার হ’য়ে ইউনিভারসিটি স্টপেজে নামে । তিনটে স্টপেজ মানে বটতলা, কলেজ পাড়া, আর ঘোষপাড়া ।
বীরপুরের ডাক্তার পাড়ায় এক প্রাক্তন শিক্ষকের বাড়িতে ভাড়া থাকে বনলতা-রা। তিনি সংস্কৃতের পণ্ডিত । খুব ভালো মানুষ । এমন বিশেষণেই তিনি পরিচিত । অবিনাশ বাবু-র এক কলিগ ঠিক ক’রে দিয়েছেন ।
এসব তো সাধারণ খবর বনলতা-দের সম্বন্ধে । কিন্তু বনলতা-র মা তাঁর ভাইদের নিষ্ঠুরতা হোক, বা বিশ্বাসহীনতা--- কোনো একটা বা উভয় কারণেই নিজেকে সামলাতে পারেননি । একটা হার্ট এ্যাটাক তাঁর হ’য়েই গেছে । শরীরে আরও নানা কম্প্লিকেশন দেখা দিয়েছে একে একে । তাঁর ট্রিটমেন্ট ক’রতে গিয়ে বাবা অনেকটা আর্থিক যুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে প’ড়েছেন ।
সৌভাগ্য এই যে, অবিনাশ সেনের সন্তান একটিই । এর বেশি হ’লে তাঁদের ভরণপোষণ চালাতে বনলতা-র বাবা এই মাগ্যির বাজারে এক মহা সমস্যায় প’ড়তেন । বনলতা মনে করে, ওর বাবা একজন নির্ভেজাল সৎ মানুষ । তাই আর্থিক ঘাটতি ম্যানেজ ক’রবার মতো যে সমস্ত রাস্তা আছে, তা তিনি অনুসরণ ক’রতে পারেননি । তবে বনলতা-র বাবা বলেন,
--- লতু, আমাকে কখনো সৎ ব’লবি না ।
সততা কোনো গুন নয় । এটা মানুষের প্রাথমিক পরিচয় । মানুষের মতো থাকবো না !
এমন কথা অবিনাশ বাবু-র লতু আগে কখনও শোনেনি । বাবা সম্বন্ধে একটা অদ্ভুত ধারনা ওর মনে । বাবা সম্বন্ধে সব সন্তানেরই একটা ভালো ধারনা থাকে ।
সব সন্তানই মনে করে, তার বাবা জগতের সবচেয়ে ভালো বাবা । নিতান্ত মদ্যপ অত্যাচারী বাবা সম্বন্ধেও সন্তান বলে,
--- আর যাই হোক, আমার বাবা-র হাজার দোষ । কিন্তু বাবা-র মনটা কিন্তু খুব সরল ।
বাস্তবে সত্যিই কি তাই ? সব সন্তানই কি তা ভাবতে পারে ? সন্তান কি তার বা তাদের বাবা-কে চেনে না ? চেনে নিশ্চয়ই চেনে । প্রায় সব সন্তানই মনে মনে অল্প-বিস্তর লজ্জিত হয় তাদের বাবা সম্বন্ধে ।
অবশ্য ততদিন সে তার বাবা-কে ভালো মনে করে, যতদিন সে অন্ধ থাকে, অজ্ঞান থাকে । বনলতা অজ্ঞান নয় । সে আজ পোস্ট গ্র্যাজুএশনের ক্যান্ডিডেট । সে বোঝে, কী ভালো, কী মন্দ । সত্যি আজ আর ও বাবা সম্বন্ধে কোনো গর্ব বোধ করে না ।
ওর বাবা-র মতো একজন যথার্থ মানুষ সম্বন্ধে গর্ব বোধ ক’রতেও হয় না ।
কিন্তু বাবা-রও জানা নেই কেন তাদের লতু বার বার বিয়ের ব্যাপারে বাধা দিচ্ছে । বনলতা-র সে ভাবনা নেহাতই বালখিল্য হ’তে পারে । বালখিল্য-ই তো । তখন সে তো টাউন স্কুলের মাত্র ক্লাশ নাইনের ছাত্রী ।
ওদের স্কুলে রি-ইউনিয়নের অনুষ্ঠান করার একটা উদ্যোগ নিয়েছিল সিনিয়ার স্টুডেন্ট-রা । সে অনুষ্ঠানে একটি বহিরাগত দাদা আবৃত্তি ক’রেছিল । সে হোল বনলতা-র যন্ত্রণা ।
প্রাক্তন ও বহিরাগত শিল্পী ছাত্র-ছাত্রীদের সেদিন বসানো হ’য়েছিল বনলতা-দের বাড়িতে । স্কুলের পাশেই ওদের বাড়ি ।
বনলতাই নিজে হাতে চা-খাবার সব পরিবেশন ক’রছিলো প্রাক্তন দাদা-দিদি’দের এবং আমন্ত্রিত শিল্পীদের । তাদের মধ্যে একটি দাদাকে দেখে হঠৎই দুর্বল হ’য়ে প’ড়েছিল বনলতা । কাঁচা বয়সের দুর্বলতা কাঁচা বয়সেই কেটে যেতো । হয়তো সেটা কিছুই হ’য়ে উঠত না । কিন্তু দুর্বলতা সেখানেই থেমে থাকল না ।
দাদা-টাও বনলতা-কে যেন কিছুটা প্রশ্রয় দিলো ওর কথার এটা ওটা উত্তর দিয়ে । এতেই বনলতা-র ভাগ্য তাকে নিয়ে অনেকটা পথ ছেলেখেলা ক’রলো ।
প্রাক্তনদের মধ্যে যারা মঞ্চে অনুষ্ঠানে আবৃত্তি, গান, গল্পপাঠ ইত্যাদি ক’রবে, তাদের সাথেই মঞ্চে সারি দিয়ে বসে গেলো দাদা-টা। বনলতা তখন একা চুপটি করে দাঁড়িয়ে ছিলো স্টাফ রুমের সামনে । এখানে ফ্লাড লাইট-টার আলো এসে প’ড়ছিল না, আর দিদিমণিদের কেউই এ তল্লাটে ছিলেন না ।
এখানে একটা প্রায়ান্ধকার পরিবেশ । নিজেকে বেশ লুকিয়ে রাখা যায় অথচ এখান থেকে স্টেজটা পুরো দেখা যায় । হঠাৎ কোথা থেকে গায়ত্রীদি এসে হাজীর । বনলতা-কে দেখেই বললেন,
--- কিরে, তুই এখানে কেন ? যা, গিয়ে বোস ওখানে । অনুষ্ঠান দ্যাখ ।
কথাটা বলে দর্শক আসন দেখিয়ে দিয়ে দিদিমণি চ’লে যেতে মনে মনে ব’লল বনলতা, ‘গায়ত্রী দি, আপনি তো জানেন না, কেন আমি এখন একটা কাঁপা কাঁপা বুক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি একান্তে । ’ আসলে মঞ্চের অতগুলো প্রাক্তন দাদা-র মধ্যে কেবল একটি দাদা যে এই প্রায়ান্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকা তরুণী হৃদয়কে বড়ো দুর্বল ক’রে দিয়েছে, তার আপনিই কী বুঝবেন ! এ যে প্রথম দর্শণেই সর্বনাশ । ’
বনলতা যেতে পারে না মঞ্চের কাছে । মনে হয় ধরা প’ড়ে যাবে । ওর দৃষ্টি তো এখন ধরা প’ড়ে যাবারই মতো ।
দ্বাদশ শ্রেণীর এক দিদি অনুষ্ঠান সঞ্চালিকা ছিলো । সেই দিদি-র নামটাও আজ আর মনে নেই বনলতার । সে ঘোষিকা হিসেবে ঘোষণা ক’রলো,
--- এবার আমাদের বিদ্যালয়ের প্রাক্তন দাদা ও দিদি এবং আমন্ত্রিত শিল্পীদের অনুষ্ঠান পরিবেশিত হবে । আমি নামগুলো পর পর জানিয়ে দিচ্ছি ।
ব’লে সেই সঞ্চালিকা দিদি একের পর এক শিল্পীদের নাম ঘোষণা ক’রে দিলেন ।
কোন ঘোষণা, কোনো নাম, কোন অনুষ্ঠান বনলতার কানে ঢুকছিল না । বনলতার চোখদুটো তো শুধু দেখছে আর দুটো চোখকে । সে কি বনলতাকে খুঁজছে ? অর্জুন যখন লক্ষ্যভেদ ক’রেছিলো, তখন বোধহয় এমন ক’রেই তাকিয়ে ছিল লক্ষ্য বস্তুর দিকে । তখন কে জানত, ঐ নামের মধ্যে একটি নাম বনলতার স্মরণ রাখা দরকার ! নামটা জরুরী । তা নয়তো সেই নাম আর নামের মালিক তার জীবনটাকে শেষ ক’রে দেবে ! তাহলে তো নামটা মনে রাখা যেতো ।
বনলতা তো তাদের নামগুলো ভালো করে শোনেনিও পর্যন্ত । সেই বয়সে কে এমনটা ক’রে একটা দপ্তরীয় বুদ্ধিমত্তা আয়ত্ত ক’রতে পেরেছে ! শুরু হ’ল প্রাক্তনদের অনুষ্ঠান । ঐ বহিরাগত দাদা-টা যে কবিতাটা আবৃত্তি ক’রলো, তাঁর মধ্যে কয়েকবার নিজের নামটা উচ্চারিত হ’তে শুনে একেবারে মুগ্ধ-মোহিত হ’য়ে পড়ে বনলতা । ও নিশ্চিত যে, ওকে লক্ষ্য ক’রেই এই কবিতাটা । দাদাটা নিশ্চয়ই কবি ।
আর সে-ও প্রেমে প’ড়েছে বনলতার । কোন না কোনভাবে সে নিশ্চয়ই ‘বনলতা’ নামটা জেনেছে আর তাই দিয়ে একটা মিষ্টি কবিতা বানিয়ে মঞ্চে ব’লেছে । বনলতার চোখের ভাষা নিশ্চয়ই দাদা-টা ধ’রতে পেরেছে । তাহলে বনলতা একাই শুধু বধ হয়নি । দ্যাদা-টাও ।
দাদা-টাও বনলতা-তে ম’রেছে নিশ্চয়ই--- এই প্রত্যয়টা বনলতাকে একটা খেলার কোর্টে যেন টেনে নিয়ে যায় । একটি যুবকের বনলতাতে না মরার কোন কারণ নেই । বনলতা জানে, সে বেশ ডাগর-ডোগর । এই শব্দদ্বৈত সে শুনেছে ছোট বয়সেই নিজের দিদার মুখে । দিদা বারবারই মাকে সাবধান ক’রতো ।
ব’লতো,
--- মিনু, মেয়েটাকে সামলে রাখিস । যা ডাগর-ডোগর চেহারা !
‘ডাগর-ডোগর’ শব্দের যথার্থ না জানলেও প্রায় সব মেয়ের মতো এটা বুঝেছিল বনলতা যে, তাঁর শরীর বেশ উদ্ধত । তাছাড়া রং থেকে শুরু ক’রে মাথার চুল--- সবই দেখার মতো । মাথা ঘোরাতে পারে যে কোন কাঁচা বয়সের মানুষের । তাই আজ একটা খেলা যেন পেয়ে বসে ওকে ।
প্রেম না বুঝলেও তার না জানা স্পর্শ বনলতাকে রোমাঞ্চিত করে। ও ভাবে, এই দাদা-টা নিশ্চয়ই একই অবস্থা উপভোগ ক’রছে । তা নয়ত এত তাড়াতাড়ি ওর নামে একটা গোটা কবিতা বানিয়ে দিলো কীভাবে ! আর নিজেকে সংবরণ ক’রতে পারে না বনলতা । তারুণ্যের চটুলতায় প্রায় নির্লজ্জের মতো ভালো-মন্দ, ঠিক-বেঠিক, উচিত-অনুচিত কিছুমাত্র বিবেচনা না ক’রে অনুষ্ঠানের শেষে চা দেবার ফাঁকে একটি কাজ গোপনে ক’রে ব’সলো বনলতা, যার মাশুল তাকে আজও গুনতে হ’চ্ছে।
সেই দাদা-র পকেটে সবার অলক্ষ্যে একটা চিঠি ঢুকিয়ে বসে সেদিনই ।
জানতেই পারেনি যে, যে কবিতাটা ঐ দাদা-টা আবৃত্তি ক’রেছে, সেটা বাংলার কোনো এক বিখ্যাত কবির রচিত কবিতা । তাকে উদ্দেশ ক’রে নয় । কতটুকুই বা বয়স তখন ! কী-ই বা বোঝে কবিতার ! কবিতা তো পাঠ্য বইতেই থাকে । কেবল জেনেছিল, ওর বান্ধবীরা তাদের বয়ফ্রেন্ডদের থেকে নাকি নানা কবিতার লাইন পায় চিঠিতে । কিন্তু পাঠ্য বইও ছাড়া তো কবিতা পড়ার বয়স সেটা নয় ।
এমনি এমনি কবিতা ক-জনই বা পড়ে ! বিজ্ঞান আর মিডিয়ার দৌলতে তো কাব্য-সাহিত্য প্রেম চুকে-বুকে যেতে ব’সেছে । তথাকথিত শিক্ষকেরাই তো আজকাল কবিতার যাথার্থ্য বোঝে না । ক্লাসে কবিতার ভুল ভুল ব্যাখ্যা করে । নোট বইতে যেমনটি লেখা আছে, তেমনটি চালিয়ে দ্যায় । তাছাড়া সাধারণ মেয়েরা কবিতা চর্চার ক্ষেত্রে কিঞ্চিৎ অনুৎসাহী তো বটেই ।
গল্প-টল্প তাদের অবসর কাটানোও নয়, শুধু দিবানিদ্রা দেবার আগে একটা নিদ্রালুতা আনার উপায় মাত্র।
বনলতা কিন্তু ভাবেওনি, একটা মেয়ে হওয়ার কারণে এটা করা যায় না । একটা ছেলে ক’রলেও ক’রতে পারে । কিন্তু অন্তত এ দেশে তো মেয়েদের কাছ থেকে এমনটা একেবারেই ভাবা যায় না । এ দেশের মেয়েদের বুক ফাটে তো মুখ ফোটে না ।
তার মানে এ নয় যে, তা বলা কোন নিষিদ্ধ একটা গণ্ডি, যেটা পেরনো মেয়েদের পক্ষে সীতাদেবীর লক্ষণরেখা পার হবার বিপদের মতো বিপদ ডেকে আনবেই । আসলে এখানেই এ দেশের নারীদের নিজস্বতা । হয়তো এটাকে সম্বল ক’রেই নারীরা এ দেশের পুরুষের সম্পদ বা অধীনস্থ হ’য়ে ওঠে । পুরুষরাও জানে, এই গোপন অথচ প্রকাশিত কথাটা । এটা এক রকম ওপেন সিক্রেট ।
কবিতা শেষ হ’লেই সেদিন এক ছুটে বাড়িতে চ’লে গিয়েছিল বনলতা । তারপর খাতার কাগজে খসখস ক’রে কী যে লিখেছিল, তা আজ আর মনে নেই । হয়তো ‘তুমি আমার…… আমি তোমার….’ এই জাতীয় কিছু । তারপর ঘর থেকে পারফিউম এনে স্প্রে-ও ক’রেছিল তাতে । ও জানে, প্রাক্তনদের অনুষ্ঠানের পরে সবাই ওদের বাড়িতেই আসবে ।
আর তখনই সর্বনাশ-টা ক’রে বসে বনলতা ।
কিন্তু সেই লক্ষ্মণরেখা পার হওয়া বনলতার জীবনে যেন সীতাদেবীর থেকেও বড়ো বিপদ ডেকে আনলো । চিঠিতে উত্তেজনায় নিজের নামটাও লেখেনি অথবা তখন লিখতে চায়নি। মনে নেই আজ । ফাংশান শেষ হ’লে দাদা-টা আবার মঞ্চে আসে ।
মাইক্রোফোন নিয়ে সোজা এ্যানাউন্স করে,
--- আজ আমি একটা চিঠি পেয়েছি । বেনামী চিঠি । যে চিঠিটা দিয়েছ, সে আমাকে ৯৮৩০০ ২২৩২২ নম্বরে ফোন কোর । আমি তার ফোনের জন্যে অপেক্ষা ক’রবো । আমি ফাংশান শেষ হলেও চ’লে যাইনি, তার কারণ এটাই ।
আবার মনে ক’রিয়ে দিই, আমার ফোন নম্বর ৯৮৩০০ ২২৩২২ ।
একবার বনলতার মনে হ’ল, বেশি সাহস দাদা-টার । মাইক্রোফোন নিয়ে এসব বলার কী দরকার ছিল ! তুমি তো জান কার্ত্তিক, কে দিয়েছে চিঠিটা, কেই-বা দিতে পারে । ও শুধু দেখলো, দাদা-টা স্টেজ থেকে নামতেই তাকে নিয়ে তাঁর বন্ধুরা নানা মস্করা ক’রছিলো, চিঠিটা দেখতে চাইছিল, সত্যি না মিথ্যে--- জানতে চাইছিল । দাদা-টা কিন্তু কাউকে চিঠিটা দেখায়নি ।
বনলতা লক্ষ্য ক’রেছে, দাদা-টা কোন উত্তর না দিয়ে যে মোটর সাইকেলে এসেছিলো, তাতে চ’ড়ে হুড়মুড় করে চ’লে যায় ।
বনলতা বুঝলো যে, দাদা-টা ওর জালে ধরা প’ড়েছে । তাহলে রুচিরা, মোহর, মনীষাদের মতো ওরও একটা বয়ফ্রেন্ড জুটে গেলো । বন্ধুদের কাছে ওর স্ট্যাটাসটা তাহ’লে থাকলো । আর এ খুব হ্যান্ডসাম ।
তার ওপর কী ভালো কবি ! এবার বন্ধুদের প্রেমপত্রে ও নিজেই কোটেশন সাপ্লাই ক’রতে পারবে । মনে মনে ভয়ও খুব হ’য়েছিলো এ্যানাউন্সমেন্ট শুনে । কে জানে কী ব’লে বসবে দাদা-টা ! বেঁচে গেছে এ যাত্রা । বাড়িতে এসব জানতে পারলে বাবা খুব কষ্ট পেতো । কিন্তু ফোন তো ক’রবে, ফোনে কী ব’লবে ? এসব তো জানা নেই ।
চিঠি লেখা এক, আর মুখে কথা বলা আর এক । কিন্তু একটা নেশা, একটা কৌতূহল, একটা আসক্তি, একটা টান ওর মনের মধ্যে ওকে এ-ফোঁড় ওফোঁড় ক’রছিল । বুকের মধ্যে একটা গুড়গুড় ধ্বনি রোজ শুনতে পেতো বনলতা । শরীরে কোথায় কোথায় কেমন কেমন যেন হ’চ্ছিল । এসব নিয়ন্ত্রণ ক’রতে পারে, সে সাধ্য কি বনলতার!
সেদিন সন্ধে হবো হবো ।
কোথা থেকে যে এতোটা সাহস পেলো মেয়েটা, তা আজও জানে না । বাবার মানিব্যাগ থেকে দুটো টাকা নিয়ে বাজারের মধ্যেকার একটা বুথ থেকে ফোনটা ক’রবে ঠিক করে । বুথটা ওদের তেমন পরিচিত না হ’লেও আশে পাশে চেনা মানুষ ঘুর ঘুর করে । এখানে ওদের তো অনেকদিনের বাস । তাই চেনা মানুষ ওকে ফোন ক’রতে দেখতে পেলে বিপদ হ’তে পারে ।
চারপাশ দেখে নিয়ে বনলতা ওর দোদুল্যমান বুক চেপে ধ’রে দুম ক’রে নম্বর মিলিয়ে বোতাম টিপে দ্যায় ৯৮৩০০ ২২৩২২-তে । কিন্তু কে জানত, কী হবে ! জীবনে কোন মেয়ে কোন ছেলের কাছ থেকে এমন প্রত্যুত্তর জীবনে পেয়েছে কিনা, তাই বা কে জানে ! ওপার থেকে ‘হ্যালো’ শুনতেই বনলতা বলে,
--- আপনি আমাকে ফোন ক’রতে বলেছিলেন । আমি….
কথাটা শেষ ক’রতে পারেনি, ওপাশ থেকে যুদ্ধের নানা অস্ত্র শেল, শক্তি, জাটি, তোমর, ভোমর, শূল, মুশল, মুদ্গর, পট্টিশ, নারাচ, কৌন্ত এসব ছুটে ছুটে আসতে লাগলো । সে সব অস্ত্রের আঘাতে জর্জরিত রক্তাক্ত বনলতা যেন মূর্ছিত হয়ে প’ড়বে, এমন অবস্থা হলো ।
ছেলেটা কড়া ভাষায় ব’লল--- আমি তোমার নামটাও জানতে চাই না ।
পরিচয় শুনতে চাই না । তুমি নাম ব’ললে সেদিনের চিঠিতে লিখতে। তোমার কোন স্ক্যান্ডাল হোক, আমি তাও চাই না । তুমি একটা ভদ্রঘরের মেয়ে নিশ্চয়ই । স্কুলে পড়াশুনো ক’রতে এসেছো ।
এভাবে কোন ছেলের জামার পকেটে প্রেমপত্র দাও তুমি ! ছি ! ছি ! জানি না, তুমি কোন ক্লাশে পড়ো । তোমার বাবা-মা এসব জানেন ? তারা কি তোমাকে এসব ক’রতে স্কুলে পাঠিয়েছেন ? এটা কো-এড স্কুল । নিজেকে সামলে চলো । আর শোন, এই নম্বরটা আজ থেকে ভুলে যেও । বুঝেছো ? এবার ফোন রাখো ।
যাও, বাড়ি যাও ।
ক্লাশ নাইনের বনলতা নীরবে নিঃশব্দে শুনে গেলো সেইসব তীব্র কথাগুলো । ওর সারা গায়ে যেন আগুনের ছ্যাকা লাগছিলো । যন্ত্রনায় আর জ্বালায় দগ্ধ হ’য়ে যাচ্ছিল বনলতা । এ কী অপমান ! এটা কী ক’রলো ও ! কেন না বুঝে এমন কাজ ক’রলো ! মরণ হয় না ওর ! এমনকি একদিন ম’রতেও চেয়েছিল ও ।
কিন্তু আত্মহত্যা ক’রতে যে সাহস লাগে, তা বুঝেছিল সেদিন । ঘরে সিলিং ফ্যানের সাথে সিনথেটিক ওড়না জ’ড়িয়ে ঝুলবে ভেবেছিল । এ অপমানিত জীবন আর রাখবে না । কিন্তু সবটা রেডি হ’য়ে গেলেই একটা আতঙ্ক গ্রাস করে ওকে। গলায় ফাঁস আটকে থাকা ওর নিজের মৃতদেহ-টা মনে মনে এঁকে ফেলতেই আতঙ্ক ওকে একেবারে কুঁকড়ে দ্যায় ।
ব্যস্ । আর সুইসাইড করা হয়নি ।
জীবনে প্রথম ভালোলাগায়, প্রথম প্রেমে এমন ধম্কি কে কবে খেয়েছে, কে জানে ! অন্তত বনলতা তো জানে না । সে রাত্রে খুব কেঁদেছিল বনলতা । কান্নার প্রথম কারণ, এ্যাত বড়ো অপমান সহ্য ক’রতে পারেনি ।
ভাগ্যিস, আর কেউ জানে না । কাউকে জড়ায়নি । তাই রক্ষে । তা নয়তো অন্যের কাছ থেকেও চূড়ান্ত অপমানিত হ’তে হ’তো । কান্নার দ্বিতীয় কারণ হলো, এই প্রথম ওর মনে হলো, একটা ভয়ানক ভুল ক’রে বসেছে ও ।
এটা একটা মেয়ে হ’য়ে করা যায় না। এটা একজন নব যৌবনপ্রাপ্ত মেয়ের কাছে বিপুল লজ্জার বিষয় হ’য়ে দাঁড়ালো । বিশেষত একজন পুরুষ মানুষের থেকে প্রত্যাখ্যান যেন বনলতাকে ক্ষত-বিক্ষত ক’রে ফেলছিল । ওর যত ক্লাসমেট ছিলো, তাদের অনেকেই প্রেম-ট্রেম করে । কিন্তু ও কথা ব’লে জেনেছে, তারা কেউই ছেলেদেরকে নিজে প্রপোজ করে নি ।
ছেলেদেরকে ‘না না’ ক’রে তাদের প্রপোজাল এ্যাক্সেপ্ট ক’রেছে মাত্র। হয়তো সেই এ্যাক্সেপ্ট করার পিছনে প্রপজ্ড টোপ ছিল । সেই টোপটি খেয়ে তাদের প্রেমিকরা প্রপোজ ক’রেছে । তা থেকে বনলতা বুঝে নিয়েছিলো, মেয়েদের প্রেম হওয়া উচিত ‘ধরি মাছ না ছুঁই পানি । ’ অর্থাৎ জলে নামবো, জল ছড়াবো, চুল ভিজাবো না ।
এসব তো পরে কালে কালে জেনেছে, কথা প্রসঙ্গে জেনেছে ।
বনলতার যে তর সয়নি তার জীবনের প্রথম প্রেমে । তার নিজের কারণেই তাকে এভাবে অপমান স’ইতে হলো । নিজের মধ্যেই লজ্জায় ছিঁড়ে কুটি কুটি হ’য়েছে ও । ঠিক মতো নামটাও শোনেনি দাদা-টার ।
হয়তো তার মুখটাও আজ দেখলে চিনতে পারবে না । সেই মুহূর্তে কি ও ভেবেছিলো, একটা ছেলে ওকে এভাবে অবহেলায় ছুঁড়ে ফেলে দিতে পারবে ! বনলতা অসুন্দর নয়। তখন তো সে সবে বিকশিত হ’চ্ছিলো একটি আসন্ন ও আকর্ষণীয় যুবতী হবার প্রত্যাশায় । এমন একটি মেয়ে যদি কোন ছেলেকে ব’লে বসে--- ‘আমি তোমাকে ভালবাসি’, একটা ছেলের পক্ষে মাথা ঘুরে যাওয়াই স্বাভাবিক ব’লে মনে ক’রেছে বনলতা । কিন্তু তা হয়নি ।
ওর আশালতা একেবারে মুড়ে খেয়ে গেছে এক অজানা কোন ডাইনী ।
মন বলছিল, দাদা-টা কি এনগেজ্ড ? ওর কি অন্যও কোন প্রেমিকা আছে ? একবার তাকে সামনে পেলে একেবারে শেষ ক’রে দেবে । আবার মনে হয়, কেনই বা এমনটা ভাবছে ! তারই বা কী দোষ ! সে-ও তো প্রেম ক’রেছে । ভালবেসেছে । তার তো কোন অন্যায় নেই ।
সে তো জানে না যে, বনলতার মতো কোন মূর্খ মেয়ে-ও পৃথিবীতে থাকতে পারে । সে-ও মন প্রাণ সব দিয়ে ব’সতে পারে তার প্রেমিককে । সেই নাম না জানা মেয়েটা তো নির্দোষ । যে সময়ে এসে বনলতা জেনেছে যে, দাদা-টা সেদিন বিখ্যাত এক কবির আবৃত্তি কবিতা ক’রেছিল, তখন সেই কবিতা পড়ার জন্যে হন্যে হ’য়ে লাইব্রেরী-তে লাইব্রেরী-তে ঘুরেছে ও । কানে শুধু একটাই ছত্র বেজে চলেছে, ‘আমারে দু-দণ্ড শান্তি দিয়েছিল নাটোরের বনলতা সেন’।
স্টেজের আবৃত্তিতে বা পরে সেই কবিতা খুঁজে পাবার পর সেই কবিতা প’ড়ে মাথামুণ্ডু কিছুই বোঝেনি বনলতা । তবে এটা বুঝছে যে, এটা একটা নির্ভেজাল প্রেমের কবিতা আর নায়িকা স্বয়ং ‘বনলতা সেন’ । তাই সমস্ত রাগ গিয়ে প’ড়েছে বাবা-মার ওপর । কেন এমন একটা নাম রেখেছে তাঁরা ? ‘বনলতা’ নাম কি এখন চলে ! যতসব পুরনো বাজে নাম ! মাকে গিয়ে ধ’রেওছে ।
--- মা, আমার এই বাজে নামটা কে দিয়েছে, বলতো ।
বনলতা ! বনলতা সেন । কী বাজে নাম ! আর কী বাজে টাইটেল ! ‘সেন’ । বিশাল বাজে টাইটেল । তার ওপর বনলতা ।
মিনতী দেবী হেসে দেন মেয়ের কথায় ।
বলেন--- কী যে বলিস তুই, লতু ! সেন টাইটেল তো কেউ সাধ ক’রে রাখেনি । এটা তো তদের পিতৃ-পিতামহের পদবী । এর আবার খারাপ ভালো হয় নাকি ? আর বনলতা নামটা রেখেছে তোর বাবা । তুই তো জানিস না, তোর বাবা একসময় কবিতা আবৃত্তি ক’রতেন । তখনি তাঁর প্রিয় কবির কবিতা ‘বনলতা সেন’থেকেই তোর নাম দিয়েছেন ।
কবি কে, জানিস ? জীবনানন্দ দাশ ।
লতুর মনে প’ড়লো ওদের পাঠ্য বইতে জীবনানন্দ দাশের কবিতা‘রূপসী বাংলা’ কবিতা ও প’ড়েছে । কী বাজে কবিতা ! কোন ছন্দে মিল-ফিল নেই । যেন গদ্য পড়ছে । ফালতু ! আর কেন যে লোকটা একটা মেয়ের নাম নিয়ে এমন একটা কবিতা লিখতে গেলো, বুঝে পায়নি বনলতা ।
নোট বইতে প’ড়েছে, লোকটা নাকি মাস্টারমশাই ছিলেন । মনে হ’য়েছিলো, এই মাস্টার মশাইরা শুধু ক্লাসেই জ্বালায় না, কবিতা লিখেও জ্বালায় । কিন্তু মাকে এ্যাতো অল্পে ছাড়তে রাজী নয় সে । ফের প্রশ্ন করে,
--- কেন ? কবিতার বনলতা কেন ? আর কোন নাম ছিলো না ?
--- সে তোর বাবার যুবক বয়সের কথা । বনলতার মা লজ্জা পান ।
--- যুবক বয়সে বাবার কী হয়েছিল ? এর সাথে বাবার যুবক বয়সের আবার কী সম্বন্ধ, বুঝতে পারে না বনলতা ।
মিনতি দেবী বলেন--- তোর বাবার মনে মনে এই স্বপ্ন ছিলো যে, তিনি বনলতা নামে কোনো মেয়েকেই বিয়ে ক’রবেন । তেমন ক’রেই একবার কাগজে বিজ্ঞাপনও দিয়েছিলেন । জীবনানন্দ দাশের বনলতা সেন তাঁর ম।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।