ঝলমল করছে দুপুরের রোদ। কিন্তু তাপ কমে এসেছে, ছুরির গা চকচকে থাকলেও তাতে ধার কমে গেলে যেমন হয়। হেমন্তের প্রভাব বাড়ছে প্রকৃতিতে। সন্ধ্যার আঁধার এখন বেশ ঠান্ডা ঠান্ডা। হরতালে অবসন্ন হয়ে আছে দুপুর।
সেদিন ছিল তিন দিনের হরতালের মধ্যম দিন।
শিশু একাডেমীর প্রাঙ্গণে কেউ নেই। তবে অফিস খোলা। প্রবেশপথের পশ্চিমে বাগান। গাছের সরু শাখাগুলো দুলিয়ে, পাতা কাঁপিয়ে বয়ে যাচ্ছে ঝিরিঝিরি হাওয়া।
তাতে ভেসে নিঃশব্দে যেন স্বাগত জানাতে এল মিষ্টি একটা গন্ধ। মনে হলো চেনা চেনা। বাগানের শেষ মাথায় গিয়ে দেখা গেল ঠিক তাই। শিউলি। বাগানের কিনার ঘেঁষা লাল ইটের পায়ে চলা পথটির খানিকটা অংশ সাদা হয়ে আছে ঝরা ফুলে ফুলে।
গাছটি বেড়ার ওপারেই।
কত রকমের আকস্মিক ঘটনাও যে ঘটে! কাজ শেষে বেরিয়ে আসছি, সঙ্গে প্রকৃতিবিষয়ক লেখক মোকারম হোসেন। তাঁর সম্পাদিত মাসিক প্রকৃতি পত্রর নতুন সংখ্যাটি দিলেন। কথা হচ্ছিল শিউলিগাছটি নিয়েই। জানালেন, নিসর্গী দ্বিজেন শর্মা গাছটি লাগিয়েছিলেন।
আর ঠিক তখনই দেখি, মাথায় এলোমেলো চুল, কাগজপত্র রাখার ব্যাগ হাতে হাস্যোজ্জ্বল মুখে প্রবীণ উদ্ভিদবিজ্ঞানী বেরিয়ে আসছেন অফিস ভবন থেকে। তিনিও এসেছিলেন কোনো কাজে। এবার শিউলিবৃত্তান্ত শোনা গেল তাঁর মুখেই।
দ্বিজেন শর্মা বলছিলেন, ‘আমার বাড়ির টবে ছিল গাছটি। চারাটি কোথা থেকে এনেছিলাম ঠিক মনে নেই।
টবে শিউলি হয়। তবে পানি দিতে হয় প্রচুর। খোলামেলা জায়গারও দরকার। এসব ঠিক হচ্ছিল না। তাই টব থেকে তুলে এখানে এনে লাগিয়ে দিয়েছিলাম।
’ সেই শিউলি ডালপালা ছাড়িয়ে উঠে গেছে মানুষের মাথার থেকে অনেক উঁচুতে। পরিণত বৃক্ষ সে এখন। শাখা ভরে উঠছে ফুলে ফুলে। তার সৌরভ নিয়ে বয়ে যাচ্ছে বাতাস। তাঁর মতে, কোনো বাগানই পূর্ণতা পায় না শিউলি না থাকে যদি।
শিউলি মূলত শরতেরই ফুল। তবে হেমন্তও বঞ্চিত নয় শিউলির শোভা ও সৌরভ থেকে। ফুল ফোটা দিনে দিনে কমে এলেও কার্তিকের শেষাবধি তার দেখা পাওয়া যাবে। শিউলি ও শেফালি দুটো নামই লিখেছেন রবীন্দ্রনাথ। ‘শেফালী বনের মনের কামনা’, ‘শিউলি ফুল, শিউলি ফুল, কেমন ভুল, এমন ভুল’, ‘শরৎ, তোমার অরুণ আলোর অঞ্জলি...শিউলিবনের বুক যে ওঠে আন্দোলি’, ‘শিউলী বনের উদাস বায়ু পড়ে থাকে তরুতলে’—এই গানগুলো শিউলির মতোই সুরভিত হয়ে আছে শ্রোতাদের কাছে।
শিউলি কেবল কবিদেরই বিমুগ্ধ করেনি, তার অসংখ্য মুগ্ধ অনুরাগী যুগে যুগে। ভোরবেলায় শিশির মাখা শিউলি ফুল কুড়োতে যাওয়ার স্মৃতিও অম্লান সেই অনুরক্তদের অন্তরে।
শিউলি নিয়ে পুরাণের বিষণ্ন কাহিনিটি অনেকেরই জানা। দ্বিজেন শর্মার শ্যামলী নিসর্গ বইতেও আছে। কোনো এক কালে এক রাজনন্দিনী ভালোবেসেছিলেন সূর্যকে।
ব্যর্থ হলো তাঁর প্রেম। প্রবঞ্চিত রাজকন্যা হলেন আত্মঘাতী। তাঁর চিতাভস্ম থেকে জন্মাল একটি গাছ। আর সেই গাছেই তাঁর বেদনা ফুটল শুভ্র ফুল হয়ে। রাতের নিভৃতে।
সূর্যের আলোর স্পর্শ পাওয়ার আগেই গেল ঝরে। সেই হলো শিউলি ফুল। উজ্জ্বল কমলাবৃন্তের ওপর সাজানো তুষার শুভ্র পাপড়ির চোখজুড়ানো স্নিগ্ধ রূপ আর মনে প্রশান্তি আনা সৌরভের জন্য শিউলি ফুল কেবল প্রিয়ই নয়, আদরণীয় হয়ে আছে ছেলে-বুড়ো—সবার কাছেই।
জন্মস্থান উত্তর-ভারত। বৈজ্ঞানিক নামNyctanthes arbor-tristis।
আমাদের দেশের সব অঞ্চলেই জন্মে। চেনা গাছ। বিস্তারিত বিবরণ নিষ্প্রয়োজন। তবে প্রয়োজন হলো যত্ন করে তাকে বাঁচিয়ে রাখা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।