সম্প্রতি টকটাইম দিয়ে বাজার থেকে দ্রব্যাদিসহ বিভিন্ন মিউজিক ও সফটওয়্যার যেমন—মোবাইল অ্যাপস ক্রয় করার অনুমতি দেওয়া যায় কি না, তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে আলোচনা হচ্ছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশ ব্যাংকের সম্মতি নিয়ে বিটিআরসি টকটাইম দিয়ে ৫০ টাকা পর্যন্ত কেনাকাটার অনুমতিও দিয়েছে। কিন্তু বিভিন্ন ব্যাংকারের মতে, টকটাইম দিয়ে দ্রব্যাদি ক্রয়-বিক্রয় করতে দিলে দেশে একটি নতুন মুদ্রার আবির্ভাব ঘটবে। ফলে দেশে দুটি সমান্তরাল মুদ্রার প্রচলন ঘটবে, যার একটি হলো টাকা এবং অন্যটি হলো টকটাইম। টাকার মুদ্রণ ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা থাকবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে।
অন্যদিকে টকটাইম নামক মুদ্রা তৈরি করার ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণব্যবস্থা থাকবে মোবাইল কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে।
মোবাইল কোম্পানি সাধারণত এক টাকার বিনিময়ে এক টাকার টকটাইম তৈরি করে থাকে। তবে তাদের ইচ্ছা অনুযায়ী তারা কখনো কখনো এক টাকার পরিবর্তে দুই টাকার টকটাইমও দিয়ে থাকে (বোনাসসহ)। তেমনিভাবে কোনো টাকা না নিয়েও মোবাইল কোম্পানি কোনো একটি মোবাইলের বিপরীতে লাখো টাকার টকটাইম ভরে দিতে পারে। অর্থাৎ বাজারে টকটাইম নামের মুদ্রার প্রবেশ দেশের বা সরকারের বা মুদ্রানীতির ওপর নির্ভর করবে না।
অন্য কথায়, দেশের জিডিপি বা মুদ্রাস্ফীতির সঙ্গে মুদ্রা তৈরির কোনো মিল থাকবে না। তাতে দেশে অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা দেখা দেবে। আর টকটাইমের বিপরীতে কোনো টাকা না থাকায় বিনা মূল্যে দ্রব্যাদি ক্রয় করা যাবে। যেমন ধরা যাক, একটি মোবাইল কোম্পানি তার কর্মকর্তাদের বেতন টকটাইম হিসেবে প্রদান করল। তাতে কোম্পানির কোনো খরচ নেই, কিন্তু কর্মকর্তারা ওই টকটাইম দিয়ে বাজার থেকে বিভিন্ন সেবা ও দ্রব্যাদি ক্রয় করতে পারবেন।
কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাঁরা ওই মোবাইল কোম্পানির রিটেইলারদের কাছ থেকে টকটাইমের বিনিময়ে নগদ টাকাও নিতে পারবেন। এতে করে মার্কেটে নতুন টাকা প্রবেশে সরকার বা কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কোনো নিয়ন্ত্রণ থাকবে না।
উল্লেখ্য, বাংলাদেশ ব্যাংক জিডিপি ও মুদ্রাস্ফীতির হার ও বার্ষিক মুদ্রা পোড়ানোর মূল্যের ভিত্তিতে প্রতিবছর নতুন মুদ্রা ছাপিয়ে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংক সেই মুদ্রা থেকে একটি টাকাও সরাসরি বাজারে ছাড়তে পারে না। অতিরিক্ত মুদ্রাবাজারে প্রবেশের উপায় হলো দুটি।
এক. রপ্তানি, এইড বা রেমিট্যান্সের মাধ্যমে দেশে আসা বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময়ে সমমূল্যের টাকা প্রাপকের মাধ্যমে বাজারে প্রবেশ করা। দুই. বিভিন্ন বন্ড, সঞ্চয়পত্র ইত্যাদির বিনিময়ে সরকার বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে সরাসরি নগদ টাকা গ্রহণ করে তা উন্নয়ন কর্মসূচি বা অন্যান্য খরচের মাধ্যমে বাজারে সরবরাহ করে। কিন্তু টকটাইম তৈরির মাধ্যমে মোবাইল কোম্পানিসমূহ বাজারে সরাসরি মুদ্রার প্রবেশ ঘটাতে পারবে। ফলে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে মুদ্রাস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ সম্ভব হবে না।
উল্লেখ্য, যেকোনো ই-মানি সার্ভিসের ক্ষেত্রে সার্ভিস প্রদানকারী সংস্থাকে সব সময় সমমূল্যের টাকা ব্যাংকে রাখতে হয়।
যেমন: মোবাইল ফিন্যান্সিয়াল সার্ভিসেস গাইডলাইনে বলা আছে, সব মোবাইল ওয়ালেটের মধ্যে যে পরিমাণ ই-মানি থাকবে, কোর ব্যাংকিংয়ের ব্যালান্সশিটে তথা ব্যাংকের ভল্টে ওই পরিমাণ টাকা থাকতে হবে। কিন্তু টকটাইমের বিপরীতে সমপরিমাণ নগদ টাকা ব্যাংকে রাখা সম্ভব নয়। কারণ, টকটাইম শুধু কেনাকাটা নয়, কথা বলতেও ব্যবহার করা হয়।
টকটাইম দিয়ে ৫০ টাকা পর্যন্ত কেনাকাটার যে অনুমতি দেওয়া হয়েছে, তাতে হয়তো দেশের অর্থনীতিতে এর প্রভাব অনুভূত হবে না, কিন্তু এই সুযোগ কাজে লাগিয়ে ভবিষ্যতে এর পরিমাণ বাড়ানো হলে দেশের অর্থনীতিতে এর নেতিবাচক প্রভাব ঠেকানো যাবে না।
টকটাইম দিয়ে কেনাকাটা করার অনুমতি পৃথিবীর কোনো দেশে আছে কি না, তা আমার জানা নেই।
কিন্তু ভিন্ন ওয়ালেট অ্যাকাউন্ট তৈরি করে, গ্রাহকের কাছ থেকে নগদ টাকা নিয়ে ও ব্যাংকে ওই পরিমাণ টাকা সংরক্ষণ সাপেক্ষে, ওই ওয়ালেটে সমপরিমাণ ই-মানি সরবরাহ করে ওই ই-মানি দিয়ে নির্দিষ্ট কিছু কেনাকাটা করার রেওয়াজ আমাদের দেশেও প্রচলিত রয়েছে। গ্রামীণফোনের মোবিক্যাশ এমনই একটি সার্ভিস। তবে এই পদ্ধতিতেও কিছু সমস্যা রয়ে গেছে। যেমন: মোবাইল কোম্পানিগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে নেই, ফলে সার্ভিসটি যথাযথভাবে পরিচালিত হচ্ছে কি না, তা কোনোভাবেই কেন্দ্রীয় ব্যাংক জানতে পারবে না। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের পক্ষে মোবাইল কোম্পানিগুলো অডিট করার কোনো সুযোগ নেই।
আবুল কাশেম মো. শিরীন: ডিএমডি, ডাচ্-বাংলা ব্যাংক।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।