আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

আমাদের দিদিরা কেন এইভাবে ঝুলে ছিল?



শোয়াইব জিবরান বৈজয়ন্তীরা ছিল ছয় বোন। কিন্তু তাদের কোন ভাই ছিল না। হয়ত তারা অনুরোধ করেছিল অথবা করেনি ফলে একটি ভাইয়ের জন্য তাদের টুলে প-িত পিতা ক্রমেই ভুল করে খালি বোনই এনে দিচ্ছিলেন। অবশ্য তাদের পিতা যাকে আমার মাস্টার মশাই বলে ডাকতাম তিনি বলে বেড়াতেন এ জন্য ব্রাহ্মণীই দায়ী। আমাদেরও তাই মনে হতো।

কেননা, প-িতজী যেহেতু শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণ চরিতামৃত পড়ে থাকেন তিনি মিথ্যা বলবেনইবা কেন? তাছাড়া আমরা তো শুনেছি দাই বলেছে, বোনগুলো বাহ্মণণীর পেট থেকেই নাকি বেরিয়ে এসেছিল। প-িতজীর কোন পাঠশালা ছিল না। ইতিহাসের শিক্ষক বলেছিলেন, লর্ড মেকলে নাকি সেগুলি বন্ধ করে দিয়েছিলেন দুশ বছর আগে। আর ওগুলি নাকি পাঠশালা ছিল না। ছিল টুল।

এজন্য লোকে তাকে টুলেপ-িত বলেও ডাকে শুনেছি। অবশ্য টুলগুলো দুশ বছর আগে বন্ধ হয়ে গেলে প-িতজী এখনও কীভাবে আছেন আমরা, মানে পাড়ার ছেলেরা বুঝে উঠতে পারিনি। বৈজয়ন্তীরদের যেহেতু কোন ভাই ছিল না সে জন্য সে অথবা তার দিদিরা আমাদের ভাই বলে জানতো। আমরা ছিলাম শত শত ভাই। তারা আমাদের মানে পাড়ার কিশোরদের কোন ভাইফোটা দেয়নি তবু আমরা তাদের বোন বলেই জানতাম।

এর একটি যৌক্তিক কারণ অবশ্য তার পিতার আমাদের প্রাইভেট পড়াতেন। আর আমাদের পাঠ্যবইয়ে লিখা ছিল শিক্ষক হলেন দ্বিতীয় পিতা। আমরা আমাদের পাঠ্যগ্রন্থগুলোকে ধর্মগ্রন্থের মতই সত্যবাদী বলে জানতাম। আমরা প-িতজীকে পিতা বলেই জানতাম। আমাদের ফসলউঠা মাঠের প্রতিটি খড় সাক্ষ্য আমরা যখন সেখানে ফুটবল খেলতে যেতাম বৈজয়ন্তিরা হাততালি দিতে আসত।

হাততালি দিলে বোনের উৎসাহে আমরা আহ্লাদিত হতাম। এখনও যদি তুমি জিজ্ঞাসা করো বিকেলের কনে দেখা আলোকে বা যেবাতাস সেদিগুলোতে বয়ে যেত তাকে, আমরা বৈয়ন্তিদের বোন বলে জেনেছিলাম। কিন্তু পাড়ায় যারা ছিল আমাদের চেয়ে একটু বয়েসে বড়-তপন, শ্যামল, নান্টু তারা জানি কেমন কেমন ছিল। তারা খেলা মাঝখানে রেখে হঠাৎ হঠাৎ পানি খাওয়ার নাম করে বৈজয়ন্তীর ঘরে যেত। আর আমরা দেখতাম বৈজয়ন্তীর দিদিরা খুব বিরক্ত হতো।

ওরা ফিরে আসার পর দিদিরা মুখ কালো করে থাকত। এজন্য আমাদের কোন পানির তুষ্ণা হতো না। কেননা, আমরা কখনও চাইনি যে আমাদের পানির জন্য দিদিদের মুখ কালো হোক। আর দাদাগুলোকে আমাদের এমনিতেই ভাল লাগত না। তারা খেলার সময় বল রেখে আমাদের উরুতে, নিতম্বে চাপ দিতো।

আমাদেও মোটেই ভাল লাগত না। এ জন্য তাদের কাছে বল গেলে আমরা খুব একটা কাছে ঘেসতে চাইতাম না ফলে গোল তারা বেশি বেশি দিত। একদিন রাতে বৈজয়ন্তিদের বাড়িতে বেশ শোরগোল শোনা দিয়ে গিয়েছিল। কুকুরগুলো হল্লা করছিল আর আর কাদের জানি মেয়েলি কান্না শুনা গিয়েছিল। অবশ্য পৃথিবীর সকল কান্না ও আহাজারির রূপ একই রকম বলে আমরা, কিশোরেরা হয়ত আলাদা করতে পারিনি।

এখনও যেমন পারিনা আলাদা করতে ফিলিস্তিন, বসনিয়া, টুতসি-হুতু বা আরাকান মানুষদের আহাজারি বা কান্নার সুর। আর তখন অনেক রাত ছিল আর আমাদের পিতামাতারা আমাদের ঘুমাতে বলেছিলেন। আর আমরা এমনিতেই ভীত ছিলাম গ্রামের তেতুল গাছ আর পাকুড় গাছ আছে বলে। কিন্তু পরদিন তেতুল গাছ বা পাকুড় গাছ নয়, কাঠাল গাছে তিনটি লাশ ঝুলানো পাওয়া গিয়েছিল বৈজয়ন্তি আর তার তিনদিদির। আমরা অবাক বিষ্ময়ে দেখি আমাদের দিদিরা ঝুলে আছে গাছে গাছে আর ফোটা ফোটা রক্ত ঝরছে তাদের পা বেয়ে।

যেমন আমরা রেফ অব প্রমিথিউস ছবিতে দেখেছিলাম। গ্রামের যারা মাথা তারা বলছিলেন, আমাদের দিদিরা আত্মহত্যা করেছে অথবা তাদের ভুতে মেরে ফেলেছে। আমরা সত্যি খুব ভয় পেয়েছিলাম। ঠাকুরমার ঝুলিতে আমরা এমনটি পড়েছিলাম। কিন্তু যেহেতু আমরা স্কুলে অংক আর বিজ্ঞান পড়ে থাকি আমাদের মন অনেকটা যুক্তিবাদী হয়ে উঠৈছিল।

দিদিরা ঝুলছিল গাছের ডাল থেকে মাটির সামান্য উপরে। তাদের রক্তের ফোটাগুলো যেখানে জমেছিল সে মাটিকে তারা চাইলেই ছুতে পারত মৃত্যুর আগে। তবে তার কেন ছুল না। আর তাদের রশি বাধা ছিল গলা থেকে তাহলে রক্ত তো মুখে না উঠে কেন আসছিল উরু বেয়ে? আর ভুত তো তাদের নেয়ার কথা ছিল পাকুড় গাছে বা তেতুল গাছে। আমরা তো সে প্রশ্নগুলোর জবাব পাইনি।

আর জিজ্ঞাসা করবো যে দাদাগুলোকে তারা কেন জানি সব পালিয়ে গিয়েছিল। তারা কেন পালিয়েছিল? বিকেলে পুলিশ এসেছিল। আমরা ভয়ে দিদিদের বাড়ি যাইনি। শুুধু সন্ধ্যার পর দিদিদের পাড়ার শ্মশানঘাটে ধোয়া উড়তে দেখেছিলাম। আর তারপর আমাদের দুএকটা দাদা যারা আমাদের উরুতে আর নিতম্বে হাত দিয়ে বিরক্ত করতো হঠাৎ উদয় হয়ে বলত যানসে যেন অবাড়ি।

ওখানে ভুত আছে। বাকীগুলোরেও শিঘ্রই নেবে। সত্যি তারা সবাই একদিন উধাও হয়ে গিয়েছিল। এখন আমাদের সে কাঠাল গাছগুলো অনেক বড় হয়েছে। জৈষ্ঠমাস এলে ঝুলে থাকে কাঠাল, যেমনটি আমাদের দিদিরা একদিন ঝুলে ছিল।

কাঠাল আমি খাই নাকো। আমি কী তাই খেতে পারি যাকে আমার মৃত দিদির মতো দেখায়?

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।