প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সম্প্রতি খতিব ও ইমামদের সম্মেলনে একটি তাৎপর্যপূর্ণ কথা বলেছেন, যা বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সমাধানের সূত্র হতে পারে। তিনি বলেছেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব নয়, শান্তি চাই। আমি জনগণের দুর্ভোগ সহ্য করতে পারি না। ’ বিএনপি-জামায়াত ক্যাডারদের সন্ত্রাসী তৎপরতার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেছেন, ‘আমি যখন দেখি তারা মানুষ পুড়িয়ে মারছে, বিশ্বাস করুন, তখন আমি খুব কষ্ট পাই। ’
প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য নিছক কথার কথা নয় বলে মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকেরা।
তাঁর এই বক্তব্যের পর রাজনৈতিক মহলের গুঞ্জন হলো, তাহলে কি প্রধানমন্ত্রী তাঁর রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের প্রতি শেষ মোক্ষম চালটি দিতে যাচ্ছেন? তাহলে কি নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সংকটের শান্তিপূর্ণ সমাধান হতে যাচ্ছে? তাহলে কি বাংলাদেশের মানুষ হরতাল-সন্ত্রাসের অভিশাপ থেকে মুক্তি পাচ্ছে? তাহলে কি মেয়াদ শেষে বাংলাদেশ সবার অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন পাচ্ছে?
বিরোধী দল মুখে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রতিষ্ঠার কথা বললেও তাদের প্রথম ও শেষ দাবি শেখ হাসিনার পদত্যাগ। তাঁকে নির্বাচনকালীন সরকারের প্রধান রাখা যাবে না। আর বিরোধী দল এ-ও জানে যে বর্তমান সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার সুযোগ নেই, ক্ষমতাসীনেরা সেটি করবেন না। সে ক্ষেত্রে বিরোধী দল যেকোনো তিনটি বিকল্পের একটি বেছে নিতে পারে: ১. শেখ হাসিনার সরকারকে চাপ দিয়ে যতটা সম্ভব দাবি আদায় করে নির্বাচনে অংশ নেওয়া; ২. দাবি আদায় করতে ব্যর্থ হলে আন্দোলনের মাধ্যমে নির্বাচন প্রতিহত করা; ৩. নির্বাচনের পর পরবর্তী সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে শেখ হাসিনার সরকারকে বাধ্য করা।
এই তিন বিকল্পের মধ্যে দ্বিতীয়টি করার সামর্থ্য বিএনপির আছে বলে মনে হয় না।
তৃতীয়টি, অর্থাৎ পরবর্তী সংসদে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রতিষ্ঠার আইন পাস করার বিষয়টি আরও কঠিন। আওয়ামী লীগ যদি বিএনপিকে বাদ দিয়ে নির্বাচনই করে ফেলতে পারে, তাহলে তাদের কথায় সংবিধান সংশোধনও করবে না। অতএব, বিএনপির জন্য প্রথম বিকল্পটিই উত্তম।
আর এই মুহূর্তে শেখ হাসিনারও উচিত হবে বিএনপিকে বাইরে রাখার চিন্তা বাদ দিয়ে সবার অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের
প্রস্তুতি নেওয়া। কেননা, প্রধান বিরোধী দলকে বাইরে রেখে, ২০০৮ সালের নির্বাচনেও যে দলটির ৩৩ শতাংশ ভোটার আছে, সংবিধান রক্ষার নামে তারা একটি নির্বাচন করলে তার ক্ষত ও ক্ষতি জাতিকে বহুদিন ধরে বইতে হবে।
বিএনপি যেমন ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি নির্বাচন করে ফেলতে পেরেছে, আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন জোটও হয়তো তার চেয়ে বেশি ভোটারের উপস্থিতিতে একটি নির্বাচন করতে পারবে। কিন্তু সেই নির্বাচন কি দেশে শান্তি, স্থিতি আনতে পারবে?
আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের বিরুদ্ধে মৌলবাদ-জঙ্গিবাদ তোষণের যে অভিযোগ করে থাকে, এ ধরনের এক্সক্লুসিভ নির্বাচন সেই মৌলবাদ-জঙ্গিবাদী শক্তিকে আরও উৎসাহিত করবে। বিশেষ করে বিএনপির মতো একটি বড় রাজনৈতিক দলকে নির্বাচনী রাজনীতির বাইরে রাখলে এসব অপশক্তির সঙ্গে তারা গাঁটছড়া বেঁধে আরও বড় অঘটন ঘটাতে চাইবে। তখন জঙ্গি ও সন্ত্রাসী তৎপরতা ২০০১-০৬ সালের পর্বের চেয়েও ভয়ংকর রূপ নিতে পারে। সেবারের সন্ত্রাসের লক্ষ্য ছিল ব্যক্তি ও দল।
এবারে তারা গোটা দেশের ওপরই আঘাত হানবে। ফলে বাংলাদেশ দীর্ঘস্থায়ী সংকটে পড়বে।
অন্যদিকে সবার অংশগ্রহণে নির্বাচন হলে যে দলই জিতুক, অগণতান্ত্রিক শক্তি ও জঙ্গিবাদী গোষ্ঠী মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। কিন্তু ‘এক্সক্লুসিভ’ নির্বাচন করলে সেই নির্বাচনের বাইরে যারা থাকবে, তারা সব সময়ই দেশকে ভয়াবহ অবস্থায় ঠেলে দেবে। তারা সফল হলে সরকারের পতন হবে, আর সফল না হলেও যে মানুষ ও সম্পদ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তার দায়ভার শেষ পর্যন্ত সরকারপ্রধান হিসেবে শেখ হাসিনাকেই নিতে হবে।
একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচনের সময় যে সংঘাত দেখা দেবে, নির্বাচনের পর শিগগির তা বন্ধ হবে না। অন্যদিকে প্রধানমন্ত্রীর ভাষায় সর্বোচ্চ ছাড় দিয়েও বিরোধী দলকে নির্বাচনী প্রক্রিয়ায় নিয়ে আসতে পারলে দেশে সংঘাত-সংঘর্ষ, হরতাল, রাস্তায় ভাঙচুর, গাড়িতে আগুন দেওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। সব দল ভোটারদের কাছে ধরনা দেবে।
তাই জেদাজেদি বাদ দিয়ে ক্ষমতাসীন ও বিরোধী—উভয় পক্ষেরই উচিত হবে একটি ইনক্লুসিভ নির্বাচনের জন্য সর্বাত্মক চেষ্টা চালানো। সরকারকে বুঝতে হবে, বিরোধী দলের নেতাদের গ্রেপ্তার করে, মামলার জালে জড়িয়ে আন্দোলন দমন করা গেলেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না।
আবার বিরোধী দলকেও উপলব্ধি করতে হবে যে আগুনে পুড়িয়ে নিরীহ মানুষ মেরে আন্দোলন বেশি দূর এগিয়ে নেওয়া যাবে না। সহিংসতার কারণে ইতিমধ্যে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা ও সমর্থন কমতে শুরু করেছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যদি দেশের মানুষের কষ্ট দেখে সত্যি সত্যি কাতর হন, তাহলে তাঁকে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সংকটের একটি সর্বগ্রহণযোগ্য সমাধান বের করতেই হবে। তিনি বিরোধী দলের নেতা খালেদা জিয়াকে টেলিফোন করেছেন। তাঁকে হরতাল প্রত্যাহারের অনুরোধ করে আলোচনায় বসতে বলেছেন।
খালেদা জিয়া তাঁর এই অনুরোধ রাখেননি। এতে বিরোধী দলের নেতাই বেশি সমালোচিত হয়েছেন। মানুষ যেমন সরকারের বাড়াবাড়ি পছন্দ করে না, তেমনি বোমা-ককটেলের হরতালও চায় না।
মহাজোটের শরিক ও ১৪ দলের নেতা রাশেদ খান মেনন প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘বিএনপি বর্তমানে যে আন্দোলন করছে, তার উদ্দেশ্য নির্বাচন নয়। এমনকি শেখ হাসিনা সরকারপ্রধানের পদ থেকে সরে দাঁড়ালেও খালেদা জিয়া নির্বাচনে আসবেন না।
’ আওয়ামী লীগের অনেক নেতাও জোর দিয়ে বলেন, সরকার যতই ছাড় দিক না কেন, বিএনপি নির্বাচনে আসবে না। কেননা, দলটির সুতা জামায়াত ও হেফাজতের সঙ্গে বাঁধা আছে। ক্ষমতাসীন দলটি যদি এতটাই আস্থাশীল হয়ে থাকে যে বিএনপি কোনো অবস্থায় নির্বাচনে আসবে না, তাহলে তো দেশের মানুষ ও বিদেশের বন্ধুদের কাছে নিজেদের সর্বোচ্চ সদিচ্ছার প্রমাণ রাখা উচিত। কেন তারা বিএনপির চরিত্র সবার কাছে উন্মোচন করতে দ্বিধাগ্রস্ত?
প্রধানমন্ত্রী শান্তি ও গণতন্ত্রের স্বার্থে যদি বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে পারেন, তিনি মহিমান্বিত হবেন। দেশ বেঁচে যাবে, গণতন্ত্র রক্ষা পাবে।
মানুষ স্বস্তি বোধ করবে। আর তিনি যদি বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে ব্যর্থ হন, তাহলে গত দুই বছরের এবং আগামী কয়েক বছরের সব অঘটনের দায় তাঁকেই নিতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী এর আগে বলেছিলেন, গণতন্ত্রের স্বার্থে তিনি সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকারে রাজি আছেন। দেশের মানুষের কাছে এই সর্বোচ্চ ত্যাগের বিষয়টি পরিষ্কার করা প্রয়োজন। সাধারণ মানুষ কিন্তু নির্দলীয়, না সর্বদলীয়—এই বিতর্কে যেতে চায় না।
তারা চায় সব দলের অংশগ্রহণে একটি নির্বাচন, একটি সংসদ এবং সেই সংসদের মাধ্যমে জনগণের প্রতিনিধিত্বশীল একটি সরকার।
এখানে একটি কথা বলা জরুরি যে বিরোধী দল দুই বছর ধরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন করলেও সেই সরকারের চরিত্র কেমন হবে বা সরকারপ্রধান কীভাবে নির্বাচিত হবেন, সেসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারেনি। খালেদা জিয়া ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকার থেকে ১০ জন উপদেষ্টা বেছে নেওয়ার যে প্রস্তাব দিয়েছেন, তা বাস্তবসম্মত নয়। তাই সমাধান খুঁজতে হবে সংসদের ভেতরেই।
সংবিধানের বিধান হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতির কাছে পদত্যাগপত্র জমা দেবেন এবং রাষ্ট্রপতি যদি মনে করেন অন্য কারও প্রতি এই সংসদের আস্থা আছে, তাহলে তিনি তাঁকে সরকার গঠনের জন্য আহ্বান জানাবেন।
এ ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ ছাড় হিসেবে শেখ হাসিনা নিজে অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব না নিয়ে সংসদের অন্য কারও ওপর ন্যস্ত করতে রাষ্ট্রপতিকে অনুরোধ করতে পারেন। তবে এই ব্যবস্থা অবশ্যই শর্তহীন হবে না। প্রধানমন্ত্রীর ‘সর্বোচ্চ ছাড়ের’ বিনিময়ে বিএনপিকে নির্বাচনে আসতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী ‘শান্তির’ কথা বলেছেন। মানুষের দুর্ভোগ দেখে তিনি মনে কষ্ট পান।
সে ক্ষেত্রে তাঁর উচিত হবে এমন কিছু করে দেখানো, যাতে মানুষের কষ্ট লাঘব হয়, প্রতিযোগিতাপূর্ণ একটি নির্বাচনের পরিবেশ সৃষ্টি হয়।
সবশেষে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি মন্তব্য দিয়েই লেখাটি শেষ করতে চাই। তিনি বলেছেন, বিএনপি গণতন্ত্রের ভাষা বোঝে না। হরতালের নামে বোমা-ককটেল মেরে মানুষ মারা, গাড়ি পোড়ানো নিশ্চয়ই গণতন্ত্রের ভাষা নয়। একই সঙ্গে তাঁকে এ কথাও স্বীকার করতে হবে যে প্রধান প্রতিযোগীকে বাইরে রেখে যদি কোনো নির্বাচন হয়, সেটিও গণতন্ত্রের ভাষা নয়।
এত দিন সামরিক স্বৈরশাসকেরা যা করেছেন, ৬৪ বছরের ঐতিহ্যবাহী দলটি কেন তা করবে?
গণতন্ত্রের ভাষা হলো সবার অংশগ্রহণে একটি সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন। সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট জয়ী হলে শেখ হাসিনা তৃতীয়বারের মতো প্রধানমন্ত্রী হবেন। আর যদি জয়ী না হয়, তাহলেও বিশ্ববাসীকে তিনি এটা দেখাতে পারবেন যে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়াও বাংলাদেশে সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন হতে পারে।
সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।
sohrab03@dhaka.net
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।