ভালো আছি
ইতিহাস কী পারে– শুধুই যে ইতিহাসের দোহাই দিই ? জাদুঘরের কাঁচের বাক্সে রক্ষিত ইতিহাস তো নিজেই বন্দি। লকলকে মাকড়সার জাল, বাদুর-চামচিকার লেদমেখে পড়ে থাকে যে ঐতিহ্য, কোন অজ্ঞাত কারণে যে সেই অচল সম্পত্তিটুকু আঁকড়ে পড়ে আছি আমরা, বুঝে আসে না। ইতিহাসের বিনোদন যদি এতই প্রিয় হয় আমার, তো আমাকে নিয়ে চলুক কোনো ব্রতচারী বতুতা। সফেদ আমামার নেকাবে জড়িয়ে উটের বাহন চলুক তব মরুর বালুকাবেলায়। আমি তখন স্বপনের জিগির তুলবো বেদুঈনের দফদফ কণ্ঠে কাসিদার সুরে সুরে।
জীবনের ভেতরে প্রবেশ করার সেও এক চমৎকার সুযোগ। না, কোনো ভাবালুতার আবেশ থেকে বলছি না। এতো হতেই পারে, তাই না ! কাহাঁতক সহ্য করা যায়। লড়াই লড়াই, যুদ্ধ যুদ্ধ, আগুন, লাশ, রক্ত, বিভীষিকা। তার ওপর ইতিহাস ধরে ধরে মিথ্যার ফুলঝুড়ি।
অথবা সত্যের গলাবজি। আমি যদি মানুষ হই, আমার প্রাণে যদি শান্তির ফল্গুধারাই নেমে আসতে চায়, তাহলে কি আমাকে পালাতেই হবে দেশের হাতছানি উপেক্ষা করে ? ইতিহাস যদি জানতেই হয় তো হানজালার রা. কাছে চলো। যিনি উহুদের জিহাদে ঝাঁপ দিলেন। নবপরিণীত প্রেয়সীর কাতরতার কথাটা ভাবা হলো না। রণাঙ্গনের চিৎকার বন্ধ হতেই শোকবিহ্বল পরিবেশ মাতম জাগবে যখন, তখন রাসুলের সা. সম্মুখে ঝলকে উঠলো একটি মেহেদিরাঙা হাত।
গতকাল আসরের সালাতান্তে তিনি এই হাতখানিকে সোপর্দ করেছিলেন হানজালার রা. করকমলে। ইতিহাস যদি এতোটাই নির্মমতা দেখাতে পারে, তবে আজ সে ইতিহাস বলুক, আমি কার ডাকে চঞ্চল হবো ? আমার দেহের অঙ্গসম মুসলিমরা যেখানে ইয়ারমুকের তৃষ্ণায় মরে, সেই দূরদেশের, নাকি আমার মাতৃভূমিতে ক্ষমতার লিপ্সায় গর্জে ওঠা লগি-বৈঠা আর দা-কুড়ালের ? মাফ করবেন, এখানেও মুসলিম বটে। আবার এখানেও আটাশ অক্টোবরের মতো একটা বীভৎস ইতিহাস আছে। কিন্তু আমি ভাবছি, ভাবতেই হবে, পথে-ঘাটের অপমৃত্যুই যদি হয় আমার নিয়তি, তাহলে কার আহ্বানে সাড়া দিলে আমার শাহাদাতের খবরে খোদায়ী দূতেরা আসবে সারি বেঁধে। আবে কাওসারের শীতলতায় ভরিয়ে গোসল দেবে আমায়।
হোক না ঘাসের আস্তরণে জড়ানো কাফন। তবু আমি ধন্য।
এক.
‘একটু আগে আমি যখন তাড়াহুড়ো করে সড়ক পার হতে গিয়ে কাদায় লাফালাফি করছিলাম, সেই বিশৃঙ্খল যানজটের মধ্যে যেখানে মৃত্যু চারিদিক থেকে টগবগিয়ে ঝাঁপিয়ে আসে, হঠাৎই ধাক্কা লেগে আমার জোতির্বলয় মাথা থেকে গড়িয়ে গেলো পথের আলকাতরার পাঁকের মধ্যে’– শার্ল বোদল্যারের লিপিকা। দেশের অবস্থা এখন অনেকটা এই আলকাতরা সদৃশ পাঁকে গড়িয়ে যাওয়ার মতো। পুরো দেশ ডুবতে বসেছে, দুশ্চিন্তা-উৎকণ্ঠায় জনগণের নাওয়া খাওয়া অবধি জেরবার, এদিকে সরকারের মাথারা নিজ নিজ মস্তক হেলিয়ে বসে আছেন, কখন নরসুন্দর এসে তাদের মু-ুটা মুড়িয়ে যাবে।
মানুষের জীবন-মরণ নিয়ে খেলতে খেলতে নৈশভোজ অনুষ্ঠানে সমঝোতার আমন্ত্রণ– এ যে কতটা নিকৃষ্ট মশকরা ভেতো বাঙালির ভোঁতা অনুভূতি কী করে বুঝবে সেটা ! অপর্যাপ্ত ক্ষমতার প্রতি আসক্তি এ বিশ্বের সর্বাপেক্ষা মরণনেশা। এমন এক নেশা, যার বশবর্তী হয়ে মানুষের সাধারণ বিচার বুদ্ধি লোপ পায়। অজান্তেই সেই নেশার ভেতরে ফোঁপরা হয়ে যায় ব্যক্তির অস্তিত্ব। এহেন মরণ নেশায় গ্রাস করে নিয়েছে সমগ্র দেশকে। ক্ষুধা থেকে অর্থের লোভ, ভয় থেকে সন্ত্রাসের আকাক্সক্ষা আর সফল দুর্নীতির জন্য চাই ক্ষমতা– কী হলো এই জাতির ? সাথে আছে প্রতিশোধ আর প্রতিহিংসার জিঘাংসা।
উচ্ছল তরুণের বুকে আজ যে সাহসের স্পন্দন শুনি, তাতে কি একবিন্দু সত্যের অনুসন্ধিৎসা আছে ? আস্ত একটা দেশ, লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি মানুষ ধীরে ধীরে কোথায়, কোন অতল অন্ধকারে হারিয়ে যাচ্ছে, কারো কোনো মাথাব্যথা নেই।
দুই.
ভারতে কোম্পানি শাসন এসেছিলো ইস্ট ইন্ডিয়া নাম নিয়ে। বিপুল একটি জনগোষ্ঠীকে চরমপন্থার গহ্বরে ঠেলে দিয়ে দেশে অস্থিরতা সৃষ্টি করা আর এই ফাঁকে জাতীয় সম্পদ লুণ্ঠন করে ইংলান্ডে পাচার করাই ছিলো তার গোপন অভীপ্সা। মহীশুরের যেই বীর টিপু আমৃত্যু ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়েছেন, খোলা তরবারি হাতে, সেই ‘সোর্ড অব টিপু সুলতান’ ইংলান্ডের জাদুঘরে শুয়ে থাকে কী করে ? আমাদের যদি অপমান হয়, তবে রানী এলিজাবেথেরইবা কতটুকু লাজ ছিলো–যিনি পুরুষ হয়েও নারী সেজেছিলেন আজীবন- এই অবান্তর প্রশ্ন বাদ দিলে চোখে পড়বে বেদনার ছায়া। কারণ সেই ইতিহাস।
ইতিহাস জপে জপে আমরা এই শিখলাম যে, কেবল দেশজ রূপের গভীরে তাকালেই বুঝবেন, হুবহু কোম্পানি শাসনের ফর্মুলা কার্যকর হচ্ছে বাংলাদেশে। ঢালাওভাবে আমদানি হয় বিদেশি কালচার। আইন হয় ইংরেজি বই-পুস্তকের কলাম দেখে। শিক্ষায় ধর্মের রস নিংড়ে ঝেড়ে ফেলা। আবার একই সঙ্গে সেই আলীগড় আর কোলকাতা আলীয়ার মতো মাদরাসা শিক্ষার রূপায়ন।
রবীন্দ্র-বঙ্কিম চেতনার জুসখেকো বুদ্ধিজীবিদের খোশামোদ তোষামোদ। উন্নয়নের হাঁকডাকের জোয়ারে ভেসে যায় বিশ্বাস। একই সঙ্গে রেশমি রুমাল কিংবা ফকিরী আন্দোলনের জন্ম, আর সেই আন্দোলন দমনে শামেলি-বালাকোটের মতো রণাঙ্গন কায়েমের পাঁয়তারা। জাতিসংঘের শান্তির মডেল এবং সাউথ এশিয়ান পুরস্কার বোগলদাবা করেই আর তর সইলো না ? লালখান বাজার এবং তারপরই ঢাকাভার্সিটির ঘটনাটা এতো অগোছালো সাজিয়ে, যা নিয়ে জনসাধারণ বিস্ময়ে মূক ও মুখর হওয়ার পরও কেন, কোন উদ্দেশ্যে অপবাদের কালিমাটা এঁকে দেওয়া প্রচারণা চালানো হচ্ছে, কে জবাব দেবে ? আগামির তরুণরা শিখছে, এদেশে মিথ্যাই বড় সত্য। বেঁচে থাকতে হলে, এদেশের কোলে মাথা রেখে ঘুমাতে চাইলে হরহামেশা মিথ্যার প্রাক্টিস ধারাোহিক রাখতে হবে।
না চাইলে চলে যাও। মুখে যদিও এ দল বলে পাকিস্তান যাও আর বি দল বলে ইন্ডিয়া ভাগো। আসলে উদ্দেশ্য সেটা নয়। ভোগরাজ্যে, বর্বর জাহেলিয়াতের মতো পঙ্কিল রাজত্ব অবিচল রাখতে সত্যবাক মানুষকে তাড়াতে হবে, অথবা মিথ্যার বেসাতির সামনে মাথা নুইয়ে থাকতে হবে। মধ্যবিত্ত থেকে নিম্নবিত্ত– চাইলেই পৃথিবীর যেকোনো রাষ্ট্রে নাগরিকত্ব দেয়া হবে– এই মর্মে দেশের সকলকে উদাত্ত স্বরে কোনো ধনকুবের আহ্বান করুক না, দেখুন না গৌরবের তিলক কোথাকার ধূলায় গিয়ে লুটায়।
বাসের ঝুলন্ত যাত্রীদের মতো বিমান বোঝাই জরুরি সার্ভিসের ব্যবস্থা করতে হবে দেশ পালানো মানুষের ভিড় সামাল দিতে। কোথায় যে পড়ে থাকবে সোঁদামাটির মদির গন্ধ, বলাকার নীড়ে ফেরা ছবি, নির্জন রাতে ডাহুকের মায়া। রে বঙ্গজননী, কেন যে রেখেছো বাঙালি করে...মানুষ যে কর নি ? হায়রে ইতিহাস। বারবার এসে দুয়ারে কড়া নাড়ে।
তিন.
ইরাকের যে ছেলেটা আবু গারিবে বাবাকে দেখতে এসে বলেছিলো, ইতিহাস সব মিথ্যা; পৃথিবীতে এখন মুসলিম বলে কেউ নেই. মনে আছে ? মনে পড়ে না, বাগদাদ থেকে সেই যে বোন ফাতেমা চিঠি লিখেছিলো একজন কাশিমকে জাগাতে ? কালাপনির দ্বীপে গড়া মাল্টার কারাগার তো ইতিহাসই, কিন্তু গুয়ানতানামোর নির্যাতনও কি আমাদের হৃদয়ে নাড়া দেয়ার ক্ষমতা রাখে ? গ্রানাডার মসজিদ নিয়ে আমাদের কত কান্না, আল লালমসজিদের উম্মে হাসসান– তাও কেবল স্মৃতি হয়ে যায় নি ? কাশ্মীর-আফগান-ঝিংজিয়াং– কই ? আছে নাকি বিশ্বে এমন কোনো ভূখণ্ড ? সিরিয়া-মিশর নিয়ে ‘সময়োপযোগী’ প্রতিবাদ এলো বটে, কিন্তু ফিলিস্তিন হলো ধূসর।
অথচ কোথাও রক্ত থামে নি। কোথাও আমাদের বিজয় আসে নি। কোথাও আমরা নিপীড়ন ছাড়া একটুখানি আদর পেলাম না। তবু আমরা লগি-বৈঠা আর দা-কুড়াল নিয়ে কলহ করি নিত্যদিন। দীন না হয় গেলো, মনুষ্যত্বও শেষ।
কোরবানি আসে যায়, আমাদের পশুত্ব ঘোচে না। পশুদের জন্য আগেকার দিনে আস্তাবল ছিলো, যেমন বারবণিতাদের জন্যও ছিলো নির্দিষ্ট পাড়া। এখন পশু আর মানুষ একসঙ্গে খায় ঘুমায়। একসঙ্গে পশুত্বের চর্চা চলে। পশুরা হাঁটে বিকোয়।
দর ওঠে আকাশ ছোঁয়া। মানুষ নির্দর হয়ে মরে থাকে ভাগাড়ে। আদুরী হয়ে অনাদরে। কী বলে ইতিহাস ? কী চায় ইতিহাস ?
আব্দুল গাফফার চৌধুরীর নাম আছে জহুরীর ‘স্বজন যখন দুশমন হয়’ বইটিতে। কেন এরা রাতারাতি লোল পাল্টায় ? কী সুখে যায় এদের দিন-রজনী ? পত্রিকা পাতাগুলো যাদের হাতে পবিত্র হলো–আক্ষরিক অর্থেই পবিত্র শব্দটা ব্যবহার করা–এখন তো সবচে’ পবিত্র গ্রন্থটির বক্তব্যও মানুষ অবিশ্বাস করে পত্রিকায় পাতায় না এলে।
আগামি জুমাবারেই হয়তো ধর্মপাতার শিরোনাম হবে– ভোট বিষয়ে কী বলে কোরআন। অথচ যিনি লিখলেন সেই আর্টিকেল, তিনি নিজেও হয়তো নিশ্চিত জানেন– যেখানে একফোঁটা সত্য নেই, টাকার লগ্নির নিচে চাপা পড়ে গেছে সত্যাসত্যের মানদ- বিবেক, প্রার্থী সংখ্যা তিনশ’ না হয়ে সাড়ে চারশ’ হোক, কিংবা আরো বেশি, তাতেও পুরো দেশজুড়ে একজন সত্যপন্থী বিবেক উচ্চকিত হবে না, হতেই পারবে না, তবুও তিনি কোরআনের দোহাই দিয়ে ভোটশালায় নিয়েই আসবেন ‘পত্রিকা বিশ্বাসী’ মানুষকে। তো যা বলছিলাম, চৌধুরী সাহেব লেখালেখির প্রথমদিকে লিখেছিলেন– আমরা যাদের সম্পর্কে লিখি, তারা আমাদের লেখা দেখে না; আর যাদের সমীপে লিখি, তারাও না। নইলে দেশজুড়ে, বলা ভালো বিশ্বজুড়ে এতো ইন্ডাস্ট্রি, এতো কারিকুলাম, এতো সুশৃঙ্খল বাহিনী, এতো আইন-প্রযুক্তি-বিজ্ঞান, এতো শিক্ষা-দীক্ষা, এইসব মিলে কী উন্নতি করছে মানুষের ? প্রতি সেকেন্ডে বিশ্বে অপঘাতে মৃত্যু মানুষের সংখ্যা হিসেব হয় হাজারে। অপরাধ হয় লাখো কোটি।
তাহলে কী হবে ? কোথায় চলবে ? কীভাবে চলবে ? আর যেখানে প্রতিমুহূর্তে বিশ্ব রঙ-রূপ বদলে ফেলে সহস্রবার, সেখানে কী করে ইতিহাস মনে রাখবো আমরা ? আসমানি শামিয়ানাসম সুবিশাল নিরাশার চাদরে ঢেকে যাচ্ছে প্রকৃতি। আঁধারের হিমাদ্রি ফেটে গলে গলে নেমে আসছে অসহ্য অন্ধকারের ঢল। মহাপ্রলয়ের প্রহর গোণে বিশ্বাসী মানুষ। ঝড়ের গতিতে বইছে যে উষ্ণ বাতাস, তার পরশে মুহূর্তেই বিশ্বাসী মানুষ অবিশ্বাসীদের থেকে আলাদা অবস্থানে চলে যায় আজকাল। অমতাযুল ইয়াওমা আইয়ুহাল মুজরিমূন...
ইতিহাসের বাহাদুরি দেখানোর সময়ের যবনিকা হয়েছে সৃষ্টইতিহাসের কালেই।
একসময় বেলালেরা আজান দিয়েছিলো ভোর হওয়ার আগেই, ভুলক্রমে। তবু আকাশের মালিক সাড়া দিয়েছেন। সূর্যকে সময়ের আগেই ঘুম ভাঙতে হয়েছে। তো আমরা কি সকালের প্রতিক্ষায় থাকবো, নাকি আজান হবে সকালের উদ্বোধনী সঙ্গীত ? প্রভাতফেরির প্রতিক্ষায় থাকা কোটি প্রাণকে শান্তিময় ঘুমের আশ্বাস দিয়ে যারা গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন, তাদেরকে এক ইতিহাসের কবি অধৈর্য হয়ে বলে গেছেন–
“এ ঘুমে তোমার মাঝিমাল্লার ধৈর্য নাইকো আর,
সাতসমুদ্র নীল আক্রোশে তোলে বিষ ফেনভার।
এদিকে অচেনা যাত্রী চলেছে আকাশের পথ ধরে,
নারঙ্গী বনে কাঁপছে সবুজ পাতা।
বেসাতি তোমার পূর্ণ করে কে মারাজানে মর্মরে ?
ঘুম ঘোরে তুমি শুনছ কেবল দু:স্বপের গাঁথা।
উচ্ছৃঙ্খল রাত্রির আজো মেটে নি কি সব দেনা ?
সকাল হয়েছে, তবু জাগলে না ?”
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।