আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

নিখোঁজ মানুষরা যায় কোথায়

১৮ বছরের সাইফুল্লাহ আল খায়ের অসুস্থ মাকে হাসপাতালে দেখতে গিয়ে উত্তরা এলাকা থেকে নিখোঁজ হন গত ৩০ অক্টোবর। উত্তরা থানায় এ বিষয়ে সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং ১৮১১) হয়েছে। ডিবি, পুলিশ, র‌্যাব থেকে শুরু করে হাসপাতাল, মর্গ- সম্ভাব্য সব জায়গায় খোঁজখবর নিয়েও সাইফুল্লাহর খোঁজ মেলেনি। একইভাবে গত ২১ অক্টোবর রামপুরা থেকে নিখোঁজ হন হাসান আকন। রামপুরা থানায় এ ব্যাপারে সাধারণ ডায়েরি (জিডি নং ১২৬২) হয়।

এখনো খোঁজ মেলেনি হাসানের। ২ নভেম্বর ৫ লাখ টাকা মুক্তিপণের দাবিতে অপহরণ হয় স্কুলছাত্র রাতিম। ৬ দিন পর তার লাশ উদ্ধার করে পুলিশ।

নিখোঁজ মানুষের মিছিলে প্রতিদিনই যোগ হচ্ছে এমন নতুন নতুন নাম। তাদের কেউ ফেরে, কেউ ফেরে না।

এ অবস্থায় নাগরিক জীবনে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। যারা নিখোঁজ হন, তাদের স্বজনদের আশঙ্কা, ভয়ঙ্কর কোনো অপরাধী চক্রের হাতে পড়েছে তারা। এমনই অজানা আশঙ্কায় দিন কাটছে তাদের। নিখোঁজ মানুষদের বছরের পর বছর খুঁজে পাওয়া না যাওয়ায় সর্বমহলে এখন প্রশ্ন, নিখোঁজ মানুষেরা যায় কোথায়।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, নিখোঁজ ব্যক্তির সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি অজ্ঞাত লাশের সংখ্যাও বেড়েছে।

রাজধানীতে গড়ে প্রতিদিন নাম-পরিচয়হীন ৬টি লাশের দাফন করা হচ্ছে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের লাশই কি অজ্ঞাত অবস্থায় দাফন হচ্ছে কিনা, তা নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না।

গত ১১ নভেম্বর বাংলাদেশ প্রতিদিনে 'সাবধান! রাজধানীতে ভয়ঙ্কর অপরাধী চক্র', 'তল্লাশির নামে যাত্রী নিয়ে লাপত্তা' শিরোনামে প্রতিবেদন প্রকাশের পর অসংখ্য নিখোঁজ ব্যক্তির স্বজনরা যোগাযোগ করেছেন। তাদের কাছ থেকে জানা গেছে, নিখোঁজ হওয়ার নানা তথ্য। নিখোঁজ মানুষেরা যায় কোথায়- এমন প্রশ্নের জবাব পুলিশ ও গোয়েন্দাদের কাছেও নেই।

এ সম্পর্কে তেমন কোনো পরিসংখ্যানও নেই পুলিশের নথিতে। নিখোঁজ ব্যক্তিদের খোঁজ পেয়েছে পুলিশ, এমন নজির খুবই কম। পুলিশ মনে করে, নিখোঁজ-সংক্রান্ত কোনো সুনির্দিষ্ট আইন নেই। শুধু যে ব্যক্তি নিখোঁজ হন তাদের স্বজনদের পক্ষ থেকে থানায় দায়ের করা সাধারণ ডায়েরি লিপিবদ্ধ করে রাখা কর্তব্য মনে করে এ কাজটি করে থানা পুলিশ। এ-সংক্রান্ত ডায়েরির তদন্তের ক্ষেত্রে কোনো বধ্যবাধকতা না থাকায় পুলিশের অবহেলা বা গাফিলতির জন্য কারও বিরুদ্ধে নালিশও করা যায় না।

পুলিশ ও ভুক্তভোগী পরিবারের সঙ্গে কথা বলে এবং নানা মাধ্যমে খোঁজখবর নিয়ে জানা যায়, গত তিন মাসে রাজধানীতে অন্তত ১৫ ব্যক্তি নিখোঁজ হয়েছেন। তাদের অধিকাংশই আর ফিরেনি। পুলিশ এদের সন্ধান দিতে পারেনি। পাওয়া যায়নি লাশও। ভুক্তভোগীরা এ জন্য বাধ্য হয়ে পত্র-পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়ে নিখোঁজ মানুষের সন্ধান করছেন।

তারা বলেছেন, পুলিশ বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যদি একটু তৎপর হতো বা সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিত, তবে নিখোঁজ ব্যক্তির সন্ধান পেতে তাদের দীর্ঘকাল প্রতীক্ষায় থাকতে হতো না।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এডিসি (উত্তর) মাহফুজুল ইসলাম জানান, নিখোঁজ ব্যক্তি এবং অজ্ঞাত লাশের পরিচয় মিলাতে গোয়েন্দা দফতরে সুনির্দিষ্ট কোনো সেল নেই। রাজধানীর যেসব স্থানে লাশ উদ্ধার হয় সংশ্লিষ্ট থানা থেকে সেসব তথ্য নিয়ে গোয়েন্দা পুলিশ তাদের খোঁজ নেওয়া শুরু করে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিখোঁজ ব্যক্তি বা লাশের পরিচয় মেলানো কঠিন হয়ে পড়ে। এ ছাড়া গোয়েন্দা দফতরে স্বজন হারানোদের অভিযোগ তদন্ত করে দেখা হয়।

গোয়েন্দা পুলিশের অপর একজন কর্মকর্তা জানান, অধিকাংশ ক্ষেত্রে দেখা যায়, কেউ নিখোঁজ হওয়ার এক থেকে দুই দিন পর পুলিশের কাছে তথ্য দেওয়া হয়। কেউ যদি কোনো দুর্ঘটনায় নিহত হন, সেই লাশ মর্গে পড়ে থাকে। মর্গের অধিকাংশ হিমাগার নষ্ট থাকায় ২-১ দিন পরই অজ্ঞাত লাশ দাফনের জন্য আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। মর্গে পড়ে থাকা লাশ আর স্বজন হারানোদের থানায় জানানোর মাঝে বড় ধরনের গ্যাপ থেকে যায়। ওই গ্যাপের কারণেই অজ্ঞাত লাশের পরিচয় মেলাতে কষ্ট হয়।

কেউ নিখোঁজ, কারও উদ্ধার হয় লাশ : উত্তরা থেকে নিখোঁজ সাইফুল্লাহ আল খায়েরের ভগি্নপতি শরিফ জানান, বিরোধী দলের টানা তিন দিন হরতালের শেষ দিন ৩০ অক্টোবর সাইফুল্লাহ নিখোঁজ হন। তিনি বলেন, সারা দেশের থানাগুলোতে তারবার্তা পাঠানো হয়েছে। হাসপাতাল মর্গসহ সব জায়গায় খোঁজ নেওয়া হয়েছে। খবর মেলেনি সাইফুল্লাহর। তাদের আশঙ্কা, ভয়ঙ্কর অপরাধী চক্র সাইফুল্লাহকে হয়তো তুলে নিয়েছে।

একইভাবে রামপুরার হাসান আকন ছাড়াও নিখোঁজ হন কাফরুলের শরিফুল হাসান সে াত। তাদের কারও খোঁজ মেলেনি। এমনিভাবেই গেণ্ডারিয়া থেকে নিখোঁজ হন পটুয়াখালীর আবদুল লতিফ খান। গাজীপুর জয়দেবপুরের স্কুলছাত্র ফারুক (১৪) কোচিংয়ে যাওয়ার পর ১৫ জুলাই থেকে নিখোঁজ রয়েছে। রবিউল ইসলাম নিখোঁজ হন বাড্ডা এলাকা থেকে।

রিয়াজ হোসেন রাজিব নামে ২৬ বছরের যুবক নিখোঁজ হন যাত্রাবাড়ী থেকে। ২ নভেম্বর ঢাকার অদূরে গাজীপুরে অপহরণ হয় স্কুলছাত্র রাতিম। দুর্বৃত্তরা রাতিমের পরিবারের কাছে পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ দাবি করে। রাতিমের বাবা মোবারক হোসেন অপহরণকারীদের কথা অনুযায়ী ১০ হাজার টাকা বিকাশের মাধ্যমে পাঠান। বাকি টাকার জন্য চাপ প্রয়োগ করে দুর্বৃত্তরা।

অপহরণের ছয় দিন পর রাতিমের লাশ উদ্ধার হয় একটি পুকুর থেকে। পুলিশ (ডিবি) পরিচয় দেওয়া সশস্ত্র ব্যক্তিরা রাজধানীর দয়াগঞ্জ বাজার এলাকা থেকে ধরে নিয়ে যায় জুয়েল সরদার, রাজীব সরদার ও মিজানুর হোসেন নামের তিন তরুণকে। অপহরণের পাঁচ দিন পর ঢাকা বাইপাসের পাশে গাজীপুরের পুবাইলে পাওয়া যায় জুয়েল আর মিজানের লাশ। রাজীবের লাশ মেলে ঢাকা-মাওয়া সড়কের পাশে সিরাজদিখানের নিমতলীতে।

ফিরে আসা : একটি ফার্মাসিউটিক্যালের কুমিল্লা জোনের ডিস্ট্রিবিউশন ম্যানেজারের বড় ছেলে মাজহারুল ইসলাম (১৫) কোচিং ক্লাসে গিয়ে আর ফেরেনি।

বাবা-মা তাদের সব আত্দীয়-স্বজনের বাসায়, সম্ভাব্য সব জায়গায় খবর নেন। ছেলের সন্ধান নেই। থানায় ছেলে হারানোর ঘটনা জানিয়ে সাধারণ ডায়েরি করে পুলিশকে অনুরোধ করেন তদন্ত করে মাজহারের সন্ধান দিতে। কিন্তু পুলিশ এর জন্য কিছুই করতে পারেনি। নিখোঁজের কিছু দিন পর এক রাতে হঠাৎ যেন চাঁদের ঝলকানি।

শিকারিদের হাতে মৃত্যু কিংবা পাচারের কবল থেকে মাজহার পালিয়ে আসে। বাড়ি এসে তার সুস্থ হতে বেশ সময় লেগেছে। স্বাভাবিক হওয়ার পর মাজহার জানিয়েছে, তাকে ঘটনার দিন সন্ধ্যায় কুমিল্লা শহরে আসা একটি ট্রাকের চালক ও তার হেলপার নাকে রুমাল দিয়ে ট্রাকে তুলে কোথায় যেন নিয়ে যায়। পরে সে জানতে পারে, তাকে রংপুরের প্রত্যন্ত অঞ্চলে আটকে রাখা হয়। সে জানায়, যে ট্রাকে করে তাকে নেওয়া হয়, ওই ট্রাকের চালকের পেছনে একচিলতে ঘুমানোর জায়গা রয়েছে।

৪-৫ দিন সেখানে তাকে বন্দী করে রাখা হয়েছিল। দিনভর তাকে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হতো। একদিন চালক সিগারেট কিনতে কিছু সময়ের জন্য বের হলে সুযোগ বুঝে পালিয়ে আসে মাজহার। প্রায় একই অবস্থার সৃষ্টি হয় রাজধানীর খিলগাঁওয়ের বাসিন্দা মাওলানা ফজলুল করিমের ছেলে শেখ জামিউল হায়দারের ভাগ্যে। তিনি ব্যবসায়িক কাজ সেরে ১ লাখ ৩৫ হাজার টাকা নিয়ে উত্তরার হাউস বিল্ডিং থেকে অপহৃত হন।

দুর্বৃত্তরা সবাই জামিউলকে ঘিরে ধরে একটি মাইক্রোবাসে উঠিয়ে নেয়। এর পর সে জ্ঞান হারিয়ে ফেলে। জামিউল জানান, জ্ঞান ফিরলে দেখি আমি সিলেট চা-বাগানের পাশে একটি পরিত্যক্ত বাড়ির গরুর খোঁয়াড়ের পাশে পড়ে আছি। তিনি জানান, আমি যখন নিখোঁজ হই তখন আমার পরিবারের সদস্যরা উত্তরা থানায় সাধারণ ডায়েরি করতে গেলেও পুলিশ কোনো ধরনের সহযোগিতা করেনি। পরে তারা অনেক চেষ্টা-তদবির করে খিলগাঁও থানায় ডায়েরি করেন।

তবে পুলিশ এ ডায়েরিরও কোনো তদন্ত করেনি। তিনি বলেন, হয়তো হায়াত ছিল কিংবা বাবা-মায়ের দোয়া ছিল, সে জন্যই দুর্বৃত্তদের হাতে সর্বস্ব খোয়ানোর পরও জীবন নিয়ে ফিরতে পেরেছি।

অজ্ঞাত লাশ বাড়ছে : শুধু রাজধানীতেই প্রতিদিন গড়ে এ ধরনের ছয়টি লাশের নাম-পরিচয় খুঁজে পাওয়া যায় না। গত ৪ বছরে শুধু রাজধানীতেই অজ্ঞাত লাশের সংখ্যা ৯ সহস াধিক। অজ্ঞাত এসব লাশের ছবি প্রকাশ করার কোনো ব্যবস্থা না নেওয়ায় লাশগুলো অজ্ঞাতই থেকে যাচ্ছে।

পুলিশ জানিয়েছে, রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় দুর্ঘটনায় আহত ও নিহত ব্যক্তিদের পথচারীরা সরকারি হাসপাতালগুলোর জরুরি বিভাগে রেখে চলে যায়। অনেক সময় আবার সন্ত্রাসীরাই নানাভাবে তাদের সহযোগীদের লাশ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে ফেলে আসে। আবার গুরুতর আহত অবস্থায় হাসপাতালে ভর্তি করে যায়। পরে পুলিশ সদস্যরা সংবাদ পেয়ে হাসপাতালে গিয়ে আহত বা নিহত ব্যক্তির পরিচয় উদ্ধারের চেষ্টা চালায়। কারও পরিচয় মেলে, আবার কারও মেলে না।

 

 

সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।