যাদের হাতে দলীল প্রমাণ কম তারা গালি দেয় বেশি
বহুল আলোচিত লেখিকা তসলিমা নাসরিন মেয়েদের যোনির স্বাধীনতায় বিশ্বাসী । রুদ্র'র মত প্রতিভাবান কবি ছাড়াও তিনি নিয়মতান্ত্রিক ভাবে বিয়ে করেছিলেন বিচিন্তার সম্পাদক মিনার মাহমুহ, আমাদের সময় সম্পাদক নইমুর রহমান কে। এছাড়াও তনি অনেকের সাথেই দৈহিক সম্পর্ক রাখতেন, যেটা তিনি খারাপ মনে করতেন না বলেই স্বেচ্ছায় স্ব উদ্দোগে প্রকাশ ও প্রচার করতেন । এগুলো অবশ্যই ওনার একান্ত ব্যক্তিগত বিষয় , যা নিয়ে আমার ব্যক্তিগতভাবে আদৌ কোন আগ্রহ নেই।
যে বিষয়টা আমার কাছে ইন্টারেষ্টিং মনে হয়েছে তা হল তিনি সম্ভবত পুং লিংগের স্বাধীনতা মানেন না।
তাই একাধিক বিয়ের কারণে হুমায়ুন আহমেদের মত কিংবদন্তীর সমালোচনায় তিনি খরগ হস্ত হয়েছেন। হতে পারে এটাই ওনার কাছে নারীবাদ, বিষয়টা আমি ঠিক বুঝি না ।
নীচের অংশটুকু ব হুল আলোচিত লেখিকা তসলিমা নাসরীনের :
আরও একটি ব্যাপারে আমি বিস্মিত হই। হুমায়ূন আহমেদের মতো বুদ্ধিমান লোক স্ত্রী পুত্র কন্যা ফেলে গোঁড়ালির বয়সী একটা মেয়েকে কেন বিয়ে করেছিলেন! দ্বিতীয় যে ব্যাপারটি দেখেছি, তা আমাকে ততটা বিস্মিত করেনি, তা হল মিডিয়ার মুখ বুজে থাকা। মিডিয়া চিরকালই ক্ষমতার দাস।
খুব কম মিডিয়াই নিরপেক্ষ হওয়ার এবং সত্য কথনের সাহস দেখাতে পারে। আমি বাংলাদেশের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের হাড় মজ্জা অবধি চিনি। ওই সমাজে আমি বড় হয়েছি, ওই সমাজ আমার সঙ্গে কারও সম্পর্কের বা বিয়ের গুজব শুনেই হায়েনার মতো দৌড়ে এসেছে আমাকে আক্রমণ করতে। আমার বিরুদ্ধে বিস্তর মিথ্যে কথা রটিয়ে মিডিয়ার অসংখ্য আমোদ জুটেছে। আমিও জনপ্রিয় লেখক ছিলাম এককালে।
আমি যদি আমার স্বামী সন্তান সংসার ত্যাগ করে আমার পুত্রের কোনও বন্ধুকে বিয়ে করে তাকে নিয়ে কোনও বাগান বাড়ি বানিয়ে বাস করতে শুরু করতাম, লোকে আমাকে আক্ষরিক অর্থে ছিঁড়ে ফেলতো, আক্ষরিক অর্থেই কেটে টুকরো টুকরো করে ফেলে রাখতো রাস্তায়, আগুনে পুড়িয়ে মারতো অথবা পাথর ছুঁড়ে মেরে ফেলতো অথবা জ্যান্ত কবর দিয়ে দিত। কারও আমার বই পড়ার তো প্রশ্ন ওঠে না। শুধু আমি নই, অন্য কোনও মেয়েকেও একই রকম করতো এই নষ্ট সমাজ। কোনও অন্যায় না করেও দেশ হারানোর শাস্তি আমি পোহাচ্ছি, অন্যায় করলে পরিণতি কী হত, তা আমি বেশ অনুমান করতে পারি। নারীর মুক্তির জন্য আর মানবাধিকারের জন্য জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সংগ্রাম করে গেছি, নিরন্তর লিখে গেছি।
আর আমাকেই কিনা দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে। আমার বিরুদ্ধে ঘৃণ্য জঘন্য অন্যায় যারা করেছে, যারা আমার মাথার দাম ঘোষণা করেছে, তাদের দিব্যি দুধ কলা দিয়ে পোষা হচ্ছে, আর দেশ থেকে জšে§র মতো তাড়ানো হয়েছে আমাকে! আজ উনিশ বছর আমাকে দেশে ফিরতে দেয় না কোনও সরকার। মুখ বুজে মজা দেখছে দেশের তথাকথিত জ্ঞানী গুণী পণ্ডিত এবং মানবাধিকারের পক্ষে লড়াই করা হিপোক্রেটস। লেখক গোর ভিডাল বলেছিলেন, ‘ভালো কাজের সব সময় একটা শাস্তি পাওনা থাকে। ’ মিডিয়া যদি পুরুষতান্ত্রিক না হত, আমার বিরুদ্ধে সরকারের অগুনতি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতো।
যেহেতু সমাজ পুরুষতান্ত্রিক, মিডিয়াও পুরুষতান্ত্রিক, সে কারণে হুমায়ূন আহমেদ সমালোচিতও হন না, নিন্দিতও হন নাবাংলাদেশের মিডিয়া এবং মানুষ প্রচণ্ড পুরুষতান্ত্রিক বলে হুমায়ূন আহমেদের পক্ষে সম্ভব হয়েছে চরমতম নিন্দার কাজ করেও বত্রিশ বছরের সংসার ভেঙে সন্তানের বন্ধুকে বিয়ে করার পরও। মিডিয়া তাঁকে ‘নিন্দিত’ হওয়ার কোনও সুযোগই দেয়নি। শুরু থেকে শেষ অবধি তাঁকে সম্বোধন করে গেছে ‘নন্দিত লেখক’ বলে। জীবনভর ‘নন্দিত’ থেকে যাওয়া।
হুমায়ূন আহমেদ নিজে ছিলেন পুরুষতন্ত্রে বিশ্বাসী।
তাই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে তাঁর ছিল এত আদর। সমাজের নারী বিদ্বেষী পুরুষতান্ত্রিক চরিত্র আরও স্পষ্ট ফুটে উঠেছে হুমায়ুন আহমেদ মারা যাওয়ার পর। গুলতেকিন হুমায়ূন আহমেদের শোক সভায় এসে কেঁদেছেন, এই কান্নার জন্য তাঁকে মহিয়সী রমণী খেতাব দেওয়া হচ্ছে। স্বামী লোচ্চামি, বদমাইশি যা খুশি করুক, তুমি স্বামীকে নিরবধি শর্তহীন ভালবেসে যাও। স্বামী সাত জনের সঙ্গে শুয়ে বেড়াক, হাজার হলেও পুরুষ তো, মেয়ে হয়ে জšে§ছো, তুমি ভাই সতী সাধ্বী থেকে যেও।
স্বামী তোমাকে লাথি দিলেও তুমি স্বামীর জন্য কেঁদে বুক ভাসিও। স্বামী তোমাকে ছেড়ে চলে গেলেও, অন্য কার সঙ্গে বাকি জীবন রং-তামাশা করলেও স্বামীর যে কোনও প্রয়োজনে পাশে দাঁড়িও, সমাজ তোমাকে বাহ্বা দেবে। আমরা ভোগ করবো, তোমরা আমাদের ভোগের বস্তু হবে, বা আমাদের ভগবান জ্ঞান করবে, বা আমাদের স্তুতি গাইবে, আমাদের মঙ্গলের জন্য জীবনপাত করবে। এই না হলে তোমরা আর মেয়ে কেন! হুমায়ূন আহমেদের সন্তানের বয়সী স্ত্রী নিজের প্রতিভা বিকাশের সুযোগ তুচ্ছ করে স্বামীর সেবা করে গেছে, অক্লান্ত পরিশ্রম করেছে তাঁকে সুস্থ করে তোলার জন্য, তাকেও অনেকে বাহবা দেবে। কেউ কেউ আবার কোনও ত্র“টি খুঁজে পেলে তার বিরুদ্ধে মামলা ঠুকে দেবে।
কেন? স্বামী দেবতার সেবায় একটু এদিক ওদিক হলে যে রক্ষে নেই!
ক’দিন আগে আমার এক বন্ধু হুমায়ূন আহমেদের একটা লেখা, তার তিন কন্যাকে নিয়ে, পড়তে দিল আমাকে। কন্যাদের সম্ভবত প্রায় দশ বছর পর তিনি দেখেছেন। আমি ভেবেছিলাম পিতা হয়ে যে অন্যায় তিনি করেছেন এর জন্য ক্ষমা চাইবেন। আবেগে কাঁপবে তার কলম। কিন্তু তা নয়, পুরো লেখাটিতেই নিজের গুণগান গেয়েছেন।
তিনি নিজে খুব মেধাবী, তাঁর জিন পেয়েছে কন্যারা, সে কারণে তাঁর কন্যারাও মেধাবী। আমি তাজ্জব! হƒদয় বলে কিছু কি ছিল না হুমায়ূন আহমেদের! দেখতে শুনতে গ্রামীণ, সরল সোজা। কিন্তু ভেতরে খুব কঠিন একটি মানুষ। নির্বিকার। নিজের সুখ আনন্দ ছাড়া দুনিয়ার অন্য কিছু থোড়াই হয়তো কেয়ার করেছেন।
জনপ্রিয়তা তাঁকে আকাশে বসিয়ে দিয়েছিল, তিনি ধরাকে সরা জ্ঞান না করলেও বড় তুচ্ছ কিছু একটা জ্ঞান করেছিলেন, ধরার মানুষগুলোকেও হয়তো তা-ই করেছিলেন। কোটি কোটি টাকার মালিক হয়েছিলেন, ক’টা টাকা দেশের মানুষের দারিদ্র্য দূর করতে, অশিক্ষা, কুশিক্ষা দূর করতে খরচ করেছিলেন? ক্যান্সার হাসপাতাল করবেন, ক্যান্সার না হলে বলতেন? নিজের শরীরে বড় রোগ ধরা পড়লে ভয়ে ভয়ে সব ব্যাটাই মানত করে, এই গড়বো, সেই বানাবো ইত্যাদি।
যে কন্যারা অভিমানে দূরে সরে ছিল, কারণ তাদের পিতা তাদের গড়ে তোলার চেয়েও বৃদ্ধ বয়সে এক কন্যাসম কিশোরীর সঙ্গে স্বপ্নের ফানুস ওড়ানো টা কেই যৌক্তিক বলে মনে করছিল, সেই কন্যারা অসুখের খবর শুনে কাছে এলে মিডিয়া খুশি হয়, মানুষ খুশি হয়। ক্ষমতাবানের সামনে সকলে নত হয়। সে বেঁচে থাকলেও হয়, সে মরে গেলেও হয়।
পুরুষের ক্ষমতা বলে কথা। সাফল্যের মুখ পুরুষের মুখ। যাদের এক সময় পায়ে ঠেলে দিয়েছিলে তুমি, তারাই এখন তোমার পায়ের কাছে এসে কাঁদছে। কারণ তুমি পুরুষ, তুমি ধনী, তুমি জনপ্রিয়, তুমি রাজা, তুমি বাদশাহ, তুমি সম্রাট, তোমার সাত খুন মাফ। হুমায়ূন আহমেদ অনেকটা ইশ্বরের মতো।
নিজের কারণে নয়, ইশ্বরভক্তদের কারণেই ইশ্বর টিকে আছেন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।