হু
শুরুতেই কিছু কথা না বললেই নয়:-
অনেক আগে থেকেই বর্তমান সোনারগাঁও অঞ্চল বিখ্যাত ছিল। এই অঞ্চলে যে সকল প্রাচীন স্থাপনা পাওয়া যায় তার মধ্যে অধিকাংশই সুলতানী ও মোঘল যুগের। ব্রিটিশ সময়ের স্থাপনা বলতে শুধু পানাম নগরের কথাই উল্লেখ করার মতো। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয় কতৃপক্ষ ভারতের বিভিন্ন প্রত্ননির্শনের তালিকা প্রস্তুত এবং তার ছবি সংগ্রহ ও সংরক্ষণের ব্যবস্থা করেন। ভারতীয় প্রত্নতত্ত্বে আলেকজান্ডার কনিংহাম একটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি।
তিনি ভারতের বিভিন্ন স্থান পরিদর্শন করে প্রত্নস্থানগুলো সনাক্ত করেছেন। জেমস ওয়াইজ বাংলার বিভিন্ন স্থান ঘুরে বেড়িয়েছেন এবং সে গুলোর কথা লিপিবদ্ধ করেছেন তার Notes on Sunargaon, Eastern Bengal নামক বইয়ে। ঢাকার বর্তমান ওয়াইজ ঘাট তার নামে নামকরণ করা হয়েছে, ধারণা করা হয় ওয়াইজ সাহেব ঢাকায় এসে প্রথমে এই ঘাটে নামেন। W.Brennand মূলত একজন চিত্র গ্রাহক । ১৮৭২ সালে তিনি বাংলার বিভিন্ন স্থাপনার চিত্র গ্রহন করেছেন।
মুঘল ও সুলতানী মসজিদ স্থাপত্য চেনার সবচাইতে সহজ উপায় হলো- সুলতানী স্থাপনায় মাত্র একটি গম্বুজ থাকে কিন্তু মুঘল মসজিদ গুলোতে একাধিক গম্বুজ থকে।
গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের সমাধি সৌধ, ১৮৭২
ছবিতে গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের সামধির ভগ্নাংশ দেখানো হয়েছে। ছবিটি সংগ্রহ করা হয়েছে Archaeological Survey of India Collections থেকে। এর চিত্র গ্রাহক W. Brennand, তিনি ১৮৭২ সালে ছবিটি তোলেন। ১৩ শতক থেকে বাংলা দিল্লির সুলতানদের অধীনে শাসন হতে শুরু করে।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে বাংলার বিভিন্ন শাসক দিল্লির সুলতানদের বশ্যতা স্বীকার না করে স্বাধীন ভাবে শাসন শুরু করে। ১৩ শতক থেকে ১৬০৮ সাল পর্যন্ত বাংলার রাজধানী ছিল সোনারগাঁও। ১৬০৮ সালে সোনারগাও মুঘলদের অধীনে চলে আসে। গিয়াস উদ্দিন আযম শাহ ১৩৬৮ থেকে ১৩৭৩ সাল পর্যন্ত বাংলার শাসন কর্তা ছিলেন। জেমস্ ওয়াইজের বর্ননায় এই সমাধির কথা উল্লেখ রয়েছে।
ছবিটিতে সমাধির ভগ্নাবস্থা দেখানো হয়েছে। সমাধি সৌধটি কাল ব্যসল্ট পাথরের তৈরি। সমাধি সৌধের গায়ে অনেক সুন্দর অলংকরণ রয়েছে, সেটি দেখার জন্য বর্তমান সময়ে তোলা একটি ছবি আপনাদের সাথে শেয়ার করা হলো।
গিয়াস উদ্দিন আযম শাহের সমাধির বর্তমান অবস্থা। এর অলংকরন গুলো অনেক সুন্দর।
সোনারগাঁও এর পুরাতন গোয়ালধি মসজিদ যা পুরানা মসজিদ নামে পরিচিত, ১৮৭২
এই ছবিটি পুরাতন গোয়ালধি মসজিদের। এর চিত্রগ্রাহক W.Brennand, তিনি ১৮৭২ সালে ছবিটি তুলেন। ছবিটি নেয়া হয়েছে ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়া’ এর সংগ্রহ থেকে। ছবিটিতে মসজিদের জরাজীর্ণ অবস্থা তুলে ধরা হয়েছে এবং মসজিদকে আকড়ে ধরে আছে বিভিন্ন ধরনের পরজীবি উদ্ভিদ। কিন্তু এই বর্তমানে পুনঃসংষ্কার করা হয়েছে, বর্তমান সময়ের একটি ছবি আমার কাছে রয়েছে, সেটিও আপনাদের কাছে শেয়ার করা হলো।
মসজিদটি সম্পর্কে জেমস ওয়াইজ তার Notes on Sunargaon, Eastern Bengal (Journal of the Asiatic Society of Bengal, vol. XLIII, part I, Calcutta, 1874), p. 92: তে বলেছেন আব্দুল হমিদ মসজিদের মাত্র ১০০ গজ দক্ষিণে এই মসজিদটি অবস্থিত। এটি সোনারগাঁও অঞ্চলের সবচাইতে পুরাতন মসজিদ। স্থানীয় লোকজন একে পুরানা মসজিদ বলে চেন। এর শিলালিপির মাধ্যমে জানা যায় যে এটি আলা উদ্দিন হোসেন শাহ্ ১৫১৯ (হি: ৯২৫) খ্রিষ্টাব্দে এটি নির্মান করেন । এই মসজিদটি পরবর্তী সময়ে পুননির্মান করা হয়।
সেই ছবিটি আমার সংগ্রহে রয়েছে। ছবিটি আমি নিজে তুলেছি ২০১৩ সালে।
পুরাতন গোয়ালধি মসজিদের বর্তমান অবস্থা। পুরাতন গোয়ালধি মসজিদটি সংষ্কার করা হয় এবং সংরক্ষান করা হয়। এটি বর্তমানে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের অধীনে রয়েছে।
নতুন গোয়ালধি মসজিদ. ১৮৭২
গোয়ালধি মসজিদের (নতুন) এই ছবিটি তুলেছেন W. Brennand ১৮৭২ সালে। জেমস্ ওয়াইজের বর্ণনায়ও মসজিদের কথা উল্লেখ রয়েছে। এই মসজিদটি আব্দুল হামিদ মসজিদ নামে পরিচিত। এই মসজিদটি গোয়ালদি মসজিদ (পুরাতন) এর ১০০ গজের ভিতরে অবস্থিত। এই মসজিদটি তুলনামূলক ভাবে ভাল অবস্থায় আছে।
এই মসজিদটির সময় কাল ১৭০৫ (হি ১১১৫) । এই মসজিদটি বাংলার বর্গাকার মসজিদের অন্যতম উদাহরণ। আব্দুল হামিদ মসজিদের আরো দুইটি ছবি রয়েছে । যার একটি পাকিস্তান আমলে তোলা এবং আরেকটি আমার নিজের হাতে তোলা।
এটিও নতুন গোলধি মসজিদ।
এটি পাকিস্থান সময়ে তুলা। বাংলা পিডিয়া হতে নেয়া হয়েছে।
নতুন গোয়াধি মসজিদের বর্তমান অবস্থা। ছবিটি ২০১৩ সালে তোলা। এটি এমন ভাবে পুননির্মাণ করা হয়েছে যে এটি প্রাচীন মসজিদ তা বোঝার আর কোন উপায় নেই।
তাছাড়া এই সমজিদটি র আয়তনও বাড়ানো হয়েছ্
পাঁচ পীরের সমাধি ও মসজিদ, ১৮৭২
ছবিটিতে পাঁচ পীরের সমাধি ও মসজিদ দেখানো হয়েছে। ছবিটি Archaeological Survey of India Collections থেকে নেয়া হয়েছে এবং ছবিটি তুলেছেন W. Brennand ১৮৭২ সালে। আলেকজান্ডার কানিংহাম এই সমজিদটির কথা বর্ণনা করেছেন তার Report of a tour in Bengal and Bihar in 1879-80 (ASI vol XV, Calcutta, 1882), p. 139: বইয়ে। পাঁচ পীর এই অঞ্চলের গরীব দুখিদের মাঝে খুব জনপ্রিয় ছিল। এছাড়াও জানা যায় যে এই অঞ্চলে যে নৌ বাণিজ্য হতো, সেই বণিক গন যাত্রা শুরুর পূর্বে পাঁচ পীরের দোয়া নিয়ে যেতেন।
আমি নিজে এই পাচ পীরের সমাধী সৌধ দেখেছি কিন্তু মসজিদটি দেখতে পারিনি। তাই পাঁচ পীরের সমাধি সৌধের নতুন ছবি দিয়ে দিলাম।
পাঁচপীরের সমাধি-২০১৩
পানাম নগরী, ১৮৭০
এই ছবিতে পানাম নগরী দেখানো হয়েছে। ছবিটি ১৮৭০ সালে তোলা তবে এর চিত্রগ্র্রাহকের নাম জানা যায় নি। পানাম নগরী সম্পর্কে আমার প্রায়ই একটা ভুল করে থাকি।
অন্যান্য স্থাপনার মতো পানামের স্থাপনাগুলোকেও আমরা মুঘল বা সুলতানি সময়ের বলে মনে করি । কিন্তু এটি হলো ব্রিটিশ সময়ের স্থাপনা। এই অঞ্চল বস্ত্র শিল্পের জন্য বিখ্যাত ছিল। তাই বিভিন্ন সময়ে অনেক বণিক এই অঞ্চলে বাণিজ্য করার জন্য আসত। অনেক সময় তাদের এখানে দীর্ঘ দিন থাকতে হতো।
তাই তারা এই অঞ্চলে বসতি স্থাপন করেছিল। বণিকদের এই বাড়ি বা গোদাম ঘরই হলো আজকের পানাম নগরী।
পানাম নগরীর বর্তমান অবস্থা
খোন্দার মুহাম্মদ ইউসুফের মসজিদ ও সমাধি, ১৮৭২
এই ছবিটিতে দেখানো হয়েছে খোন্দার মুহাম্মদ ইউসুফের মসজিদ ও সমাধি সৌধ। এটি বর্তমানে সোনারগাঁওয়ের দমদমা এলাকায় অবস্থিত। ছবিটি নেয়া হয়েছে Archaeological Survey of India Collections থেকে এবং ছবিটি তুলেছেন W.Brennand ১৮৭২ সালে ।
জেমস ওয়াইজের বর্ণনায়ও এই মসজিদের কথা উল্লেখ রয়েছে। এখানে যে সমাধি সৌধ রয়েছে তাতে তিনটি কবর রয়েছে- ধারনা করা হয় এই কবরে একটি তার নিজের, একটি স্ত্রীর, এবং একটি তার পিতার। এই কবরগুলো নিয়ে আবার বির্তকও রয়েছে- বলা হয় পিতার কবর টি হয়তো তার ছেলের। এখানে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে জানা যায় যে এটি ১৭০০ সালে নির্মিত। এই সমাধি সৌধের আশে পাশে আরো বেশ কয়েকটি কবর রয়েছে।
একানে রয়েছে আন্দার কোটা বা চিল্লা কোটা নামে একটি প্রাচীন স্থাপনা। ধারণা করা হয় এই আন্দার কোটাই হলো বাংলার প্রথম মাদরাসা। এই সমাধি ও মসজিদের বর্তমান সময়ের ছবি রয়েছে আমার কাছে সেটিও শেয়ার করলাম।
খোন্দার মুহাম্মদ ইউসুফের মসজিদ ও সমাধির বর্তমান অবস্থা
খোন্দার মুহাম্মদ ইউসুফের মসজিদ ও সমাধির আশেপাশের কিছু কবর।
দুল্লালপুর ব্রিজ, পানাম, ১৮৭২
এই ব্রিজটিকে দুল্লালপুর ব্রিজ নামে ডাকা হয়।
এই ছবিটি নেয়া হয়েছে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়াএর সংগ্রহ থেকে। ছবিটি তুলেছেন। W. Brennand ১৮৭২ সালে। জেমস্ ওয়াইজ এর Notes on Sunargaon, Eastern Bengal (Journal of the Asiatic Society of Bengal, vol. XLIII, part I, Calcutta, 1874), p. 91: বইতে এই ব্রিজের বর্ণনা করা রয়েছে। এই ব্রিজটি তিনটি আর্চ(পিলার) বিশিষ্ট।
এই ব্রিজটি মুঘল সময়ের।
দুল্লালপুর ব্রিজের বর্তমান অবস্থা। বাংলাপিডিয়া থেকে নেয়া
সোনরাগাঁও অঞ্চলের একটি রাস্তা, ১৮৭০
এই ছবিতে সোনারগাঁওএর পানাম নগরী অঞ্চলের একটি রাস্তা দেখানো হয়েছে। এ অলোকচিত্রের চিত্রগ্রাহক সম্পর্কে জানা যায় নি। এই ছবিটি নেয়া হয়েছে ‘Views in India and Bangladesh’, part of the Temple Collection বই থেকে ।
এখানে দেখানো হয়েছে ছায়াঘেরা সুনিবিড় গ্রামের একটি রাস্তা।
একটি ব্রিজের ভগ্নাংশ, ১৮৭০
সেনারগাঁও অঞ্চলে প্রচুর নদী রয়েছে। এই কারণে এই অঞ্চলের প্রচুর খালও খনন করা হয়েছিল। এর পেছনে দুইটি কারণ ছিল- ১. বন্যার পানি যেন সহজে নেমে যেতে পারে, ২. সামরিক প্রতিরক্ষার কাজে এই খাল গুলো গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত। তাই এই অঞ্চলে অনেক আগে থেকেই খালের উপর ব্রিজ নির্মান করা হতো।
এই ছবিতে সোনারগাঁও অঞ্চলের একটি ব্রিজের ধ্বংসাবশেষ দেখানো হয়েছে। এই ছবির আলোকচিত্রী সম্পর্কে কিছু জানা যায় নি। ছবিটি তোলা হয়েছে ১৮৭০ সালে।
একটি ব্রিজের মধ্যম খিলানের অংশ বিশেষ, ১৮৭০
এই ছবিতে দেখানো হয়েছে একটি ব্রিজের মধ্য খিলানের অংশ বিশেষ । এই ছবিটির আলোক চিত্রগ্রহক সম্পর্কে জানা যায় নি।
ছবিটি নেয়া হয়েছে ‘Views in India and Bangladesh’, part of the Temple Collection বই থেকে।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কুটি, ১৮৭২
এই ছবিটি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানীর কুটির একটি ছবি। এই কুটিটি সোনারগাঁও এর পানামে অবস্থিত। ছবিটি ১৮৭২ সালে তোলা হয়েছে। এর চিত্রগ্রাহক W. Brennand, ছবিটি বর্তমানে আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়র কাছে সংরক্ষিত রয়েছ্ ।
সোনারগাঁও একসময় মসলিনের জন্য বিখ্যাত ছিল, এই কারণে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানী এখানে একটি কুটি স্থাপন করেন। জেমস্ ওয়াইজের বর্ণনায়ও এই কুটির কথা উল্লেখ রয়েছে।
ময়ূরপঙ্খী ব্রিজ, ১৮৭০
সোনারগাঁয়ের ময়ূরপঙ্খী খালের উপর নির্মিত একটি ব্রিজের ছবি। ছিবিটি ১৮৭০ সালে তোলা, এর চিত্রগ্রাহক সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় নি। এই ব্রিজের অবস্থান সম্পর্কে বিতর্ক রয়েছে।
অনেকে মনে করেন এটি ঢাকার কোন এক খালের উপর নির্মিত ছিল, আবার অনেকে মনে করেন এটি সোনারগাঁয়ে নির্মিত ছিল। তবে অধিকাংই মনে করেন এটি সোনারগাঁয়ের ময়ূর পঙ্খী খালের উপর নির্মিত । তবে এই ব্রিজটির অবস্থান কোথায় তা এখনো সনাক্ত করা যায় নি
খাস নাগরা তালাও, ১৮৭২
এটি একটি দিঘীর ছবি। এই ছবিটি নেয়া হয়েছে Archaeological Survey of India Collections থেকে। ছবিটি তুলেছেন W.Brennand ১৮৭২ সালে।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।