লেখার চেয়ে পড়ায় আগ্রহী। ধার্মিক, পরমতসহিষ্ণু।
প্রতিক্রিয়াজাত পাকিস্তান, সমাজতন্ত্রের জুজু ও একাত্তর
ব্রিটিশযুগে বৃহত্তর ভারতে মুসলিম সমাজের অবস্থান খুব একটা সুখকর ছিল না। প্রথমত: তারা সদ্য ক্ষমতা হারানো জাতি-সম্প্রদায়। আর এতো ইতিাহস-বিশ্রুত যে, সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী ক্ষমতা-হারানো গোষ্ঠীকে সব সময়ই চাপের মুখে রাখে।
বিজিত গোষ্ঠীর সঙ্গে বিজয়ী দলের আচরণের প্রকার, স্বরূপ এবং মাত্রা সে অনুসারেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত: ব্রিটিশরা ক্ষমতালাভের কিছু দিনের মধ্যেই অনুধাবন করে যে, তাদের সহায়ক এ দেশীয় একটি গোষ্ঠী তৈরি না হলে ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও দীর্ঘায়িত হবে না। তাই তারা সংখ্যাগুরু হিন্দুদের প্রতিই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তৃতীয়ত: শাসকদের সঙ্গে শাসিত জনতার সব সময়ই এক রকমের দূরত্ব থাকে, ভুল বোঝাবুঝি থাকে। মুসলিম শাসনামলে শাসিত সমাজ ছিল হিন্দু-সম্প্রদায়।
আর এ কারণেই হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের এক রকমের দূরত্ব ছিল, ভুল বোঝাবুঝি ছিল। ব্রিটিশ আমলেও এর রেশটুকু অব্যাহত ছিল। চতুর্থত: ব্রিটিশদের শাসননীতি ছিল ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ তথা ‘ভাগ কর, শাসন কর’ পর্যায়ের। তাই ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’য়ের মতো মুসলমানদের দুঃখ-বেদনার আস্তর পুরোই হতে থাকে ক্রমান্বয়ে।
ইতিহাসের একটি অমোঘ বিধান হল, ক্ষমতা চিরকাল স্থায়ী হয় না।
ব্রিটিশ শাসনের রশি এক সময় শিথিল হয়ে আসে। এই শিথিলতার কারণ হল, কালের বিবর্তনে শাসন ও শোষণের পদ্ধতি যে ভিন্ন রকম হতে বাধ্য, সে বিষয়ে তাদের অসচেতনতা ও উদ্যোগহীনতা। অন্যদিকে হাজারো নেতিবাচকতা সত্ত্বেও ইউরোপীয় আলোকায়ন যুগের সূচনা, এর প্রচার এবং বিস্তার ঘটে। এ আলোকায়ন-স্পৃষ্ট কতিপয় মানুষ ব্রিটিশ শাসনের অভ্যন্তরেই মশালচির কাজ করতে থাকেন। তখন কোনো প্রমিথিউস না থাকলেও কাজটা ছিল ঠিক প্রমিথিউসেরই।
এদের মাধ্যমেই ব্রিটিশ শাসিত নানা প্রান্ত জেগে উঠতে থাকে বা জেগে ওঠে।
সত্য বটে, ব্রিটিশবিরোধী তৎপরতায় মুসলিম সম্প্রদায় ছিল অগ্রগামী। কারণ, ক্ষমতা-হারানো জাতি ক্ষমতার জন্য সচেষ্ট হবে, সে আর বিচিত্র কী? কিন্তু তাদের তৎপরতার কিছু পরে বা অনেক পরে হিন্দুরাও জাগতে থাকে। হিন্দুরা যেহেতু সংখ্যাগুরু এবং তাদের জাগরণের পথ ও প্রক্রিয়া যুগের চাহিদা-সংলগ্ন, তাই পরিণতিতে এরাই এগিয়ে যায়। ব্রিটিশদের কৃপা-ধন্য কংগ্রেস যখন ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতার পথে এগুতে থাকে, এতে মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্তিও বাড়তে থাকে।
এই এগোনোর ভেতরে, জাগরণের পরতে পরতে হিন্দু ধর্মীয় সংস্কারের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্র হতে শুরু করে। বলাই বাহুল্য, এরূপ ধর্মীয় সংস্কারের প্রথম শিকার কিন্তু মুসলিম সমাজ। ভেতরে ভেতরে হিন্দুত্ববাদের এই ফল্গুধারা বহমান থাকলেও শুরুতে তা প্রকট আকার ধারন করে নি। তবে এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ কংগ্রেসই বৃহত্তর ভূমিকা পালন করে।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ব্রিটিশ-বিরোধী মানসিকতা ও তৎপরতা কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায় থেকেই শুরু।
তাদের জন্য এ পথটা কখনোই মসৃণ ছিল না। এর কারণ একাধিক। প্রথমত: তাদের প্রধান শত্রু বিট্রিশ হলেও দেশীয় অন্যান্য সম্প্রদায়কে তারা আস্থায় নিতে পারে নি। দ্বিতীয়ত: ব্রিটিশের মতো সদাজাগ্রত একটি সাম্রাজ্য-শক্তিকে যে নীতি ও শক্তির মাধ্যমে কাবু ও পদানত করা যায়, তা তাদের অনায়ত্ত ছিল। তৃতীয়ত: জনসংখ্যার দিক থেকে তারা যেমন সংখ্যালঘু, তেমনই অশিক্ষার কারণে সচেতনতার দিক থেকেও তারা ছিল পিছিয়ে।
আর তাই ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে তারা প্রধান হয়ে উঠতে পারে নি। কিন্তু কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বা ভারতের সর্বত্র যখন ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সমান্তরালেই হিন্দুত্ববাদের জাগরণ হতে থাকে, তখনই মুসলিম সম্প্রদায়ের টনক নড়ে। এ বিষয়টি প্রথম উপলব্ধি করেন মুসলিম সমাজে ব্রিটিশ-দালাল বলে খ্যাত, আলীগড় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ। পরে, আরো পরে, কংগ্রেসের অভ্যন্তরে মুসলিম সদস্যগণ টের পেতে থাকেন যে, তাদের জমিন দিন-দিন সংকীর্ণ হয়ে আসছে। আর তখন কংগ্রেসের সদস্যরাই মুসলিম লীগ গঠনের উদ্যোগ নেন, যারা পরে পাকিস্তানের প্রস্তাবক ও বাস্তবায়নকারী।
অর্থাৎ পাকিস্তান আন্দোলন দীর্ঘ পরিকল্পনার কোনো অংশ নয়, বরং একটি অনিবার্য প্রতিক্রিয়ার প্রকাশমাত্র! এর পর ব্রিটিশ বিতাড়ন মানে অনিবার্য দ্বিখণ্ডিতকরণ। একটি মুসলিম লীগের দরকষাকষির ফসল ‘পাকিস্তান’, অপরটি হিন্দু সংখ্যাগুরু পার্টি কংগ্রেসের ‘ভারত’। এই বিভাজনের পক্ষে-বিপক্ষে এখনও বিতর্ক চলমান, ভবিষ্যতে তা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু যে ত্যাগের বিনিময়ে বিভাজনটা হল, তার ইতিহাস কতটুকু সংরক্ষিত ও চর্চিত? উপরন্তু এ রক্ত-বন্যার প্রাপ্তি কতটুকু, তাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।
ভারত যখন বিভাজনের পথে, স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে, তখন তথাকথিত আদর্শিক চালবাজ পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী শক্তির নতুন ভাবনা উপস্থিত হয়।
তাদের উদ্বেগ হল,এ বিভাজিত অংশের বা দুটি অংশের কে নেবে দখল? সমাজতন্ত্রের পুরোধা রাশিয়া, নাকি পুঁজিবাদের মোড়ল আমেরিকা? হ্যাঁ, ১৯১৮ সালের বিপ্লবের পর রুশ যেমন প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থার ভিতকে নাড়িয়ে দেয়, ১৯৪৫ সনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও তখন আমেরিকাকে শক্তির জানান দিতে উদ্বুদ্ধ করে। দুই পরাশক্তি তখন উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে ছিল উপমহাদেশের গতিবিধির উপর। কংগ্রেসের নীতি ছিল অখণ্ড ভারত, তাই মুসলিম লীগের খণ্ডিতকরণ নীতির মোকাবেলায় তারা সুষ্পষ্ট ভাষায় বলে ফেলে, ‘আপাতত মেনে নিলেও তারা অখণ্ড ভারতের নীতি থেকে সরে আসবে না। ’ আর যাই কোথা? মুসলিম লীগের পাকিস্তানকে শুরু থেকেই অস্তিত্ব হারানোর আশঙ্কা পেয়ে বসে। অস্তিত্ব-রক্ষার তাগিদে কালিকভাবে জিন্নাহই প্রথম আমেরিকার দ্বারস্থ হন! ব্যস, শুরু হল পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী শিবিরের অত্যাশ্চর্য জুজুখেলা।
ভারতে যখন বিট্রিশ-বিরোধী আন্দোলন চলমান, তখন সংখ্যায় নগণ্য হলেও কার্ল মার্কসের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি অন্তত স্কুল-কলেজ-পড়–য়া সচেতন তরুণদের কানে আছড়ে পড়তে থাকে। শ্লথভাবে এবং ক্ষীণধারায় হলেও এরা এদেশে রুশ মডেলের সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতে থাকে। কারো কারো স্বপ্ন ছিল বৃহৎ ভারত যেহেতু আর থাকছে না, তাই খণ্ডিত ভারতেই একে বাস্তবায়ন করায় উদ্যোগ নিতে হবে। কারো করো ভাবনা আরো এক ধাপ এগিয়ে। তাদের মতে, পাকিস্তানে বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানেই বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন হতে পারে।
এ খবর আমেরিকারও জানা ছিল। তাই পাকিস্তানের জিন্নাহর প্রস্তাবকে অনতিবিলম্বে লুফে নেয়। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের ভিতরে যেন কোনোভাবেই সমাজতন্ত্রের চর্চা না হতে পারে, সে ব্যাপারে বিপুল আকারের আর্থিক অনুদানসহ নান রকমের তৎপরতার সূচনা করে।
মার্কসবাদ নিয়ে ধর্মীয় মহল, বিশেষত মুসলিম-সমাজের সঙ্গত কারণেই নেতিবাচক মনোভাব ছিল। একে তো তাদেরই কারো কারো মতে, তা ধর্মহীন; কারো কারো মতে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা।
অন্যদিকে বিপ্লবের পর রাশিয়া ও চিনে তথাকার প্রতিবাদী মুসলিম-সমাজের মাঝে নেমে এসেছিল অমানিশার অন্ধকার। কিন্তু পুঁজিবাদে তা নেই, বরং বাহ্যত পুঁজি ধর্মকে স্বীকার করে। যদিও পুঁজিবাদ অত্যন্ত কৌশলে ধর্মকে রূপান্তর করে নেয়, অধর্মকে ধর্মরূপে উপস্থাপন করার কৌশল গ্রহণ করে, জোর করে ধর্মকে-ধর্মীয় স্বাধীনতা কেড়ে নেয় না। তাই সরল ও সাধারণ মুসলিম-সম্প্রদায় এভাবেই পুঁজিবাদের প্রতি বিগলিত ও সমাজবাদের প্রতি অনীহ হয়ে পড়ে। উপরন্তু সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষণে আমেরিকার যে অবদান (?), তাতে তা নির্ঘাত একটি অশুভ দৈত্য হিসাবেই রূপায়িত হয়।
মুসলিমবিশ্ব, বিশেষত পাকিস্তানের সাধারণ মুসলিম জনগণ আমেরিকা কর্তৃক বর্ণিত সমাজবাদের বয়ান শুনে একে তলিয়ে দেখার যে ইমানি দায়িত্ব ছিল, তা হারিয়ে বসে। এভাবেই সমাজতন্ত্র ইসলামের একমাত্র এবং প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হয়।
সমাজতন্ত্র আকাশ থেকে পাওয়া কোনো বস্তু নয়; বরং বলা ভাল, ‘মানুষেরই জন্য’ মানুষেরই গড়া একটি আদর্শ (?) বা রাষ্ট্র-ব্যবস্থা এবং অবশ্যই তা দোষ-গুণের বিপুল সমাহার। কিন্তু যে দার্শনিক অবস্থান ও জ্ঞানতাত্ত্বিক উৎস থেকে এর উৎসার-উৎপত্তি, তার বিশ্লেষণে বিরোধীদের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না, এখনো নেই। তবে মার্কসবাদীদের নিজেদের আচরণে, বিরোধীদের বিপুল অপপ্রচারে এ যে ‘মানুষেরই মঙ্গলের জন্য গড়া একটি ব্যবস্থা’, তা সমূলে ঢাকা পড়ে যায়।
জ্ঞানতাত্ত্বিক ও আচরণিকভাবে এর বিরোধী চর্চার ফুলঝুরি আমেরিকার সুবাদে সর্বত্রই ছিল, বাস্তবায়ন ছিল না। শুধু আদর্শিক অবস্থান থেকে এক মাওলানা মওদুদিই ভাসাভাসাভাবে এর আর্থিক ও বিপ্লবী অবস্থানটুকু আত্মস্থ করতে সক্ষম হন। জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থান থেকে এর চুলচেরা বিশ্লেষণ ও গ্রহণ-বর্জনের কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করা হয় নি। তবে একে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ফায়েদালুটার বিরাট এক মচ্ছব ছিল, এখনো আছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইসলাম প্রতিষ্টার জন্য।
কিন্তু প্রতিষ্ঠিত অবিভাজিত পাকিস্তানে কতটুকু ইসলাম ছিল? অনেক চাপাচাপি ও জবরদস্তির পর পাকিস্তান যে সংবিধান প্রসব করে, তা কতটুকু ইসলাম-সম্মত ছিল? প্রাথমিক প্রয়াস হিসাবে একে মেনে নিলেও তা বাধাগ্রস্ত হল কেন? এ-কি ভারতের কংগ্রেসের কারণে, নাকি রুশজাত সমাজতন্ত্রের কারণে? যে মানুষ একসময় ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ শ্লোগান দিয়েছিল, সে-ই কেন আবার ‘লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়, ইয়ে আজাদি জুটা হ্যায়’ বলে গলা ফাটায়? এ জন্য দায়ী কি সমাজতন্ত্র, নাকি ভারতের হিন্দু ও কংগ্রেস? পাকিস্তানের শাসন-ব্যবস্থা স্থিতিশীল হয় নি কেন? স্থিতিশীল করার জন্য ইসলামী দল ও মানুষগুলোর কী ভূমিকা ছিল? তবে এতটুকু জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কারো ট্রাঙ্কে, বাসার আলমিরা বা দেরাজে মার্কসের বই থাকার কারণে জেলে যেতে হয়েছে, জেরার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারণ, পাকিস্তানের পদে পদে বাধাসৃষ্টি করার জন্য দায়ী এই সমাজতন্ত্র, এই মার্কসবাদ! সমাজতন্ত্র আর মার্কসবাদের এতই কারিশমা যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজে ইসলামের জানবাজ সিপাহসালার ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতাগণ জীবিত ও সক্রিয় থাকা অবস্থায়ই তা পরিকল্পিত ইসলামের আদর্শিক পথে এগিয়ে না গিয়ে মুষ্টিমেয় তথাকথিত নাস্তিক সমাজবাদীদের পথ-পরিক্রমায় চলার উপক্রম হয়!
যেই মুসলিম লীগের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ-দলের প্রায়োগিক প্রয়োজন মিইয়ে আসে। এর সদস্যরা তখন ক্ষমতা আর পদের ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর পেট চিঁড়েই তখন বের হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরবর্তীকালের আওয়ামী লীগ। প্রথাগত ধারণা মতে, মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়ার কারণে যার নেতা-কর্মীরা ইসলামী আওতার বাইরে চলে যায়, সমাজতন্ত্রের কথা বলে এই আওয়ামী লীগ তো পুরোপুরি কাফেরই হয়ে গেল! আর এভাবেই জামায়াতে ইসলামীসহ অপরাপর ইসলামী দলগুলো আরো মুসলিম হয়ে পড়ে! এ যেন বঙ্কিমের সেই উচ্চারণের মতো, ‘তুমি অধম হইলে আমি উত্তম হইবা না কেন’? প্রশ্ন হল, মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে, পার্টির মেনোফেস্টোতে সমাজতন্ত্রের গুটিকয় নীতি যুক্ত করে আওয়ামী লীগ একেবারে মার্কস-মার্কা নাস্তিক্যবাদী পার্টি হয়ে গেল, একি পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হলফ করে বলতে পারবেন? কোনো তাত্ত্বিক, দার্শনিক একে কি মার্কসের গড়া সমাজবাদী পার্টি বলতে পারবেন?
একাত্তরে এসে ইসলামী দলগুলো ধর্মের তত্ত্ব ও দর্শনের আবরণে আওয়ামী লীগের বিরোধিতার মূল কারণ হিসাবে একাধিক অজুহাতের মধ্যে এটাকেই অন্যতম ও প্রধান হিসাবে দাঁড় করায়।
এখনো নিজ ভক্তবৃন্দের মাঝে এ-সব তথ্য কপচিয়ে একাত্তরের স্বাধীনতা-বিরোধিতাকে হালাল করার দুর্মর চেষ্টা অব্যাহত আছে। ধর্মীয় আবহে কতিপয় শব্দের ব্যবহার এবং অন্ধ আবেগ তৈরি করা ছাড়া পূর্বের মতো এখনো সমাজতন্ত্রের দার্শনিক ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বিকল্প হিসাবে এরা শক্ত কোনো পাটাতন তৈরি করতে পারে নি। এর কারণ, ইসলামের অর্থ ও শাসন-ব্যবস্থার অনেক কিছুই এদের কাছে এখনো প্রথাগত ব্যাখ্যার নিগড়েই আটকে আছে। এরা অবচেতনভাবে পুঁজিবাদের অন্ধ তল্পিবাহক। যেমনটি আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকেই পুঁজিবাদী।
কিন্তু আওয়ামী লীগ নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে কতিপয় শব্দ ব্যবহার করেছে নিজ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ অনুসারে, যা কোনোভাবেই মার্কসীয় দার্শনিক অবস্থান থেকে নয়। আর বিরোধীরা পাক-মার্কিন যোগসাজশে একেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
আর হ্যাঁ, প্রাসঙ্গিকভাবেই বলা যায়, একাত্তরের স্বাধীনতা-বিরোধিতার অন্য একটি যুক্তি ছিল, ‘এতে ভারতই লাভবান হবে’। ভারত যে কাজের সুবিধা পাবে, তাতে কোনোভাবেই সমর্থন দেওয়া যাবে না; কারণ, ভারত শত্রু। ভারত শত্রু ঠিক আছে, পাকিস্তান কি তাহলে মিত্র ছিল? পাকিস্তান যখন শোষণ করে, চুষণ করে, পেষণ করে, তখন কোথায় ছিল তার মিত্রতা? কোথায় ছিল ইসলামী আন্দোলন-আদর্শ? শেখ মুজিবের রাজনৈতিক পাটাতন তৈরি হয় কীভাবে? অমুসলিমদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আন্দোলন করলে এই মুসলিম-ভূখণ্ডে তিনি এতটা জনপ্রিয় হতে পারতেন না।
যে অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক নিপীড়ন-বঞ্চনার কথা তিনি বলেছেন, তাতে ইসলামী পরিভাষা নেই বটে, কিন্তু এতে সাধারণ মানুষের অন্তরাত্মার আকুতিটুকু ফুটে উঠেছিল। তাই দেশের প্রায় সকল ইসলামী দল একসঙ্গে মিলে, ধর্মীয় আদর্শ ও চিন্তার কথা বলে, ভারতজুজুর ভয় দেখিয়েও হালে পানি পায় নি। ‘ভারত দে হারামজাদা, নইলে তোর মানচিত্র খাবো’ এটা কবির ভাষা নয়, শেখ মুজিবের ভাষণ নয়, সাধারণ জনতার আকুতি ও প্রাণান্তকর দাবির সারনির্যাস মাত্র। তাই প্রশ্ন হল ভারতবিরোধিতার নামে আমার পেট শূন্য থাকবে কেন? এর উত্তর কি কোনো ইসলামী দল দিতে পারবে? ভারত নিয়ে যাবে বলে আমাকে না খেয়ে থাকতে হবে, শোষিত হতে হবে, প্যাদানি খেতে হবে, নির্যাতিত হতে হবে, মুখ বুজে ধর্ষিত হতে হবে, এটা ইসলামের কোন জায়গায় লেখা আছে?
মোটকথা হল, পাকিস্তানে যে সমাজতন্ত্রের জুজু তৈরি হয়েছিল, তার পেছনে পাক-মার্কিনের যোগ-সাজশই ছিল মূল কারণ। পাকিস্তানের শাসকরা নিজেদের ব্যর্থতাকে-অযোগ্যতাকে ঢেকে রাখার মোক্ষম হাতিয়ার হিসাবে একে চালান করে।
হাতে-গোনা বাম-ঘারানার ছেলে-পিলেরা যেন মার্কিন-বিরোধী কোনো জনমত তৈরি করতে না পারে, পাকিস্তানের তরী কোনোভাবেই যেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্দরে ভিড়বার অবকাশ না পায়, সে-জন্য মার্কিন প্রশাসন নিরলসভাবে কাজ করে। বোধ-বুদ্ধিহীন, অসচেতন-আধা-সচেতন ধর্ম-নেতাগণ নিজের কানে হাত না দিয়েই চিলের পেছনে দৌড়াতে থাকেন, ‘কান নিয়েছে চিলে’ ম্লোগান শুনেই। আর হ্যাঁ, পাকিস্তানের ব্যর্থতার মূল কারণও এখানেই নিহিত। তা ছিল আদ্যান্ত প্রতিক্রিয়াশীলতার এক বিশাল দৈত্যশালা, যেখানে সামান্য একটি ক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগপিছু না ভেবে অসংখ্য প্রতিক্রিয়াশীলতার ঢেউ তৈরি হত। সৃজনশীলতা নয়, প্রতিক্রিয়াশীলতাই যার অমোঘ নিয়তি, তার পরিণতি যদি নেতিবাচক হয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না।
কিন্তু অবাক হই, এখনো প্রতিক্রিয়াশীলতাকে ধর্ম ও জ্ঞান হিসাবে প্রচারের চেষ্টা দেখে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।
ব্রিটিশযুগে বৃহত্তর ভারতে মুসলিম সমাজের অবস্থান খুব একটা সুখকর ছিল না। প্রথমত: তারা সদ্য ক্ষমতা হারানো জাতি-সম্প্রদায়।
আর এতো ইতিাহস-বিশ্রুত যে, সদ্য ক্ষমতাপ্রাপ্ত গোষ্ঠী ক্ষমতা-হারানো গোষ্ঠীকে সব সময়ই চাপের মুখে রাখে। বিজিত গোষ্ঠীর সঙ্গে বিজয়ী দলের আচরণের প্রকার, স্বরূপ এবং মাত্রা সে অনুসারেই নির্ধারিত হয়ে থাকে। দ্বিতীয়ত: ব্রিটিশরা ক্ষমতালাভের কিছু দিনের মধ্যেই অনুধাবন করে যে, তাদের সহায়ক এ দেশীয় একটি গোষ্ঠী তৈরি না হলে ক্ষমতা পাকাপোক্ত ও দীর্ঘায়িত হবে না। তাই তারা সংখ্যাগুরু হিন্দুদের প্রতিই সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেয়। তৃতীয়ত: শাসকদের সঙ্গে শাসিত জনতার সব সময়ই এক রকমের দূরত্ব থাকে, ভুল বোঝাবুঝি থাকে।
মুসলিম শাসনামলে শাসিত সমাজ ছিল হিন্দু-সম্প্রদায়। আর এ কারণেই হিন্দু সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুসলিম সম্প্রদায়ের এক রকমের দূরত্ব ছিল, ভুল বোঝাবুঝি ছিল। ব্রিটিশ আমলেও এর রেশটুকু অব্যাহত ছিল। চতুর্থত: ব্রিটিশদের শাসননীতি ছিল ‘ডিভাইড এন্ড রুল’ তথা ‘ভাগ কর, শাসন কর’ পর্যায়ের। তাই ‘মড়ার উপর খাড়ার ঘা’য়ের মতো মুসলমানদের দুঃখ-বেদনার আস্তর পুরোই হতে থাকে ক্রমান্বয়ে।
ইতিহাসের একটি অমোঘ বিধান হল, ক্ষমতা চিরকাল স্থায়ী হয় না। ব্রিটিশ শাসনের রশি এক সময় শিথিল হয়ে আসে। এই শিথিলতার কারণ হল, কালের বিবর্তনে শাসন ও শোষণের পদ্ধতি যে ভিন্ন রকম হতে বাধ্য, সে বিষয়ে তাদের অসচেতনতা ও উদ্যোগহীনতা। অন্যদিকে হাজারো নেতিবাচকতা সত্ত্বেও ইউরোপীয় আলোকায়ন যুগের সূচনা, এর প্রচার এবং বিস্তার ঘটে। এ আলোকায়ন-স্পৃষ্ট কতিপয় মানুষ ব্রিটিশ শাসনের অভ্যন্তরেই মশালচির কাজ করতে থাকেন।
তখন কোনো প্রমিথিউস না থাকলেও কাজটা ছিল ঠিক প্রমিথিউসেরই। এদের মাধ্যমেই ব্রিটিশ শাসিত নানা প্রান্ত জেগে উঠতে থাকে বা জেগে ওঠে।
সত্য বটে, ব্রিটিশবিরোধী তৎপরতায় মুসলিম সম্প্রদায় ছিল অগ্রগামী। কারণ, ক্ষমতা-হারানো জাতি ক্ষমতার জন্য সচেষ্ট হবে, সে আর বিচিত্র কী? কিন্তু তাদের তৎপরতার কিছু পরে বা অনেক পরে হিন্দুরাও জাগতে থাকে। হিন্দুরা যেহেতু সংখ্যাগুরু এবং তাদের জাগরণের পথ ও প্রক্রিয়া যুগের চাহিদা-সংলগ্ন, তাই পরিণতিতে এরাই এগিয়ে যায়।
ব্রিটিশদের কৃপা-ধন্য কংগ্রেস যখন ক্রমান্বয়ে স্বাধীনতার পথে এগুতে থাকে, এতে মুসলিম সমাজের অন্তর্ভুক্তিও বাড়তে থাকে। এই এগোনোর ভেতরে, জাগরণের পরতে পরতে হিন্দু ধর্মীয় সংস্কারের মাত্রা তীব্র থেকে তীব্র হতে শুরু করে। বলাই বাহুল্য, এরূপ ধর্মীয় সংস্কারের প্রথম শিকার কিন্তু মুসলিম সমাজ। ভেতরে ভেতরে হিন্দুত্ববাদের এই ফল্গুধারা বহমান থাকলেও শুরুতে তা প্রকট আকার ধারন করে নি। তবে এটা ঐতিহাসিক সত্য যে, ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ক্ষেত্রে এ কংগ্রেসই বৃহত্তর ভূমিকা পালন করে।
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, ব্রিটিশ-বিরোধী মানসিকতা ও তৎপরতা কিন্তু মুসলিম সম্প্রদায় থেকেই শুরু। তাদের জন্য এ পথটা কখনোই মসৃণ ছিল না। এর কারণ একাধিক। প্রথমত: তাদের প্রধান শত্রু বিট্রিশ হলেও দেশীয় অন্যান্য সম্প্রদায়কে তারা আস্থায় নিতে পারে নি। দ্বিতীয়ত: ব্রিটিশের মতো সদাজাগ্রত একটি সাম্রাজ্য-শক্তিকে যে নীতি ও শক্তির মাধ্যমে কাবু ও পদানত করা যায়, তা তাদের অনায়ত্ত ছিল।
তৃতীয়ত: জনসংখ্যার দিক থেকে তারা যেমন সংখ্যালঘু, তেমনই অশিক্ষার কারণে সচেতনতার দিক থেকেও তারা ছিল পিছিয়ে। আর তাই ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনে তারা প্রধান হয়ে উঠতে পারে নি। কিন্তু কংগ্রেসের অভ্যন্তরে বা ভারতের সর্বত্র যখন ব্রিটিশ-বিরোধী আন্দোলনের সমান্তরালেই হিন্দুত্ববাদের জাগরণ হতে থাকে, তখনই মুসলিম সম্প্রদায়ের টনক নড়ে। এ বিষয়টি প্রথম উপলব্ধি করেন মুসলিম সমাজে ব্রিটিশ-দালাল বলে খ্যাত, আলীগড় আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা স্যার সৈয়দ আহমদ। পরে, আরো পরে, কংগ্রেসের অভ্যন্তরে মুসলিম সদস্যগণ টের পেতে থাকেন যে, তাদের জমিন দিন-দিন সংকীর্ণ হয়ে আসছে।
আর তখন কংগ্রেসের সদস্যরাই মুসলিম লীগ গঠনের উদ্যোগ নেন, যারা পরে পাকিস্তানের প্রস্তাবক ও বাস্তবায়নকারী। অর্থাৎ পাকিস্তান আন্দোলন দীর্ঘ পরিকল্পনার কোনো অংশ নয়, বরং একটি অনিবার্য প্রতিক্রিয়ার প্রকাশমাত্র! এর পর ব্রিটিশ বিতাড়ন মানে অনিবার্য দ্বিখণ্ডিতকরণ। একটি মুসলিম লীগের দরকষাকষির ফসল ‘পাকিস্তান’, অপরটি হিন্দু সংখ্যাগুরু পার্টি কংগ্রেসের ‘ভারত’। এই বিভাজনের পক্ষে-বিপক্ষে এখনও বিতর্ক চলমান, ভবিষ্যতে তা অব্যাহত থাকবে। কিন্তু যে ত্যাগের বিনিময়ে বিভাজনটা হল, তার ইতিহাস কতটুকু সংরক্ষিত ও চর্চিত? উপরন্তু এ রক্ত-বন্যার প্রাপ্তি কতটুকু, তাও প্রশ্নের ঊর্ধ্বে নয়।
ভারত যখন বিভাজনের পথে, স্বাধীনতার দ্বারপ্রান্তে, তখন তথাকথিত আদর্শিক চালবাজ পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী শক্তির নতুন ভাবনা উপস্থিত হয়। তাদের উদ্বেগ হল,এ বিভাজিত অংশের বা দুটি অংশের কে নেবে দখল? সমাজতন্ত্রের পুরোধা রাশিয়া, নাকি পুঁজিবাদের মোড়ল আমেরিকা? হ্যাঁ, ১৯১৮ সালের বিপ্লবের পর রুশ যেমন প্রচলিত বিশ্বব্যবস্থার ভিতকে নাড়িয়ে দেয়, ১৯৪৫ সনের দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধও তখন আমেরিকাকে শক্তির জানান দিতে উদ্বুদ্ধ করে। দুই পরাশক্তি তখন উন্মুখ হয়ে তাকিয়ে ছিল উপমহাদেশের গতিবিধির উপর। কংগ্রেসের নীতি ছিল অখণ্ড ভারত, তাই মুসলিম লীগের খণ্ডিতকরণ নীতির মোকাবেলায় তারা সুষ্পষ্ট ভাষায় বলে ফেলে, ‘আপাতত মেনে নিলেও তারা অখণ্ড ভারতের নীতি থেকে সরে আসবে না। ’ আর যাই কোথা? মুসলিম লীগের পাকিস্তানকে শুরু থেকেই অস্তিত্ব হারানোর আশঙ্কা পেয়ে বসে।
অস্তিত্ব-রক্ষার তাগিদে কালিকভাবে জিন্নাহই প্রথম আমেরিকার দ্বারস্থ হন! ব্যস, শুরু হল পুঁজিবাদী ও সমাজবাদী শিবিরের অত্যাশ্চর্য জুজুখেলা।
ভারতে যখন বিট্রিশ-বিরোধী আন্দোলন চলমান, তখন সংখ্যায় নগণ্য হলেও কার্ল মার্কসের ধ্বনি-প্রতিধ্বনি অন্তত স্কুল-কলেজ-পড়–য়া সচেতন তরুণদের কানে আছড়ে পড়তে থাকে। শ্লথভাবে এবং ক্ষীণধারায় হলেও এরা এদেশে রুশ মডেলের সমাজতন্ত্রের স্বপ্ন দেখতে থাকে। কারো কারো স্বপ্ন ছিল বৃহৎ ভারত যেহেতু আর থাকছে না, তাই খণ্ডিত ভারতেই একে বাস্তবায়ন করায় উদ্যোগ নিতে হবে। কারো করো ভাবনা আরো এক ধাপ এগিয়ে।
তাদের মতে, পাকিস্তানে বিশেষত পূর্ব পাকিস্তানেই বিপ্লবের মাধ্যমে সমাজতন্ত্রের বাস্তবায়ন হতে পারে। এ খবর আমেরিকারও জানা ছিল। তাই পাকিস্তানের জিন্নাহর প্রস্তাবকে অনতিবিলম্বে লুফে নেয়। শুধু তাই নয়, পাকিস্তানের ভিতরে যেন কোনোভাবেই সমাজতন্ত্রের চর্চা না হতে পারে, সে ব্যাপারে বিপুল আকারের আর্থিক অনুদানসহ নান রকমের তৎপরতার সূচনা করে।
মার্কসবাদ নিয়ে ধর্মীয় মহল, বিশেষত মুসলিম-সমাজের সঙ্গত কারণেই নেতিবাচক মনোভাব ছিল।
একে তো তাদেরই কারো কারো মতে, তা ধর্মহীন; কারো কারো মতে, ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রব্যবস্থা। অন্যদিকে বিপ্লবের পর রাশিয়া ও চিনে তথাকার প্রতিবাদী মুসলিম-সমাজের মাঝে নেমে এসেছিল অমানিশার অন্ধকার। কিন্তু পুঁজিবাদে তা নেই, বরং বাহ্যত পুঁজি ধর্মকে স্বীকার করে। যদিও পুঁজিবাদ অত্যন্ত কৌশলে ধর্মকে রূপান্তর করে নেয়, অধর্মকে ধর্মরূপে উপস্থাপন করার কৌশল গ্রহণ করে, জোর করে ধর্মকে-ধর্মীয় স্বাধীনতা কেড়ে নেয় না। তাই সরল ও সাধারণ মুসলিম-সম্প্রদায় এভাবেই পুঁজিবাদের প্রতি বিগলিত ও সমাজবাদের প্রতি অনীহ হয়ে পড়ে।
উপরন্তু সমাজতান্ত্রিক বিশ্লেষণে আমেরিকার যে অবদান (?), তাতে তা নির্ঘাত একটি অশুভ দৈত্য হিসাবেই রূপায়িত হয়। মুসলিমবিশ্ব, বিশেষত পাকিস্তানের সাধারণ মুসলিম জনগণ আমেরিকা কর্তৃক বর্ণিত সমাজবাদের বয়ান শুনে একে তলিয়ে দেখার যে ইমানি দায়িত্ব ছিল, তা হারিয়ে বসে। এভাবেই সমাজতন্ত্র ইসলামের একমাত্র এবং প্রধান শত্রু হিসাবে চিহ্নিত হয়।
সমাজতন্ত্র আকাশ থেকে পাওয়া কোনো বস্তু নয়; বরং বলা ভাল, ‘মানুষেরই জন্য’ মানুষেরই গড়া একটি আদর্শ (?) বা রাষ্ট্র-ব্যবস্থা এবং অবশ্যই তা দোষ-গুণের বিপুল সমাহার। কিন্তু যে দার্শনিক অবস্থান ও জ্ঞানতাত্ত্বিক উৎস থেকে এর উৎসার-উৎপত্তি, তার বিশ্লেষণে বিরোধীদের তেমন কোনো আগ্রহ ছিল না, এখনো নেই।
তবে মার্কসবাদীদের নিজেদের আচরণে, বিরোধীদের বিপুল অপপ্রচারে এ যে ‘মানুষেরই মঙ্গলের জন্য গড়া একটি ব্যবস্থা’, তা সমূলে ঢাকা পড়ে যায়। জ্ঞানতাত্ত্বিক ও আচরণিকভাবে এর বিরোধী চর্চার ফুলঝুরি আমেরিকার সুবাদে সর্বত্রই ছিল, বাস্তবায়ন ছিল না। শুধু আদর্শিক অবস্থান থেকে এক মাওলানা মওদুদিই ভাসাভাসাভাবে এর আর্থিক ও বিপ্লবী অবস্থানটুকু আত্মস্থ করতে সক্ষম হন। জ্ঞানতাত্ত্বিক অবস্থান থেকে এর চুলচেরা বিশ্লেষণ ও গ্রহণ-বর্জনের কোনো উদ্যোগই গ্রহণ করা হয় নি। তবে একে কেন্দ্র করে রাজনৈতিক ফায়েদালুটার বিরাট এক মচ্ছব ছিল, এখনো আছে।
পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ইসলাম প্রতিষ্টার জন্য। কিন্তু প্রতিষ্ঠিত অবিভাজিত পাকিস্তানে কতটুকু ইসলাম ছিল? অনেক চাপাচাপি ও জবরদস্তির পর পাকিস্তান যে সংবিধান প্রসব করে, তা কতটুকু ইসলাম-সম্মত ছিল? প্রাথমিক প্রয়াস হিসাবে একে মেনে নিলেও তা বাধাগ্রস্ত হল কেন? এ-কি ভারতের কংগ্রেসের কারণে, নাকি রুশজাত সমাজতন্ত্রের কারণে? যে মানুষ একসময় ‘লড়কে লেঙ্গে পাকিস্তান’ শ্লোগান দিয়েছিল, সে-ই কেন আবার ‘লাখো ইনসান ভুখা হ্যায়, ইয়ে আজাদি জুটা হ্যায়’ বলে গলা ফাটায়? এ জন্য দায়ী কি সমাজতন্ত্র, নাকি ভারতের হিন্দু ও কংগ্রেস? পাকিস্তানের শাসন-ব্যবস্থা স্থিতিশীল হয় নি কেন? স্থিতিশীল করার জন্য ইসলামী দল ও মানুষগুলোর কী ভূমিকা ছিল? তবে এতটুকু জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়ের হলে কারো ট্রাঙ্কে, বাসার আলমিরা বা দেরাজে মার্কসের বই থাকার কারণে জেলে যেতে হয়েছে, জেরার সম্মুখীন হতে হয়েছে। কারণ, পাকিস্তানের পদে পদে বাধাসৃষ্টি করার জন্য দায়ী এই সমাজতন্ত্র, এই মার্কসবাদ! সমাজতন্ত্র আর মার্কসবাদের এতই কারিশমা যে, সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলিম সমাজে ইসলামের জানবাজ সিপাহসালার ও পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতাগণ জীবিত ও সক্রিয় থাকা অবস্থায়ই তা পরিকল্পিত ইসলামের আদর্শিক পথে এগিয়ে না গিয়ে মুষ্টিমেয় তথাকথিত নাস্তিক সমাজবাদীদের পথ-পরিক্রমায় চলার উপক্রম হয়!
যেই মুসলিম লীগের লক্ষ্য ছিল পাকিস্তান প্রতিষ্ঠা, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর এ-দলের প্রায়োগিক প্রয়োজন মিইয়ে আসে। এর সদস্যরা তখন ক্ষমতা আর পদের ভাগাভাগি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এর পেট চিঁড়েই তখন বের হয় আওয়ামী মুসলিম লীগ, পরবর্তীকালের আওয়ামী লীগ।
প্রথাগত ধারণা মতে, মুসলিম শব্দটি বাদ দেওয়ার কারণে যার নেতা-কর্মীরা ইসলামী আওতার বাইরে চলে যায়, সমাজতন্ত্রের কথা বলে এই আওয়ামী লীগ তো পুরোপুরি কাফেরই হয়ে গেল! আর এভাবেই জামায়াতে ইসলামীসহ অপরাপর ইসলামী দলগুলো আরো মুসলিম হয়ে পড়ে! এ যেন বঙ্কিমের সেই উচ্চারণের মতো, ‘তুমি অধম হইলে আমি উত্তম হইবা না কেন’? প্রশ্ন হল, মুসলিম শব্দটি বাদ দিয়ে, পার্টির মেনোফেস্টোতে সমাজতন্ত্রের গুটিকয় নীতি যুক্ত করে আওয়ামী লীগ একেবারে মার্কস-মার্কা নাস্তিক্যবাদী পার্টি হয়ে গেল, একি পৃথিবীর কোনো রাষ্ট্রবিজ্ঞানী হলফ করে বলতে পারবেন? কোনো তাত্ত্বিক, দার্শনিক একে কি মার্কসের গড়া সমাজবাদী পার্টি বলতে পারবেন?
একাত্তরে এসে ইসলামী দলগুলো ধর্মের তত্ত্ব ও দর্শনের আবরণে আওয়ামী লীগের বিরোধিতার মূল কারণ হিসাবে একাধিক অজুহাতের মধ্যে এটাকেই অন্যতম ও প্রধান হিসাবে দাঁড় করায়। এখনো নিজ ভক্তবৃন্দের মাঝে এ-সব তথ্য কপচিয়ে একাত্তরের স্বাধীনতা-বিরোধিতাকে হালাল করার দুর্মর চেষ্টা অব্যাহত আছে। ধর্মীয় আবহে কতিপয় শব্দের ব্যবহার এবং অন্ধ আবেগ তৈরি করা ছাড়া পূর্বের মতো এখনো সমাজতন্ত্রের দার্শনিক ও তাত্ত্বিক ব্যাখ্যার বিকল্প হিসাবে এরা শক্ত কোনো পাটাতন তৈরি করতে পারে নি। এর কারণ, ইসলামের অর্থ ও শাসন-ব্যবস্থার অনেক কিছুই এদের কাছে এখনো প্রথাগত ব্যাখ্যার নিগড়েই আটকে আছে। এরা অবচেতনভাবে পুঁজিবাদের অন্ধ তল্পিবাহক।
যেমনটি আওয়ামী লীগ জন্মলগ্ন থেকেই পুঁজিবাদী। কিন্তু আওয়ামী লীগ নিজের রাজনৈতিক অস্তিত্ব ও স্বার্থ রক্ষার উদ্দেশ্যে কতিপয় শব্দ ব্যবহার করেছে নিজ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ অনুসারে, যা কোনোভাবেই মার্কসীয় দার্শনিক অবস্থান থেকে নয়। আর বিরোধীরা পাক-মার্কিন যোগসাজশে একেই আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসে।
আর হ্যাঁ, প্রাসঙ্গিকভাবেই বলা যায়, একাত্তরের স্বাধীনতা-বিরোধিতার অন্য একটি যুক্তি ছিল, ‘এতে ভারতই লাভবান হবে’। ভারত যে কাজের সুবিধা পাবে, তাতে কোনোভাবেই সমর্থন দেওয়া যাবে না; কারণ, ভারত শত্রু।
ভারত শত্রু ঠিক আছে, পাকিস্তান কি তাহলে মিত্র ছিল? পাকিস্তান যখন শোষণ করে, চুষণ করে, পেষণ করে, তখন কোথায় ছিল তার মিত্রতা? কোথায় ছিল ইসলামী আন্দোলন-আদর্শ? শেখ মুজিবের রাজনৈতিক পাটাতন তৈরি হয় কীভাবে? অমুসলিমদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য আন্দোলন করলে এই মুসলিম-ভূখণ্ডে তিনি এতটা জনপ্রিয় হতে পারতেন না। যে অর্থনৈতিক শোষণ ও রাজনৈতিক নিপীড়ন-বঞ্চনার কথা তিনি বলেছেন, তাতে ইসলামী পরিভাষা নেই বটে, কিন্তু এতে সাধারণ মানুষের অন্তরাত্মার আকুতিটুকু ফুটে উঠেছিল। তাই দেশের প্রায় সকল ইসলামী দল একসঙ্গে মিলে, ধর্মীয় আদর্শ ও চিন্তার কথা বলে, ভারতজুজুর ভয় দেখিয়েও হালে পানি পায় নি। ‘ভারত দে হারামজাদা, নইলে তোর মানচিত্র খাবো’ এটা কবির ভাষা নয়, শেখ মুজিবের ভাষণ নয়, সাধারণ জনতার আকুতি ও প্রাণান্তকর দাবির সারনির্যাস মাত্র। তাই প্রশ্ন হল ভারতবিরোধিতার নামে আমার পেট শূন্য থাকবে কেন? এর উত্তর কি কোনো ইসলামী দল দিতে পারবে? ভারত নিয়ে যাবে বলে আমাকে না খেয়ে থাকতে হবে, শোষিত হতে হবে, প্যাদানি খেতে হবে, নির্যাতিত হতে হবে, মুখ বুজে ধর্ষিত হতে হবে, এটা ইসলামের কোন জায়গায় লেখা আছে?
মোটকথা হল, পাকিস্তানে যে সমাজতন্ত্রের জুজু তৈরি হয়েছিল, তার পেছনে পাক-মার্কিনের যোগ-সাজশই ছিল মূল কারণ।
পাকিস্তানের শাসকরা নিজেদের ব্যর্থতাকে-অযোগ্যতাকে ঢেকে রাখার মোক্ষম হাতিয়ার হিসাবে একে চালান করে। হাতে-গোনা বাম-ঘারানার ছেলে-পিলেরা যেন মার্কিন-বিরোধী কোনো জনমত তৈরি করতে না পারে, পাকিস্তানের তরী কোনোভাবেই যেন সোভিয়েত ইউনিয়নের বন্দরে ভিড়বার অবকাশ না পায়, সে-জন্য মার্কিন প্রশাসন নিরলসভাবে কাজ করে। বোধ-বুদ্ধিহীন, অসচেতন-আধা-সচেতন ধর্ম-নেতাগণ নিজের কানে হাত না দিয়েই চিলের পেছনে দৌড়াতে থাকেন, ‘কান নিয়েছে চিলে’ ম্লোগান শুনেই। আর হ্যাঁ, পাকিস্তানের ব্যর্থতার মূল কারণও এখানেই নিহিত। তা ছিল আদ্যান্ত প্রতিক্রিয়াশীলতার এক বিশাল দৈত্যশালা, যেখানে সামান্য একটি ক্রিয়ার সঙ্গে সঙ্গে আগপিছু না ভেবে অসংখ্য প্রতিক্রিয়াশীলতার ঢেউ তৈরি হত।
সৃজনশীলতা নয়, প্রতিক্রিয়াশীলতাই যার অমোঘ নিয়তি, তার পরিণতি যদি নেতিবাচক হয়, তাতে অবাক হওয়ার কিছু থাকে না। কিন্তু অবাক হই, এখনো প্রতিক্রিয়াশীলতাকে ধর্ম ও জ্ঞান হিসাবে প্রচারের চেষ্টা দেখে। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।