বই সংক্ষেপ
প্রতিটি লেখকই তার লেখা দিয়ে সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেন, তবে কেউ কেউ থাকেন, যারা পুরো সাহিত্যকেই তার লেখার আলোড়নে এগিয়ে নিয়ে যান অনেকদূর । অনেক অনেক পথ-নির্দেশনার মধ্যেও তারা মাইলস্টোন, অনেক তারার মাঝে নক্ষত্র । সায়েন্স ফিকশন জগতের এমনি এক নক্ষত্র আইজাক আসিমভ আর সায়েন্স ফিকশনের এই গ্র্যান্ডমাষ্টারের শ্রেষ্ঠতম কীর্তি “ফাউন্ডেশন” ।
দূর ভবিষ্যতের কাহিনী ।
সব গ্রহ মিলে গড়ে উঠেছে “এম্পায়ার”, যার শাসনকেন্দ্র “ট্র্যানটর” নামের গ্রহ ।
সভ্যতার চরম উৎকর্ষে মানুষ । কিন্তু এম্পায়ারের শাসকদের সীমাহীন লোভ আর অদূরদর্শিতার ফলে স্থবির হয়ে পড়েছে এম্পায়ার ।
ট্র্যানটরের বিজ্ঞানী “হ্যারি সেলডন” এ সময় আবিষ্কার করেন সাইকোহিস্ট্রি বা মনো-ইতিহাস, উদ্ভাবন সাইকোলজি থেকে হলেও যা মূলত স্ট্যাটিসটিক্যাল সায়েন্স । সাইকোহিস্ট্রি গাণিতিক ভাবে বিশাল কোন জনগোষ্ঠির ভবিষ্যৎবানী করতে সক্ষম । মানবগোষ্ঠি যত বড় হবে, সাইকোহিস্ট্রি’র গনিতের ফলাফল (ভবিষ্যৎবানী) হবে তত নির্ভুল ।
তবে স্ট্যাটিসটিক্যাল সায়েন্স বলেই, কোন নির্দিষ্ট ব্যাক্তি বা কয়েকজন ব্যাক্তি’র বেলায় কার্যকর নয় এই বিজ্ঞান ।
হ্যারি সেলডন সাইকোহিস্ট্রি’র সাহায্যে ভবিষ্যৎবানী করেন – আর পাঁচশ বছরের মধ্যেই ধ্বংস হয়ে যাবে এম্পায়ার । সব গ্রহ এম্পায়ারের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করবে । এই বিদ্রোহ আর যুদ্ধে ধ্বংস হয়ে যাবে মানবসভ্যতা । মানুষ আবার ফিরে যাবে বিজ্ঞানহীন বর্বর যুগে, যার ব্যাপ্তি হবে ত্রিশ হাজার বছর ।
সেলডনের এই মতবাদ খেপিয়ে দেয় এম্পায়ারের শাসকগোষ্ঠিকে । রাষ্ট্রদ্রোহের মামলায় বিচারের সম্মুখীন করা হয় তাকে । বিচারে প্রশ্নের মুখে দাঁড়িয়ে সেলডন বলেন – তিনি এবং তার প্রজেক্টে কাজ করা বিজ্ঞানীরা ধ্বংস পরবর্তী ত্রিশ হাজার বছরের অন্ধকার যুগকে কমিয়ে এক হাজার বছরে আনতে কাজ করছেন । তারা চান, পৃথিবীর সব জ্ঞানকে একত্রিত করে এন্সাইক্লোপেডিয়া বানাতে এবং সব গ্রহে তার অনুলিপি সংরক্ষন করতে, যাতে অন্ধকার সেই যুগে মানুষ এই এন্সাইক্লোপেডিয়ায় সংরক্ষিত জ্ঞানকে কাজে লাগিয়ে আবার নতুন সভ্যতা গড়ে তুলতে পারে ।
সেলডনের মতো এতো বিখ্যাত একজন বিজ্ঞানীকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার সাহস পায়না শাসকগোষ্ঠি, আবার তাকে ট্র্যানটর-এ রাখাও বিপদজ্জনক ।
তাই সম্রাটের পক্ষ থেকেই তার কাজকে অনুমোদন ও পৃষ্ঠপোষকতা করা হয় এবং কাজের সুবিধার্থে(!) তাকে এবং তার প্রজেক্টে’র লোকদের পাঠানো হয় এম্পায়ার থেকে অনেক দূরে, গ্যালাক্সির অপর প্রান্তে “টার্মিনাস” নামের একটি জনবসতিহীন গ্রহে । মূলত – সেলডনকে দূরে রাখা এবং নির্বাসনে পাঠানোই ছিল তাদের উদ্দেশ্য । ছ’মাসের মধ্যে সেলডন ও তার প্রজেক্টে’র সব বিজ্ঞানীরা চলে যান টার্মিনাসে ।
এদিকে এই প্রোপাগান্ডা, বিচার এবং বিচারের ফলাফল ছিল সেলডনের দীর্ঘ দিনের সাইকোহিস্ট্রি’র চর্চা এবং এম্পায়ারের শাসকদের উপর তার পর্যবেক্ষনের উপর ভিত্তি করে পূর্বানুমিত এবং ক্ষেত্র বিশেষে সেলডনেরই পূর্ব পরিকল্পিত । প্রকৃত পক্ষে তিনিই আলাদা একটি গ্রহে যেতে চাইছিলেন তার প্রজেক্টে’র লোকদের,- তথা সেরা বিজ্ঞানীদের নিয়ে ।
তার আসল লক্ষ্য গ্যালাক্সির সেরা বিজ্ঞানীদের নিয়ে দুটি গ্রহে দুটি “ফাউন্ডেশন” স্থাপন করা, ধ্বংসত্তোর যুগে যাদের নেতৃত্বে গড়ে উঠবে নতুন সভ্যতা এবং প্রতিষ্ঠিত হবে নতুন এম্পায়ার । এর মধ্যে প্রথমটি হবে প্রযুক্তি নির্ভর বিশ্ব, যার অবস্থান টার্মিনাসে । আর দ্বিতীয় ফাউন্ডেশন থাকবে সবার অগোচরে, অজ্ঞাত গ্রহে । প্রথম ফাউন্ডেশনের সাথে সাথে তিনি গোপন এক গ্রহে স্থাপন করেন দ্বিতীয় ফাউন্ডেশন, যার অবস্থান এবং কাজের ব্যপারে, এমনকি প্রথম ফাউন্ডেশন এরও কেউ কিছু জানে না । আর অত্যন্ত সতর্কতার সাথে তিনি নিশ্চিত করেন, সাইকোহিস্ট্রি তো দূরের কথা এমনকি সাইকোলজিতে পন্ডিত কোন বিজ্ঞানী যাতে প্রথম ফাউন্ডেশনে না থাকে ।
মৃত্যুর আগে সেলডন তার কিছু বক্তব্য হলোগ্রাফিক ভিডিওতে রেখে যান, যেগুলো টার্মিনাসের এক কক্ষে রাখা হয় । বলা হয়, নির্দিষ্ট কিছু বিপর্যয়ের সময় ফাউন্ডেশনের জন্ম বার্ষিকীতে খুলে যাবে ভল্ট এবং আবির্ভূত হবে সেলডনের হলোগ্রাফিক ভিডিও, যাতে থাকবে তার বক্তব্য এবং পথ-নির্দেশনা ।
পেরিয়ে যায় পঞ্চাশ বছর ।
মানব সভ্যতার চিরাচরিত নিয়মে আশেপাশের শক্তিশালী গ্রহগুলো দখল করতে চায় ফাউন্ডেশন । কিন্তু রাজনৈতিক প্রজ্ঞাবিহীন বিজ্ঞানীরা এই দখলের বিরূদ্ধে ব্যবস্থা নিতে নারাজ ।
ফাউন্ডেশনের নতুন জেনারেশন, যাদের নেতা মেয়র “স্যালভর হার্ডিন”, ন্যুনতম আত্বরক্ষার জন্য হলেও সামরিক ক্ষমতা অর্জনের পক্ষে । অন্যদিকে এন্সাইক্লোপেডিয়া কমিটির প্রধানের বক্তব্য- তাদের কাজ শুধু “সেলডন প্ল্যান” অনুযায়ী এন্সাইক্লোপেডিয়া বানানো; সামরিক সক্ষমতা অর্জন নয় ।
এমনি বিপর্যয়ের সময়, ফাউন্ডেশন স্থাপনের পঞ্চাশতম বার্ষিকীতে খুলে যায় ভল্ট এবং আবির্ভূত হয় সেলডনের হলোগ্রাফিক ভিডিও । পূর্ব ধারণকৃত এই বার্তায় সেলডন প্রকাশ করেন ভয়ঙ্কর সত্য । তিনি বলেন- ফাউন্ডেশনের লক্ষ্য কখনই এন্সাইক্লোপেডিয়া বানানো নয় বরং এম্পায়ারের শাসকদের এই অজুহাত দেখিয়ে তিনি ব্যবস্থা করেন ট্র্যানটর থেকে অনেক দূরে আলাদা একটি গ্রহের, যেখানে থাকবে তরুণ, উদ্যমী এবং মেধাবী কিছু বিজ্ঞানী ।
এই জনগোষ্ঠী ইম্পেরিয়াল সিভিলাইজেশন থেকে অনেক দূরে থেকে সম্পূর্ণ নিঃসঙ্গ ভাবে বেড়ে উঠবে এবং হাজার বছর পর তারাই গড়ে তুলবে বিজ্ঞান সমৃদ্ধ নতুন সভ্যতা তথা নতুন এম্পায়ার । সেলডন ফাউন্ডেশনের জনগনকে নিজেদের উদ্যোগেই বিপর্যয় থেকে পথ বের নিতে বলেন ।
সেদিনই মেয়র স্যালভর হার্ডিন ক্যু’এর মাধ্যমে এন্সাইক্লোপেডিয়া কমিটির প্রধানের কাছ থেকে দখল করেন ক্ষমতা, এন্সাইক্লোপেডিয়া কমিটিকে করা হয় অবলুপ্ত । জটিল থেকে জটিলতর দিকে মোড় নেয় কাহিনী । ফাউন্ডেশনের জনগন পা রাখে তাদের নতুন ইতিহাসের পথে ।
অস্ত্র নেই, শক্ত অর্থনীতি নেই, তারপরও তাদের মনে দৃঢ় বিশ্বাস – সেলডন প্ল্যান আছে তাদের রক্ষার জন্য । এই সেলডন প্ল্যান আর লুকিয়ে থাকা সেকেন্ড ফাউন্ডেশন রক্ষা করবে তাদের প্রতিটি বিপদে ।
ফাউন্ডেশন কি পারবে আশেপাশের শক্তিশালী গ্রহগুলোর আগ্রাসন থেকে নিজেদের রক্ষা করতে ? কিভাবে তারা পাড়ি দেবে আরও ৯৫০ বছর ? আদৌ কি সেলডন প্ল্যান সঠিক ? সত্যিই কি তারা গড়ে তুলবে নতুন সভ্যতা ? সেকেন্ড ফাউন্ডেশন কোথায় ? তাদের অবস্থান কেউ জানেনা কেন ?
কি নেই এই বইতে ? পড়তে পড়তে পাঠকের মনে হবে, এ যেন পৃথিবী সৃষ্টি থেকে মানব সভ্যতার উম্মেষ, উত্তরণ আর দীর্ঘ পথযাত্রার বর্ণনা’র ক্ষুদ্র সঙ্কলন । ভবিষ্যতের বিজ্ঞান নিয়ে কোন কল্প কাহিনী নয় – আমাদের বর্তমান পৃথিবী আর সমকালীন রাজনীতির কোন কাহিনী । দূর্বলকে সবলের গ্রাস করার আকাঙ্ক্ষা, অর্থনীতির মাধ্যমে সবল হয়ে ওঠা, অজানা জ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি মানুষের ভয় এবং তার ব্যাখ্যার জন্য ধর্মকে টানা, অজ্ঞানতাকে হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করে অনগ্রসর জনগোষ্ঠীকে শাসন, মোল্লাতন্ত্র, স্বৈরাচারী শাসকদের নিজেকে ধর্মীয় অবতার হিসাবে জাহির ও ধর্মকে ব্যবহার করে রাজ্যশাসন ইত্যাদি সব কিছুই যেন মানবসভ্যতার ইতিহাসের কোন না কোন সময়ের কাহিনীকে তুলে ধরে ।
যেকোন সায়েন্স ফিকশন থেকে “ফাউন্ডেশন” সিরিজের পার্থক্য – বেশীর ভাগ সায়েন্স ফিকশন যেখানে মূলত ভবিষ্যতের বিজ্ঞান, চমকপ্রদ প্রযুক্তি নিয়ে আবর্তিত হয়, সেখানে ফাউন্ডেশনের বড় আকর্ষণ তার বলিষ্ঠ প্রেক্ষাপট এবং কাহিনী । বিশাল ক্যানভাস, অনেক চরিত্র, কাহিনীর প্রয়োজনে উপযুক্ত মাত্রায় ভবিষ্যতের প্রযুক্তি’র বর্ণনা, গল্পের অভাবনীয় বাঁক এবং মোড় বইটিকে অতুলনীয় উচ্চতায় নিয়ে গেছে । বরং সায়েন্স এর বাপারগুলো রেখে বেশীর ভাগ সময় মন ডুবে থাকে অনুপম দক্ষতায় বিশ্বাসযোগ্য করে ফুটিয়ে তোলা সমাজনীতি, রাজনীতি, অর্থনীতি এবং সার্বিকভাবে একটি মানব সভ্যতা এগিয়ে যাওয়ার গল্পে । সাথে আসিমভের লেখনীর মাজেজা তো আছেই ।
“ফাউন্ডেশন”, “ফাউন্ডেশন অ্যান্ড এম্পায়ার” এবং “সেকেন্ড ফাউন্ডেশন” নিয়ে ফাউন্ডেশন ট্রীলজী’র মূল বইগুলো ।
১৯৬৬ সালে এই ট্রীলজী “বেষ্ট অল টাইম সায়েন্স ফিকশন সিরিজ” হিসাবে “হুগো অ্যাওয়ার্ড” লাভ করে । এই ট্রীলজী’র পাঠকদের চাপে, তিরিশ বছর পর সিরিজটাকে সম্প্রসারিত করে আরও চারটি বই লেখা হয়- “ফাউন্ডেশন এজ”, “প্রিলিউড টু ফাউন্ডেশন”, “ফরোয়ার্ড দ্য ফাউন্ডেশন” এবং “ফাউন্ডেশন অ্যান্ড আর্থ” ।
বইটি’র অনুবাদ করেছেন জি এইচ হাবীব, প্রকাশিত হয়েছে “সন্দেশ” থেকে । পৃষ্ঠা ১৯১ এবং মূল্য – ২৫০ টাকা । অত্যন্ত বলিষ্ঠ অনুবাদ, নির্ভুল বানান আর প্রাঞ্জল ভাষা আপনাকে বই পড়ার আনন্দকে আরও বাড়িয়ে দেবে।
বইটি কিনতে ক্লিক করুনঃ ঢাকা বুক বাজার
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।