আমৃত্যু সাধারন হয়ে সাধারনের মাঝেই থাকতে চাই।
ছোট বেলায় দেখতাম মা কবিতা লিখতেন। উনার একটা কবিতার খাতা ছিল, টালি খাতার মতন দেখতে, লাল মলাটের। অনেক কবিতা ছিল সেই খাতায়। মা’র কবিতা আবার বিভিন্ন ম্যাগাজিনেও ছাপা হত।
শুনেছি, ‘বেগম’ নামের একটা জার্নাল বের হত মহিলা রাইটারদের জন্য। ওটাতে উনার একটা কি দুইটা কবিতা ছাপা হয়েছিল। তাতে বাবার খুব ঈর্ষা হল। বাবাও ছড়া লিখলেন আমার মায়ের দেখাদেখি-
“এক লোক নাম তার বিল্লাহ,
খেয়ে পরে উঠে যেত কিল্লায়।
একদিন ছোঁ মেরে নিয়ে গেল চিলে,
তাই দেখে সকলের চমকাল পিলে।
”
সেই ছড়া শুনে আমাদের কী হাসি! বাবাও হাসতেন আমাদের সাথে সাথে। হাসতেন আর বলতেন, ‘তোর মা কবিতা লিখে ঠিকই কিন্তু পড়ে না। আমি কিন্তু কবিতা পড়ি। ’
আমরা বলতাম, ‘আপনি কি কবিতা পড়েন, শোনান তো?’
যত বারই জিজ্ঞেস করতাম উনি দুইটা লাইনই বলতেন-
“চাঁদের নিচে ইঁদুর মরা হেমন্ত প্রান্তর,
আমি ব্যর্থ পয়গম্বর। ”
আমরা যদি জিজ্ঞেস করতাম এটা কার লিখা, উনি বলতে পারতেন না।
প্রতিবারই উত্তরটা মা-ই দিতেন, ‘শামস-ই-তাবরীযি’। আমরা আবারো হাসতাম, বাবাও।
আমি যখন ক্লাস ফোর এ পড়ি, তখন বাবা আমাকে একটা নীল মলাটের ডায়েরি দিয়েছিলেন। আমি সেই ডায়েরিতে যা ইচ্ছা হত লিখতাম। ছেলেবেলায় অনেকগুলো জীবনের লক্ষ্য ছিল।
যেমন-আইসক্রীম বিক্রেতা হব, লেইস-ফিতা ফেরী করব, গান শিখে বিরাট গায়িকা হব, অভিনেত্রী হব, পুলিশ হব, পকেটমার হব, মজার খানাওয়ালা হব(শনপাপড়ি নামের যে খাবারটা আছে ওটাকে আমরা বলতাম মজার খানা)-চার পাশের জগতে দেখা যা আমার ভাল লাগত, যা আমাকে আকর্ষণ করত, তাই আমার জীবনের লক্ষ্য হয়ে যেত। আহা! কত সহজ ছিল সব কিছু। বাবার কাছ থেকে ডায়েরী পেয়ে এই প্রথম মনে হল, আমি কবি হব। হাবিজাবি লিখে ভর্তি করে ফেলেছিলাম ডায়েরিটা। শুধু ডায়েরি না, বইয়ের প্রথম কিংবা শেষ পৃষ্ঠায়ও লিখতাম।
আব্দুল্লাহ-আল-মুতীর ‘আকাশ অনেক বড়’ বইটার পেছনের পৃষ্ঠায় কী জানি কি মনে করে আমি লিখলাম(বইটা এখনো আছে)-
“স্মৃতি তুমি বেদনার নীল,
তুমি গ্রহ-নক্ষত্রের মাঝে গেলে হারিয়ে।
তোমার আকাশ অনেক বড়,
শীঘ্রই এসো বেরিয়ে।
সেই আকাশ ফেলে মনের আঙিনায়,
ধরা দাও আত্ম-ক্যাম্পাসে। ”
সেই হাবিজাবি লিখা পড়ে আমার খালাত ভাই আপেল মাহমুদ আমাকে এমন নাজেহাল করল। লিখাটা ধরে ধরে মুরুব্বিদের সবাইকে দেখাল।
আর আমাকে সামনে পেলেই হাত নেড়ে মুখ ভেংচে বলত, ‘স্মৃতি তুমি ধরা দাও পাঞ্জাবীর পকেটে। ’ (একদা আমার ডাক নাম পাঞ্জেরী ছিল। সেটাকে বিকৃত করেই পাঞ্জাবী। ) সে বছর(২০০১ সাল হবে। ক্লাস সেভেনে ছিলাম)ডিসেম্বর মাসে একটা আঞ্চলিক ম্যাগাজিনে আমার একটা কবিতা ছাপা হল।
কবিতার নাম- হে স্বাধীনতা।
প্রথম কয়েকটা লাইন এরকম-
“হে স্বাধীনতা!
তুমি হৃদয়ের আঙ্গিনায় ছড়িয়ে থাকা
কবিতার ফুলঝুরি মালা।
ভাসা চোখের গভীর দৃষ্টিতে আঁকো
স্নিগ্ধ ভালবাসা।
হে স্বাধীনতা!
তোমায় নিয়ে ছন্দের পর ছন্দ সাজানোর
তাইতো এত আকুলতা। ...”
ছাপার অক্ষরে নিজের নাম দেখে যে কী আনন্দ হল! শুধু যে ছাপা হল তাই নয়, ওরা পুরস্কারও দিল।
প্রথম পুরস্কার পেলাম আমি। আপেল মাহমুদ মনে হয় খুব হিংসিত হল। কারন- এরপর থেকে আমাকে দেখলেই কারনে-অকারনে আমার কান মলে দিত, নয়তো মাথায় গাট্টা মেরে চলে যেত। বন্ধুরা প্রশংসা করল, এর-তার কাছে বলে বেড়াল। বাংলা ব্যাকরন পড়াতেন মান্নান স্যার।
তিনি মনে করলেন আমি বুঝি বাংলা সাহিত্যে পড়লে ভাল করব। তাই সেই অনুযায়ী উপদেশও দিয়ে ফেললেন।
তারপর অনেক সময় পেরিয়ে গেছে। আমার মা এখন কবিতা লিখেন না। তার সেই টালি খাতার মত দেখতে লাল মলাটের কবিতার খাতাটাও আর নেই।
বাবাকে হারিয়েছি তিন বছর হল। হারিয়ে ফেলেছি সেই নীল ডায়েরিটাও। মান্নান স্যারকে হারিয়েছি। বাংলা সাহিত্যে পড়া হয় নি আমার। আর কবিতা লিখার সাহস সেদিনই হারিয়ে ফেলেছি যেদিন হেলাল হাফিজের ‘যে জলে আগুন জ্বলে’ পড়েছি।
কিন্তু স্মৃতিগুলো রয়ে গেছে-যেন এইতো সেদিনের ঘটনা।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।