আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

বিদায় নেলসন ম্যান্ডেলা, স্যালুট নেলসন ম্যান্ডেলা

মুক্তিযুদ্ধের সেই উত্তাল দিনুলোতে, অজস্র তরুণ কি অসম সাহসিকতা নিয়ে দেশমাতৃকাকে রক্ষা করেছিল!

বিদায় নেলসন ম্যান্ডেলা, স্যালুট নেলসন ম্যান্ডেলা --------------------------------------- ডঃ রমিত আজাদ নেলসন ম্যান্ডেলা নামটির সাথে পরিচয় সেই ছোটবেলা থেকেই। এই নামের পাশাপাশি আরেকটা কথা শিখেছি - বর্ণবাদ। কি এই বর্ণবাদ? ইংরেজীতে এবং পৃথিবীর অনেক ভাষায়ই একে বলে Racism, বাংলায় আমরা বলি বর্ণবাদ। বাংলা শব্দটি হয়তো একটু বেশী এ্যাপ্রোপিয়েট হবে। কারণ বিষয়টি সরাসরি বর্ণ বা রঙের সাথে জড়িত।

বাংলাদেশের মানুষ হিসাবে বর্ণ শব্দটির সাথে আমরা আরো একটু বেশি পরিচিত কারণ অত্র অঞ্চলে উদ্ভুত ও প্রচলিত হিন্দু ধর্মেও বর্ণ বলে একটি কনসেপ্ট ও সংস্কার রয়েছে। এটা হিন্দু ধর্মের ধর্মীয় রীতি। এখানে একজন ব্যক্তির সামাজিক অবস্থান উঁচু না নিচু তা মেধার ভিত্তিতে হয়না, হয় জন্মসূত্রে। ইতিহাসবিদরা মনে করেন যে, অত্র অঞ্চলে একসময় এক জাতি বসবাস করতেন তাদের গাত্রবর্ণ ছিলো কৃষ্ণবর্ণ। এরা দ্রাবিড় জাতির অন্তর্ভুক্ত।

এই জাতিটিই বিশাল সিন্ধু সভ্যতার জনক ছিলো। পরবর্তিতে বহিরাগত আর্যরা সসস্ত্র হামলা চালিয়ে বাহুবলে এই অঞ্চল দখল করে নেয়। আর্য শব্দটি এসেছে 'অরি' থেকে যার অর্থ বিদেশী। অর্থাৎ বিদেশী একটি জাতি বাহুবলে এই অঞ্চল দখল করে নেয়। এরপর তারাই এখানে বর্ণভেদ প্রথা চালু করে।

এই বিদেশী আর্যরা বসবাস করতো মধ্য এশিয়ার কৃষ্ণসাগর তীরবর্তি অঞ্চলে। তাদের গায়ের রঙ ছিলো সাদা। এই বিজয়ী শেতাঙ্গরা বর্ণভেদ প্রথায় নিজেদের বানায় উচ্চবর্ণ (ব্রাহ্মণ - যাদের কাজ শিক্ষা দান, পুজা পাঠ ইত্যাদি, ক্ষত্রীয় - যাদের কাজ শাসন কার্য পরিচালনা করা ও যুদ্ধ করা) আর স্থানীয় কৃষ্ণগাত্র জনগণকে (যেহেতু তারা পরাজিত ছিলো) বানায় নিম্নবর্ণ। কেবলমাত্র গায়ের রঙই নির্ধারণ করে দিচ্ছে কে শাসক আর কে শাসিত। ইংরেজী Racism শব্দটি Race-এর সাথে জড়িত।

মানবজাতি কয়েকটি Race-এ বিভক্ত (Caucasoid, Mongoloid, Nigroid ও Australoid) এটা বৈজ্ঞানিক গবেষণায় যেমন পাওয়া যায়, তেমন চোখের দেখায়ও বোঝা যায়। এই চারটি রেইসের দৈহিক গড়ন ও গাত্রবর্ণ ভিন্ন ভিন্ন। এই বৈচিত্রে আদৌ কোন সমস্যা নাই। কিন্তু এক শ্রেণীর মানুষ আছে যারা মনে করে যে, রেস অনুযায়ী সুপিরিয়রিটি ও ইনফেরিয়রিটি-র রাঙ্ক আরোপ করা যায়। বর্ণবাদ হল একজাতি অন্য জাতি অপেক্ষা উৎকৃষ্ট বা তার উপর কর্তৃত্ব করার অধিকারী এমন ধারণা বা বিশ্বাস এবং এমন ধারণার ফলে অন্য জাতির প্রতি বৈষম্যমূলক আচরণ।

বিষয়টি প্রকট হয়ে ওঠে ইউরোপে প্রোটেস্টান্ট ধর্মের উদ্ভবের পর। প্রোটেস্টান্ট ধর্মের প্রসার ঘটে জার্মানী, হল্যান্ড ও ইংল্যান্ডে এবং পরবর্তিতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে (এখানকার শাসকশ্রেণীর পূর্বপুরুষরা মূলতঃ হল্যান্ড ও ইংল্যান্ডে-এর)। গাত্রবর্ণের বিচারে এরা শেতাঙ্গ। এই প্রোটেস্টান্ট শেতাঙ্গরা পিউরিটানিজমে বিশ্বাসী। তারা মনে করে যে, কেবল শেতাঙ্গরাই পিওর অন্য কথায় সুপিরিয়র।

মূলতঃ এই দর্শন থেকেই রেসিজমের উদ্ভব। মার্কিনী শেতাঙ্গরা একসময় তাদের বাগিচায় কাজ করার জন্যে আফ্রিকায় পাঠিয়ে দিতো মানুষ ধরার দল, তারা সেখান থেকে কৃষ্ণাঙ্গদের ধরে নিয়ে আসতো। মার্কিন মুলুকে পা রাখার পর প্রকৃতির বুকে মুক্ত বিচরণ করা এই কালো মানুষগুলো হয়ে যেত শৃঙ্খলিত ক্রীতদাস। এই রীতি চলে কয়েকশো বছর। শেতাঙ্গদের পাশবিক শক্তির কাছে হার মানতে বাধ্য হয়েছিলো কৃষ্ণাঙ্গরা।

পরাজিত হয়েছিলো সাম্য ও মানবতা, জয়ী হয়েছিলো বর্ণবাদ। কেবল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রই নয় প্রোটেস্টান্ট শাসিত পৃথিবীর অনেক দেশেই বর্ণবাদ ও স্লেভারী ছিলো নরমাল প্র্যাকটিস। ১৬৫২ সালে ওলন্দাজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দক্ষিণ আফ্রিকায় কেপ টাউন শহর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে কেপ কলোনি স্থাপন করেছিল। ১৭৯৫ সালে ব্রিটিশরা কেপ কলোনি দখল করে নেয়। ব্রিটিশরা মূলত দীর্ঘ সমুদ্রযাত্রার বিরতির জন্য বিশ্রাম ও দাস ব্যবসার উদ্দেশ্যে এ এলাকা দখল করে এবং স্থায়ীভাবে বসতিতে উৎসাহ পায়।

কেপ কলোনিতে বুয়ররাও থাকত। বুয়র শব্দটা ডাচ -এর মানে চাষি। তারা কথা বলত আফ্রিকানা ভাষায়- ডাচ ও জার্মানিক ভাষা মিলে আফ্রিকানা ভাষা টি তৈরি হয়েছিল। পরে তারা কেপ কলোনি থেকে ব্রিটিশদের চাপে চলে যায় ও দক্ষিণ আফ্রিকার উত্তরাঞ্চলে একটি বুয়র রিপাবলিক গড়ে তোলার চেষ্টা করে। ১৮৬৭ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার খনিতে হীরে ও ১৮৮৪ সালে স্বর্ণ পাওয়া যায়।

এসব মূল্যবান সম্পদের সন্ধানে বহিরাগত বাড়তে থাকে। এর কিছুকাল পরে দক্ষিণ আফ্রিকার কৃষ্ণাঙ্গ আদিবাসী, ব্রিটিশ শাসকশ্রেনি ও ডাচ-বুয়র দের মধ্যে ত্রিমূখি লড়াই আরম্ভ হয়। ফলশ্রুতিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল গঠিত হয় (যেমন, সাদাদের "ন্যাশনাল পার্টি", কালোদের আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস। ১৯৪৮ সালের নির্বাচনে সাদাদের ন্যাশনাল পার্টি জয়ী হয়। তারপর থেকে শ্বেতকায় শাসকশ্রেনি নিয়ন্ত্রন করতে থাকে অশেতাঙ্গদের।

এর ফলে যে নীতি নিতে হয়-তাই "আপার্টহাইট" বা বর্ণবৈষম্য নীতি। সমগ্র দক্ষিণ আফ্রিকাকে সাদা, কালো, বর্ণময় বা কালারড ও ইন্ডিয়ান-এই চার ভাগে ভাগ করে ফেলা হল। তবে যেকোন অন্যায় অবিচারেরই একটি শেষ রয়েছে। বিশাল রোম সাম্রাজ্যেরও পতন হয়েছিলো। সেই সংগ্রামের একটি উজ্জ্বল নাম স্পার্টাকাস।

তেমনি বর্ণবাদের বিরুদ্ধেও মানুষ সোচ্চার হয়ে ওঠে দক্ষিণ আফ্রিকায় সেই সংগ্রামের একটি উজ্জ্বল নাম নেলসন ম্যান্ডেলা। সংক্ষিপ্ত জীবনী : নেলসন রোলিহ্লাহ্লা ম্যান্ডেলা ১৮ জুলাই ১৯১৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার থেম্বু রাজবংশে জন্মগ্রহণ করেন। ম্যান্ডেলার পিতা মপাকানইসার ছিল চারজন স্ত্রী ও সর্বমোট ১৩টি সন্তান(৪ পুত্র, ৯ কন্যা)। ম্যান্ডেলার মা মপাকানইসার ৩য় স্ত্রী নোসেকেনি ফ্যানি। তাঁর ডাক নাম ‘‘ রোলিহ্লাহ্লা’’ অর্থ হলো ‘‘ গাছের ডাল ভাঙে যে’’ অর্থাৎ দুষ্ট ছেলে।

ম্যান্ডেলা তাঁর পরিবারের প্রথম সদস্য যিনি স্কুলে পড়াশোনা করেছেন। স্কুলে পড়ার সময়ে তাঁর শিক্ষিকা মদিঙ্গানে তাঁর ইংরেজি নাম রাখেন ‘‘নেলসন’’। দক্ষিণ আফ্রিকায় ম্যান্ডেলা তাঁর গোত্রের দেয়া ‘‘মাদিবা’’ নামে পরিচিত। শৈশব কাটে নানার বাড়িতে। স্কুল থেকে পাস করার পর ম্যান্ডেলা ফোর্ট হেয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যাচেলর অফ আর্টস কোর্সে ভর্তি হন।

এখানেই অলিভার টাম্বোর সাথে তার পরিচয় হয়। টাম্বো ছিল ম্যান্ডেলার ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অন্য বন্ধু ট্রান্সকেই এর সিংহাসনের উত্তরাধিকারী কাইজার (কে ডি) মাটানজিমা। যার হাত ধরে বান্টুস্থানের রাজনীতি ও নীতিনির্ধারণের সাথে জড়িত হন তিনি। পরবর্তীতে এসব নীতিমালার ক্ষেত্রে দুজনে মতবিরোধ হয়।

বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম বর্ষের শেষে ম্যান্ডেলা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে ছাত্র সংসদের ডাকা আন্দোলনে জড়িত হয়ে পড়েন। এর জন্য তাকে ফোর্ট হেয়ার থেকে চলে যেতে বলা হয়। ম্যান্ডেলা ফোর্ট হেয়ার ছাড়ার পর জানতে পারেন, জোঙ্গিন্তাবা তাঁর সন্তান জাস্টিস (যুবরাজ ও সিংহাসনের উত্তরাধিকারী) এবং ম্যান্ডেলার বিয়ে ঠিক করার ঘোষণা দিয়েছেন। বিয়ে করতে রাজি না থাকায় তারা জোহানেসবার্গে চলে যান। সেখানে একটি খনিতে প্রহরী হিসাবে কাজ নেন ম্যান্ডেলা।

বিয়ে এড়াতে জোঙ্গিন্তাবার থেকে পালিয়ে আসার বিষয়টা খনির মালিক কিছুদিন পরেই জেনে যান। এ কারণে তাকে কাজ থেকে ছাঁটাই করে দেয়া হয়। পরবর্তীকালে জোহানেসবার্গের আইনী প্রতিষ্ঠান উইটকিন, সিডেলস্কি অ্যান্ড এডেলম্যানে কেরানি হিসাবে যোগ দেন। এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সময়ে ম্যান্ডেলা ইউনিভার্সিটি অফ সাউথ আফ্রিকার দূরশিক্ষণ কার্যক্রমের অধীনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। পরে ইউনিভার্সিটি অফ উইটওয়াটার্সরান্ডে আইন বিষয়ে স্নাতকোত্তর পড়াশোনা শুরু করেন।

এসময় তিনি জোহানেসবার্গের উত্তর দিকের শহর আলেক্সান্ড্রিয়াতে বাস করতেন দক্ষিণ আফ্রিকায় ১৯৪৮ এর নির্বাচনে বর্ণবাদে বিশ্বাসী ও বিভিন্ন জাতিকে আলাদা করার পক্ষপাতি থাকা আফ্রিকানারদের দল ন্যাশনাল পার্টি জয়লাভ করে। ন্যাশনাল পার্টির ক্ষমতায় আসার প্রেক্ষপটে ম্যান্ডেলা সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। তিনি আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের ১৯৫২ সালের অসহযোগ আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। ১৯৫৫ সালে জনগণের সম্মেলনেও তার ভূমিকা ছিল গুরুত্বপূর্ণ। এ সম্মেলনে দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদ বিরোধী আন্দোলনের মূল ভিত্তি হিসাবে মুক্তি সনদ প্রণয়ন করেন তিনি।

ম্যান্ডেলা প্রথম থেকেই অহিংস আন্দোলনের পক্ষপাতী ছিলেন। কিন্তু দক্ষিণ আফ্রিকার বর্ণবাদী শ্বেতাঙ্গ সরকার ১৯৫৬ সালের ৫ই ডিসেম্বর ম্যান্ডেলা সহ ১৫০ জন বর্ণবাদ বিরোধীকর্মীকে দেশদ্রোহিতার মামলায় গ্রেপ্তার করে। সুদীর্ঘ ৫ বছর (১৯৫৬-১৯৬১) ধরে মামলা চললেও পরে সব আসামী নির্দোষ প্রামণিত হয়। ১৯৬১ সালে এএনসির সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন ‘উমখোন্তো উই সিযওয়ে’ (অর্থাৎ ‘‘দেশের বল্লম’’) এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে নেতৃত্ব গ্রহণ করেন ম্যান্ডেলা। তিনি বর্ণবাদী সরকার ও তার সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে অন্তর্ঘাতী ও চোরাগোপ্তা হামলা পরিকল্পনা ও সমন্বয় করেন।

এতে বর্ণবাদী সরকার পিছু না হটলে প্রয়োজনবোধে গেরিলা যুদ্ধে যাবার জন্যও পরিকল্পনা করেন। ম্যান্ডেলার সহকর্মী উলফি কাদেশ ম্যান্ডেলার নেতৃত্বে শুরু করেন সশস্ত্র আন্দোলন। ম্যান্ডেলা নিজে তাঁর এই সশস্ত্র আন্দোলনকে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে নিতান্তই শেষ চেষ্টা বলে অভিহিত করেন। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের দীর্ঘদিন ধরে চলতে থাকা নিপীড়ন ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে অহিংস আন্দোলন সফল হবে না বলে তিনি উপলব্ধি করেন এবং এ জন্যই সশস্ত্র আন্দোলনের পথ বেছে নেন। ১৯৬২ সালের ৫ই আগষ্ট ম্যান্ডেলাকে গ্রেপ্তার করা হয়।

তাঁকে জোহানেসবার্গের দূর্গে আটক রাখা হয়। ১৯৬১ সালে শ্রমিক ধর্মঘটে নেতৃত্ব দেয়া এবং বেআইনীভাবে দেশের বাইরে যাবার অভিযোগে তাঁকে অভিযুক্ত করা হয়। ১৯৬২ সালের ২৫ শে অক্টোবর ম্যান্ডেলাকে এই দুই অভিযোগে ৫ বছরের কারাদন্ড দেয়া হয়। এর দুই বছর পর ১৯৬৪ সালের ১১ ই জুন ম্যান্ডেলার বিরুদ্ধে এএনসির সশস্ত্র সংগ্রামে নেতৃত্বদানের অভিযোগ আনা হয় ও শাস্তি দেয়া হয়। ম্যান্ডেলার কারাবাস শুরু হয় রবেন দ্বীপের কারাগারে।

এখানে তিনি তাঁর ২৭ বছরের কারাবাসের প্রথম ১৮ বছর কাটান। সশ্রম কারাদণ্ডের অংশ হিসাবে রবেন দ্বীপের কারাগারে ম্যান্ডেলা একটি চুনাপাথরের খনিতে শ্রমিক হিসাবে কাজ করতে বাধ্য হন। কারাগারে থাকার সময়ে ম্যান্ডেলা লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের দূরশিক্ষণ কর্মসূচীর আওতায় পড়াশোনা শুরু করেন এবং আইনে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৬৪ সালের ২০ শে এপ্রিল প্রিটোরিয়াল সুপ্রিম কোর্টে আসামীর কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে ম্যান্ডেলা তাঁর জবানবন্দিতে ব্যাখ্যা করেন কেনো এএনসি সশস্ত্র আন্দোলন বেছে নিয়েছে। ম্যান্ডেলা বলেন যে, ‘‘বহু বছর ধরে এএনসি অহিংস আন্দোলন চালিয়ে এসেছিলো।

কিন্তু শার্পভিলেন গণহত্যার পর তাঁরা অহিংস আন্দোলনের পথ ত্যাগ করতে বাধ্য হন। এই গণহত্যা, কৃষ্ণাঙ্গদের অধিকারকে অবজ্ঞা করে দক্ষিণ আফ্রিকা প্রজাতন্ত্র ঘোষণা দেয়া, জরুরি অবস্থার ঘোষণা এবং এএনসিকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পরে ম্যান্ডেলা ও তাঁর সহযোদ্ধারা অন্তর্ঘাতমূলক সশস্ত্র সংগ্রামকেই বেছে নেন। তাঁদের মতে সশস্ত্র আন্দোলন ছাড়া অন্য কোনো কিছুই হতো বিনাশর্তে আত্মসমর্পণের নামান্তর। ’’ ১৯৮০র দশকে এমকে বর্ণবাদী সরকারের বিরুদ্ধে গেরিলা যুদ্ধ শুরু করে। এতে অনেক বেসামরিক লোক হতাহত হন।

ম্যান্ডেলা স্বীকার করেন, বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম চালাতে গিয়ে এএনসি অনেক সময় মানবাধিকার লংঘন করেছে। পরবর্তীকালে ১৯৮১ সালে তাঁকে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর নির্বাচনে প্রার্থী হিসাবে মনোনয়ন দেয়া হয়। কিন্তু তিনি প্রিন্সেস অ্যানের কাছে সেই নির্বাচনে হেরে যান। ১৯৮২ সালের মার্চ মাসে ম্যান্ডেলাকে রবেন দ্বীপের কারাগার থেকে পোলসমুর কারাগারে স্থানান্তর করা হয়। ১৯৮৫ সালের ফেব্র“য়ারিতে দক্ষিণ আফ্রিকার তদানিন্তন রাষ্ট্রপতি পি ডব্লিউ বোথা ম্যান্ডেলাকে শর্তসাপেক্ষে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব দেন।

শর্তটি ছিলো, ম্যান্ডেলাকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে সশস্ত্র সংগ্রাম ত্যাগ করতে হবে। ম্যান্ডেলা এই প্রস্তাব প্রত্যাখান করেন। তাঁর মেয়ে জিন্দজির মাধ্যমে একটি বিবৃতি দেন। যাতে তিনি বলেন, ‘‘ আমাকে মুক্ত করার জন্য দেয়া এ কেমনতরো প্রস্তাব, যেখানে জনগণের সংগঠনটিকে নিষিদ্ধ করে রাখা হচ্ছে? কেবল মুক্ত মানুষই আলোচনায় বসতে পারে। বন্দীরা কখনো চুক্তি স্বাক্ষর করতে পারে না।

ম্যান্ডেলা ও ন্যাশনাল পার্টি সরকারের মধ্যকার প্রথম আলোচনাটি অনুষ্ঠিত হয় ১৯৮৫ সালের ডিসেম্বর মাসে। কোবি কোয়েটসি ম্যান্ডেলার সাথে কেপ টাউনের ভোক্স হাসপাতালে দেখা করেন। ম্যান্ডেলা তখন প্রস্টেট গ্রন্থিও শল্য চিকিৎসা শেষে আরোগ্য লাভ করছিলেন। পরের চার বছর ধরে ম্যান্ডেলার সাথে সরকার একাধিকবার আলোচনায় বসে। কিন্তু এসব আলোচনায় বিশেষ কিছু অগ্রগতি হয়নি।

১৯৮৮ সালে ম্যান্ডেলাকে ভিক্টর ভার্সটার কারাগারে সরিয়ে নেয়া হয়। মুক্তির আগ পর্যন্ত সেখানেই বন্দী ছিলেন তিনি। ১৯৮৯ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি বোথা হৃদরোগে আক্রান্ত হন এবং পদ থেকে সরে দাঁড়ান। তাঁর স্থলাভিষিক্ত হন ফ্রেডেরিক উইলেম ডি ক্লার্ক। রাজনৈতিক এই পটপরিবর্তনের পরেই ডি ক্লার্ক ১৯৯০ সালের ফেব্র“য়ারি মাসে ম্যান্ডেলাকে মুক্তি দেয়ার কথা ঘোষণা করেন।

১৯৯০ সালের ২রা ফেব্র“য়ারি দক্ষিণ আফ্রিকার তদানিন্তন রাষ্ট্রপতি এফ ডব্লিউ ক্লার্ক আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেস সহ অন্যান্য বর্ণবাদ বিরোধী সংগঠনের উপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুনে নেন। একই সাথে তিনি ঘোষণা দেন, ম্যান্ডেলাকে অচিরেই মুক্তি দেয়া হবে। ভিক্টর ভার্সটার কারাগার থেকে ম্যান্ডেলাকে ১৯৯০ সালের ১১ই ফেব্র“য়ারি মুক্তি দেয়া হয়। মুক্তির দিনে ম্যান্ডেলা জাতির উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন, ‘‘ ১৯৬০ সালে আমরা সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করতে বাধ্য হই। বর্ণবাদের হিংস্রতার হাত থেকে আত্মরক্ষার খাতিরেই আমরা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের সশস্ত্র অঙ্গসংগঠন উমখান্তো উই সিযওয়ে গঠন করেছিলাম।

সশস্ত্র সংগ্রাম শুরু করার পেছনের কারণগুলো এখনো রয়ে গেছে। তাই এ সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো পথ নেই। আমরা আশা করি, শান্তি আলোচনার জন্য উপযুক্ত পরিবেশ অচিরেই সৃষ্টি হবে এবং আমাদের আর সশস্ত্র সংগ্রাম চালিয়ে যাবার দরকার থাকবে না। সংখ্যাগুরু কৃষ্ণাঙ্গদের জন্য শান্তি নিয়ে আসা, আর স্থানীয় ও জাতীয় নির্বাচনে কৃষ্ণাঙ্গদের ভোটাধিকার সুনিশ্চিত করাই আমাদের মূল লক্ষ্য। ’’ কারা মুক্তির পর ম্যান্ডেলা আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতৃত্ব গ্রহণ করেন।

১৯৯০ হতে ১৯৯৪ পর্যন্ত তিনি এই দলের নেতা ছিলেন। ১৯৯৩ সালের এপ্রিল মাসে আফ্রিকান ন্যাশনাল কংগ্রেসের নেতা ক্রিস হানিকে হত্যা করা হয়। এই হত্যাকণ্ডের ফলে সারা দেশে সহিংসতা ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দেয়। সেসময় দক্ষিণ আফ্রিকার রাষ্ট্রপতি না থাকা সত্বেও ম্যান্ডেলা রাষ্ট্রপতি সুলভ ভাষণ দেন। ম্যান্ডেলা এসময় জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া এক ভাষণে শান্তি বজায় রাখার অনুরোধ জানান।

দেশের কিছু অংশে দাঙ্গা হলেও মোটের উপর শান্তি বজায় থাকে তার আহ্বানে। এই সময় তিনি দক্ষিণ আফ্রিকায় বর্ণবাদ অবসানের লক্ষ্যে সরকারের সাথে আলোচনায় বসেন। এই শান্তি আলোচনা ফলপ্রসূ হবার পর ১৯৯৪ সালে দেশের ইতিহাসে প্রথমবারের মতো সব বর্ণের মানুষের অংশগ্রহণে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। গণতান্ত্রিকভাবে প্রথম রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হন ম্যান্ডেলা। তিনি ১৯৯৪ হতে ১৯৯৯ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতির দায়িত্ব পালন করেন।

২০০৪ সালে জনজীবন থেকে অবসর নিয়েছেন ম্যান্ডেলা। ২০০৫ সালে যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষস্থানীয় ম্যাগাজিন রিডার্স ডাইজেস্টকে একান্ত সাক্ষাৎকার বলেছেন , ” আমি কোনো দেবতা হিসেবে উপস্থাপিত হতে চাই না। একজন সাধারণ মানুষ হিসেবেই স্মরণীয় হয়ে থাকতে চাই, যার ভালো-মন্দ দুই-ই আছে। ” ২০০৮ এর জুলাই পর্যন্ত ম্যান্ডেলা ও এএনসি কর্মীদের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা ছিল। শুধু মাত্র নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘের সদরদপ্তরে তাঁদের আসার অনুমতি ছিলো।

এর কারণ ছিলো ম্যান্ডেলার ষাটের দশকের সশস্ত্র আন্দোলনে দক্ষিণ আফ্রিকার তদানিন্তন সরকার ম্যান্ডেলা ও এএনসিকে সন্ত্রাসবাদী হিসাবে ঘোষণা করেছিল। ২০০৮ এর জুলাইতে এসেই ম্যান্ডেলাকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সরকারে প্রণীত সন্ত্রাসবাদীদের তালিকা হতে সরিয়ে নেয়া হয়। দক্ষিণ আফ্রিকার সরকারের সাথে শান্তি আলোচনায় অবদান রাখার জন্য ম্যান্ডেলা এবং রাষ্ট্রপতি এফ ডব্লিউ ডি ক্লার্ককে ১৯৯৩ সালের নোবেল শান্তি পুরস্কার দেয়া হয়। গত চার দশকে ম্যান্ডলো ২৫০টিরও অধিক পুরস্কার পেয়েছেন। তাছাড়াও তিনি ১৯৮৮ সালে শাখারভ পুরস্কারের অভিষেকে পুরস্কারটি যৌথভাবে অর্জন করেন।

ব্যক্তিগত জীবনে ম্যান্ডেলা ৩ বার বিয়ে করেন। তাঁর ৬টি সন্তান, ২০জন নাতি-নাতনি এবং অনেক প্রপৌত্র রয়েছে। থেম্বুর উপজাতীয় নেতা মান্দলা ম্যান্ডেলা হলেন নেলসন ম্যান্ডেলার নাতি। বর্ণবাদবিরোধী আন্দোলনের অবিসংবাদিত নেতা নেলসন ম্যান্ডেলা আর নেই। স্থানীয় সময় গত বৃহস্পতিবার রাতে দেশটির প্রেসিডেন্ট জ্যাকব জুমা রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে ম্যান্ডেলার পরলোকগমনের খবর ঘোষণা করেন।

৯৫ বছর বয়সী ম্যান্ডেলা জোহানেসবার্গের হাউটন শহরতলিতে নিজ বাড়িতে বিশেষ ব্যবস্থায় নিবিড় চিকিত্সার অধীনে ছিলেন। ফুসফুসে সংক্রমণজনিত অসুস্থতার কারণে প্রিটোরিয়ার মেডিক্লিনিক হাসপাতালে প্রায় তিন মাস চিকিত্সা নেওয়ার পর গত ১ সেপ্টেম্বর বাড়িতে ফেরেন তিনি। সেখানেই তিনি শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন। মানুষের অধিকার আদায়ের আন্দোলনে চিরসংগ্রামী এই মহান নেতার প্রয়ানে শোক প্রকাশ করছি, পাশাপাশি তার সংগ্রামী জীবনের প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শন করে তাকে জানাই সশ্রদ্ধ স্যালুট। (তথ্যসূত্রঃ ইন্টারনেটে প্রাপ্ত বিভিন্ন আর্টিকেল ও কিছু বই।

আমি তাদের লেখকদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি। )

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.