আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মার্ক্সীয় দর্শনের প্রতি আমাদের ঘৃণাঃ জাতিগত লুম্পেন চরিত্রের এক অসামান্য এক্সহিবিশন

আমি এমন এক সাধারন মানুষ হতে চাই যে অসাধারন হবার পেছনে দৌঁড়ায়না এবং বিনা প্রশ্নে কিছু গ্রহন করেনা ।

দিনের শেষে মানুষকে তার চিন্তা দিয়েই ( যদিও বিষয়টি ব্যক্তির পারিপার্শ্বিকতা , ব্যক্তির শ্রেণী অবস্থান এইসব উপাদানের বৈচিত্র্যতার কারণে তর্কসাপেক্ষ ) বিশ্লেষণ করতে হয় । তার অজস্র ভুল-ত্রুটি থাকা সত্ত্বেও তার জীবনে আত্মত্যাগের অংশটি যদি নির্ধারক হয়ে থাকে তবে তা উল্লেখ করেই তার সমালোচনা করতে হয় । নয়তো সেই সমালোচনায় শিক্ষনীয় কিছু খুঁজে পাওয়া যায়না । তা কেবল বিষোদগারের ঘেরাটোপে দমবন্ধ হয়ে মৃত্যুবরণ করে ।

আমাদের সমাজে শৈশব থেকেই নানাবিধ বিভাজন দেখাতে দেখাতে এবং পরিবার , সমাজ হতেই সেসব বিভাজনকে স্বযত্নে লালন করার শিক্ষা দেওয়া হয় । তুমি মুসলমান ও হিন্দু , তুমি ক্লাসের ফার্স্ট বয় ও প্লেইন এন্ড সিম্পলী ব্যাকবেঞ্চার ডাফার , তুমি বড় হয়েছো আরবান শহরে সে হয়েছে এতিমখানায় । সমাজের প্রতিটি পরতে এই বিভাজনের জয়গান গাওয়া হয় , তাকে প্রোমোট করা হয় । এই নিদারুণ বাস্তবকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য সামাজিকতার নামে দ্বিধাহীনভাবে মিথ্যাচার করা হয় । এই ধরণের বিভাজনের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া হয়েছে কিংবা আমরা এই বিভাজনের বিরুদ্ধে এই প্রমাণে আমাদের প্রচেষ্টার অথবা প্রয়াসের সর্বোচ্চো উদাহরণ হলো একই টিফিন বাক্সে খাবার ভাগাভাগি করে সেই বিভাজনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান !!!! গ্রহণ করা নয়তো শীতের সময় আসলে মানুষজনের সম্পর্কে আগে-পিছে কিছু জানবার আগ্রহবোধ না করেই দান-খয়রাত করে তাকেই মানবতার শেষ পাঠ বলে মনে করে শীতনিদ্রায় যাওয়া ।

নিজেদের মার্ক্সবাদী বলে দাবী করা মানুষগুলো তাতেই সীমাবদ্ধ থাকতে পারেননা । তাদেরকে প্রতিনিয়ত জেগে থাকতে হয় । নিজেদের সহজাত চিন্তাভাবনা দ্বারাই তাদের সবাইকে দেখিয়ে দিতে হয় যে যেখানে এসে আমরা থেমে যাচ্ছি কিংবা থেমে যাই প্রকৃতপক্ষে যাত্রার শুরু সেখান থেকেই । পৃথিবীর যে কোন প্রান্তের মার্ক্সবাদীরই এর চেয়ে ভিন্নভাবে চিন্তা করার সুযোগ কিংবা অবকাশ নেই , অবকাশ থাকেনা । তেমনটা হলে সেই ব্যক্তির মার্ক্সবাদের বদহজম হয়েছে , তা আত্মস্থ হয়নি নিশ্চিত ।

বাংলাদেশ অনেক পরের কথা ভারত উপমহাদেশ থাকাকালীন সময় থেকেই এই ভূখন্ডের কমিউনিস্ট আন্দোলনের ইতিহাস ঘাটতে গেলে প্রতি পদে পদে নানাবিধ দোদুল্যমনতা , বিশ্বাসঘাতকতা , ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদীতার পরাকাষ্ঠা , নেতৃত্বের প্রতি মধ্যবিত্তসুলভ লোভ , ভাবগত নায়কসুলভ রোমান্টিকতা , ক্ষমতা কুক্ষীগত করে রাখবার ক্ষুদে ব্যক্তিগত মালিকানা এসবের চিত্র উঠে আসবে । তার একটিও মিথ্যা নয় । কিন্তু এখানেই বিষয়টি শেষ হয়ে যায়না । এর বিপরীতে যেই ঘটনাবহুল , সংগ্রামমুখর ইতিহাস আছে তার ইতিবৃত্তান্ত কিংবা উপাখ্যান যাই বলি সেই বাস্তব অনেক বেশী জীবন্ত , অনেক বেশী অস্তিত্বশীল । যেই কমিউনিস্ট নেতা ক্ষুদে ব্যক্তিগত মালিকানার দোষে কমিউনিস্ট রাজনীতির বিকাশের পথে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি করেছেন দেখা যাবে তার সমগ্র জীবনই এমন সব আত্মত্যাগে পরিপূর্ণ যেগুলোর সন্ধান জানতে পারলে যে কোন মানুষ নিশ্চিতভাবেই তার সাথে নিজেকে তুলনা করে নিজের কূপমন্ডুকতার জায়গাগুলো উপলব্ধি করে সেই নেতার প্রতি শ্রদ্ধাবনত হবে ।

অন্ততপক্ষে তেমনটাই প্রত্যাশিত । কিন্তু হয় তার সম্পূর্ণই বিপরীত । বুর্জোয়া আইন-কানুন সংবিধানে সন্ত্রাসীকে যেভাবে সমাজ , রাষ্ট্র , তার পারিপার্শ্বিক থেকে বিচ্ছিন্ন , নিরাকার এক সত্তা হিসাবে দেখা হয় , দেখানো হয় আমাদের সমাজে কমিউনিস্ট নেতা-কর্মীদেরও তার থেকে ভিন্ন কোনভাবে দেখা হয়না । কোন কমিউনিস্ট নেতা বেনসন খায় , কোন কমিউনিস্ট দলের কর্মী ভালো কোন পোশাক পরে , কোন কমিউনিস্ট নেতার স্ত্রী সহবাস মোদ্দাকথা তার জ্ঞাতিগোষ্ঠী , ঠিকুজির নাড়ি বের করে , তাকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত ব্যবচ্ছেদ করে পূর্ব নির্ধারিত রায় অনুযায়ী তাকে মাটিতে নামিয়ে ফেলা হয় । এটা অবধারিত , কারণ এমনটাই সিদ্ধান্ত থাকে ।

ব্যক্তিকে টেনেহিঁচড়ে মাটিতে নামানোর পেছনের কারণ হলো সেই ব্যক্তির চিন্তাকে মাটিচাপা দেওয়া । কেন মাটিচাপা দেওয়া ? কারণ সেই চিন্তা অনেকের প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তার জন্য স্পষ্ট হুমকির । এছাড়া অন্য কোন কারণ থাকবার যুক্তি নেই । আমাদের সমাজে গণতান্ত্রিক চিন্তাচেতনার কনামাত্র কোন স্থান কোনকালেই ছিলোনা , বর্তমানেও তার কোন স্থান নেই । জাতীয় সম্পদ রক্ষার দাবীতে রাস্তায় আন্দোলনরত আনু মুহাম্মদ পুলিশের লাঠিপেটায় পা ভেঙ্গে ফেললেও তার বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হয়না ।

যেন তার মার খাওয়াটাই অনিবার্য নিয়তি । আনু মুহাম্মদ স্রেফ নন – এনটিটি । স্রেফ আওয়ামী লীগের মনপছন্দের ভাষায় সেক্যুলারিজমের ধোঁয়াটে এবং বাগাড়ম্বরপূর্ণ ব্যাখ্যার কাঁদায় নিজেকে জড়াননি বলে পশ্চীম পাকিস্তানের স্ট্যাবলিশমেন্টেকে নাড়িয়ে দিয়ে তাদের সাথে লড়াইয়ের ফসল হিসাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরী ছেড়ে দেওয়া বদরুদ্দীন উমরকে ‘ প্রো – ইসলামিস্ট ‘ এর মতো নোংরা , জঘন্য গালাগাল করা হয় । বদরুদ্দীন উমরের তাতে কিছু যায় আসেনা । তিনি আজীবনই এসব সহ্য করে এসেছেন ।

কিন্তু তার লেখার মুগ্ধ পাঠকদের একজন আমার পক্ষে তা মেনে নেওয়া সম্ভব হয়নি , এখনো এই মিথ্যাচার আমার পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব হয়না । সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীর পরিচয় আমাদের কাছে কেবলমাত্র শিক্ষক হিসাবে । আবুল কাশেম ফজলুল হকের পরিচয়ও আমাদের মগজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে সেই বৃত্তের বাইরে যেতে পারেনি । কিন্তু এই মানুষগুলোর চিন্তা ?? রাজনৈতিক দর্শন ?? তাকে নিমেষে হাওয়া করে দিয়ে তাদের স্রেফ বিশ্ববিদ্যালয়ের বিদগ্ধ শিক্ষকরুপে সম্মাননা দেওয়া হয় । কিংবা বলা ভালো সম্মাননা দেওয়ার ভান করা হয় মাত্র ।

১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষভাবে অংশগ্রহণ করা কৃষকের সন্তান মোফাখখার ইসলাম চৌধুরীকে ৩৩ বছর পরের ১৬ ডিসেম্বরে বিনা বিচারে ( তার বিরুদ্ধে কোথাও কোন পুলিশ কেস ছিলোনা ) ক্রসফায়ারে হত্যা করা হবে । ডঃ মিজানুর রহমান টুটুলকে হত্যা করে তার মুখের কষ বেয়ে রক্ত ঝরতে থাকবার ছবি পত্রিকায় আসবে তবু কারো বলার সাহস হবেনা কেন তাকে বিনা বিচারে হত্যা করা হলো । সে যদি অপরাধীই হয়ে থাকে তবে রাষ্ট্রপক্ষের কেন সাহস হলোনা তাকে আইন-আদালতের আওতায় এনে বিচার করবার ? অপরাধের মোটিভ না জেনেই কাউকে শাস্তি প্রদান করা খোদ নিজেই একটি ঘৃণ্য অপরাধ তা অনুধাবণ করতে কি বিদগ্ধ পন্ডিত হতে হয় ? বাংলা ভাই নামক কথিত বর্বরের বিরুদ্ধে নিরাপদ অবস্থানে থেকে আমরা কম কথা বলিনি । তবুও কি কেউ এই প্রশ্নটি করেছিলাম বগুড়ায় বাংলা ভাই যাকে হত্যা করে তার লাশ উল্টা করে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছিলো সেও কমিউনিস্ট ছিলো এই রহস্যের সূত্র কি ? নাহ , আমরা কেউই প্রশ্নটি করবার জন্য সাহস হৃদয়ে ধারণ করিনা । আমরা কেউই এই প্রশ্নগুলো করার সাহস করিনা কেন এবং কিভাবে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও বামপন্থী নারীকর্মীদের পুলিশ গ্রেফতার করার পর পঞ্চাশ –ষাট দশকের মতো পুলিশ কাস্টডীতে ঢুকিয়ে “ ভিতরে ভরে দেওয়ার “ হুমকি দেয় কিংবা দিতে পারে ।

নারীবাদ নিয়ে সভা – সেমিনার , সিম্পোজিয়ামে নিজেদের ব্যস্ত রাখা মানুষজনরা নিজেরাও মনে রাখেননা এবং আমরাও তাদের মনে করাইনা যে এর প্রত্যেকটি ঘৃণ্য অপরাধের বিরুদ্ধে টু-শব্দ না করাটাই সবচাইতে বৃহৎ পরিসরে পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনাকে লালন করা । কারণ এই পুরুষতান্ত্রিক চিন্তা-চেতনা খোদ রাষ্ট্রকর্তৃক অনুমোদিত এবং পালিত । ক্ষমতার সাথে পুরুষতান্ত্রিকতার সম্পর্ক একেবারে জন্মলগ্ন থেকেই এই সত্যটি প্রতিবার এই জায়গাতে এসেই তারা বিস্মৃত হন । এই প্রবণতাকে এখন আর ভুল বলা যাবে বলে মনে করিনা । পূর্বেই লিখেছি আবারো লিখছি যে কমিউনিস্ট নেতা – কর্মী মানেই সে ধর্মপুত্র যুধিষ্ঠির কিংবা অবতার এমন মনে করার কোন কারণ নেই ।

এই বিশ্লেষণ কিংবা মনোভাব খোদ মার্ক্সীয় বিশ্লেষণেরই পরিপন্থী । উপরিউক্ত যাদের কথা উল্লেখ করলাম তারা কেউই ভুল-ত্রুটির ঊর্ধ্বে নন । অতি অবশ্যই নন কোনভাবেই নন । বাংলাদেশ রাষ্ট্রের , সমাজের বর্তমানের বিপদসংকুল চিত্রই তার সবচেয়ে বড় প্রমাণ । কিন্তু নূন্যতম বিশ্লেষণী ক্ষমতার সাথে মানবিকবোধের উপস্থিতি আমাদের থাকলে তাদের যে কোন বস্তুনিষ্ঠ সমালোচনা করার আগে এমনকি তাদের মতামতের সাথে দ্বিমত পোষণ করার আগেও তাদের জীবনের নানাবিধ আত্মত্যাগ , সংগ্রাম ইত্যাদির বিষয়গুলোকে মাথায় রেখেই তা করা উচিত ।

সেটাই প্রত্যাশিত কারণ তাদের যার যার জীবনে তাদের যেই আত্মত্যাগ তার সিকিমাত্রও আমরা নিজেদের জীবনে করিনি । এই অধম লেখকও তাদেরই অন্তর্ভুক্ত । আমাদের কোন অধিকার নেই কলমের এক খোঁচায় বদরুদ্দীন উমরকে মনগড়াভাবে “ প্রো-ইসলামিস্ট “ গালাগাল দেওয়ার । আমাদের কনামাত্রও সাধ্য নেই প্রতিক্রিয়াশীলতা বিস্তৃত করার অন্যতম নিকৃষ্ট মাধ্যম পত্রপত্রিকার মিথ্যা ভাষ্য অনুযায়ী ডঃ মিজানুর রহমান টুটুলকে এক কথায় সন্ত্রাসী বলে আখ্যায়িত করবার । সকল প্রকারের ভুলভ্রান্তি , দোদুল্যমনতা থাকা সত্ত্বেও যেই মানুষগুলো তাদের রাজনৈতিক কার্যকলাপের পথে থাকতে আমাদের জন্য অচিন্তনীয় এমন সব আত্মত্যাগ তাদের জীবনে নিঃসংকোচে স্বীকার করে গিয়েছেন তাদের সমালোচনার নামে কলমের এক খোঁচায় নাই করে দেওয়াটা আমাদেরই আত্মমর্যাদাহীন চরিত্রের , তার সাথে আমাদের শ্রমবিমুখতা , চিন্তাবিমুখতার নগ্ন প্রকাশ ছাড়া কিছু নয় ।

এ মোটেও অপ্রত্যাশিত কিছু নয় ৪২ বছর পরেও আমরা ট্যাক্স দিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের পুষি , আমাদের আল্লামা শফীদের সহ্য করতে হয় , এরশাদ আমাদের রাজনীতির ট্রাম্পকার্ড , আমাদের শামীম ওসমানদের নেতা বলে মেনে নিতে হয় , জাতীয় পতাকা সংবলিত গাড়ীতে রাজাকারেরা মন্ত্রী হয়ে চড়ে বেড়ায় । আমাদের মতো দেউলিয়া , লুম্পেন চরিত্র দ্বারা পরিপূর্ণ সমাজে এরাই ন্যায়-নীতি থেকে শুরু করে শিল্প-সাহিত্য সবকিছুর অবিসংবাদিত , বিতর্কহীন বিচারক । কারণ সক্রিয় জননযন্ত্রের মাধ্যমে উত্তরাধিকারী রেখে যাওয়া ছাড়া আমাদের নিজেদের প্রকৃতার্থে বিশেষ কোন অবদান ছিলোনা , থাকেনা ।

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।