আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

চরম হতাশায় বিএনপির নেতাকর্মীরা



অন্যের শক্তির ওপর নির্ভর করে নিজেদের দাবি-দাওয়া আদায় ও সরকারকে বিপাকে ফেলতে একের পর এক চেষ্টা ব্যর্থ হওয়ার পর এখন আর নতুন কোনো পথ খুঁজে পাচ্ছে না বিএনপি। এছাড়া দাবি আদায়ে সরকারকে সময় বেঁধে দেয়া এবং সময় পার হওয়ার পর একেবারে চুপসে যাওয়ায় মাঠের নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চরম হতাশা। বিভিন্ন ইস্যুতে নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন বক্তব্য ও স্ববিরোধী কথাবার্তা নিয়েও আছে বিরূপ আলোচনা। সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিএনপি সবচেয়ে বেশি নির্ভর করেছিল জামায়াত-শিবিরের ওপর। দলটির ধারণা ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার নিয়ে জামায়াত-শিবির দেশে এমন পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে যাতে সরকার বিপদে পড়ে যাবে এবং এক পর্যায়ে সেনাবাহিনী ক্ষমতা নেবে।

এ কারণে জামায়াতকে খুশি করতে মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য গঠিত ট্রাইব্যুনাল ভেঙে দেয়ার কথাও বলে বিএনপি। ‘আটক জামায়াত নেতারা যুদ্ধাপরাধী নন’ বলে দাবি করেন খালেদা জিয়া। একই চিন্তা থেকে হেফাজতে ইসলামকে সমর্থন দেন খালেদা জিয়া। তাদের সহায়তা করতেও বলেন তিনি। অথচ হেফাজতের ১৩ দফার সঙ্গে একমত হতে পারেননি খালেদা জিয়া।

এই দুই শক্তির পাশাপাশি একটা সময় বিএনপি কূটনীতিকদের ওপর নির্ভর করেছিল। বিশেষ করে আমেরিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের মুসলিম অধ্যুষিত দেশগুলোর প্রতি নির্ভর করেছিল। বিএনপি ধারণা করেছিল, ওই দেশগুলো সরকারকে চাপে ফেলে তাদের দাবি আদায়ে সহায়তা করবে। কিন্তু নির্ভরশীল এই তিন গোষ্ঠী বিএনপিকে সহায়তা করতে পারেনি। অন্যের শক্তির ওপর নির্ভর করে যখন দলটির সর্বোচ্চ নেতৃত্ব কোনো সফলতা পাননি, তখন বারবার দাবি আদায়ে সরকারকে সময় বেঁধে দেয়ার ঘটনায় দলটির মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মধ্যে সৃষ্টি হয়েছে চরম হতাশা।

এ পর্যন্ত বিএনপি নির্দলীয় সরকারের দাবি মানতে তিন বার সময় নির্ধারণ করে দিয়েছে। কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে এই দাবির প্রতি কোনো কর্ণপাত করা হয়নি। বেঁধে দেয়া সময় শেষ হওয়ার পর কোনো কঠোর কর্মসূচি দেয়া হয়নি। বিএনপির ২০১২ সালের মার্চে প্রথম দফায় ৯০ দিন সময় বেঁধে দেয়। এই সময় শেষ হওয়ার পর ১১ জুন দাবি আদায়ে আবারো সময় দিয়ে বলেন, ওই বছরের রোজার ঈদের পর কঠোর আন্দোলন করা হবে।

সর্বশেষ গত ৪ মে শাপলা চত্বরে ৪৮ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেন খালেদা। এমনকি ওই দিন শাপলা চত্ত্বরে বসে যাওয়া না যাওয়া নিয়েও মঞ্চে দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভোগেন খালেদা জিয়া। সময় দেয়ার পর দীর্ঘদিন দিন পার হয়ে গেলেও তেমন কোনো কর্মসূচি দিতে পারেনি বিএনপি নেতৃত্বাধীন জোট। বিভিন্ন দাবি আদায়ে এই জোট এখন বেশ কয়েকটি হরতাল করেছে। কিন্তু হরতাল সফল করার ব্যাপারে কোনো উদ্যোগ লক্ষ্য করা যায়নি।

কেন্দ্রীয় নেতারা হরতাল ডেকে ঘরে বসে থাকেন। এখন হরতালে কর্মীরাও নামেন না। সমাবেশ করার মতো অবস্থা না থাকায় বারবার তারিখ ঘোষণা করেও তা পেছাতে হচ্ছে। রাজনৈতিক সংকটের মধ্যে দলের অভ্যন্তরীণ সংকট ও জোটের টানাপোড়েন নিয়ে সমস্যায় পড়েছে বিএনপি। ফলে সরকার পতনের এক দফা দাবি আদায়ে সরকারের ওপর এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো চাপ সৃষ্টি করতে পারেনি তারা।

অভ্যন্তরীণ সংকটের প্রকৃতি জানতে চাইলে বিএনপির কয়েকজন দায়িত্বশীল নেতা বলেন, তাদের প্রধান সংকট হলো দলের চেয়ারপারসনের নির্দেশ নেতা-কর্মীরা সেভাবে মানছেন না। মাঠপর্যায়ে আছে নেতৃত্বের সংকট। ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিকভাবে মোকাবিলার জন্য তেমন কোনো কৌশলও নিতে পারেনি দলটি। এর প্রভাব পড়েছে কর্মীদের মধ্যে। তারা মনে করছেন, নেতারা নিজস্ব কর্মসূচি দিয়ে কর্মীদের মনে আশা জাগাতে পারছেন না, তাদের নির্ভর করতে হচ্ছে কেবল সরকারের ভুল ও ব্যর্থতার ওপর।

এসব নিয়ে এখন কঠিন সময় পার করতে হচ্ছে বিএনপিকে। বিএনপির স্থায়ী কমিটির কয়েকজন নেতা ও বিএনপির রাজনীতি পর্যবেক্ষণ করেন, এমন একাধিক ব্যক্তি বলেছেন, বিএনপির বড় সমস্যা হলো, তাদের দলের অনেক সমর্থক আছে, কিন্তু সেই তুলনায় দলের প্রতি অনুগত কর্মী কম। যারা নেতৃত্বে আছেন তাদের মধ্যে বিভাজন বেশি। নেতাদের মধ্যে বিশ্বাস-আস্থার অভাবও আছে। দাবি আদায়ে কর্মপরিকল্পনা নির্ধারণ করার মতো প্রজ্ঞা বা রাজনৈতিকভাবে বিচক্ষণ নীতিনির্ধারকের অভাবও প্রকট হয়ে উঠছে।

এর আঁচ পাওয়া যায় পরিস্থিতি বুঝতে সময় নেয়া এবং একই বিষয়ে দলের নেতাদের ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান থেকে। তাদের মতে, এটাই এখন দলটির সংকটের মূল কারণ। দলের এই অগোছালো অবস্থায় সুযোগ নিচ্ছে ১৮ দলীয় জোটের শরিকেরাও। গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে কার্যত দিকনির্দেশনাহীন হয়ে পড়া প্রধান শরিকের ওপর তখন কোনো কোনো শরিক চাপ তৈরি করতে সক্ষম হয়। ফলে কোনো বিষয়ে সুদৃঢ় অবস্থান নিতে বেগ পেতে হয় দলটিকে।

যেকোনো সংকটে বিএনপি জনগণকে দলের সঠিক অবস্থান জানাতে ব্যর্থ হয়েছে। সংসদে যাওয়া না-যাওয়া নিয়ে বিএনপির সঠিক কোনো অবস্থান জানা যায়নি। বিভিন্ন সময়ে ভিন্ন ভিন্ন দাবিতে সরকারবিরোধী আন্দোলন হয়েছে। এতে সাধারণ মানুষ বিভ্রান্ত হয়েছে। জিয়া পরিবারের সমস্যা নিয়ে আন্দোলনই হয়েছে সবচেয়ে বেশি।

মাঠের নেতা-কর্মীদের বড় অংশ একে ভালোভাবে নেয়নি। সরকারি দলের দিক থেকেও এমন অভিযোগ করা হয় যে, জনগণের কোনো ইস্যু নিয়ে বিরোধী দল আন্দোলন করেনি। খালেদা জিয়া ও তারেক রহমানের মামলা নিয়েও আছে নানা শঙ্কা। খালেদা জিয়া কোনো কারণে গ্রেফতার হলে নেতৃত্ব কে দেবেন তাও নির্ধারিত নয়। সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমান লন্ডনে আছেন।

তিনি কবে আসবেন তা কেউই জানে না। দলের নেতাদের মধ্যে যারা সরকারের সঙ্গে আলোচনা করেন সমাধানের পক্ষে, তারা মনে করেন, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে সরকারকে পাল্টা প্রস্তাব দিতে পারেনি বিএনপি। শাহবাগের আন্দোলন নিয়েও একেক সময় একেক বক্তব্য দেয়া দলের জন্য ক্ষতি হয়েছে। জামায়াতে ইসলামীর ব্যাপারে কখনো নির্লপ্ত থাকা আবার কখনো কাছে টানা বিভ্রান্তি সৃষ্টি করেছে। ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার নিয়েও বিএনপি তাদের অবস্থান মানুষের কাছে পরিষ্কার করতে পারেনি।

সর্বশেষ সময়মতো কাউন্সিল করতে না পারা দলটির একটি বড় সাংগঠনিক ব্যর্থতা হিসেবে দৃশ্যমান হয়েছে। এটা দলের সংকটকে আরও বাড়িয়ে দিয়েছে বলে মনে করেন কেউ কেউ। সবচেয়ে বড় কথা, একক কোনো ইস্যুতে বিএনপি রাজনৈতিক দল হিসেবে জনসম্পৃক্ততা তৈরি করতে পারেনি। স্থানীয় সরকারের নির্বাচন নিয়েও নানা মত আছে দলের মধ্যে। কোনো নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে, কখনো নিচ্ছে না।

এতে তৃণমূলের নেতারা বিভ্রান্ত হচ্ছেন। তারা রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে স্পৃহা হারিয়ে ফেলছেন। সাম্প্রতিক রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে জননিরাপত্তা কমিটি গঠনের কথা বলা হলেও এখনো একটি কমিটিও গঠিত হয়নি। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে জেলা, উপজেলায় ১৮ দলের শরিকদের নিয়ে সম্মিলিত সংগ্রাম পরিষদ গঠনের নির্দেশ দেয়া হলেও কেবল খুলনা জেলায় করা হয়। কেন্দ্রের বাইরে ১৮ দলের মধ্যে সমন্বয়ের সমস্যা থাকায় জেলা-উপজেলায় কর্মসূচি পালন বাধাগ্রস্ত হয়।

গত ৫ মে ঢাকায় হেফাজতের কর্মসূচিতে অংশ নিতে ও সহায়তা করতে নির্দেশ দেন খালেদা জিয়া। কিন্তু দেখা গেছে তার নির্দেশনা দলের কোনো নেতা-কর্মী মানেননি। হেফাজতকে সফলভাবে সরিয়ে দিতে পেরে আওয়ামী লীগও অনেকটা নির্ভার। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কয়েকটি অনুষ্ঠানে খালেদা জিয়াকে ইঙ্গিত করে বলেছেন, ‘ওনি ঘোষণা দেয়ার পরও হেফাজতের পাশে ওনার কোনো নেতাকর্মী এসে দাঁড়ায়নি। কারণ দলের নেতাকর্মীদের ওপর ওনার নিয়ন্ত্রণ নেই।

’ খালেদা জিয়া গত বছরের অক্টোবরে ভারত সফর করেন। সেখান থেকে ফিরে এসে চিরাচরিত ভারত বিরোধিতা থেকে সরে আসেন। বিএনপি নেতারাও বলেন, ভারত বিরোধিতা বলে কোনো অবস্থান তাদের নেই। কিন্তু এর কয়েক মাস পর যখন ঢাকায় ভারতের রাষ্ট্রপতি প্রণব মুখার্জি এলেন তখন তার সঙ্গে দেখা পর্যন্ত করলেন না খালেদা। খালেদার সঙ্গে কূটনীতিকদের বৈঠকেও ভারতের হাইকশিমনারকে অনুপস্থিত থাকতে দেখা গেছে।

তাছাড়া বিএনপি গত চার বছরে বিভিন্ন ঘটনার পর কূটনীতিকদের সঙ্গে বৈঠক করেছে। গুলশানের বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের এক কর্মকর্তা এ ধরনের ১৭টি বৈঠকের কথা বলেছেন। কিন্তু এসব বৈঠক থেকে তেমন কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি। কোনো কোনো বৈঠকে আমেরিকান দূতাবাস থেকে কোনো প্রতিনিধি পর্যন্ত আসেননি। সম্প্রতি খালেদা জিয়া ১০টি মুসলিম দেশের রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে তার কার্যালয়ে বৈঠক করেন।

হেফাজতে ইসলামের আন্দোলনের সময় বাংলাদেশের মানুষকে তারা দেখাতে চেয়েছিল বিএনপি মুসলমানদের সঙ্গে আছে। এছাড়া এসব মুসলিম দেশে বিপুলসংখ্যক বাংলাদেশী কাজ করে। এই রাষ্ট্রগুলোকে সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্য আহ্বান জানান তিনি। কিন্তু এর কোনোটিই কাজে আসেনি। ওই বৈঠকের কোনো ফলাফল দেখা যায়নি।

কার পরে কে নেতৃত্বে গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, শুধু চেয়ারপারসন স্থায়ী কমিটির সভা ডাকতে পারেন। খালেদা জিয়া কোনো কারণে গ্রেফতার হলে বা গৃহবন্দী হলে দলের নীতি-নির্ধারণী ফোরাম জাতীয় স্থায়ী কমিটির সভাও কেউ ডাকতে পারবেন না। দল কিভাবে চলবে, কেউ জানে না। দলের নির্দিষ্টি কোনো মুখপাত্র নেই। কোনো ইস্যুতে কার কাছ থেকে দলের আনুষ্ঠানিক বক্তব্য জানা যাবে, সেটা পরিষ্কার নয়।

এ সরকারের শুরুর দিকে একবার নজরুল ইসলাম খানকে মুখপাত্র হিসেবে আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দিয়েছিল। এরপর ধরে নেয়া হয়, ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব একই সঙ্গে মুখপাত্র, কিন্তু এ বিষয়ে দলের কোনো ঘোষণার কথা জানা যায়নি। ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিক দফা কারাগারে গেছেন। প্রথম দফা তার অনুপস্থিতিতে দলের বক্তব্য তুলে ধরেছিলেন তরিকুল ইসলাম। তিনি দলের সমন্বয়কারী ছিলেন।

দ্বিতীয় দফা ফখরুল কারাগারে যাওয়ার পর এবার অসুস্থতার কারণ দেখিয়ে তরিকুল আর সমন্বয়কারী হতে রাজি হননি, এমনকি ঢাকায়ও ফিরেননি। এরপর অগত্যা গণমাধ্যমের কাছে দলের বক্তব্য তুলে ধরার দায়িত্ব দেয়া হয় সালাহউদ্দিন আহমদকে। দায়িত্ব গ্রহণের কিছুদিন পরই তাকে গ্রেফতার করা হয়। তারপর থেকে চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা শামসুজ্জামান দুদু অঘোষিত মুখপাত্র। মহাসচিব হওয়ার জন্য বিএনপি অনেকেই আগ্রহী বলে জানা যায়।

কিন্তু ভারপ্রাপ্ত মহাসচিব গ্রেফতার হলে, তখন দলের সমন্বয়কারী হতে কেউ রাজি হন না মামলা ও গ্রেফতারের ভয়ে। চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা উপদেশ দেবেন, তাকে দিয়ে দলের মুখপাত্রের কাজ করানো বিএনপির অভ্যন্তরীণ বেহাল পরিস্থিতির একটি উদাহরণ। দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়ের সাম্প্রতিক কিছু বক্তব্যও দলের ভেতরের নাজুক পরিস্থিতির বহিঃপ্রকাশ বলে ধরে নেয়া যায়। তিনি সংস্কারপন্থীদের কটাক্ষ করে শুক্রবার যে বক্তব্য রেখেছেন তা দলের ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি করেছে বলে জানা গেছে। Click This Link


অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।