দিনটি ছিল ২৫ মে, ১৬১১ সাল। সালতানাতে মোগলের রাজধানী ফতেপুর সিক্রির শাহী প্রাসাদের মূল ফটক থেকে শুরু করে দেওয়ানি খাসের পুরো চত্বরটিই মনে হচ্ছিল দুলহান-দুলহানিয়ার মতো। আরবীয় তেজি ঘোড়া, সাদা রংয়ের উট এবং শাহী হাতিগুলোকে সাজানো হয়েছিল বিশেষ সাজে। নহবত, শানাই, যুদ্ধ কড়াইগুলোর ছন্দ মেলানো সুর এবং ৩০ মিনিট পর পর ১০০টি কামানের গগনবিদারী আওয়াজে রাজধানীসহ আশপাশের ২০০ মাইলের মধ্যে বসবাসকারী প্রজারা টের পাচ্ছিল যে, তাদের সম্রাট নূর উদ্দিন মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর তৎকালীন পৃথিবীর সবচেয়ে সুন্দরী, মেধাবী এবং চৌকস রমণী মেহেরুন নিসা ওরফে নূরজাহানকে ২০তম স্ত্রী হিসেবে বিয়ে করছেন। দেওয়ানি খাসের ঠিক মাঝামাঝি, দক্ষিণ দিকের ঘরটিতে সাজানো হয়েছিল বাসর।
আজ থেকে প্রায় সোয়া চারশ বছর আগে কামরাটিকে প্রাকৃতিকভাবে প্রায় শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত করা হয়েছিল। মোগল ঐতিহ্য অনুযায়ী কামরায় কোনো দরজা না থাকলেও ২৩ রকমের বাহারি পর্দা, ইরানি গালিচা এবং হিন্দুস্তানি ফুলের সাহায্যে এক স্বপ্নপুরী তৈরি করা হয়েছিল। রঙিন ঝাড়বাতিতে এক হাজার মোমের আলো, কস্তূরী ও মৃগনাভীর সুভাসের সঙ্গে নিরাপদ দূরত্বে থেকে মৃদু স্বরে শানাইয়ের সুর নারী-পুরুষের হৃদয়কে মিলনের জন্য পাগল করে দিচ্ছিল। নির্জন বাসর ঘরে সম্রাট জাহাঙ্গীর প্রবেশ করা মাত্র বধূবেশে সম্রাজ্ঞী মেহেরুন নিসা উঠে কুর্নিশ করলেন। সম্রাট এবং সম্রাজ্ঞী চার বছর ধরে অধীর আগ্রহে আজ রাতের মধুময় বাসরের জন্য অপেক্ষা করছিলেন।
আবেগের আতিশয্যে উভয়ে কিছুক্ষণ নির্বাক হয়ে রইলেন। সম্রাজ্ঞীর জন্য এটি দ্বিতীয় বাসর আর সম্রাটের জন্য ২০তম। সম্রাটের অন্য কোনো বাসরের সঙ্গে প্রেম বা প্রণয়ের প্রণতি ছিল না। কেবল রাজনীতি এবং ক্ষেত্রবিশেষে দুর্বার যৌনাকাঙ্ক্ষা থেকে তিনি পর পর ১৯টি বিয়ে করেছিলেন। প্রায় সবাই ছিলেন রাজদুহিতা।
বাসর ঘরে ঢুকে প্রথমেই আলিঙ্গন এবং দৈহিক প্রশান্তি লাভের চেষ্টা। প্রায় সর্বক্ষেত্রেই তিনি অর্ধ মাতাল হয়ে বাসর ঘরে ঢুকতেন এবং নব পরিণীতার সামনে বসে মদ খেয়ে আরও মাতাল হওয়ার চেষ্টা করতেন। এর পর ফার্সি কবিতা আওড়াতে আওড়াতে বাসর ঘর গুলজারের চেষ্টা চালাতেন। কিন্তু ১৬১১ সালের ২৫ মে তারিখের বাসরটি ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। বাসর ঘরে প্রবেশের আগে সম্রাট তার হাম্মাম খানায় টানা দুই ঘণ্টা ধরে মেশক ও আম্বর মিশ্রিত পানিতে গোসল সারেন।
এর আগে শাহী ক্ষৌরকার উত্তমভাবে তার ক্ষৌরকার্য সম্পন্ন করান। শাহী কবিরাজকে আগেই নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল সর্বোৎকৃষ্ট উত্তেজক ওষুধ বানানোর জন্য। বলা হয়েছিল, সম্রাট সারা রাত জেগে থাকতে চান এবং অনেক বাসর রাতকে উপভোগ করতে চান হেকিম তার সারা জীবনের মেধা ও প্রজ্ঞা দিয়ে সম্রাটের জন্য ওষুধ প্রস্তুত করেছিলেন। সেবনের সঙ্গে সঙ্গে সম্রাট তার দেহে প্রচণ্ড উত্তেজনা অনুভব করেন। হেকিমের পরামর্শ মতো তিনি গত ২৪ ঘণ্টায় কোনো মদ্যপান করেননি।
ফলে তার দেহ-মন একই সঙ্গে মেহেরুন নিসাকে পাওয়ার জন্য পাগল হয়ে পড়েছিল। কিন্তু এ কী! সম্রাজ্ঞীর সামনে দাঁড়িয়ে তিনি যখন তার মুখের দিকে তাকালেন_ শারীরিক উত্তেজনা মুহূর্তের মধ্যে হিমশীতল হয়ে গেল। সম্রাজ্ঞী মেহেরুন নিসা অবনত মস্তকে অঝোরে কাঁদছিলেন। সম্রাটের কবিমন ভীষণভাবে আহত হলো। তিনি কান্নার কারণ বা তাৎপর্য জানতে চাইলেন।
বিদূষী সম্রাজ্ঞী বলতে শুরু করলেন_আলম্পানা! এই শাহী প্রাসাদের বাসর শয্যার সামনে দাঁড়িয়ে আমি কেবল আমার নিয়তির কথা ভাবছিলাম। আবেগ, কৃতজ্ঞতা এবং আনন্দে আমার দেহমন পুলকিত। আমার চোখের অশ্রু যেন কৃতজ্ঞতার বহতা নদী। আমি কৃতজ্ঞ আমার রবের প্রতি। সবকিছুই কেমন যেন স্বপ্নের মতো মনে হচ্ছে।
জীবনের মুহূর্তগুলো কেমন যেন মেলাতে পারছি না। ১৫৭৭ সালে কান্দাহারের এক মরুভূমিতে আমার জন্ম। প্রচণ্ড অভাবের তাড়নায় আমার আব্বা মির্জা গিয়াস বেগ পরিবারের অন্যান্য সদস্যসহ পারস্য থেকে হিন্দুস্তানে হিজরত করেন। আমি তখন মাতৃগর্ভে। আমাদের পারিবারিক কাফেলার সবাই শতছিন্ন ও ময়লাযুক্ত কাপড় পরিধান করছিলেন।
আমাদের কোনো বাহন ছিল না। খালি পায়ে প্রায় অভুক্ত অবস্থায় আমরা মরুময় পথ পাড়ি দিচ্ছিলাম। আমাদের কাফেলার না ছিল কোনো অর্থ কিংবা না ছিল কোনো খাদ্য। আমরা কোনো গ্রাম দেখলে গ্রামবাসীর কাছে ভিক্ষা চাইতাম। আবার কোনো জঙ্গলের কাছ দিয়ে গেলে সাধ্যমতো শিকারের চেষ্টা করতাম।
মরুভূমির উত্তপ্ত বালুকা এবং পর্বতময় এলাকার শিলাখণ্ড আমাদের পথের ক্লান্তিকে বাড়িয়ে দিচ্ছিল। আমরা দুর্বল হতে হতে প্রতি মুহূর্তে মৃত্যু আলিঙ্গনের জন আকাঙ্ক্ষা করছিলাম। এরই মধ্যে কয়েকবার হিংস্র বাঘের সামনে পড়লাম। বাঘ আমাদের দরিদ্রতা ও অসহায়ত্বের জন্য বেশ খাতির করে এড়িয়ে গেল। কয়েকটি ডাকাত দলের মুখোমুখি হলাম।
তারাও আমাদের এড়িয়ে গেল। শাহানশাহ এ আলম! অমাবস্যার ঘোর রজনীতে আমার জন্ম হয় কান্দাহারের বিরান মরুভূমিতে। আমার ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত আম্মাজান কোনো প্রসব বেদনা ছাড়াই আমাকে প্রসব করেন। পথের ক্লান্তিতে তার সর্বাঙ্গ ছিল প্রায় অনুভূতিহীন। কণ্ঠ ছিল শব্দ করার অযোগ্য।
অন্যদিকে দীর্ঘদিন মাতৃগর্ভে আমি প্রায় অভুক্ত অবস্থায় বড় হচ্ছিলাম। কাজেই অমাবস্যার ঘোর অন্ধকারে আমার আম্মা যখন প্রসব করলেন তখন প্রসূতি এবং নবজাতক কেউ শব্দ করল না। আমাদের কাফেলায় কোনো আলো জ্বালানোর ব্যবস্থা ছিল না। কৃষ্ণপক্ষের নক্ষত্ররাজির মৃদু আলোতে সবাই আমার প্রসবকালীন কর্মসমূহ সমাধান করল। আমাকে মৃত শিশু ভেবে মরুভূমির মধ্যে ফেলে রেখে সবাই সামনের দিকে অগ্রসর হতে থাকল।
মহান বাদশাহ আকবরের বন্ধু মালিক মাসুদ পারস্য থেকে ওই পথ দিয়েই হিন্দুস্তান যাচ্ছিলেন। পরদিন সকালের আলো যখন আমার মুখের ওপর পড়ল তখন আমি প্রথম চিৎকার করে কেঁদে উঠলাম। মালিক মাসুদের কাফেলা ধূসর মরুভূমির বিজন প্রান্তরে নবজাতকের কান্না শুনে এগিয়ে এলেন। দেখলেন একটি বাঘিনী বসে আমাকে পাহারা দিচ্ছে। কাফেলার লোকজন দেখে বাঘিনীটি নিঃশব্দে নিরাপদ দূরত্বে সরে গিয়ে মায়াভরা দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে থাকল।
আগ্রা রাজ দরবারের প্রভাবশালী আমির এই অভূতপূর্ব দৃশ্য দেখে যারপরনাই বিস্মিত ও হতবাক হলেন। তিনি আমাকে কুড়িয়ে নিলেন এবং মুখমণ্ডলের দিকে তাকিয়ে ললাটে রাজটিকা দেখতে পেলেন। আমি মালিক মাসুদের আশ্রয়ে তার কাফেলার সঙ্গে হিন্দুস্তানের রাজধানী আগ্রার দিকে এগুছিলাম। আমার আশ্রয়দাতা পিতা আমার সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্যের জন্য সবকিছুই করলেন। আমি ২-১ দিনের মধ্যেই সুস্থ ও সবল হয়ে উঠলাম।
স্বর্গীয় হাসি এবং নবজাতকের চিরায়ত অঙ্গভঙ্গির মাধ্যমে আমি আমার আশ্রয়দাতার মনকে প্রশান্ত করে দিচ্ছিলাম। তিনি আমার জন্য যাত্রাপথে অতি উত্তম ধাত্রী কাম দুধ মা খুঁজছিলেন। নিয়তির নির্মম পরিহাসে কয়েক দিন পর আমার আশ্রয়দাতার কফেলার সঙ্গে আমার জন্মদাতার কাফেলার সাক্ষাৎ ঘটে এবং আমার জন্মদাত্রী মাকেই নিয়োগ করা হয় আমার ধাত্রী হিসেবে। আলোচনার এক পর্যায়ে আমার জন্মদাতার পরিচয় পেয়ে যান আমার আশ্রয়দাতা। আমাদের দুঃখ-দুর্দশা এবং অভাব অভিযোগের কথা শুনে আশ্রয়দাতা পিতা খুবই ব্যথিত ও মর্মাহত হন।
তিনি আমাদের তার খরচে আগ্রা নিয়ে যাওয়ার অঙ্গীকার করেন এবং রাজদরবারে আমার আব্বাকে একটি চাকরি প্রদানের প্রতিশ্রুতি দেন। আমার আশ্রয়দাতা পিতা মোগল রাজদরবারে অতিশয় জনপ্রিয় এবং গ্রহণযোগ্য ব্যক্তি ছিলেন। বাদশাহ নামদার শাহানশাহ আকবর তাকে প্রচণ্ড ভালোবাসতেন। অন্যদিকে আমার বাবা মির্জা গিয়াস বেগ লেখাপড়া জানা বুদ্ধিমান লোক ছিলেন। তার শরীরেও রাজ রক্ত ছিল এবং পারস্য অভিজাত্য ও কুলীনতার মার্জিত দিকগুলো তার ব্যক্তিত্বে প্রকাশিত হতো।
শাহানশাহ আব্বাকে দেখে সন্তুষ্ট হলেন এবং তাকে মোটামুটি একটি ভালো চাকরি দিলেন। তাকে কাবুলের জায়গিরদার করা হলো। সে কাবুলের কান্দাহারে আমি ও আমার পরিবার একসময় ভিখারির মতো সময় কাটিয়েছিলাম। মাত্র কয়েক মাসের মাথায় আমরা সেখানকার শাসক হয়ে গেলাম। আমার আব্বা মির্জা গিয়াস বেগ কাবুলের শাসক হওয়ার অল্প কিছু দিনের মধ্যেই সবকিছু চমৎকারভাবে গুছিয়ে নেন।
কেন্দ্রীয় সরকারে তিনি সবচেয়ে বেশি পরিমাণ রাজস্ব পাঠাতে থাকেন। সাম্রাজ্যের উত্তর দিকের রাজ্যগুলোর মধ্যে কাবুল ছিল সবচেয়ে বেশি সমস্যাসংকুল এবং দরিদ্র এলাকা। পাশর্্ববর্তী পারস্য সাম্রাজ্য, চীন, রাশিয়া প্রভৃতি শক্তিশালী রাষ্ট্রের হুমকি ও আক্রমণ উপেক্ষা করে কাবুলে সুশাসন স্থাপন সত্যিই কঠিন ছিল এবং আমার আব্বাজান তা অত্যন্ত দক্ষতার সঙ্গেই করেছিলেন। ফলে মহামতি আকবর আজম আমার আব্বাকে রাজধানীতে ডেকে বিরাট রাজকীয় সংবর্ধনা দেন। তাকে ইতিমাত-উদ-দৌলা বা সাম্রাজ্যের স্তম্ভ (চরষষবৎ ড়ভ ঃযব ংঃধঃব) উপাধি দেওয়া হয়।
আমি এবং আমার অপর দুই ভাই শরিফ খান ও আসফ খান রাজকীয় পরিবেশে কাবুলে বেড়ে উঠতে থাকি। এতটুকু বলে সাম্রাজ্ঞী তার মায়াবী চক্ষু মেলে সম্রাটের দিকে তাকালেন। বাসর ঘরের বাইরের সানাই ইতোমধ্যে থেমে গিয়েছিল। সময়ও অনেক হয়েছিল। দুর্গশীর্ষে স্থাপিত ঘণ্টায় বিকট টং টং আওয়াজ তুলে জানান দিল রাত দ্বিপ্রহর।
জাহাঙ্গীর মেহেরুন নিসার হাত ধরলেন। আদর করার জন্য হালকা করে একটু টান মারলেন। ঠিক এ মুহূর্তের জন্যই সম্রাজ্ঞী অপেক্ষা করছিলেন। তিনি বুকের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। বহু রমণীতে অভ্যস্ত সম্রাট একটু অবাকই হলেন।
কারণ কোনো নারীই আগে স্বপ্রণোদিত হয়ে তার বুকে মাথা রাখেনি কিংবা আলিঙ্গন করেনি। তারা সবাই সম্রাটের ইচ্ছার কাছে নতিস্বীকার করতে আসে। হুকুম মতো দাঁড়িয়ে থাকে। আবার হুকুম মতো শুয়ে পড়ে। এদের অনেকে আবার ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কাঁপতে থাকে।
ফলে নারী-পুরুষের স্বাভাবিক মিলনের স্বাদ সম্রাট জীবনে ২-১ বার পেয়েছেন কিনা সন্দেহ। সম্রাজ্ঞী সর্বোচ্চ আবেগ দিয়ে সম্রাটকে জড়িয়ে ধরলেন। সম্রাটও প্রথা বিরুদ্ধ কাজ করে বসলেন। তিনি নববধূকে কোলে তুলে নিলেন এবং গভীর চুম্বনে তার ঠোঁট এবং মুখমণ্ডল সিক্ত করলেন। এ যেন স্বর্গীয় আবেশ।
নারীর চুল ও তার দেহের সুঘ্রাণ যে মানুষকে এত মোহিত করতে পারে সম্রাট জীবনে প্রথম তা টের পেলেন। তিনি নববধূকে কোল থেকে নামিয়ে গভীর আলিঙ্গনে জড়িয়ে ধরলেন। উষ্ণ, নরম ও সুঘ্রাণযুক্ত অপরূপ দেহবল্লরীর মানবী সম্রাটের সবকিছু আচ্ছন্ন করে ফেলল। তিনি বধূকে পাশে বসিয়ে তার চাঁদ মুখখানার দিকে তাকালেন। মেহেরুন নিসা এবার ফুঁফিয়ে কেঁদে উঠলেন।
হতবিহ্বল সম্রাট জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে স্ত্রীর পানে তাকালেন। সম্রাজ্ঞী তার আসন ছেড়ে স্বামীর পায়ের কাছে বসলেন এবং তার উরুর ওপর অনেকটা কাত হয়ে মাথাটি রাখলেন এবং পুনরায় বলতে শুরু করলেন_হে সাহেবে আলম, আজ আমার মনে হচ্ছে জীবনের প্রথম বাসর রাতের দুঃসহ স্মৃতির কথা। ১৫৯৪ সালের কোনো এক বসন্তে আলী কুলি ইজতাজুল ওরফে শের আফগানের সঙ্গে আমার বিয়ে হয়। আমার বয়স তখন ১৭ বছর। থাকতাম লাহোর রাজপ্রাসাদে।
আমার আব্বা তখন কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন আরও উঁচু পদে কাজ করেন। লাহোরের মোগল সেনাপতি খান এ খানান আবদুর রহিমের অধীনে চাকরি করতেন শের আফগান। মিওয়ার এর রানার বিরুদ্ধে অত্যন্ত বীরত্বপূর্ণ যুদ্ধ করার জন্য আপনিই তাকে শের আফগান উপাধি দিয়েছিলেন। আমি তাকে চিনতাম না কিন্তু নাম জানতাম। ইতোমধ্যে আমরা সপরিবারে রাজধানী আগ্রার ফতেপুর সিক্রিতে বেড়াতে যাই।
আব্বা রাজপ্রাসাদে মহানুভব সম্রাট আকবরের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। অন্যদিকে আমার মা আছামত বেগম শাহী অন্তঃপুরে রাজ মহীয়সী যোধা বাইয়ের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি পান। তিনি সঙ্গে করে আমাকেও নিয়ে যান। আমার বয়স তখন ১৪ বছর এবং আপনি সে সময় আনার কলির সঙ্গে গভীর ভালোবাসায় মগ্ন। প্রথম সাক্ষাতেই সম্রাট আমাকে ভীষণ পছন্দ করেন এবং মোগল হেরেম থেকে শিক্ষা গ্রহণ করার জন্য আমাকে মনোনীত করেন।
আমার পরিবারের জন্য এ ছিল এক বিরল সম্মান এবং অসাধারণ পুরস্কার ও প্রাপ্তি। এর ফলে আমি দেওয়ানে খাসের অন্তঃপুরে স্থান পেলাম। অন্যদিকে আমার আব্বা এবং দুই ভাই আগ্রার রাজদরবারে অধিকতর উঁচু পদে নিয়োগ পান। তখন আমাদের সুখ ও সমৃদ্ধির অন্ত ছিল না। মোগল হেরেমে আমাকে অন্যান্য রাজকুমারীর সঙ্গে রেখে সোহবত সেখানো হতো।
আরবি ও ফার্সি সাহিত্য, ইতিহাস ও ঐতিহ্য আমাদের পড়ানো হতো। যুদ্ধবিদ্যা তথা সামরিক বিষয়াদিও শেখানো হতো। অশ্ব চালনা, তীর ছোড়া, তলোয়ার চালানো এবং সৈন্য পরিচালনায় আমার দক্ষতা অন্যান্য রাজকুমারী তো দূরের কথা, রাজকুমারদের চেয়েও শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করল। সম্রাট আমার এই গুণাবলীর জন্য তার আপন কন্যাদের মতো স্নেহ করতেন। এ ছাড়া নৃত্য, গীত, ছবি অাঁকা, বাগানের ডিজাইন, পোশাক ও অলঙ্কারাদিতে আমার অনবদ্য ডিজাইনের সুখ্যাতি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছিল।
এভাবে আমি প্রায় তিন বছর রাজ অন্তঃপুরে থেকে অনেক কিছু শিখলাম এবং জানলাম। সবাই আমাকে আপনার ব্যাপারে সাবধান করত। বলত ভুলেও যেন আপনার সম্মুখে না পড়ি। আপনার মোহময় চোখের তীব্র আকর্ষণ নাকি কোনো মেয়েই উপেক্ষা করতে পারে না। এরই মধ্যে আনার কলির সঙ্গে আপনার বিয়োগান্ত ঘটনা, শাহানশাহের বিরুদ্ধে আপনার যুদ্ধ ঘোষণা, যুদ্ধে আপনার পরাজয়, সম্রাট কর্তৃক মৃত্যুদণ্ড প্রদান এবং সব শেষে ক্ষমার ঘটনা নিয়ে অন্তঃপুরে আলাপ-আলোচনা হতো।
মনে মনে আমার খুবই ইচ্ছা হতো, অন্তত দূর থেকে হলেও যেন আমি আপনাকে একবারের জন্য দেখতে পেতাম!অবশেষে আমি আপনাকে দেখলাম। নিজের সৌভাগ্যের কপাল পোড়ানোর জন্য দেখলাম। সে রাত ছিল নওরোজ অর্থাৎ নববর্ষের রাত। শাহী প্রাসাদের অন্তঃপুরে বসেছিল মিনা বাজার। আমার বয়স তখন সবে ১৬ থেকে ১৭-তে পড়েছিল।
শরীরে যৌবন এবং নারীত্বের চিহ্নগুলো ফুটে উঠেছিল অসাধারণ সৌন্দর্য নিয়ে। হাম্মাম খানায় ঢুকে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে বান্ধবীরা বিবস্ত্র হয়ে একে-অপরের সৌন্দর্য দেখতাম এবং নানা রকম রং রসের কথা বলতাম। বলতে বলতে আমরা নিজেরা নিজেরা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে পড়তাম। আমার সৌন্দর্যে সবাই মুগ্ধ হতো, প্রশংসা করত এবং ঈর্ষাও করত। এসব আমার ভীষণ ভালো লাগত।
যৌবনের চঞ্চলতায় আমরা মাঝে-মধ্যে দেওয়ানি খাস-এর অন্তঃপুর থেকে একটু বের হতে চাইতাম। কিন্তু খোজা প্রহরীরা কখনো আমাদের সেই সুযোগ দিত না। সে রাতের নওরোজের মিলনমেলায় আপনি এলেন। শাহী নহবত বেজে উঠল। নকীব হুঙ্কার তুলে আপনার আগমনবার্তা ঘোষণা করল।
সম্রাজ্ঞী যোধা বাইয়ের নেতৃত্বে রাজ অন্তঃপুরের রাজকুমারী ও অভিজাত মহিলাদের সঙ্গে লাইনে দাঁড়িয়ে আমিও দুরু দুরু বুকে আপনার আগমনের প্রতীক্ষায় রইলাম। আপনি এগুচ্ছিলেন আর মেয়েরা আহ্লান ওয়া সাহ্লান বলে আপনাকে স্বাগতম জানাচ্ছিলেন। মাঝে-মধ্যে আপনার মাথার ওপর ফুল ছিটাচ্ছিল। আপনি বিষণ্ন মনে এগুনোর সময় রাজকুমারীদের বিভিন্ন উপহার দিচ্ছিলেন। কিন্তু যখন আমার সামনে এলেন তখনই ঘটল বিপত্তি।
আপনি হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলেন এবং নিজের বহু মূল্যবান পান্নার হারটি নিজ হাতে আমার গলায় পরিয়ে দিলেন। আপনি আমার নাম, পিতার নাম জানতে চাইলেন। আবেগ, ভয় আর শিহরণের আতিশয্যে আমি সংজ্ঞা হারালাম। এ খবর সঙ্গে সঙ্গে শাহানশাহে আকবরের দরবারে পেঁৗছানো হলো। আমাকে সে রাতেই ফতেপুর সিক্রির রাজপ্রাসাদ থেকে লাহোর রাজপ্রাসাদের উদ্দেশে পাঠানো হলো।
সম্রাটের হুকুমে ১৫৯৪ সালে মাত্র ১৭ বছর বয়সে আলীকুলি খাঁ ওরফে শের আফগানের সঙ্গে আমার বিয়ে দেওয়া হয়। শের আফগানের সরকারি বাসভবনে আমাদের বাসর সাজানো হয়। বাসর ঘরে নববধূর দায়িত্ব ও কর্তব্য সম্পর্কে আমার পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠ মহিলারা আমাকে যথাসম্ভব শিখিয়েছিলেন। প্রথম বাসরে স্বামীর সংস্পর্শে কি কি অসুবিধা হতে পারে তাও আমাকে শেখানো হয়েছিল। মোগল হেরেমে বেড়ে ওঠা অন্যান্য রাজকুমারীর মতো আমিও জীবনে বাবা, ভাই, সম্রাট এবং যুবরাজের সম্মুখে দাঁড়ানো ব্যতিরেকে অন্য কোনো পুরুষকে দেখা বা কথা বলার সুযোগ পাইনি।
বিশেষত বয়স ১০ বছর পূর্ণ হওয়ার পর। কাজেই বাসর ঘরে আমি গালিচার ওপর প্রস্তুত বাসর শয্যায় বসে থর থর করে কাঁপছিলাম। কিছুক্ষণ পর শের আফগান ঢুকলেন। আমি ভয়ার্ত চোখে তার দিকে তাকালাম। প্রায় ৭ ফুট উচ্চতার পেটানো বলিষ্ঠ শরীরের দুর্ধর্ষ সৈনিক তিনি।
খালি হাতে বাঘের সঙ্গে লড়ে একাধিক বাঘ হত্যার বীরত্বপূর্ণ ইতিহাস রয়েছে তার। গম্ভীর মুখে তিনি কামরায় ঢুকে তিনি আমাকে দাঁড়ানোর নির্দেশ দিলেন। আমি দাঁড়ালাম এবং মাথা নুইয়ে কুর্নিশ করলাম। তিনি আমার সব পরিধেয় বস্ত্র এবং অলঙ্কার খুলে তার সামনে দাঁড়ানোর হুকুম দিলেন। আমি তাই করলাম।
একটু পর তিনিও উদোম হলেন। এত বিশাল আকৃতির একজন সিংহপুরুষ আমার সামনে উদোম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে_ আমি ভাবতেই পারছিলাম না। আমার মাথায় চক্কর দিচ্ছিল এবং শরীর বেয়ে ঘাম ঝরছিল। শের আফগানের সংস্পর্শে আমি সঙ্গে সঙ্গে জ্ঞান হারালাম। আমার যখন জ্ঞান ফিরল তখন বোধ করি বেলা দ্বিপ্রহর।
শিয়রে আম্মাজানসহ পরিবারের নিকটাত্দীয় মহিলারা উৎকণ্ঠিত হয়ে দাঁড়িয়ে আছেন। বৃদ্ধশাহী হেকিম ও তার স্ত্রীও উপস্থিত। ব্যথায় সারা শরীর নাড়াতে পারছিলাম না। আমার বিশেষ স্থানে প্রচুর রক্তপাত হওয়ার পর আমার সারা শরীর ফুলে উঠেছে। সবাই ধারণা করছিল আমি বোধ হয় মরে গেছি।
কিন্তু আমি মরিনি। বোধ হয় আজকের এই রাতটির জন্যই বেঁচে ছিলাম। বাসর রাতের দুঃসহ স্মৃতি ধারণ করে আমি প্রায় দুই মাস শয্যাশায়ী অবস্থায় অসুস্থ দিন কাটালাম। এর মধ্যে শের আফগান কায়বার আমাকে দেখতে এলেন। মনে হলো তিনি অনুতপ্ত।
এর কয়েক দিন পরই শাহানশাহ আকবরের দরবার থেকে শের আফগানের বদলির নির্দেশ এলো। নতুন কর্মস্থান সুবে বাংলার বর্ধমান। ১৬০৫ সালে তাকে বর্ধমানের জায়গিরদার করা হলো। আমরা সপরিবারে লাহোর থেকে বর্ধমান গেলাম। সম্পূর্ণ অজানা এবং নতুন একটি পরিবেশে আমি গেলাম।
পিতা-মাতা-ভাই সবাই আবার আগ্রার রাজদরবারে আরও উঁচু পদে নিয়োগ পেলেন। বর্ধমানে আমরা ছিলাম দুই বছর। এই সময়ের প্রতিটি রাতই আমার কাছে আসত এক ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্ন হিসেবে। আমি গর্ভবতী হয়ে পড়লাম এবং একটি কন্যাসন্তানের জন্ম দিলাম। শের আফগান আদর করে আমারই নামে তার নাম রাখলেন মেহেরুন নিসা।
শের আফগানের বীভৎস যৌন নিপীড়ন থেকে বাঁচার জন্য আমি দিন-রাত চিন্তা করতাম। তাকে আমি আরও বিয়ে করার জন্য প্ররোচিত করলাম। কিন্তু সে রাজি হলো না। আমাকে ঘিরে তার ভালোবাসা ছিল অকৃত্রিম। কিন্তু তার চাহিদা পূরণের কোনো ক্ষমতাই আমার ছিল না।
আমি কাবুল থেকে বেশ কয়েকজন বিশাল দেহের সুন্দরী বাঁদী আনালাম। কিন্তু শের আফগান তাদের কাউকে শয্যাসঙ্গী হিসেবে গ্রহণ করল না। তার সব আগ্রহ কেবল আমাকে ঘিরেই। আমি শারীরিক ও মানসিকভাবে দিনকে দিন অসুস্থ হয়ে পড়ছিলাম। প্রতি রাতের বেদনা ও দুঃসহ স্মৃতি ভুলে থাকার জন্য আমি সন্ধ্যা হলেই আফিম খাওয়া শুরু করলাম।
শের আফগান প্রতি রাতে এক আফিমখোর তন্দ্রাচ্ছন্ন রমণীর সঙ্গে রাত কাটাত। এভাবে রাতের ঘটনা আমার মনে থাকত না বটে, কিন্তু সারা শরীরের তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করতাম সব সময়। এরই মধ্যে কি মনে করে আমি আপনাকে চিঠি লিখলাম সম্ভবত ১৬০৭ সালে। আমি লিখেছিলাম আমার দুর্বিষহ দিনলিপির কথা। অভিযোগ করেছিলাম আপনাকে।
বলেছিলাম, সেই নওরোজের রাতে আপনার দৃষ্টি যদি আমার ওপর না পড়ত তাহলে সদাশয় মহান বাদশাহ আকবর হয়তো আমাকে তড়িঘড়ি বিয়ে দিতেন না। আর আমাকেও অভিশপ্ত জীবনের ঘানি টানতে হতো না। চিঠিটি হয়তো আপনাকে ভীষণভাবে আহত করেছিল। আপনি সুবেবাংলার গভর্নর কুতুবউদ্দীন খান কোকাকে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের নির্দেশ দিলেন। সেমতে রাজকীয় সেনাবাহিনী কুতুবউদ্দিন কোকার নেতৃত্বে ১৬০৭ সালের ৩০ মে বর্ধমান উপস্থিত হয়।
আমাদের প্রাসাদে শের আফগানের কাছে আপনার গ্রেফতারি পরোয়ানা দেখানো হয়। শের আফগান বিষয়টি খুব শান্তভাবে গ্রহণ করেন। আমার কাছে এসে খুব স্বাভাবিকভাবে বিদায় নেন। কন্যাকে কোলে তুলে আদর করেন। এর পর নিরস্ত্র অবস্থায় কুতুবউদ্দিন কোকার শিবিরে যান।
সুবেবাংলার গভর্নরের তাঁবুতে ঢোকার সঙ্গে সঙ্গে কি মনে করে শের আফগান হঠাৎ করেই তাকে আক্রমণ করে বসেন এবং মারাত্দকভাবে আহত করেন। ফলে কুতুবউদ্দিন ঘটনাস্থলেই মারা যান। অন্যদিকে শাহী রক্ষীরা একসঙ্গে আক্রমণ চালিয়ে শের আফগানকে মেরে ফেলে। মৃত্যুর আগে শের আফগান গগনবিদারী আওয়াজ তুলে কেবলই বলছিল, 'হামারি মেহেরুন নিসা! হামারি মেহেরুন নিসা!' এর পর আমাকে আমার কন্যাসহ আগ্রায় আনা হয়। আমার স্থান হয় আপনার সৎ মা সুলতানা বেগমের প্রাসাদে।
আমি তখন সম্পূর্ণ অসুস্থ শারীরিক ও মানসিকভাবে। আপনার হুকুমে দেশি-বিদেশি শাহী চিকিৎসকরা আমার চিকিৎসা করতে থাকেন প্রায় চার বছর ধরে। এরই মধ্যে আমার অনুরোধে আপনি একটিবারও আমাকে দেখতে আসেননি। আমার চেহারা তখন খুবই খারাপ হয়ে গিয়েছিল। কাজেই এই চেহারা আপনাকে দেখিয়ে কষ্ট দেওয়া বা পাওয়ার কোনো অভিলাষই আমার ছিল না।
অবশেষে দীর্ঘ চিকিৎসার পর আমি সুস্থ হয়ে উঠি। একদিন আপনার একটি ছবি দেখার পর আমার হৃদয় মন পুলকিত হয়ে ওঠে। রাতে যখন আপনার ছবিটি নিয়ে শয়নকক্ষে গেলাম এবং মনে মনে আপনার কথা কল্পনা করলাম তখন শরীর বেশ উত্তেজিত হয়ে উঠল। আমি অনুভব করলাম, আমি সুস্থ হয়ে উঠেছি। আমি আপনাকে জানালাম_ বিয়ের জন্য আমি প্রস্তুত।
সম্রাজ্ঞী মেহেরুন নিসা যখন তার কাহিনী বলতে ছিলেন তখন দুর্গে শেষ প্রহরের ঘণ্টা বেড়ে উঠল। শাহী মসজিদ থেকে আজানের ধ্বনি ভেসে আসল। সম্রাট জাহাঙ্গীর তার প্রিয়তমা পত্নীর কাছে আরও ঘটনা শোনার জন্য আবদার করলেন। সম্রাজ্ঞী মুচকি হেসে সম্রাটের কাছে অনুমতি চাইলেন পরবর্তী রাতে বাকি ঘটনা বর্ণনা করার। আবেদন মঞ্জুর হলো।
মোঘল হেরেমের দুনিয়া কাঁপানো প্রেম ( ২য় পর্ব)
নূরজাহানের তখনকার নাম ছিল মেহেরুন নিসা। ১৬১১ সালের ২৬ মে ছিল বিয়ের দ্বিতীয় দিন। সম্রাট জাহাঙ্গীর বলতে গেলে সারা রাত ঘুমাননি। নূরজাহানের জীবনকর্ম তাকে প্রবলভাবে আকর্ষণ করেছিল। ফলে কোনো ক্লান্তিই তাকে স্পর্শ করেনি।
বাসরশয্যা থেকে বের হয়ে আসেন সূর্য ওঠার আগেই। এটিই ছিল হেরেমের রীতি। নিজের খাস কামরায় ঢুকতে ঢুকতে তিনি ভাবলেন_ এত বড় কামনাহীন সংযমী পুরুষ তিনি হলেন কী করে! এই প্রথম এক রমণী সারা রাত তার সামনে বসে ছিল। কিন্তু তার চেতনা কেবল অনুসরণ করছিল রমণীর বক্তব্যকে। তার শরীর বা মন একবারও যৌনাতুর হয়ে রমণীর পানে ধাবিত হয়নি।
নারীর যে সব অঙ্গের প্রতি পুরুষের দুর্বার আকর্ষণ থাকে সেগুলোর দিকে একবারের জন্যও ভ্রূক্ষেপ ছিল না সম্রাটের_ এমন কেন হলো? ভাবতে ভাবতে সম্রাট খাস কামরার সঙ্গে লাগোয়া হাম্মামখানায় ঢুকলেন। মোগল রীতি অনুযায়ী হাম্মামে শুধু গোসল করার বিধান ছিল। অন্যান্য প্রাকৃতিক কর্মের জন্য ভিন্ন স্থানে ভিন্ন ভিন্ন ব্যবস্থা ছিল।
বাসর-পরবর্তী হাম্মামে গোসলের জন্য সম্রাট একাই উপস্থিত ছিলেন। অন্যান্য দিনে সম্রাটের গোসল পর্বটিও একটি আনুষ্ঠানিকতার মাধ্যমে সম্পন্ন হয়।
সম্রাট প্রথমে হাম্মামের নির্ধারিত পানির চৌবাচ্চাটিতে নামেন, যা আগে থেকেই তার জন্য নানারকম সুগন্ধি দিয়ে প্রস্তুত রাখা হয়। হাম্মামের পানির তাপমাত্রাও নিয়ন্ত্র্রণ করা হতো তার রুচিমাফিক। সম্রাট জাহাঙ্গীর সাধারণত হালকা উষ্ণ পানিতে গোসল সারতেন। সম্রাটের প্রিয় কয়েকজন উজির-সেনাপতি উপস্থিত থাকতেন গোসলের সময়। সম্রাট ইচ্ছা পোষণ করলে তাদের মধ্যে দুই-একজন অনুমতি পেত সম্রাটের সঙ্গে চৌবাচ্চাটিতে নেমে একসঙ্গে গোসল সম্পন্ন করার জন্য।
আমন্ত্রিত রাজপুরুষের জন্য এ ছিল এক বিরল সম্মান। সম্রাটের ইচ্ছায় সেদিন কেউ উপস্থিত ছিল না। একান্ত খোঁজা প্রহরী, কয়েকজন বিশ্বস্ত গোলাম ও বাদীকে নিয়ে খুব তাড়াহুড়া করে গোসল সারলেন।
প্রথা অনুযায়ী সকালের নাস্তা পর্বটিও সম্রাট তার রাজ দরবারের পাত্র-মিত্রদের সঙ্গে করতেন। এখানে বসেই দিনের কর্মপরিধি নির্ধারিত হতো।
কখনো কখনো রাষ্ট্রদূতরা সম্রাটের সঙ্গে প্রাতরাশ সভায় উপস্থিত থাকতেন। প্রায় ১০০ বছরের মোগল ঐতিহ্য ভেঙে হঠাৎ করেই সম্রাট ইচ্ছা পোষণ করলেন সম্রাজ্ঞী মেহেরুন নিসাকে প্রাতরাশ সভায় উপস্থিত করানোর জন্য। তিনি এলেন। অপরূপ রূপের ঝলকানিতে সমগ্র হলঘরটি আলোকিত করার জন্য। সম্রাট জীবনে দিনের আলোতে তার প্রিয়তমা পত্নীকে দেখেননি কখনো, সেই কবে একবার দেখা হয়েছিল মিনাবাজারে যখন আলীকুলি খাঁর সঙ্গে তার বিয়ে পর্যন্ত হয়নি।
এরপর গত চার বছরে বাসরঘরের স্মৃতিছাড়া কেবল একবার দেখেছিলেন তাও আবার দূর থেকে। তিনি জানতেন তার নবপরিণীতা স্ত্রী অসাধারণ মেধাবী, দুর্দান্ত সাহসী, আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত। তাবৎ দুনিয়ার রাজনীতির খবর যেমনি জানেন, তেমনি প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের স্থাপত্যকলা, পোশাকের ডিজাইন, বাগান স্থাপন এবং সর্বোপরি যুদ্ধবিদ্যায় বিশেষজ্ঞ। সেদিনের প্রাতরাশে সম্রাজ্ঞীর আমন্ত্রণের মূল উদ্দেশ্য ছিল কিন্তু রাজনৈতিক।
সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে বাংলা প্রদেশ প্রবলভাবে অশান্ত হয়ে ওঠে।
বিশেষত বর্তমান বাংলাদেশে তখন বারভঁূইয়া বা বারোজন প্রভাবশালী জমিদারের প্রচণ্ড দাপট। বাংলা বিখ্যাত বারভূঁইয়াদের নেতা ঈসা খাঁর মৃত্যুর পর তার সুযোগ্য ছেলে মুসা খানের নেতৃত্বে জমিদাররা মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে প্রবল প্রতিরোধ গড়ে তোলেন। ওই আন্দোলনের অগি্নঝরা দিনগুলোতে মেহেরুন নিসা ছিলেন বর্ধমানে, সেখানকার শাসক আলীকুলি খাঁর স্ত্রী হিসেবে। সুবে বাংলার রাজধানী তখন রাজমহলে। সম্রাট তার অতি প্রিয়ভাজন কুতুবউদ্দিন খান কোকাকে ১৬০৬ সালে সুবে বাংলার গভর্নর করে পাঠান।
কোকা ছিলেন সম্রাটের আবাল্য প্রিয় বন্ধু, বিশ্বস্ত সহচর এবং যুদ্ধের ময়দানে পরীক্ষিত সেনাপতি। সম্রাট যখন তার পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করেছিলেন তার জীবনের স্বপ্নের নায়িকা আনারকলির মৃত্যুর পর তখন হাতেগোনা অল্প কয়েকজন সেনাপতি তাকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছিলেন। কোকা ছিলেন তাদের অন্যতম। এ ছাড়া কোকার মা ছিলেন সম্রাটের দুধ মা এবং পরম শ্রদ্ধার পাত্র। এ সম্পর্কে সম্রাট তার আত্দজীবনী তুযুকে জাহাঙ্গীরীতে লেখেন_ কোকার মা ছিলেন আমার দুধ মা।
আমি স্পষ্ট বুঝতে পারতাম যে আমার দুধ মা আমাকে আমার নিজের মায়ের চেয়েও বেশি ভালোবাসেন। তার মৃত্যুতে আমি যেন বজ্রাহতের মতো আঘাতপ্রাপ্ত হই। তার লাশ অন্যদের সঙ্গে কাঁধে বহন করে কবরস্থানে নিয়ে যাই। পরম শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার কারণে দুধ মায়ের পা দুটি আমার কাঁধে নিয়ে শবযাত্রা শুরু করি। তার লাশ কবর দেওয়ার পর মনে হলো আমি বোধহয় বেঁচে নেই, কিংবা আমার আর বেঁচে থাকার দরকার নেই।
প্রচণ্ড বেদনায় আমি কয়েক দিন খাইনি। এ সময় আমি আমার দৈনন্দিন পোশাকও পরিবর্তন করিনি।
বাংলার পরিবেশ অশান্ত হয়ে উঠলে সম্রাট তার বাল্যবন্ধু ও বিশ্বস্ত সহচর কুতুবউদ্দিন কোকাকে গভর্নর নিয়োগ করেন। কোকা সবকিছু গুছিয়ে ওঠার আগেই মেহেরুন নিসার স্বামী বর্ধর্মানের শাসক আলীকুলি খাঁ ওরফে শের আফগান বিদ্রোহী হয়ে ওঠেন। সম্রাটের নির্দেশে কোকা সেই বিদ্রোহ দমন করতে গিয়ে নিজেই শের আফগানের হাতে নির্মমভাবে খুন হন।
আগ্রার রাজপ্রাসাদে যখন কোকার মৃত্যু সংবাদ পেঁৗছল, তখন প্রায় মধ্যরাত। কোকার সঙ্গে সম্রাটের ব্যক্তিগত সম্পর্কের কারণে প্রহরীরা অনেকক্ষণ ধরে সিদ্ধান্ত নিতে পারল না, এত রাতে দুঃসংবাদ বহনকারী দূতকে প্রাসাদে ঢুকতে দেবে কিনা এবং তারা দিলও না। কিন্তু দূত করে বসল এক দুঃসাহসী কর্ম। সম্রাট জাহাঙ্গীর ক্ষমতায় আরোহণ করার পর তার খাসকামরা, দরবার এমনকি জেনানা মহলের নাচঘরটিতে বসিয়েছিলেন একটি করে ঘণ্টা। উদ্দেশ্য জনসেবা।
সম্রাট মনে করলেন, তার দরবারের আমলাতান্ত্রিক জটিলতা কিংবা রাজপ্রহরীদের কড়াকড়ির কারণে কোনো নির্যাতিত মজলুম ব্যক্তি সর্বমহলের কাছ থেকে হতাশ হয়ে সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাইতে পারেন। ন্যায়বিচারের স্বার্থে যিনি সম্রাটের কাছে আসতে চাচ্ছেন কিন্তু পারছেন না। এ ধরনের লোকদের জন্য তিনি তার অবস্থানের স্থানগুলোতে কয়েকটি ঘণ্টা স্থাপন করলেন। এসব ঘণ্টার সঙ্গে রশি বেঁধে রশিটির অপর প্রান্ত দুর্গের বাইরে স্থাপন করলেন। এর পর নকীবের মাধ্যমে রাজ্যময় ঘোষণা করে দিলেন যে কোনো ব্যক্তি রাত-দিনের যে কোনো সময় রশিটি টান দিয়ে সম্রাটের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারবেন।
ঘণ্টাগুলো স্থাপিত হওয়ার পর কয়েকবার এতে টান পড়েছে। কিন্তু সবই দিনের বেলায়। কার্যকালীন সময়ে। এই প্রথম মধ্যরাতে কোকার মৃত্যু সংবাদ বহনকারী দূত রাজপ্রহরীদের বাধায় হতাশ হয়ে দুর্গের বাইরে চলে এলেন এবং রশিটিতে টান দিলেন।
মধ্যরাতে সম্রাটের ঘণ্টায় টান পড়ার সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র ফতেপুর সিক্রি নগরী জেগে উঠল।
মূল রাজপ্রাসাদ এবং এর আশপাশের এলাকা পাহারা দিত প্রায় এক লাখ সৈন্য। তিনটি সিফটে ৩০ হাজার করে সেনা অস্ত্রসহ টহল দিত। এর মধ্যে পাঁচ হাজার ছিল অশ্বারোহী, এক হাজার গোলন্দাজ, পাঁচ হাজার তীরন্দাজ এবং বাকি সব পদাতিক। প্রায় সবাই প্রচলিত অস্ত্রের পাশাপাশি বন্দুক বা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করত। সম্রাটের ঘণ্টায় টান পড়ার সঙ্গে সঙ্গে মূল ঘণ্টাটি বিকট শব্দে বেজে উঠল।
গোলন্দাজ বাহিনী দুর্গের মূল ঘণ্টার শব্দের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পরপর সাতবার কামান দাগল। অর্থ আমরাও সতর্কভাবে জেগে আছি। ৫০০ সৈন্যের একটি চৌকস অশ্বারোহীর দল বের হয়ে এলো দুর্গের বাইরে। কোকার মৃত্যুর সংবাদ বহনকারী দূতকে নিয়ে যাওয়া হলো সম্রাটের সামনে।
সোর্স: http://www.bd-pratidin.com/
দেখা হয়েছে ৫৮ বার
বুকমার্ক হয়েছে ১ বার