১. প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দাঁড়িয়ে গেলেন।
বিরোধীদলীয় নেতা বেগম খালেদা জিয়া নীরব কেন- এ প্রশ্ন আত্দসম্মানবোধসম্পন্ন মুক্তিযুদ্ধের বীরত্বের গৌরবগাথা স্বাধীন বাংলাদেশের জনগণের সামনে দেখা দিয়েছে। বলছিলাম যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতা কাদের মোল্লার ফাঁসির রায় কার্যকর হওয়ার পর পাকিস্তানের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী নিসার আলী খানের বিবৃতি, জাতীয় পরিষদে নিন্দা প্রস্তাব এমনকি একসময়ের ক্রিকেট কিংবদন্তি ইমরান খানের মন্তব্যে দেশজুড়ে প্রতিবাদের ঝড় উঠলেও প্রধান বিরোধী দল বিএনপি একদম চুপচাপ। একটি স্বাধীন দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে '৭১-এর পরাজিত পাকিস্তান যেভাবে হস্তক্ষেপ করেছে তাতে দুনিয়াকে জানিয়ে দিয়েছে এখনো তারা পরাজয়ের গ্লানিতে ভুগছে। পরাজয়ের বেদনা ও গ্লানি কতটা দীর্ঘস্থায়ী হতে পারে ৪২ বছর পর পাকিস্তান দেখিয়ে দিয়েছে।২. নিউইয়র্কে ভারতীয় কূটনীতিক দেবযানীকে পুলিশ গ্রেফতার করে যেভাবে বিবস্ত্র করে তল্লাশি চালিয়েছে, মাদকাসক্ত ও যৌনকর্মীদের সঙ্গে আটক করে রেখেছে সেই অপমান মহাত্দা গান্ধীর মহান গণতান্ত্রিক ভারতের জনগণ মানতে পারেনি। তাদের আত্দসম্মানবোধ থেকে তারা নয়া দিলি্লর মার্কিন দূতাবাসের কূটনীতিকদের জন্য অর্পিত সব সুযোগ-সুবিধা প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তারা বিমানবন্দরের বিশেষ পাস প্রত্যাহার করেছে, আমদানি ছাড়পত্র স্থগিত করেছে। মার্কিন দূতাবাসের বাইরের ব্যারিকেড বুলডোজার দিয়ে তুলে নিয়েছে।
ভারতে অবস্থিত মার্কিন বিদ্যালয়গুলোয় কর্মরত শিক্ষকদের ভিসা ও অন্যান্য তথ্য সরবরাহ করতে বলেছে সরকার। তাদের কূটনীতিক দেবযানীকে জাতিসংঘে ভারতের স্থায়ী মিশনে নিয়োগ দিয়েছে। অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে লোকসভা ও রাজ্যসভায় সব দলের প্রতিনিধিরা অভিন্ন কণ্ঠে দাবি জানিয়েছেন। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দেবযানীকে সসম্মানে ভারতে ফিরিয়ে না আনা পর্যন্ত পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ পার্লামেন্টে যাবেন না বলে রাজ্যসভায় ঘোষণা দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং একে শোচনীয় ঘটনা বলে নিন্দা জানিয়েছেন।
যে কংগ্রেস জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিজেপি ঘোষিত প্রধানমন্ত্রী প্রার্থী নরেন্দ্র মোদিকে দুনিয়ানিন্দিত হিটলার বলে সম্বোধন করেছে সেই মোদিও ভারত সরকারের পাশে দাঁড়াতে ভোলেননি। গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় ভারতের রাজনীতিতেও নানা মত-পথের নেতারা পরস্পরকে ঘায়েল করতে বিভিন্ন কৌশল নিয়ে থাকেন। কঠোর ভাষা প্রয়োগ করেন বক্তৃতার মঞ্চে। কিন্তু যখন কারগিল যুদ্ধ শুরু হয়েছিল সোনিয়া, বাজপেয়ি পাশাপাশি বসতে ভুল করেননি। এবারও একজন কূটনীতিকের হেনস্তার ঘটনায় ভারতের রাজনৈতিক শক্তি অভ্যন্তরীণ বিভেদ চরমে থাকলেও এক মোহনায় দাঁড়িয়ে কথা বলেছে।
বিএনপি আকস্মিকভাবে দুই দিন আগে বলেছে, ভবিষ্যতে তারা ক্ষমতায় এলে বাংলাদেশের মাটি কাউকে ভারতের বিরুদ্ধে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। অতীতে বিএনপি শাসনামলে ব্যবহার করতে দেওয়া হয়েছিল বলেই এ ঘোষণা বারবার দিতে হচ্ছে। দুঃখজনক ঘটনা যে ক্ষমতার জন্য যত কৌশল তা একটি দল নিতেই পারে। কিন্তু দেশের অস্তিত্বের ওপর যখন রাষ্ট্রীয় ও কূটনৈতিক শিষ্টাচারবহিভর্ূত আঘাত আসে তখন সব মত-পথ ভুলে গিয়ে জাতীয়তাবাদী শক্তিকে এক কাতারে দাঁড়াতে হয়। পাকিস্তান পার্লামেন্ট ও তাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের এই নগ্ন ভূমিকার বিপরীতে বিএনপি সরকারের পাশে দাঁড়াতে পারেনি।
এটি দুঃখজনক। এটি বেদনার। যে বিএনপি বড় গলায় স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব রক্ষার কথা চিৎকার দিয়ে বলে সেই বিএনপি এখানেও জাতীয়তাবাদী ট্রেনে উঠতে পারল না, বোমার মতো যেন স্টেশনে বাদামের ঠোঙ্গা হাতে দাঁড়িয়ে থাকল। এখনো সময় আছে বিএনপি নেতৃত্ব এ ব্যাপারে দল ও নেত্রীর অবস্থান খোলাসা করতে পারেন। স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের প্রতি আনুগত্য এবং জাতীয়তাবোধ লালন বক্তৃতার বিষয় নয়, এটি পরীক্ষার বিষয়।
পরীক্ষার সময়সীমাও চলে যাচ্ছে। বিএনপি নেতৃত্বকে বুঝতেই হবে। ইতিহাসনিন্দিত জামায়াতের জন্য রাজনীতিতে হিসাব কষবে নাকি জনগণের মনের ভাষাকেই লালন করবে।
৩. কূটনীতিক দেবযানী ইস্যুতে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী সালমান খুরশিদ পরিষ্কার বলেছেন, 'বিষয়টি এখন আর ব্যক্তি পর্যায়ে সীমাবদ্ধ নেই। এটি একটি জাতি হিসেবে আত্দমর্যাদাবোধ এবং বিশ্বে আমাদের অবস্থানের ব্যাপার।
' মনোভাব দেখে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি ভারতের নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেননকে টেলিফোন করে এ ঘটনার জন্য দুঃখ প্রকাশ করেছেন। এমনকি তিনি আশা করেছেন ভারতের সঙ্গে মার্কিন সম্পর্কের উষ্ণতা বহাল থাকবে। সম্পর্কের কোনো টানাপড়েন হবে না। পর্যবেক্ষকরাও মনে করেন এতে দুই দেশের সম্পর্ক শীতল হবে না। জন কেরি মেননকে জানিয়েছেন দেবযানীর বয়সতুল্য তার দুটি কন্যাও রয়েছে।
ভারতের সংসদের উচ্চকক্ষে ভারতীয় জনতা পার্টির নেতা অরুণ জেটলি বলেছেন, 'ভারতের উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় সম্পর্ককে আরও গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের মতো একই ধরনের আচরণ করা। ' তিনি দেবযানীর ঘটনাকে জেনেভা কনভেনশনের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেন। ভারতের বহুজন সমাজবাদী পার্টির নেতা মায়াবতী বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীর প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকরা ভারতে পদার্পণ করলে তাদের অনেক সম্মান দেখানো হয়। এ বিষয়টি এখন ভেবে দেখা দরকার।
এমনকি ভারতের একটি ডানপন্থি বিরোধী দলের সমর্থকরা দিলি্লর মার্কিন দূতাবাসের সামনে বিক্ষোভ করে যুক্তরাষ্ট্রকে ক্ষমা চাওয়ার দাবি তুলেছে। বলেছে, অন্যথায় তাদের নিরাপত্তা দেওয়া হবে না। যুক্তরাষ্ট্রের একটি সফররত প্রতিনিধি দলের সঙ্গে ভারত সরকার বা কংগ্রেস ও বিজেপি নেতৃত্বের কেউ দেখা পর্যন্ত করেননি। '৭১ সালে পাকিস্তান হানাদার বাহিনী যেভাবে হত্যা, ধর্ষণ, লুটপাট চালিয়েছে তার জন্য আমাদের সরকার ও বিরোধী দল, সিভিল সোসাইটি সবাইকে এক কাতারে দাঁড়িয়ে যেমন ক্ষমা চাইতে বলা উচিত তেমনি আজকের ঘটনার জন্য পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে কৈফিয়ত চাওয়া উচিত। সরকার ও বিরোধী দল মিলে কড়া ভাষায় নিন্দা জানিয়ে পাকিস্তানকে ক্ষমা চাইতে বলা উচিত।
'৭১ সালে আমাদের সুমহান মুক্তিযুদ্ধে ভারত ও তার নেত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী যেভাবে পাশে দাঁড়িয়েছিলেন সেভাবে কেউ পাশে দাঁড়ায়নি। সেদিন সোভিয়েত ইউনিয়ন পাশে ছিল। বিশ্ববিবেক ছিল গণহত্যার বিপক্ষে। পাশে ছিল যুক্তরাজ্য। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথের ভূমিকা স্মরণীয়।
সেদিনের লন্ডন ছিল মুক্তিকামী বাঙালির পক্ষে বিশ্বজনমত গড়ে তোলার তীর্থস্থান। পরাক্রমশালী পশ্চিমা দেশই নয়, চীন ও মধ্যপ্রাচ্য পাকিস্তানের প্রতিই ছিল সহানুভূতিশীল। মুক্তিযুদ্ধের মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হত্যাকাণ্ডের পর অনেক দেশ আমাদের স্বীকৃতি দিয়েছে। সেই ঘোর অন্ধকার সময়ে বাঙালির ইস্পাতকঠিন বীরত্বের ঐক্য সব ষড়যন্ত্র, আক্রমণ মোকাবিলা করে যুদ্ধজয়ী হয়েছিল। আজকের বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে গভীর দেশপ্রেমের কোনো ঘাটতি নেই।
রাজনৈতিক অনৈক্য সেই ইস্পাতকঠিন ঐক্য গড়ে তোলার অন্তরায়। বিজয়ের এই মাসে পাকিস্তান নামক রাষ্ট্রের এ অশোভনীয় নিন্দনীয় ভূমিকার বিরুদ্ধে সবাইকেই দাঁড়াতে হবে। সরকারের পাশে বিএনপিকেও রাজনীতির নানা মত-পথ ভুলে পাকিস্তান ইস্যুতে দাঁড়াতে হবে। রাজনীতির মত-পথ যার যার। দেশ ও মাটি সবার।
এ মাটি লাখো শহীদের রক্তে কেনা পবিত্র মাটি। এ মাটির প্রতি অসম্মান আমরা সইতে পারি না।
৪. আমাদের মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের পর পর বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরী ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলেক ডগলাস হিউমকে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছিলেন। উত্তরে ডগলাস বলেছিলেন, আমাদের কিছুটা সময় দিন। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জুলফিকার আলী ভুট্টোর সঙ্গে একটু আলাপ করে নিই।
আত্দমর্যাদাশীল জাতির সন্তান আবু সাঈদ চৌধুরী পাল্টা বলেছিলেন, আপনারা আমাদের বিপদে সাহায্য করেছেন। আমরা কৃতজ্ঞ। ভাববার জন্য সময় চাইলে সময় নিন। কিন্তু ভুট্টোর সঙ্গে আলাপ করে স্বীকৃতি দিতে চাইলে সেই স্বীকৃতির প্রয়োজনীয়তা বাংলাদেশের মানুষ অনুভব করে না। সদ্য স্বাধীন দেশের নেতা বঙ্গবন্ধু বাহরাইন সফরকালে পায়ের ওপর পা তুলে, সেই চিরচেনা পাইপে এরিন মোরের ধোঁয়া ছেড়ে বলেছিলেন, কোনো আরব বন্ধু আমাদের স্বীকৃতি দিল কি দিল না তা আমাদের কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়।
ফিলিস্তিনি স্বাধীনতা সংগ্রামী জনগণের প্রতি আমাদের সমর্থন রয়েছে, থাকবে। এটার সঙ্গে স্বীকৃতি জড়িত নয়। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্বের পূর্বসূরিদের অবদান ঐতিহ্য গৌরবের। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক, মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী ও জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের রাজনৈতিক উত্তরাধিকারিত্বের বাংলাদেশে আত্দমর্যাদা ও আত্দসম্মানবোধ উপেক্ষা করে জনগণের রাজনীতি করার সুযোগ নেই। এ কথাটি আজকের বিরোধী দলকে ভাবতে হবে।
'৭১-এর কলঙ্কের ঢোল জামায়াত-শিবিরকে গলা থেকে নামিয়ে বিএনপিকে দেশ ও জনগণের পাশে দাঁড়াতে হবে। পাশের ভারত যেখানে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে একজন কূটনীতিকের অসম্মান নিয়ে এক কাতারে দাঁড়াতে পারল সেখানে একটি দেশের বিরুদ্ধে পরাজিত পাকিস্তানের এই দম্ভ, ঔদ্ধত্যের বিরুদ্ধে আমরা কেন দাঁড়াতে পারব না? শেখ হাসিনা দাঁড়িয়েছেন, খালেদা জিয়া আপনিও দাঁড়ান।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।