সাধারণ মানুষের জমি প্লট বানিয়ে বেনামে বরাদ্দ নেওয়ার অভিযোগ পাওয়া গেছে সাবেক গৃহায়ন ও গণপূর্ত প্রতিমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খানের বিরুদ্ধে। পূর্ত মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে থাকার সময় প্রভাব খাটিয়ে তিনি এই কাজ করেছেন। অথচ ওই জমির মালিকানা নিয়ে উচ্চ আদালতে মামলা চলছে। জমির ওপর স্থগিতাদেশও জারি করেছেন আদালত। তারপরও সেখানে প্লট তৈরি করে বরাদ্দ দেওয়া হয়।
আর এর সবকিছু রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক) করেছে পূর্ত মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশানে মান্নান খানের বরাদ্দ নেওয়া প্লটটির আয়তন সাড়ে পাঁচ কাঠারও বেশি। বর্তমান বাজারমূল্য অন্তত ১৫ কোটি টাকা। তিনি গত ৩ আগস্ট রাজউক চেয়ারম্যানের কক্ষে কয়েক ঘণ্টা বসে থেকে নিজে হাতে ওই প্লটের বরাদ্দপত্র নেন। এর পর দ্রুততায় গত ৫ আগস্ট তেজগাঁও ভূমি অফিসে গিয়ে লিজ দলিলও সম্পন্ন করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক রাজউকের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা বলেন, 'কাগজ-কলমে আনোয়ার হোসেনের নাম ব্যবহার করা হলেও আড়ালে ওই প্লটটি নিয়েছেন মান্নান খান নিজেই। লিজ দলিলের পরদিনই মান্নান খানের লোকজন ওই প্লটে গিয়ে মালিকানাও জানান দিয়ে এসেছেন। ' লিজ দলিলে দেখা গেছে, প্লটের মালিক হিসেবে আনোয়ার হোসেনের ঠিকানা হলো, আনোয়ার হোসেন, পিতা মরহুম আবদুল করিম, গ্রাম-ভাটারচর, ডাক-নয়াবাদ, থানা-আড়াইহাজার ও জেলা-নারায়ণগঞ্জ। কিন্তু ওই ঠিকানায় আনোয়ার হোসেন নামের কাউকে পাওয়া যায়নি। তার পিতা হিসেবে মরহুম আবদুল করিম নামের কোনো ব্যক্তিরও সন্ধান দিতে পারেননি স্থানীয়রা।
জমি নিয়ে আদালতে মামলা পরিচালনাকারীদের একজন গুলশান ১৩০ নম্বর সড়কের ২৬ নম্বর বাড়ির বাসিন্দা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আনোয়ার হোসেনের নাম ব্যবহার করে মান্নান খান সাহেবই প্লটটি নিয়েছেন। এটা ওপেন সিক্রেট। পূর্বাচলে প্লট বরাদ্দের ক্ষেত্রেও এ ধরনের অনেক কাহিনী প্রতিমন্ত্রী থাকাকালে তিনি ঘটিয়েছেন। রাজউকের সম্পত্তি বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, 'রাজউকে এরকম অনেক ঘটনা আছে, যেখানে কাগজ-কলমে থাকা নামের আড়ালে রাঘোব বোয়ালরাই প্লটের মালিক। এ ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে।
' রাজউকের একজন জ্যেষ্ঠ প্রকৌশলী বলেন, 'রাষ্ট্রীয় ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে ১৩/এ ধারায় গত কয়েক বছরে অনেক প্লট দেওয়া হয়েছে। সে ক্ষেত্রেও সাবেক প্রতিমন্ত্রী এমন কাহিনী ঘটিয়েছেন। কাগজ-কলমে যদু-মধুর নাম ব্যবহার করে আড়ালে আরেকজন প্লট নিয়েছেন। এটিও সেই ঘটনারই একটি। '
সরেজমিনে ওই প্লটে গিয়ে দেখা যায়, গুলশান ১ নম্বর গোলচত্বর থেকে গুলশান ২ নম্বরের দিকে গুলশান এভিনিউ ধরে যেতেই বাঁ পাশে ৩২ নম্বর সড়ক।
সড়কটি গুলশান লেকের ধার পর্যন্ত সোজা চলে গেছে। লেকের পাড় ঘেঁষে ৩২ ও ৩৩ নম্বর সড়কের মধ্যে ৩২/এ নামের একটি সংযোগ সড়ক। এ সড়ক ঘেঁষেই তৈরি হয়েছে ১, ৩, ৫ ও ৭ নম্বর প্লট। একেবারে উত্তরে ৩৩ নম্বর সড়ক ঘেঁষে ১ নম্বর প্লটের অবস্থান। এর তিনদিকে সীমানাপ্রাচীর দেওয়া।
ভেতরে নানা ধরনের ছোট গাছপালা। এই প্লটটিই মান্নান খানের বলে জানান জাকির হোসেন নামের স্থানীয় এক বাসিন্দা। ভুক্তভোগী জমির মালিকরা অভিযোগ করেন, গুলশানের ভোলা মৌজার সিএস ২৫৯ ও ২৬০ নম্বর দাগের জমি ব্যক্তি মালিকানাধীন ছিল। ১৯৬৩ সালের দিকে তৎকালীন ঢাকা ইমপ্রুভমেন্ট ট্রাস্ট (ডিআইটি) এলএ কেসের মাধ্যমে জায়গাটি হুকুম দখলের উদ্যোগ নেয়। সে অনুযায়ী অনেককে ক্ষতিপূরণ দিয়ে জায়গাটি অধিগ্রহণ করে।
পরবর্তীতে হুকুমদখল না করে এ জায়গা অবমুক্ত করা হয় এবং ক্ষতিপূরণের অর্থ জমির মালিকের কাছ থেকে ফেরতও নেয় ডিআইটি। ১৯৯৩ সালের ১২ অক্টোবর রাজউকের বোর্ডসভায় গুলশানের ৩৬০, ২৫৯ ও ২৬০ নম্বর দাগের জমি অবমুক্ত করার সিদ্ধান্ত হয়। ১৯৯৪ সালের ৬ আগস্ট রাজউক আনুষ্ঠানিকভাবে এই সিদ্ধান্তের ঘোষণা দেয়। রাজউকের পর ঢাকা জেলা প্রশাসকের কার্যালয় থেকে ১৯৯৫ সালের ১ জানুয়ারি ওই তিনটি দাগের জমি অবমুক্ত করার নোটিস দেওয়া হয়। কিন্তু হঠাৎ ২০০৭ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় রাজউক জায়গাটি নিজের বলে দাবি করে।
এ নিয়ে জমির মালিক শেখ রায়হান আহমেদ ও শেখ আশরাফ উদ্দিন আহমেদ আদালতে মামলা দায়ের করেন। আদালত ওই জমির ওপর স্থগিতাদেশ জারি করেন। স্থগিতাদেশ থাকাবস্থায় মান্নান খানের নির্দেশে গুলশানের ৩২ ও ৩৩ নম্বর সড়কের পশ্চিমপ্রান্তের লেকের পাড়ে দুটি সড়কের সঙ্গে সংযুক্ত করে ৩২/এ নম্বর নামের একটি সড়ক তৈরি করে রাজউক। সড়ক ঘেঁষে ৫ কাঠা ৯ ছটাক ১৪ বর্গফুট আয়তনের চারটি প্লট তৈরি করা হয়। এর মধ্যে ১ নম্বর প্লটটি বরাদ্দ দেওয়া হয় আনোয়ার হোসেনকে।
রাজউকে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বারিধারার ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে ফরিদপুর সদরের গুহলক্ষ্মীপুরের বাসিন্দা এম রহমতুজ্জামান রাজউকের তালিকাভুক্ত ছিলেন। সেই ক্ষতিগ্রস্তের নথিই হাত করেন মান্নান খান। তারপর সেটি আনোয়ার হোসেনের নামে পাওয়ার অব অ্যাটর্নি দেওয়া হয়। এক্ষেত্রে রাজউকের দালাল হিসেবে পরিচিত রুহুল খাদেম সহযোগিতা করেন। রাজউকের নথির ঠিকানা অনুযায়ী, বারিধারা ডিওএইচএস-এর ৫ নম্বর সড়কের ৩২৬ নম্বর ঠিকানায় গিয়ে রহমতুজ্জামানের ভাই রায়হানুজ্জামানকে পাওয়া যায়।
তিনি বলেন, 'ভাই এখন আর জীবিত নেই। তবে বারিধারার ক্ষতিগ্রস্ত হিসেবে তার একটি প্লট পাওয়ার কথা ছিল শুনেছিলাম। পরে কী হয়েছে, আর জানি না। ' এ ব্যাপারে অ্যাডভোকেট আবদুল মান্নান খানের সঙ্গে ফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করলে তার ব্যক্তিগত কর্মকর্তা সবুজ নামের এক ব্যক্তি ফোন ধরেন। তিনি জানান, স্যার এখন নির্বাচনী এলাকায়।
নির্বাচনী কাজে ব্যস্ত। এ প্রসঙ্গে রাজউক চেয়ারম্যান নুরুল হুদারও কোনো মন্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে রাজউকের পরিচালক (সম্পত্তি) নজরুল ইসলাম বলেন, 'যে কোনো বিষয়ে কথা বলতে আমাদের নিষেধ আছে। '
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।