অনেকের সঙ্গে রানা প্লাজার ধ্বংসস্তূপে চাপা পড়েছিলেন চায়না বেগম। গতকাল বৃহস্পতিবার সকাল পর্যন্ত স্বামী আবদুর রহমান জানতেন না চায়না বেঁচে আছেন, না মরে গেছেন।
প্রথম চার-পাঁচ দিন ধসে পড়া রানা প্লাজা ও বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে বেড়িয়েছেন দেড় বছরের ছেলে সুমনকে নিয়ে। বাচ্চাটাকে মায়ের আদর দেওয়ার জন্য সঙ্গে রাখেন আবদুর রহমানের ছোট বোন শেফালিকেও। গত তিন-চার দিন সাভার অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় মাঠকেই ঠিকানা বানিয়েছেন আবদুর রহমান।
কিন্তু সন্ধান মেলেনি জীবিত বা মৃত চায়নার। অবশেষে গতকাল সকাল সাতটার দিকে চায়না বেগমের লাশ এসে পৌঁছায় অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় মাঠে। পরিচয় নিশ্চিত করে লাশ গাড়িতে তুলতে তুলতে ১২টা বেজে যায়। বাবা ও ফুফু সুমনের মায়ের লাশ দেখে কাঁদছিল আর সুমন শুধু তাকিয়ে ছিল ফ্যালফ্যাল করে। মর্মান্তিক সেই দৃশ্যের সামনে দাঁড়িয়ে চোখের পানি ধরে রাখা যায় না।
আবদুর রউফের বাড়ি সিরাজগঞ্জের শাহজাদপুরে। দুপুর ১২টার পর যখন আঞ্জুমান মফিদুল ইসলামের লাশের অ্যাম্বুলেন্সটি অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ ত্যাগ করে তখনো কাঁদছিলেন তিনি। কোলের সন্তানটিকে অবশ্য মায়ের চেহারা দেখানো হয়নি। কারণ, আট দিন ধ্বংসস্তূপের মধ্যে থেকে লাশটা প্রায় বিকৃত হয়ে গেছে।
রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় যেসব নারী-পুরুষ মারা গেছেন, তাঁদের অনেকেই বাসায় কোলোর শিশু রেখে গিয়েছিলেন।
কাজ শেষে ফিরে এসে যে বাবা-মায়ের নাড়ি ছেঁড়া ধন, বুকের মানিককে আদর করার কথা, তাঁরাই আজ না ফেরার দেশে চলে গেছেন। অনেকের লাশও খুঁজে পাওয়া যায়নি এখনো। কিছু কিছু শিশুর বয়স এতই কম যে বাঁচা-মরা জিনিসটাই বোঝে না তারা। কিন্তু বড় হয়ে মা-বাবার কবরটাও হয়তো দেখতে পারবে না অনেক হতভাগ্য শিশু।
৩০ ঘণ্টা দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়েও উদ্ধার করা যায়নি শাহীনাকে।
তাঁর দেড় বছরের শিশুসন্তান রবিন এখন নানার কাছে। রবিন মায়ের পেটে থাকা অবস্থায় বাবা নিরুদ্দেশ। এ রকম আরও অনেক শিশু ভবনধসের ঘটনায় এতিম হয়ে পড়েছে। এদের ভবিষ্যৎ ভাবনায় নিকটজনদের কপালে আজ দুশ্চিন্তার বলিরেখা ।
শেরপুরের নালিতাবাড়ীর সেলিম রানা ও রহিমা খাতুন দম্পতি কাজ করতেন রানা প্লাজায়।
সেলিম চতুর্থ ও রহিমা সপ্তম তলায় ছিলেন। ভবন ধসে পড়ার পরদিন রহিমার লাশ পাওয়া যায়। কিন্তু এখনো সেলিমের লাশ পাওয়া যায়নি। ওই ভবনে সেলিমের বোন মনিরাও কাজ করতেন। তিনিও নিখোঁজ।
রহিমা ও সেলিম রানার ১০ বছর বয়সী একটি শিশুসন্তান রয়েছে, নাম রনি। গতকাল দাদি সালেহা বেগম নাতি রনিকে নিয়ে অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় মাঠে এসে কান্নায় ভেঙে পড়েন। তিনি বলেন, সব হারিয়ে তিনি এখন অসহায়। ছেলে ও ছেলের বউয়ের লাশ পাওয়া গেছে। অবুঝ নাতি রনিকে কোলে নিয়েই তাঁদের খোঁজে ছুটে বেড়াচ্ছেন।
এখন নিজের কী হবে আর এই অবুঝ শিশুকে নিয়ে কী করবেন, ভেবে পাচ্ছেন না এই অসহায় নারী।
দুই বছরের রুবিনা মা-বাবা বলতে পারে। সে জানে না রানা প্লাজা ধসের ঘটনায় তার জীবনের যে কী ওলটপালট হয়ে গেল। দাদি রোকেয়া বেগম অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠ থেকে পাঁচ টাকার ঝালমুড়ি কিনে দিয়েছেন। এটা নিয়েই সে ব্যস্ত।
রুবিনার মা সোনিয়া আক্তার সপ্তম তলায় কাজ করতেন। ভবন ধসে পড়ার পর থেকেই তিনি নিখোঁজ। রোকেয়া বেগম বলেন, ছেলের বউয়ের খোঁজ নেই। ছেলেটাও শ্বাসকষ্টের রোগী। এখন শিশু রুবিনার কী হবে, সেই চিন্তায় অস্থির।
মরিয়ম বেগমের বাড়ি গাইবান্ধায়। ছয় মাসের সন্তান রানীকে নিয়ে স্বামীর খোঁজ করছেন এক সপ্তাহ ধরে। তিনি জানান, তাঁর স্বামী রানা ফ্যান্টম পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। ভবন ধসে পড়ার পর আর তাঁর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয়ের মাঠেই আছেন কয়দিন ধরে।
লাশের গাড়ি এলেই ছুটে যান। কিন্তু রানাকে পাওয়া যায় না। ছয় মাস বয়সী এই শিশুকে নিয়ে কী করবেন বুঝে উঠতে পারছেন না মরিয়ম।
সাভার ব্যাংক কলোনির বাসিন্দা ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী মোবারক হোসেনের কোনো স্বজন চাপা পড়েনি রানা প্লাজায়। কিন্তু প্রতিদিনই একবার আসেন অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় মাঠে।
তিনি বলেন, ‘এতিম এসব কোলের শিশুকে দেখলে মন ভেঙে যায়। কারণ, আমারও এমন দুটি সন্তান রয়েছে। কিছু করতে পারছি না। ওদের জন্য তাই দোয়া করে যাচ্ছি, গায়ে হাত বুলিয়ে আদর করছি। ’
অধরচন্দ্র উচ্চবিদ্যালয় মাঠের এক কোণে মা-বাবা হারা শিশুদের নামের তালিকা করছে ‘পল্লী প্লাস’ নামে একটি প্রতিষ্ঠান।
সংস্থাটি এ পর্যন্ত মা কিংবা বাবা মারা গেছে কিংবা নিখোঁজ আছেন, এমন ২৫টি শিশুর একটি তালিকা করেছে। ।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।