আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

ঝমচড়ার ব্যাপারটা

বাড়ির আশপাশের ডোবানালায়, আর ছোট ছোট পুকুরে ও বড়শি পেতে বসে থাকে। কখনও কখনও অনেক দূরেও চলে যায় মাছ ধরার জন্য। বড়শি ফেলে রেখে এক দৃষ্টিতে সুতার দিকে তাকিয়ে থাকতে বেশ ভালো লাগে ওর। মনে হয়, এই বুঝি কিছু একটা ধরা পড়ল। মনে তখন আতঙ্ক আর আনন্দমিশ্রিত একটা শিহরণ খেলে যায়।


মাছ তেমন একটা টাবলু কখনও পায় না। মাঝেমধ্যে ভাগ্য যদি খুব ভালো থাকে তো অনেকক্ষণ অপেক্ষা করার পর বড়শিতে দু-একটা পুঁটি মাছ গাঁথা পরে। কিন্তু তাতে ওর আনন্দ এতটুকুও কমে না।
মাছ দিয়ে ও কী করবে! মাছ ধরার আনন্দটাই তো ওর কাছে অনেক বড়।
স্কুলে টাবলুর অনেক বন্ধু ওর এই শখের কথা জানে।

অনেকেই ওকে সঙ্গ দেয় মাছ ধরার সময়। তবে কেউ থাকুক বা না থাকুক, তাতে টাবলুর কিছু যায় আসে না।
সেদিন ছুটির পর, স্কুলের গেইট দিয়ে বের হতে হতে জামাল টাবলুকে বলল, “কী রে মাছ-টাছ কেমন পাচ্ছিস?”
“এই তো ভালোই। ”
“রুই কাতলা বোয়াল-- সব ধরা পড়ছে তো?” মুচকি হেসে জামাল ঠাট্টা করার চেষ্টা করল।
টাবলু কিছু না বলে অন্য দিকে তাকিয়ে হাঁটতে লাগল।

জামাল আবার বলতে লাগল, “আমি কী বলি শোন। একদিন চল, আমার মামার বাড়িতে যাই। বিশাল বাড়ি। সামনে বিশাল পুকুর। পুকুরে প্রচুর মাছ, যত ইচ্ছে মাছ ধরবি।


টাবলু কিছুটা উৎসাহিত বোধ করল, “কতদূর তোর মামার বাড়ি?”
“এই তো, বেশি দূরে না। আমাদের এই রেলস্টেশন থেকে ট্রেনে চড়ে আধাঘণ্টার মতো। তারপর ট্রেন থেকে নেমে আরও আধাঘণ্টার পায়েহাঁটা পথ। বিশাল জঙ্গলের মধ্যে বাড়ি তো, তাই হাঁটতে হয়। এই পরশুই তো আমাদের স্কুল বন্ধ।

চল ওই দিনই যাই। মাছ-টাছ ধরে আসি। মামারা এখন আর সে বাড়িতে থাকেন না। ছেলেমেয়েরা বড় হয়েছে তো, ওই জঙ্গলের বাড়িতে আর থাকা যায় না। বাড়িটা ভাড়া দিয়ে গেছেন যাওয়ার আগে।

তবে যারাই বাড়িটা ভাড়া নেন, কেন জানি বেশি দিন থাকে না। ’
টাবলু জিজ্ঞাসা করল, “কেন, বেশিদিন থাকে না কেন?”
“আমি ঠিক জানি না। তবে আম্মা বলছিল, বাড়িটার নাকি কী একটা দোষ আছে। ”
“দোষ? বাড়ির আবার দোষ থাকে নাকি?”
জামাল বিরক্ত হয়ে বলল, “কী জানি বাবা! আমি এত কিছু জানি না। পরশু গেলে চল।

বকবক করিস না “
দিনদুয়েক পর, দুপুরে ওরা খাওয়া-দাওয়া সেরে ট্রেনে করে রওনা দিল। একেবারে ফাঁকা ট্রেন। দুই পাশে নদীনালা আর ঘন জঙ্গল ফেলে রেখে ট্রেন খুব দ্রুত চলতে লাগল।
আধাঘণ্টা পর ওরা যে স্টেশানে নামল, ওটা দেখে কোনো স্টেশান বলে মনেই হয় না। ছোট্ট একটা বাজারের মতো।

এলোমেলোভাবে ছড়ানো কয়েকটা চায়ের দোকান। আর এক রুমের একটা লাল দালান। ওটাই স্টেশন। ভেতরে চশমাপরা মাঝবয়েসী একটা লোক বসে বসে ঝিমুচ্ছিল। দেখে মনে হল স্টেশনমাস্টার।

ওদের দেখে বলল, “কী? কোথায় যাচ্ছ?”
জামাল বলল, “এই তো যাব ঝমচড়াতে। ”
“ঝমচড়াতে!”
লোকটার চোখ-মুখ থেকে যেন বিস্ময় ঝরে পড়ল, “এই বিকেল বেলা ওখানে কেন?”
“মাছ ধরতে যাব। ”
“ঠিক আছে। গেলে যাও। কিন্তু সন্ধ্যার ঠিক আগে আগে ফিরে এসো।

রাত হলে আবার……। ”
লোকটা কথা আর শেষ করলেন না।
জামাল বলল, “কেন? রাত হলে কী?”
“না মানে, দিনকাল তো ভালো নয়। তাই বললাম আর কী। ”
“ও আচ্ছা।

ঠিক আছে। আগে আগেই চলে আসব। ”
এই বলে ওরা দুজন ঝোপঝাড়ের মাঝ দিয়ে পায়েহাঁটা একটা সরু পথে নেমে পড়ল।
পুরা পথটাই কাঁচা। পথের মাঝেমধ্যে দেখা গেল, কিছু ভাঙা শামুকের খোলস আর কী যেন পড়ে আছে, সাপের ডিমের মতো।


শীতের বিকেল, দূরে হালকা কুয়াশা পড়তে শুরু করেছে। অনেকক্ষণ সোজা যাওয়ার পর পথটা হঠাৎ বামে বাঁক নিল। বামে বাঁক নিতেই দেখা গেল, জঙ্গলের ভেতর বিশাল একটা একতলা দালান। দেখেই কেমন যেন মনে হল। মনে হল বাড়িটা পরিত্যক্ত।


টাবলু বলল, “এটাই তোর মামার বাড়ি?”
“হুম। চল বাড়ির পেছনে যাই। ওখানেই বড় পুকুরটা। ”
বাড়ির পেছনে সত্যিই বিশাল এক পুকুর। পুকুরের চারপাশে সারিসারি গাছ।

একপাশে পাকা ঘাট।
টাবলু ঘাটের একেবারে নিচের সিঁড়িতে নেমে পড়ল। বড়শিতে গাঁথবার জন্য সঙ্গে করে ও কেঁচো নিয়ে এসেছিল। ঘাটের পাকা সিঁড়িতে ছেড়ে দিতেই সবগুলো কেঁচো একসঙ্গে মোচর দিয়ে উঠল। দেখলেই কেমন যেন বমি চলে আসে।

জামাল দুহাত দূরে সরে গিয়ে বলল, “কী বিশ্রী জিনিস রে বাবা! এগুলো হাতে ধরিস কীভাবে!”
টাবলু কিছু না বলে একমনে বড়শিতে কেঁচো গাঁথতে লাগল।
জামাল ঘাটের উপরের সিঁড়িতে উঠে জোরে ডাক দিল, “ট্যারা আছিস রে?”
টাবলু ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, “ট্যারা আবার কে?”
“এ বাড়ির চাকর। অনেকদিন ধরে আছে। মামা চলে গেলেও ট্যারা যায়নি। এখানেই থাকে।

ঘরবাড়ি, জঙ্গল সব দেখাশোনা করে। ”
“জঙ্গলেরও দেখাশোনা করে নাকি?”



“হুম, করে। বাড়ির ওধারে জঙ্গলে কত ধরনের গাছপালা আছে জানিস? শতশত আম-জাম-লিচু। আরও কতশত গাছ। কেউ যাতে ফল চুরি না করতে পারে, ট্যারা তাই দেখেশুনে রাখে।


জামালের ডাকের কিছুক্ষণের মধ্যেই অদ্ভুত চেহারার বেঁটেখাটো একটা লোক উপস্থিত হল। কারও গায়ের রং যে এত কালো হতে পারে, লোকটিকে না দেখলে বিশ্বাসই হয় না। মুখের গড়নটাও অন্যরকম। থ্যাবড়া নাক। নিচের চোয়ালটাও কেমন যেন সামনের দিকে বাড়ানো।

আর চোখের উপরে ঘন ভ্রু।
লোকটি ওদের কথার মাঝখানে চলে আসাতে ওরা আগে খেয়াল করেনি। হঠাৎ দেখে ওরা দুজনেই চমকে উঠল। আর জামাল তো আগে কখনও লোকটিকে দেখেনি।
লোকটির কণ্ঠস্বরও একদম চিকন।

চিঁচিঁ করে বলল, “আপনারা কারা?”
জামাল একটু রেগে গেল। বলল, “আমরা কারা মানে! এটা আমার মামার বাড়ি। তুমি কে? আর ট্যারা কোথায়?”
লোকটির চোখেমুখে কেমন যেন একটা ঝিলিক খেলে গেল। বলল, “ও ট্যারা, ও তো বাড়ির পেছনের জঙ্গলে। আমার ছেলেমেয়েদের সঙ্গে খেলছে।


জামাল বলল, “তা তুমি কয়দিন ধরে থাক এখানে? আগে তো কখনও দেখিনি। ”
“তা তো অনেক দিন হয়ে গেল। আপনারা শহরের মানুষ, এই অন্ধকার জঙ্গলের কথা কি আপনাদের জানার কথা?” লোকটির চোখেমুখে আবারও অন্য রকম একটা ঝিলিক।
“আচ্ছা, ঠিক আছে। বুঝলাম।

তুমি এখন ট্যারাকে ডাকো। আমরা মাছ ধরব। ”
‘ও, আপনারা মাছ ধরতে এসেছেন? খুব ভালো। খুব ভালো। কিন্তু ট্যারা তো এখন আসতে পারবে না।

বললাম না, ও খেলছে। আমাকে বলুন, আমি করছি। ”
এই বলে লোকটি পাঞ্জাবির বুকের বোতাম খুলে ঘষঘষ করে বুক চুলকাতে লাগল। জামাল আর টাবলু দেখল, লোকটির বুকে বেশ ঘন লোম। এবার ওরা দুজনেই বেশ ভয় পেয়ে গেল।


লোকটি চিঁচিঁ করে আবার বলল, “তা আপনারা কিছু খেয়ে নিন আগে। ডাব খাবেন? পেড়ে নিয়ে আসি?”
বলেই লোকটি ওদের অনুমতির জন্য অপেক্ষা না করেই চলে গেল কোথায় যেন।
ঘাটের পাশেই সারিসারি উঁচু নারকেল গাছ। একটি নারকেল গাছের নিচে গিয়ে লোকটি লুঙ্গিতে কাছা দিল। তারপর ওদের দুজনকেই অবাক করে দিয়ে, একদম তরতর করে গাছের মাথায় চলে গেল।


জামিল আর টাবলু এ ওর মুখ চাওয়া-চাওয়ি করতে লাগল। কিছুক্ষণের মধ্যেই দুটি কাঁটা ডাব নিয়ে লোকটি হাজির।
বলল, “নিন। আগে ডাব খান। পরে আরাম করে মাছ ধরবেন না হয়।


ওরা হাত বাড়িয়ে ডাব নিল। ওদের অবাক ভাব তখনও কাটেনি। আস্তে আস্তে ডাবের পানি গিলতে লাগল দুজনে। লোকটি এবার চতুর হাসি হেসে বলল, “মাছ পেলে কিন্তু আমাদেরও দিতে হবে। ইস, কতদিন মাছ খাই না।


এই বলে লোকটি জিহবা দিয়ে ঠোঁটের চারপাশটা চেটে নিল।
“আচ্ছা ঠিক আছে, মাছ পেলে পরে না হয় দেখা যাবে। ”
এবার জামাল আর টাবলু মাছ ধরতে নেমে পড়ল। লোকটিও ধীরে ধীরে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ির ওপাশে চলে গেল।
টাবলু বড়শি ফেলে বলল, “লোকটিকে কেমন জানি মনে হচ্ছে রে।

আমার ভয় লাগছে। চল বাড়ি ফিরে যাই। ”
জামাল বলল, “আরে ধুর, ভয়ের কী আছে! ট্যারা আসলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। ”
“ট্যারা কই? ওর তো কোনো চিহ্নই দেখতে পাচ্ছি না। ”
“তা অবশ্য ঠিক।

অনেকক্ষণ তো হয়ে গেল। ও সমস্যা নেই, কিছু হবে না। ভয় না পেলেই চলবে। ”
কাঁপা কাঁপা গলায় যখন কথাগুলো বলছিল, তখন টাবলুও বুঝতে পারল, জামালও কিছুটা ভয় পেয়েছে।
ওদের কথার মাঝখানে টুপ করে বড়শিতে একটা মাছ ধরা পড়ল।

মাঝারি সাইজের একটা তেলাপিয়া। মাছ পেয়ে ওদের সে কী খুশি!
একটু পরে আরও একটা। কিছুক্ষণ পরে আরও একটা। এভাবে অনেকক্ষণ চলতে লাগল। মাছ ধরা পড়তে লাগল একটু পরপরই।

ওরা লোকটির কথা একেবারেই ভুলে গেল।
শীতকাল। ঝপ করে সন্ধ্যা নেমে পড়ে। ওরা খেয়ালই করেনি যে চারপাশে হাল্কা অন্ধকার হয়ে গেছে। কিছুক্ষণ পরে একটা শব্দে ওদের ধ্যান ভাঙল।

কেমন যেন একটা শব্দ-- ফসফস... অনেকজন মানুষ এক সঙ্গে জোরে জোরে নিঃশ্বাস ফেললে যেমন শব্দ হয়, ঠিক সে রকম।
আশপাশে তাকিয়ে কিছু দেখতে না পেয়ে ওরা যখন পিছনে ফিরে তাকাল, তখন দুজনই ভয়ে একেবারে কাঠ। যা দেখল, তা একেবারেই অবিশ্বাস্য। টাবলুর হাত থেকে বড়শিটা পানিতে পরে গেল। জামিল ও ভয়ে গো গো করতে লাগল।


ওরা দেখল, ঠিক বিশ-পঁচিশ জনের মতো হবে, আর দেখতে অবিকল ঐ লোকটির মতোই, ঘাটের উপর দাঁড়িয়ে আছে। গায়ে কোনো জামাকাপড় নেই। সবারই সমস্ত শরীর পুরু ঘন লোমে ঢাকা। সবাই ফোসফোস করে নিঃশ্বাস নিচ্ছে।
সেই লোকটি দাঁড়িয়ে সবার সামনে।


বলল, “ওরাই আমার ছেলেমেয়ে। তা কেমন মাছ পেলেন? আমাদের সবাইকে একটা করে দেন। আহ, কতদিন মাছ খাই না। আজকে সবাই মজা করে মাছ খাব। ”
লোকটি এই কথা বলার সঙ্গে সঙ্গে বাকি সবাই একসঙ্গে মুখ হা করে চিঁচিঁ শব্দ করে উঠল।

হা করতেই দেখা গেল, সবার মুখে ধারাল চকচকে দাঁত। অন্ধকারেও কেমন জ্বলজ্বল করে উঠল।
বোঝা গেল, আর যাই হোক, এরা মানুষ নয়। মানুষের এই রকম দাঁত থাকতেই পারে না।
জামিল আর টাবলুর তখন ভয়ে মরে যাওয়ার অবস্থা।

ঘাটের পাশে ওরা সবগুলো মাছ রেখেছিল। জামিল কোনো রকমে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে বলল, “ঐ যে মাছ। ”
এই কথা বলতে যত দেরি, সবাই একসঙ্গে মাছের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। কাঁচা মাছে কচকচ করে ধারালো দাঁত বসাতে লাগল।
জামিল-টাবলু আর সময় নষ্ট করল না।

এই সুযোগ। বড়শি-টরশি ফেলে দৌড়। কুয়াশার মধ্যে ঝোপঝাড় আর গাছপালা ভেঙে এক দৌড়ে রেলস্টেশন।
ট্রেন তখনও আসেনি। স্টেশনমাস্টার ওদের দেখে বলল, “কী? তোমরা এত হাঁপাচ্ছ কেন? মাছ ধরতে না গেলে? মাছ কই?”
ওরা চুপ করে আছে দেখে একটু পরে আবার বলল, “বুঝেছি, ভূতের পাল্লায় পড়েছিলে।


“ভূত!” দুজনে একসঙ্গে চিৎকার করে উঠল।
“হুম, ভূত। সন্ধ্যার পরে ওই এলাকায় তো কেউ আর যায় না। আশপাশের বাড়িঘরগুলোতেও ওদের জ্বালায় টেকা যায় না। না পেরে সবাই পালিয়েছে।

যারা যারা দেখেছে, সবাই বলেছে, ওরা বানর ভূত। বানরের মতো দেখতে, কিন্তু কথা নাকি বলে মানুষের মতো করে। ওদের মধ্যে অনেকে আবার ছোট ছোট বাচ্চাদের ভুলিয়ে-ভালিয়ে নিয়ে গিয়ে পানিতে ফেলে দেয়। তা তোমাদের সঙ্গে কী করল?”
ততক্ষণে ট্রেন চলে এসেছে। ওরা আর স্টেশনমাস্টারের কথার উত্তর দিল না।

একলাফে ট্রেনে উঠে পড়ল। ওদের বুকের ভেতর হৃৎপিণ্ডটা তখনও ধুকপুক ধুকপুক করছে।

সোর্স: http://bangla.bdnews24.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.