বোধকরি পৃথিবীতে যতগুলো দেশের অভ্যুদয় ঘটেছে তাদের মধ্যে জন্মের সময় সবচেয়ে বেশি জন্ম যন্ত্রণা সইতে হয়েছে বাংলাদেশকে। ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ শহীদ, ৩ লাখ মা-বোনের ইজ্জত, ১ কোটি মানুষের দেশান্তর আর কোটি কোটি মানুষের দুঃখ-দুর্দশা ও অনিশ্চয়তার জীবনপাতের মধ্যদিয়ে জন্ম হয় এই দেশটির। এতসব দুর্দশা আর ত্যাগের মধ্যদিয়ে আমরা অর্জন করি স্বাধীনতা, গর্বিত মালিক হই লাল-সবুজ পতাকার। ১ লাখ ৫৬ হাজার বর্গ কি.মি. জমিন আর লক্ষাধিক বর্গ কি.মি. মহিসোপান নিয়ে পৃথিবীর মানচিত্রে দাঁড়িয়ে থাকা বাংলাদেশের মাটি, পানি, আকাশ আজ আমাদের। এ দেশ আমার মা।
স্বাধীনতার পরে এ কথাগুলোর দালিলিক স্বীকৃতি দেওয়া রয়েছে ১৯৭২ সালে প্রণীত আমাদের শাসনতন্ত্রে। আমি টেকনাফ, তেঁতুলিয়া, বেনাপোল, তামাবিল এই চতুর্সীমার বাঙালি-পাহাড়ি, হিন্দু-মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান, রাজা-প্রজা যেই হই না কেন আমরা সবাই আমার অধিকার, আমার দায়বদ্ধতা সবকিছুই আমাদের শাসনতন্ত্রেই বিধৃত এবং স্বীকৃত। আজ আমরা প্রিয় বাংলাদেশের স্বাধীন নাগরিক। এ দেশের প্রতিটি বালুকণার প্রতি বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র অনুযায়ী অঞ্চল, ধর্ম, বিশ্বাস, বর্ণ কোনো কারণেই কারও চাকরি, বসবাস কিংবা আইনানুগ যে কোনো ধরনের সুযোগ-সুবিধা কোনো নাগরিকেরই যোগ্যতা অনুযায়ী পাওয়া বা ভোগ করার অধিকার ক্ষুণ্ন হওয়ার কথা নয় কিংবা তার কোনো কারণও নেই। মানবিক ভাবনা বাদ দিলেও এ ধরনের যে কোনো ডিসক্রিমিনেশ দেখিয়ে আইনগতভাবেই আমরা এসব ব্যাপারে কেউ কারও দিকে অঙ্গুলি উঁচু করতে পারি না।
একটি নির্দিষ্ট অঞ্চল, ধর্ম, গোষ্ঠী বা অন্য কোনো নির্দেশকের আবহে জন্ম নেওয়া বা বেড়ে ওঠার কারণে কেউ কোনো নাগরিককে আলাদা উচ্চতায় কিংবা ভিন্ন চোখে নিচু গণ্য করে দেখতে পারেন না।
২৯ ডিসেম্বর সন্ধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জায়গায় স্রেফ একটি আড্ডায় মিলিত হয়েছিলাম। সেখানে অনেক রকম আলোচনার পর এক পর্যায়ে রাজা-উজির মেরে আড্ডার বিষয়বস্তু চলে এলো ওই দিন মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা বেগম জিয়ার প্রায় গৃহবন্দিত্ব অবস্থায় তার গুলশানের বাসায় সাংবাদিকদের কাছে তার দেওয়া একটি বক্তব্যকে ঘিরে। তার বক্তব্যে তিনি বলেছেন সময় এলে তারা গোপালগঞ্জ জেলার নামটি মুছে ফেলবেন বা পরিবর্তন করে ফেলবেন। পাঠকগণ, নিশ্চয়ই জানেন গোপালগঞ্জ জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মস্থান, শেখ হাসিনারও পৈতৃক নিবাস।
২৯ তারিখ সন্ধ্যায় বেগম খালেদা জিয়ার বাড়ি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা ঘিরে রেখেছিলেন, তাদের মধ্যে একদল নারীকর্মী ছিলেন। এদের অন্তত একজন ছিলেন গোপালগঞ্জের অধিবাসী। আমরা টেলিভিশনে দেখেছি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এই কর্মী বা কর্মকর্তা বেগম জিয়ার সঙ্গে কোনো ব্যাপারে কথা বলার সময় তিনি তাকে ধমক দেন। তার বাড়ি গোপালগঞ্জ জেনে তিনি উচ্চৈঃস্বরে বলে ওঠেন_ ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে গোপালগঞ্জের নাম বদলে ফেলা হবে। বেগম জিয়া কেবল বিএনপি কিংবা ১৮ দলের নেতা নন, তিনি বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় নেতাও।
জাতীয় সংসদ কর্তৃক সর্বসম্মতভাবে প্রণীত বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র ধর্ম, বর্ণ কিংবা অঞ্চলের মধ্যে ঘৃণা, বিবাদ, হিংসা, বিদ্বেষ, অনুরাগ-বিরাগ যে কোনো ধরনের বিভাজন তৈরি করে এমন কোনো আচরণ-উচ্চারণ বা বিভেদ তৈরির মনোভাব প্রদর্শন স্বীকৃতি দেয় না। এ আড্ডায় আলোচনা একপর্যায়ে খানিকটা রাজনৈতিক মোড় নিয়ে নিল। অংশগ্রহণকারীদের একজন শাসনতন্ত্রের এসব বিষয়গুলো উচ্চারণ করে খুবই মর্মাহত বোধ করলেন। আমি জানি না বাংলাদেশের যে কোনো নাগরিক বিশেষ করে গোপালগঞ্জের কোনো বাসিন্দা বেগম জিয়ার বক্তব্যে সংক্ষুদ্ধ হয়ে আদালতে যেতে তাড়নাবোধ করবেন কি-না? বাংলাদেশের রাজনীতির ইতিহাস ও প্রেক্ষিত বর্ণনা করে একজন বলে ফেললেন, গোপালগঞ্জের খোকা (শেখ মুজিব) পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ বানিয়েছেন এ অপরাধেই ১৯৭৫ সালে তাকে সপরিবারে হত্যার পর তাকে যেমন ইতিহাস থেকে প্রতিক্রিয়াশীল শক্তি মুছে ফেলতে চেষ্টা করেছে, সেই একই কায়দায়, একই কারণে এবং সেই একই শক্তিই কী এবার ভূগোল থেকে গোপালগঞ্জকেও মুছে দিতে চাচ্ছেন? আলোচনার পক্ষে-বিপক্ষে তথ্য এবং যুক্তি দাঁড় করাতে গিয়ে অংশগ্রহণকারীদের কেউ কেউ আমাদের নেতা-নেত্রীরা যিনি যখন ক্ষমতায় থাকেন তখন তিনি বা তার দল নিজ এলাকার জন্য কি করেন এবং তার প্রতিপক্ষের এলাকার মানুষকে কীভাবে ট্রিট করেন তার কিছু চিত্র তুলে ধরলেন। উদাহরণ দিতে গিয়ে বিগত সময়ে বিশেষ করে ২০০১ থেকে ২০০৬ সাল পর্যন্ত পাবলিক সার্ভিস কমিশন বা বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরির জন্য পরীক্ষা দেওয়ার সময় কোনো কোনো সদস্য নাকি প্রার্থীদের কাছে জিজ্ঞেস করে জানতে চাইতেন প্রার্থী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ কোনো হলের শিক্ষার্থী কিনা? বাড়ি গোপালগঞ্জ বা বৃহত্তর ফরিদপুরে কিনা? আর সেটা হলে চাকরি পাওয়ার সম্ভাবনা না-কি কমে যেত।
একইভাবে অন্য একজন অংশগ্রহণকারীও ১৯৯৬ থেকে ২০০১ এবং ২০০৯ থেকে এখন পর্যন্ত সরকারি চাকরিপ্রাপ্তদের মধ্যে গোপালগঞ্জ বা বৃহত্তর ফরিদপুরের সংখ্যা কত, কোন সব পদে তারা আছেন তাও একটু জেনে নিতে বললেন। এ আড্ডায় অংশগ্রহণকারীদের আলোচনা থেকে মনে হয়েছে, এসব তথ্য জানতে পারলে ভালো হতো। যখন বেগম খালেদা জিয়া সরকার গঠন করেন তখন শুনেছি ফেনী বা নোয়াখালী অঞ্চলের কিছু কিছু মানুষ স্লোগান দেন কিংবা বলাবলি করেন_ 'গর্ব মোদের আলাদা-ফেনীর মেয়ে খালেদা'। এ সময় বগুড়ার মানুষ হয়তো বলেন, 'গর্ব মোদের আলাদা-বগুড়ার বধূ খালেদা'। আমার দৃঢ় বিশ্বাস শেখ হাসিনার ব্যাপারেও গোপালগঞ্জ/ ফরিদপুর কিংবা রংপুরের কিছু মানুষের উচ্চারণও একই রকম।
আমার ধারণা হয়, এসব এলাকার কিছু মার্কা মারা মানুষের এ ধরনের উচ্চারণ আমাদের দুই নেত্রীর নেতৃত্বের সীমানা ছোট করে দেয়। তবে আমাদের জন্য সবচেয়ে অনুতাপ এবং চিন্তার বিষয় হলো, নেতা-নেত্রীরা যখন নিজ মুখে কিছু উচ্চারণ করেন কিংবা তাদের নেতৃত্বে সরকার গঠন করে বাংলাদেশের নাগরিকদের মধ্যে যে কোনো ধরনের বিভাজন বা বৈষম্যের মনোভাব তৈরি করেন কিংবা তা উসকিয়ে দেন। বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে তখন আমরা স্বস্তিবোধ করি না।
গোপালগঞ্জ, ফেনী, বগুড়া, রংপুরসহ ৬৪টি জেলা নিয়েই ১৬ কোটি মানুষের এই বাংলাদেশ। এখানে কোনো বিভেদের জায়গা নেই।
দয়া করে লক্ষ প্রাণের রক্তে কেনা স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আমরা সবাই যেন সবাইকে সমান পাল্লায় মাপি-সমান চোখে দেখি। ২০১৩ সাল বিদায় নিয়েছে। এসেছে নতুন বছর ২০১৪ সাল। নতুন বছরে আমরা একটু নতুন করে কী আমাদের ভাবনা শুরু করতে পারি না? পাল্টে দেওয়া বা মানুষকে বিচ্ছিন্ন করা নয়, আসুন এ মুহূর্ত থেকে আমরা সবাইকে এক করে, সবাইকে সঙ্গে নিয়ে এক হয়ে সামনের দিকে এগিয়ে যাই। আর কোনো বিশেষ আনুকূল্য বা বিভেদের ভাবনা নয়।
লেখক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক এবং বাংলাদেশ প্রেস ইনস্টিটিউটের (পিআইবি) সাবেক মহাপরিচালক।
E- mail: Skasalam@gmail.com
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।