আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

গণচেতনার ইশতেহার

জাতির মৃত বিবেক জাগ্রত করতে চাই
১৯৪৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগের ম্যানিফেস্টোতে সামাজিক অবস্থা, মতামত, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সমগ্র জনসাধারণের ধর্ম সভ্যতা, সংস্কৃতি, স্বাস্থ্য নিরাপত্তা ও সুষ্ঠু জীবনের সমান অধিকার ও সমান সুযোগ প্রতিষ্ঠার প্রত্যয় ব্যক্ত করা হয়। সেখান থেকে বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী সংগঠনটির ইতিহাসের চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আওয়ামী মুসলিম লীগ থেকে আওয়ামী লীগে রূপান্তর। বাংলা ভাষা, স্বায়ত্তশাসন, ‘বাংলাদেশ’ নামকরণ, ‘বাংলাদেশ’কে স্বাধীন সার্বভৌম দেশ ঘোষণা, দীর্ঘ ৯ মাসের রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা লাভ, অর্থাৎ বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন, চুয়ান্নর নির্বাচন, আটান্নর সামরিক শাসন-বিরোধী আন্দোলন, বাষট্টির শিক্ষা আন্দোলন, চৌষট্টিতে দাঙ্গা-বিরোধী আন্দোলন, ছেষট্টির ৬-দফা, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ঊনসত্তরের গণ-অভ্যুত্থান, সত্তরের নির্বাচন, ঐতিহাসিক ৭ মার্চ, মহান মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা লাভ প্রত্যেকটি ঘটনায়ই বাঙালির জাতীয় জীবনের এক একটি জীবন্ত ইশতেহার। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বেই রচিত হয়েছিল সে ইশতেহার। সেই ইশতেহার বাস্তবায়ন করতে গিয়ে গভীর ষড়যন্ত্রের শিকার হয়েছে আওয়ামী লীগ।

বাঙালি জাতি হারিয়েছে তার পিতাকে; কারাগারের নির্মম প্রকোষ্ঠে নিহত হয়েছেন জাতীয় চার নেতা। স্বৈরাচাররা হরণ করেছে বাঙালির ভোট ও ভাতের অধিকার।
স্বাধীনতা প্রাপ্তির পর আওয়ামী লীগের প্রতি মানুষের ছিল অপরিসীম প্রত্যাশা। রক্তস্নাত ধ্বংসস্তূপের মধ্যে শূন্য হাতে শুরু ১৯৭২ থেকে ১৯৭৫ কালপর্বে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির পথে এগিয়ে যায়। বিশ্বব্যাংকের ১৯৮৭ সালের রিপোর্ট অনুযায়ী ১৯৭২-৭৫ সালে জাতীয় আয় বৃদ্ধির বার্ষিক হার ছিল ৭ শতাংশ।

১৯৭৬-৮০ পর্যন্ত সময়ে কমে দাঁড়ায় ৪.৭ শতাংশে। ১৯৮০-৮১ থেকে ১৯৮৫-৮৬ সালে আরও হ্রাস পেয়ে দাঁড়ায় মাত্র ৩.৬ শতাংশে। ১৯৭২-৭৩ থেকে ১৯৭৫-৭৬ সাল পর্যন্ত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পায় ৮.৫ শতাংশ। ১৯৭৬-৭৭ থেকে ১৯৮০-৮১ উৎপাদন ২.১ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পায়, ১৯৮০-৮১ থেকে ১৯৮৫-৮৬ সাল পর্যন্ত খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির হার ছিল মাত্র ১.৭ শতাংশ। এই সময়কালের গড় প্রবৃদ্ধির হারের তুলনা করলে দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধুর সময়কালে প্রবৃদ্ধির হার ছিল সর্বাপেক্ষা বেশি ৭.০৬ শতাংশ।

জিয়াউর রহমানের আমলে প্রবৃদ্ধি কমে গিয়ে ৪.৭৫ শতাংশে এবং এরশাদের আমলে আরও কমে গিয়ে দাঁড়ায় ৩.৯৫ শতাংশে। বঙ্গবন্ধুর আমলে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৮৬ কোটি ডলার। জিয়া ও এরশাদের আমলে বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ বেড়ে যথাক্রমে ৩৮০ কোটি ডলার ও ১০৩৫ কোটি ডলারে দাঁড়ায়। ভূমিহীনদের সংখ্যা বঙ্গবন্ধু আমলে ছিল ৩৫ শতাংশ। জেনারেল জিয়ার আমলে ৫৫ শতাংশ আর এরশাদ আমলে ৭৫ শতাংশের ঊর্ধ্বে দাঁড়ায়।


বঙ্গবন্ধু হত্যার পর শুরু হয় ইতিহাস দখলের কালো অধ্যায়; পুনর্বাসিত হয় স্বাধীনতা-বিরোধী পক্ষ। স্বৈরশাসকদের পরিচর্যায় শুরু হয় ‘মুক্তিযুদ্ধের বাংলাদেশ’-বিরোধী তৎপরতা। দীর্ঘ স্বৈরশাসনে ক্ষত-বিক্ষত আওয়ামী লীগকে বাঁচিয়ে রাখে ত্রিশ লক্ষ শহীদের রক্তের ইশতেহার- বঙ্গবন্ধুর মতাদর্শ। এরপর বঙ্গবন্ধু-কন্যা শেখ হাসিনার স্বদেশ প্রত্যাবর্তন। শুরু করেন সাংগঠনিক কার্যক্রমে নেতৃত্ব প্রদান।

নানা ঘটনাপ্রবাহের মধ্য দিয়ে সময়ের প্রয়োজনে নতুন অর্থনৈতিক নীতিমালা গ্রহণ করে আওয়ামী লীগ। ৯০-র দশকের শুরুতে প্রণীত আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক নীতিমালার প্রধান লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয় ‘দারিদ্র্য বিমোচন ও ক্রমান্বয়ে স্বাবলম্বিতা অর্জন’। এরপর ৯১-র নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ইশতেহারে স্বৈরাচার পতনের মধ্য দিয়ে জনগণের কাছে জবাবদিহিতামূলক সংসদীয় পদ্ধতির গণতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার করা হয়। একই সাথে ঘোষণা করা হয় বাঙালিত্বের মূল ইশতেহার ‘স্বাধীনতার লক্ষ্য, আদর্শ ও স্বপ্ন’ বাস্তবায়নের।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ১৯৯৬-র নির্বাচনী ইশতেহারে প্রধান অঙ্গীকার ছিলÑ আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ও মানুষের অধিকার সংরক্ষণে ‘জাতীয় ঐক্যমত্যের সরকার পরিচালনা’।

ওই নির্বাচনে রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব গ্রহণ করে সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সংসদীয় কমিটিগুলোতে মন্ত্রীদের পরিবর্তে সংসদ সদস্যদের চেয়ারম্যান করা এবং সংসদে প্রধানমন্ত্রীর সরাসরি প্রশ্নোত্তর পর্ব চালু করা ছিল আওয়ামী লীগের একটি যুগান্তকারী পদক্ষেপ। ওই সময় খাদ্যে ৪০ লাখ টন ঘাটতি পূরণ করে স্বয়ম্ভরতা অর্জনের পথে এগিয়ে যায় দেশ। পার্বত্য চট্টগ্রামে শান্তিচুক্তি, গঙ্গার পানিচুক্তি, আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের মর্যাদা লাভ, সকল রেকর্ড ভেঙে প্রায় ৬ শতাংশ অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জন, মাথাপিছু আয় ২৮০ মার্কিন ডলার থেকে ৩৮৬-তে উন্নীত, গড় আয়ু ৫৮.৭ থেকে ৬১.৮ বছরে উন্নীত, বিদ্যুৎ উৎপাদন ১৬০০ মেগাওয়াট থেকে দ্বিগুণের বেশি ৪২০০ মেগাওয়াটে বৃদ্ধি করাসহ অনেকগুলো খাতে বিস্ময়কর সাফল্য অর্জন করে আওয়ামী লীগ।
২০০১-এর ইশতেহারে অর্থনৈতিক মুক্তির তথা ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অনুন্নয়ন, পশ্চাৎপদতা ও নিরক্ষরতার অভিশাপ মুক্তি এবং উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনের মধ্য দিয়ে ২০২১ সালের মধ্যে সুন্দর, সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার অঙ্গীকার করে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের অন্য ইশতেহারগুলোর মতো এখানেও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়নের প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করা হয়।

২০০১-র নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ঠেকাতে স্বাধীনতা-বিরোধী জামাতের সঙ্গে জোট করে বিএনপি। বাধাগ্রস্ত হয় বাঙালির মূল ইশতেহার ‘স্বাধীনতা সংগ্রামের চেতনা’ বাস্তবায়নের স্বপ্ন। বিএনপির নেতৃত্বাধীন সরকারের সময় জাতীয় পতাকা ওঠে একাত্তরের ঘৃণিত মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের গাড়িতে। দুর্নীতিতে রেকর্ড চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ।
বাঙালির ধমনীতে প্রবাহিত ইশতেহার (মুক্তিযুদ্ধের চেতনা) রক্তে আগুন জ্বেলে দেয় মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার উচ্চারিত হয় আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনার কণ্ঠে।
২০০৮-এ সংকট মোচন ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ বিনির্মাণে দিনবদলের সনদ ‘রূপকল্প-২০২১’ শিরোনামে প্রকাশিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার অঙ্গীকার ব্যাপকভাবে আলোড়িত করে বাঙালি জাতিকে। জনগণের বিপুল সমর্থনে সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট। নির্বাচনী ইশতেহারের প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী শুরু হয় মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কার্যক্রম। কাদের মোল্লার ফাঁসির মধ্য দিয়ে দায়মুক্তির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ।

যুদ্ধাপরাধীদের বাঁচাতে নৈরাজ্য সৃষ্টির মধ্য দিয়ে নানা ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয় পরাজিত শক্তি।
রাজনৈতিক বৈরী পরিস্থিতির মধ্যেও বিদ্যুৎ, জ্বালানি, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, তথ্যপ্রযুক্তি বিপ্লব, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, শিক্ষা, কৃষি ও শিল্প খাতে অর্জিত হয়েছে অভূতপূর্ব সাফল্য। বিদ্যুৎ উৎপাদন ১০,০০০ মেগাওয়াট ছাড়িয়েছে, ৬.২ শতাংশ প্রবৃদ্ধি অর্জন, মাথাপিছু আয় ১০৪৪ ডলারে উন্নীত, ৩৭৫ মিলিয়ন টন খাদ্য উৎপাদনের রেকর্ড সৃষ্টি, দারিদ্র্যের হার হ্রাস পেয়ে হয়েছে ২৬.২০ শতাংশ, প্রবাসী আয় ৪৮ বিলিয়ন ডলারে উন্নীতসহ অনেক খাতেই বাংলাদেশ পেয়েছে ঈস্পিত সাফল্য।
প্রধান বিরোধী দলের দায়িত্বহীনতা ও জামাতনির্ভর রাজনীতি, যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার অপতৎপরতায় উন্নয়ন কর্মকা- ছাপিয়ে বাংলাদেশের প্রধান আলোচিত বিষয় হয়ে ওঠে মানবতাবিরোধী যুদ্ধাপরাধের বিচার প্রসঙ্গ।
এরই মধ্যে গত ২৮ ডিসেম্বর ২০১৩ ‘শান্তি, গণতন্ত্র ও সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ’ শিরোনামে নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে আওয়ামী লীগ।

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি নির্বাচনে অংশ নেওয়া কয়েকটি দলও তাদের নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করেছে। নির্বাচনে অংশ না নেওয়া বিরোধী দল এবং তাদের মিত্রদের রয়েছে অঘোষিত ইশতেহার। গত কয়েক বছরে বিএনপি-জামাতের কর্মকাণ্ডে প্রকাশ পেয়েছে যুদ্ধাপরাধীদের রক্ষার অঘোষিত ইশতেহার। গণতন্ত্র, স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব, ভোটাধিকার যেভাবেই দেখা হোক না কেন, বাংলাদেশের রাজনীতির প্রধান ইস্যু হয়ে দাঁড়িয়েছে যুদ্ধাপরাধ প্রসঙ্গ। জন্মলগ্ন থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কথা বলে আসা বিএনপি যুদ্ধাপরাধের পক্ষে অবস্থান নিয়ে কার্যত চেতনাশূন্য হয়ে পড়েছে।

ফলে নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েছে তাদের রাজনীতি।
জাতির সম্মুখে একমাত্র অঙ্গীকার সকল যুদ্ধাপরাধীর বিচারের রায় কার্যকরের মধ্য দিয়ে গণচেতনার ইশতেহার বাস্তবায়ন।


লেখক : গবেষণা ও পরিকল্পনা পরিচালক, সোসাইটি অব পার্লামেন্ট ওয়াচ


 

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।

প্রাসঙ্গিক আরো কথা
Related contents feature is in beta version.