আমাদের কথা খুঁজে নিন

   

মালোপাড়ায় হামলায় জামায়াতকর্মীরা, উস্কানি ওহাবের

এই প্রশ্ন ৫ জানুয়ারির দশম নির্বাচনের দিন হামলার শিকার মালোপাড়ার কারো নয়; যশোরের অভয়নগর উপজেলার চাপাতলা গ্রামের মালোপাড়ার পাশের বুড়ি ভৈরব নদীর উল্টা পাড়ের দিয়াপাড়া গ্রামের ৯৬ বছর বয়সী অধীর পালের।

ঘটনার দিন নদী পাড়ি দিয়ে আসা আক্রান্ত হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের কয়েকটি পরিবারকে নিজের বাড়িতে আশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি। অধীর পাল ভেবে কোনো তলই পান না- কারা এতো নিষ্ঠুর, এতো অমানবিক হতে পারে!

মালোপাড়ায় এখন এক ধরনের চাপা ফিসফিস অথবা মুখে কুলুপ এঁটে রাখা মানে, মুখ খুলতে না চাওয়ার বাস্তবতা। প্রকাশ্যে কথপোকথনে তারা তাদের বিপন্নতা, আতঙ্কের কথা বলে যাবে কাঁদতে কাঁদতে অথবা কান্না ধরা গলায়। কিন্তু হামলাকারীর নাম বলবে না কোনোমতেই।

ওখানকার বাসিন্দা বিকাশ বিশ্বাস, যার ঘর ভেঙ্গেছে, ট্রাঙ্ক ভেঙ্গে লুট হয়েছে ঋণ নেয়া ২০ হাজার টাকা; কারা হামলাকারী- এ প্রশ্নে চুপ করে থাকেন। পাশে থাকা তার স্ত্রী উজ্জ্বলা বিশ্বাস বললেন, “আমাদের স্বামীরা কি তখন মেয়েছেলেদের বাঁচাবে নাকি হামলাকারীর চেহারা চিনে রাখপে, কন? ওরা তো মুখে কালো কাপড় বেঁধে হামলা করেছিল। ”

অভয়নগরের চারপাশের এলাকা ঘুরে, স্থানীয়দের সাথে কথা বলে জানা গেছে, দশম সংসদ নির্বাচনে অভয়নগর-বাঘার পাড়া-বসুন্দিয়া ইউনিয়ন নিয়ে বিস্তৃত যশোর-৪ নির্বাচনী আসনে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের প্রার্থী রনজিত কুমার রায় নৌকা প্রতীক নিয়ে প্রার্থী হলেও তাকে সমর্থন জানাননি নবম জাতীয় সংসদের হুইপ শেখ আব্দুল ওহাব, যার বাড়ি অভয়নগরেই। বরং তিনি দলীয় সিদ্ধান্ত উপেক্ষা করে কলস প্রতীক নিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন।

 

বিদায়ী সংসদের হুইপ শেখ আব্দুল ওহাব

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মালোপাড়ার এক বাসিন্দা বলেন, “শেখ আব্দুল ওহাব সংসদের হুইপ হবার কারণে প্রশাসনে তার প্রভাব যেমন, তেমনি তার রয়েছে নিজস্ব ক্যাডার বাহিনী।

তার বাহিনী মালোপাড়ার হিন্দু ধর্মাবলম্বী বাসিন্দাদের কলস প্রতীকে ভোট দেবার জন্য চাপ দিয়ে গেছে ভোটের দিন পর্যন্ত । হামলার দিন শিবিরের ছেলেপেলেদের সাথে ওদেরও দেখেছি। ” 

নাম প্রকাশ না করতে শুধু মালোপাড়ার হিন্দু বাসিন্দা নয়, পাশের অন্যান্য ইউনিয়নের হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকজনও অনুরোধ করেন।

যশোর সদরে ব্যবসা করা শ্রীধরপুর ইউনিয়নের এক বাসিন্দা জানান, ২৮ ডিসেম্বর চাপাতলা গ্রামের পাশের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের চত্বরে এক নির্বাচনী সমাবেশ করেন শেখ ওহাব। নির্বাচনে পরাজিত হলে হিন্দুদের ওপর ঝামেলা হবে বলে সেখানে তিনি হুমকি দেন।

মালোপাড়া মন্দিরের পেছনে বুড়ি ভৈরব নদীর পাড়ে দাঁড়িয়ে কথপোকথনের সময় ৫৯ বছর বয়সী জেলে, ক্ষতিগ্রস্ত দুলাল বিশ্বাস বলেন, “ঘটনা তো সকাল বেলা থেকেই। কেন্দ্রে বিশ্বজিত, দেবব্রত মার খেল, আমদের লোকজন গিয়ে আবার মুসলমান বক্করকে মারিছে, ওরা সবাইকে বলে দিল, বক্কর মারা গেছে। তারপর ৩/৪ নসিমন (অটোভ্যান ধরনের স্থানীয় ইঞ্জিন চালিত বাহন) করে এসে রাম দা, লাঠি নিয়ে ভাংচুর, আগুন দেলো।

“আমরা তো তখন সবাইকে ফোন করেছিলাম। থনায় ফোন করেছি, আওয়ামী লীগ নেতাদের ফোন করেছি, হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান পরিষদের নেতাদের ফোন করেছি।

সকলকেই ফোন করেছি। কিন্তু পুলিশ, নেতা কেউ আসেনি। ”

ঘটনার সময় অভয়নগর থানা পুলিশকে ফোন করা হলেও তারা কেন পৌঁছাননি এমন প্রশ্নে এস পি জয়দেব কুমার, যিনি এখন ছুটিতে আছেন, বলেন, “তখন আমরা সবাই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম। সেই দিন তো নির্বাচনের দিন ছিল। আর ফোর্স ছিল না পাঠানোর মতো।

সাড়ে ৬টার দিকে শুনেছি, তখনই পাঠিয়েছিলাম, কিন্তু ততোক্ষণে সন্ত্রাসীরা চলে গেছে। আমাদের নেগলিজেন্সি ছিল, এটা ভাবা ঠিক নয়। ”

 

দুলাল বিশ্বাসের উপার্জনের একমাত্র অবলম্বন মাছ ধরার জালও পুড়িয়ে দেয় হামলাকারীরা। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

 

যশোর শহরে ৩০ বছর ধরে ফটো সাংবাদিক হিসাবে কাজ করা হানিফ ডাকুয়া বলেন, “এবারের টানা অবরোধ হরতালের সময় আমাদের সবচে বেশি হামলার মুখে পড়তে হয়েছে বসুন্দিয়া-রূপদিয়া এলাকায়। এখানে শিবির কর্মীরা খুবই স্ট্রং।

তারা গাড়ি ভাংচুর, আগুন দেয়া ছাড়াও সাংবাদিকদের ওপরে হামলা করেছে। ”

অভয়নগর থেকে যশোর সদরের পথে ১০ কিলোমিটার দূরে বসুন্দিয়া ইউনিয়ন, ১৫ কিলোমিটার দূরে নরেন্দ্রপুর ইউনিয়নের রূপদিয়া গ্রাম। সাধারণের কাছে এসব গ্রাম জামায়াত-শিবিরের ঘাঁটি হিসাবে পরিচিত। আর চাঁপাতলার সবচে বেশি কাছে, একই ইউনিয়ন, প্রেমবাগ ইউনিয়নের বালিয়াডাঙ্গি গ্রামে স্থানীয় জামায়াতের আমির মাওলানা আজিজুর রহমানের বাড়ি।

মালোপাড়ার শঙ্কর বিশ্বাস বলেন, হামলায় যে জামায়াত-শিবিরের সদস্যরা ছিল, এ ব্যাপারে তারা নিশ্চিত।

ঘটনার রাতে অভয়নগর থানার এস আই মো. মহসিন হাওলাদার বাদি হয়ে যে মামলা করেন, তাতে যে ৪৮ জনকে আসামি করা হয়, তাতে তাদের জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্র শিবির ও বিএনপির ‘দুস্কৃতকারী’ হিসাবে উল্লেখ করা হয়।

বালিয়াডাঙ্গির উত্তরপাড়ার বাসিন্দা অভয়নগর থানা জামায়াতের আমির আজিজুর রহমানের বাড়ি গেলে দেখা যায়, তার ঘরে তালা। ঘরের চারপাশে ভাংচুরের চিহ্ন।

আজিজুর রহমানকে চাচাশ্বশুর হিসাবে পরিচয় দেয়া হীরা বেগম বলেন, ৬ জানুয়ারিই আজিজুর রহমান বাড়ি ছেড়ে চলে গেছেন। ৭ জানুয়ারি পুলিশ আর যৌথবাহিনী তাকে না পেয়ে ‘বাড়ি ভাঙচুর করে’ চলে গেছে।

সেলিম শিকদার নামে আরেক বাসিন্দা জানান, এইখানে তারা সবাই জামায়াতের সমর্থক। তাই পুলিশ-বিজিবির যৌথ বাহিনী ধরপাকড় চালিয়ে যাচ্ছে। গ্রামে বেশিরভাগ পুরুষই পালিয়ে আছেন অন্য কোথাও।

 

ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা ইকবাল কবির জাহিদ

 

ভবদহ পানি নিস্কাশন সংগ্রাম কমিটির প্রধান এবং ওয়ার্কার্স পার্টির স্থানীয় নেতা ইকবাল কবির জাহিদ, যিনি ওই আসন থেকে মহাজোটের পক্ষ থেকে মনোনয়ন চেয়েছিলেন নির্বাচনে, বলেন, “জামায়াত-শিবিরের কর্মীরা যে হামলায় অংশ নিয়েছে, এ নিয়ে সন্দেহ নেই। তবে সঙ্গে আওয়ামী লীগের কর্মীরাও ছিল, যারা শেখ ওহাবের লোক।

তিনি বলেন, “রনজিত সরকার আওয়ামী লীগ থেকে নির্বাচনের টিকেট পাওয়ার পর থেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন ওহাব। দেখলেন না, উনি পার্টির সিদ্ধান্ত অমান্য করে কলস মার্কা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলেন!

“এইটা তো পরিকল্পিত। না হলে পরে ৩/৪ নসিমন ভরে লোক আসবে কেমন করে কয়েক ঘণ্টার ভেতর? পুলিশ কেন সাড়া দেয়নি বলেন! আমার মনে হয়, আমি তো বড় হয়েছি এই যশোর শহরেই, আর রাজনীতির কারণে অভয়নগরের ওদের চিনি অনেকদিন থেকে। ওরা আসলে গুচ্ছ ভোটার। মানে ওরা বেশিরভাগই ভোটের বেলায় একই সিদ্ধান্তে ভোট দেয়।

স্বাধীনতার পর থেকেই ওরা নৌকার ভোটার। রনজিত আবার হিন্দু, টিকেটও নৌকার। ওরা যে নৌকায় ভোট দেবে, এটা কলস মার্কা নিয়ে দাঁড়ানো ওহাব সাহেব আগেই বুঝে ফেলেছেন। ভোটের জন্যই উনি হামলা চালিয়েছেন জামাত শিবিরের কমীদের ব্যবহার করে। ”

“অবশ্যই এটা পরিকিল্পিত”, বেশ জোর দিয়েই বলেন ইকবাল কবির জাহিদ।

অনেকেই প্রকাশ্যে এবং অপ্রকাশ্যে বিদায়ী সংসদের হুইপ এবং এই এলাকার সাবেক সংসদ সদস্য শেখ আব্দুল ওহাবের দিকে আঙুল তোলায় অভয়নগরের বাগুটিয়া ইউনিয়নের সিঙ্গার বাজারে তার বাসায় কথা বলতে যান এই প্রতিবেদক।

মালোপাড়ার হামলাকে পরিকল্পিত বলা হচ্ছে, আপনি কি মনে করেন- এমন প্রশ্নে স্বাভাবিক ভঙ্গিতে পাল্টা প্রশ্ন করেন ওহাব।  

“আপনি কি মনে করেন, ২/৩ নসিমনে করে লোক আনতে কি আগে থেকে পরিকল্পনা করা লাগে?”

এরপর তিনি নিজের সহকারীর দিকে তাকান সমর্থন পাওয়ার ভঙ্গিতে। তারপর বলতে থাকেন, “কেউ যদি হামলা করতে চায়, এটা এক/ দেড় ঘণ্টার ব্যাপার- হামলার জন্য লোক জোগাড় করা। এইটা পরিষ্কার জামায়াত শিবির, বিএনপির কাজ।

কেন, আপনি মামলার এজাহার দেখেননি? প্রাথমিকভাবে যাদের নাম পাওয়া গেছে সবাই জামায়াত শিবির বিএনপির কর্মী উল্লেখ আছে। ”

 

যশোরের অভয়নগরে মালোপাড়ার প্রবেশপথে পুলিশি নিরাপত্তা। গত ৫ জানুয়ারি ভোটের পর এই এলাকাতেই হিন্দুদের ওপর সাম্প্রদায়িক হামলা হয়। ছবি: মুস্তাফিজ মামুন/ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

 

জামায়াত-শিবিরের কর্মীদের ব্যবহার করে তিনিই হামলা করেছেন, এমন অভিযোগ প্রসঙ্গে ওহাব বলেন, “কারা বলেছে এসব কথা। এটা রনজিত বলেছে।

ও তো কার্টেসি জানে না। আমার সাথে ডিসি অফিসে দেখা হলো, আমি তাকে কেমন আছেন জিজ্ঞেস করেছিলাম, সে তার জবাব না দিয়ে কানে ফোন লাগিয়ে কথা বলতে বলতে উঠে গেল। ও এসব বলছে একদম রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থেকে। ও তো আমাকে শত্রু মনে করে।

“আপনি আমাকে বলেন, অফ দ্য রেকর্ড, ইলেকশন কি ফেয়ার হয়েছে? কী আর বলব।

অভয়নগরে আমি বড় হয়েছি। এটা আমার জন্মস্থান। ও তো এখানকার না। ও হিন্দুদের কী বুঝবে! এখন আমাকে দোষী করা সোজা। দলই যেখানে আমাকে বোঝেনি, ও তো এখন এরকম বলবেই।

যাক, এটা পরিষ্কার জামায়াত-শিবির, বিএনপির কাজ। ”


সোর্স: http://bangla.bdnews24.com

অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।