ভারতের রাজনীতিতে সাড়াজাগানো নতুন দল 'আম আদমি পার্টি' অর্থাৎ এএপি এখন সর্বত্র আলোচনায় বিচরণ করছে। এই দলের নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল সংগঠনটি শুরু করার মাত্র এক বছরের মধ্যে দিলি্লতে নির্বাচনে জয়ী হয়ে অভূতপূর্ণ সাফল্য প্রদর্শন করে রাজনীতিতে নতুন চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছেন। তিনি সরকার গঠন করেছেন এবং মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে মাত্র কয়েক দিনে দুর্নীতিবিরোধী এবং জনকল্যাণমূলক এমন কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন যার কারণে সবার দৃষ্টি এখন এই নতুন দলের দিকে। দিলি্ল রাজ্যের নির্বাচনে ঐতিহ্যবাহী কংগ্রেস ও প্রধান বিরোধী দল বিজেপিকে পাশ কাটিয়ে সরকার গঠন করে প্রচলিত রাজনীতিতে প্রচণ্ড ধাক্কা দিয়েছে এই নতুন দল। জনগণ এক ব্যতিক্রমধর্মী রাজনৈতিক দল ও নেতৃত্বের প্রতি প্রবলভাবে আকর্ষিত হচ্ছে এবং তাদের প্রতি কৌতূহল ও আগ্রহ বৃদ্ধি পাচ্ছে।
দিলি্লতে জয়লাভ করেই ক্ষান্ত নয় এই আম আদমি পার্টি, অর্থাৎ সাধারণ মানুষের দল। তাদের দৃষ্টি এখন বহুদূরে প্রসারিত। মাত্র তিন মাস পর জাতীয় নির্বাচন। এপ্রিল-মে মাসের নির্বাচনে নির্ধারণ হবে আগামী দিনে কোন দল কিংবা মোর্চা শাসন করবে বিশ্বের সবচেয়ে বড় গণতন্ত্র ভারতকে। সবচেয়ে বড় কথা হলো কে হবেন দেশের নতুন প্রধানমন্ত্রী।
সবার দৃষ্টি এখন সেদিকেই নিবদ্ধ।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে, ভারতের আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখা হচ্ছে বিরোধীদলীয় নেতা নরেন্দ্র মোদি এবং শাসক কংগ্রেসের তরুণ নেতা রাহুল গান্ধীকে। তবে দৌড়ে মোদি এগিয়ে আছেন বলেই মনে করা হচ্ছে। গুজরাটের সফল মুখ্যমন্ত্রী, কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নে বেশ বিতর্কিত মোদি অবশ্যই এগিয়ে আছেন বলেই প্রতীয়মান হচ্ছে। তিনি এবং তার দল বেশ আগেই প্রধানমন্ত্রিত্ব এবং আগামী দিনের সরকার গঠনের লক্ষ্যে কর্মকাণ্ড শুরু করেছেন।
মোদি বেশ সাড়াও পাচ্ছেন। তিনবারের দক্ষ মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে তিনি ভারতের ব্যবসায়ী মহল এবং আরও অনেকের সমর্থন পাচ্ছেন। কারণ তার সময়ে গুজরাট রাজ্য শিল্প ও বাণিজ্যে প্রভূত উন্নতি সাধন করেছে এবং সে কারণে নরেন্দ্র মোদি সমাদৃত হচ্ছেন। তবে ভারতের এবং বহির্বিশ্বের ধর্মনিরপেক্ষ এবং প্রগতিশীল শক্তিরা নরেন্দ্র মোদিকে ভারতের মতো বহু ধর্মীয় ও বহু ভাষাগত বিশাল গণতান্ত্রিক দেশটির নেতা হিসেবে দেখতে রাজি নন। তাই তারা মোদির তীব্র সমালোচনা করছেন।
তবে ২০০২ সালে গুজরাটের জঘন্য সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার সময়ের মুখ্যমন্ত্রী মোদি সম্প্রতি সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারে নমনীয় মনোভাব দেখাচ্ছেন। তিনি সংখ্যালঘু মুসলিমদের কাছে টানার চেষ্টা করছেন। বলছেন, ভারতের উন্নয়ন হিন্দু ও মুসলিমদের সমন্বিত প্রয়াসেই সম্ভব। বলার অপেক্ষা রাখে না, তিনি অনুধাবন করছেন যে ভারতের মতো ১২০ কোটি মানুষের ধর্মনিরপেক্ষ দেশের সরকারপ্রধান হতে গেলে সংখ্যালঘুদের সমর্থনও প্রয়োজন। দেশের ২০ ভাগ মানুষ সংখ্যালঘু এবং এদের মাঝে ১২ ভাগ হলো মুসলিম।
বাকিরা শিখ, খ্রিস্টান, পার্সি ও অন্যরা।
অন্যদিকে রাহুল গান্ধী ও তার দল কংগ্রেস ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রবক্তা এবং সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী। বর্তমানে এই কংগ্রেস দলের নেতৃত্বে একটি বহুদলীয় কোয়ালিশন সরকার ক্ষমতায় রয়েছে। তবে পরপর দুই মেয়াদের পর এই সরকার আগামীতে আবার ক্ষমতায় আসতে পারবে কিনা তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ বিদ্যমান। কেননা, গত কয়েক বছরে সরকার বেশ কয়েকটি বড় ধরনের দুর্নীতি-সংক্রান্ত ঘটনায় প্রচণ্ডভাবে সমালোচিত হয়েছে এবং জনগণের সমর্থনও অনেকাংশে হারিয়েছে।
তা ছাড়া আগামী মেয়াদে ক্ষমতায় এলে কে হবেন দেশের প্রধানমন্ত্রী- এ ব্যাপারেও কংগ্রেস বিরোধী বিজেপি দলের তুলনায় পিছিয়ে আছে। যদিও মনে করা হচ্ছে, কংগ্রেসপ্রধান সোনিয়া গান্ধীর একমাত্র ছেলে ও সংগঠনের দ্বিতীয় প্রভাবশালী নেতা তরুণ রাহুল গান্ধীই হবেন সেই পদের জন্য প্রার্থী, তথাপি এ ব্যাপারে এই কলাম লেখা পর্যন্ত কোনো সরকারি ঘোষণা আসেনি। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী ড. মনমোহন সিং এর মধ্যে বলেছেন, তিনি আর প্রধানমন্ত্রী হতে আগ্রহী নন, যদি তার কংগ্রেস দল ক্ষমতায় আসতেও সমর্থ হয়। বর্ষীয়ান মনমোহন রাহুল গান্ধীর ব্যাপারে তার সমর্থনের কথাও বলেছেন। কিন্তু কথা হলো, রাহুল সাম্প্রতিককালের রাজ্য নির্বাচনে তেমন কোনো সফলতা দেখাতে পারেননি।
সে কারণে তার জাতীয় নির্বাচনে সাফল্য নিয়ে সন্দেহ বিরাজমান। তা ছাড়া আগামী নির্বাচনের মাত্র তিন মাস বাকি থাকলেও এ বিষয়ে কংগ্রেস ও মিত্ররা পিছিয়ে আছে বিজেপি ও সহযোগীদের তুলনায়। তা সত্ত্বেও আগামী দিনের প্রধানমন্ত্রিত্ব মোদি এবং রাহুলের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে বলে মনে করা হচ্ছে যদি না অপ্রত্যাশিতভাবে কোনো নতুন ঘটনা ও ব্যক্তির উদ্ভব হয়। এখন মনে হচ্ছে, মোদি-রাহুলের বাইরেও হয়তো তেমনই কোনো সম্ভাবনা সৃষ্টি হতে পারে। এ সম্ভাবনার উন্মেষ ঘটাচ্ছে নতুন দল এএপি এবং এর নেতা অরবিন্দ কেজরিওয়াল।
সাড়াজাগানো দলটি আগামী জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশব্যাপী সদস্য সংগ্রহ অভিযানে নেমেছে এবং অবিশ্বাস্য সমর্থন অর্জন করছে। এতে উৎকণ্ঠিত হয়ে উঠছে দুটি বড় দল কংগ্রেস ও বিজেপি। দিলি্লতে কংগ্রেসকে পরাজিত করে এবং বিজেপিকে পাশ কাটিয়ে সরকার গঠন করার পর থেকে জনগণকে অপ্রত্যাশিত উপহার দিয়ে যাচ্ছে নতুন সরকার। তারা যেসব নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল তারচেয়ে আরও বেশি করতে আগ্রহী বলেই মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল ধারণা দিচ্ছেন। এতে মানুষ প্রচলিত রাজনীতি ও সরকারের তুলনায় ব্যতিক্রমধর্মী উদ্যমের সন্ধান পাচ্ছে।
পানি, বিদ্যুৎ ও যানবাহনের ব্যয়ে সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ সুবিধার উন্মোচন ঘটছে। মানুষ আশান্বিত হচ্ছে। রাজনীতিবিদদের সম্পর্কে ভালো ধারণা হচ্ছে। আগে মেট্রোতে করে মুখ্যমন্ত্রী কেজরিওয়াল শপথ নিয়ে আসেন এবং অন্য মন্ত্রীরা সাধারণ গাড়ি ব্যবহার করছেন। মুখ্যমন্ত্রীর বিলাসী বাসভবনে থাকবেন না কেজরিওয়াল।
মন্ত্রীরা ও অন্যরা তাদের সম্পদের হিসাব দিয়েছেন এবং সেটা খতিয়ে দেখার এবং কিছু দিন অন্তর তদন্ত করার বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপও নেওয়া হয়েছে। তাই নতুন সরকারের প্রতি জনগণের আস্থা ও বিশ্বাস বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারা রাজনীতির সুন্দর চেহারাও দেখতে পাচ্ছেন। কিন্তু শুধু দিলি্ল রাজ্য সারা দেশ নয়। ভারতে দুর্নীতিবিরোধী আন্দোলনে সীমাহীন উদ্দীপনা সৃষ্টিকারী বর্ষীয়ান নেতা আন্না হাজারের একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগী হয়েই মাত্র ৪৪ বছর বয়স্ক অরবিন্দ কেজরিওয়ালের পরিচিতি হয়েছে।
পরবর্তী সময়ে আন্নাহাজারে ও তার আরও কয়েকজন সহযোগী রাজনীতির সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে সম্পৃক্ত হওয়ার বিষয়ে অনাগ্রহী হলেও অরবিন্দ এবং আরও কয়েকজন 'আম আদমি পার্টি' গঠন করেন। তাদের বক্তব্য হলো- রাজনীতিতে না এলে তাদের কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হবে না। এই দলের আত্দপ্রকাশ ঘটেছে মাত্র ১০ মাস আগে এবং তারা দিলি্ল রাজ্যের নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে অভাবিত সাফল্য পেয়েছে।
আন্নাহাজারের আশীর্বাদ রয়েছে নতুন দলের প্রতি। অন্তত সেটাই দাবি করেছেন কেজরিওয়াল।
তবে আগামী লোকসভা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করা একটি নতুন দলের পক্ষে সেটা সহজেই অনুধাবন করা যায়। তবে থেমে থাকেনি আম আদমি পার্টি। তাদের লক্ষ্য হলো, আগামী ২৬ মার্চ অর্থাৎ ভারতের প্রজাতন্ত্র দিবসের আগে সারা দেশে অন্তত এক কোটি সদস্য নিবন্ধন করা। সেদিকে ভালো সাড়া পাচ্ছে তারা, শুধু নতুন দিলি্লতে মাত্র একদিনেই ৫০ হাজার সদস্য পাওয়া সম্ভব হয়েছে। নরেন্দ্র মোদির গুজরাটেও সেই সাড়া পাওয়া যাচ্ছে।
তাই কিছুটা হলেও ভীত রাহুল গান্ধী ও মোদি উভয়েই।
দিলি্লর বিজেপিপ্রধান হর্ষবর্ধন ছুটে গেছেন গুজরাটে নরেন্দ্র মোদির কাছে। রাহুল জরুরি সভা করছেন পরামর্শদাতাদের সঙ্গে। কারণ একটাই। কী করে নতুন দলকে মোকাবিলা করা যায়।
দুটো বড় দলই দুর্নীতির ঊধের্্ব নয়। বরং ক্ষমতায় থাকাকালে তাদের অনেক নেতা-কর্মীর বিত্তবৈভব ঘটেছে। কংগ্রেস সরকারের বর্তমান মেয়াদে টেলিফোন, আবাসন, কমনওয়েলথ গেমসসহ অনেক বড় ধরনের দুর্নীতির ঘটনায় সরকার বিপর্যস্ত। বিজেপির শাসনামলেও ঘটেছে এমনই সব দুর্নীতি। তাদের সময়ে শাসন ও সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে প্রসারিত হয়েছে দুর্নীতি।
জনগণ এ পরিস্থিতি থেকে পরিত্রাণ চায় বলেই নতুন দলের প্রতি অনেকেই এগিয়ে আসছেন। কতদূর যেতে পারবে এই দুর্নীতিবিরোধী দল সেটা দেখার বিষয়।
লেখক : সিনিয়র সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিষয়ের বিশ্লেষক।
।
অনলাইনে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা কথা গুলোকেই সহজে জানবার সুবিধার জন্য একত্রিত করে আমাদের কথা । এখানে সংগৃহিত কথা গুলোর সত্ব (copyright) সম্পূর্ণভাবে সোর্স সাইটের লেখকের এবং আমাদের কথাতে প্রতিটা কথাতেই সোর্স সাইটের রেফারেন্স লিংক উধৃত আছে ।